আমাদের সরকার এবং জাতীয় মিডিয়ার কথা বিশ্বাস করতে হলে মানতেই হবে যে ভারতে সবচেয়ে বিপজ্জনক সন্ত্রাসবাদীরা এই মুহুর্তে মোটেই হাতে গ্রেনেড বা এ কে ৪৭ নিয়ে ঘুরছে না, বরং তারা সঙ্গে বহন করছে অন্য এক অস্ত্র – কোভিড-১৯। মাওবাদী চীনের থেকে আমদানি করা এই সর্বাধুনিক জৈব অস্ত্র নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে জৈবসন্ত্রাসবাদীর দল। দিল্লীতে জমায়েত হওয়া তাবলিগি জামাত থেকে এই সন্ত্রাসবাদী মুসলিমদের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে এক ভাইরাল চিপ – যা সংক্রমণ ছড়িয়ে হিন্দুদের শেষ করে দেবে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের বদলে এই নতুন সন্ত্রাসীরা করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে। তারা ফলে থুতু ছেটাচ্ছে, জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁচি দিচ্ছে, কাশছে, বাসের জানালা থেকে বমি করছে – এসবই তাদের সন্ত্রাসী “আক্রমণের” নতুন কায়দা।
এরকম ভয়ঙ্কর হিংস্র সব জল্পনার কথা শুনলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বর্তমান ভারতে ইসলামোফোবিয়া আর কারো লুকিয়ে পোষার প্রয়োজন হয় না – এটা এমন কি কোন ওপেন সিক্রেটও আর নয় – এ এখন শ্বাসপ্রশ্বাসের মতই স্বাভাবিক। এবং মহামারীর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে এই ইসলামোফোবিয়া। লকডাউনে সবাই গৃহবন্দী হলেও একে আটকে রাখা যায়নি। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্র করোনার চেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এই ফোবিয়া, সমস্ত ভারতীয় মুসলিমকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে “সন্ত্রাসবাদী”র তকমায়। সমস্ত খারাপ কিছুর উৎস মুসলমানেরাই। ক্রমশঃ এক ধরণের রূপকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে যেখানে হিন্দুরা হল “পবিত্র” সংক্রমণ আর মুসলিমরা “বিপজ্জনক” সংক্রমণ। পবিত্র সংক্রমণ তো ছড়িয়ে পড়তেই পারে, কী বা করার আছে – কিন্তু বিপজ্জনক সংক্রমণকে যে কোন মূল্যে আটকাতেই হবে। সামাজিক হিন্দুত্ববাদের আধিপত্য ছাড়া কে-ই বা আটকাতে পারে এই সন্ত্রাস? কারণ মুসলমানেরা তো জন্মগতভাবেই “সন্ত্রাসবাদী” – তাই না? যেমন একজন ব্রাহ্মণ বা একজন অস্পৃশ্য – জন্মগতভাবেই তাই। একজন যাযাবর জন্মগতভাবে “অপরাধী”, যারা নাচ গান নাটক করে তারা জন্মগত “বেশ্যা”।
এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে মুসলিম সমাজেও এই বর্ণভেদ প্রচলিত নেই, কিন্তু তাদের সামাজিক রীতিনীতি তো এখনো হিন্দুত্ব-অনুসারী নয়। সাধারণ হিন্দু সমাজ এই মুসলিম সমাজকে বোঝে না, এবং তাদের চোখে তাই মুসলিম মানেই উচ্ছৃঙ্খল, অশিক্ষিত এক জাত যারা যে কেউ এসব বিপজ্জনক সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে সমাজে। অতএব এখন মূল চ্যালেঞ্জটা হল মুসলিমদের আটকে রাখা, কোয়ারান্টাইন করা, বিচ্ছিন্ন করা – সি-এ-এ, এন আর সি বিরোধি প্রতিবাদের সময় যা করা যায়নি কিছুতেই। এই রোগ অতএব রাষ্ট্রের কাছে একই সাথে অমঙ্গল এবং মঙ্গলের বার্তাবাহী – যেমন বাংলার "শীতলা ”মা" – রোগ যত ব্যাপক হয়, তাঁর মহিমা তত বাড়ে। রাষ্ট্রও তাই। স্বর্গরাজ্যের সুনাগরিকত্বে “অপর”এর অধিকার নেই, সেখান থেকে “শয়তান”কে দূর করতেই হবে।
শুধু মহামারীর কথা বললে তা কখনোই মহামারী নিয়ে বলা হয় না, শুধু রোগ সংক্রমণের কথা বললে যেমন রোগ সংক্রমণের কথা কিছুই বলা হয় না। প্লেগ মহামারী হোক বা করোনা ভাইরাস, কাউকেই পৃথক করে দেখলে তার প্রকৃত স্বরূপ বোঝা যাবে না। অতি ক্ষুদ্র আণবিক ভাইরাস যখন কোন শরীর বা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আগে সে সেই শরীরের মধ্যে তার একটা নিজস্ব ক্ষুদ্র দুনিয়া তৈরী করে নেয় – যা তাকে জোগাবে বেঁচে থাকার, আরো ছড়িয়ে পড়ার, বড় হবার রসদ। আলবেয়ার কামু তাঁর “দ্য প্লেগ” বইতে প্রথম এই ক্ষুদ্র বিশ্বের যোগসাজসের কথা আমাদের সামনে আনেন – দ্য প্লেগ শুধু যে প্লেগ মহামারীর ওপর রচিত এক ক্লাসিক তা-ই নয়, ইউরোপীয় সমাজ এবং ব্যক্তিক্ষেত্রে নাজি মতবাদ ছড়িয়ে যাবার এক রূপকও বটে। অনিশ্চিত বিশৃঙ্খলার সময়ে জীবন মৃত্যুর যে অসম্ভব খেলো হয়ে যাওয়া আমরা দেখি চোখের ওপর, এই বই তারও রূপক বটে। এবং মৃত্যুর যে অনিবার্যতা আমরা এমনিতে টের পাই না যতক্ষণ না তার মুখোমুখি হয়ে পড়ছি, তাকে নিয়েও এই কাহিনী। মহামারী মানে ওলোটপালোটের সময়। আমাদের সুশৃঙ্খল প্রচলিত ও পরিচিত জীবনযাত্রাকে টেনে থামিয়ে দিয়ে, আমাদের সমস্ত গতিবিধি স্তব্ধ করে দিয়ে সমস্ত নির্মাণের একেবারে মূল ধরে নাড়া দেয় মহামারী। আমাদের সাধারণ সব দুশ্চিন্তাকে নিমেষে করে দেয় অবান্তর। মানব সভ্যতার ভেতরে দেখা দেয় এক গভীর ফাটল। এই সেই সময় যখন আমরা আর মানুষের নয়, তার দর্শনের, তার দূরদৃষ্টির বাঁচামরা নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হই, তার ঘনিষ্ঠতার, সম্পর্কের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে বাধ্য হই। একটা ভাইরাসের কত শক্তি যে সে বিশ্ব ব্যবস্থাকে কত সহজে ওলোট পালট করে দিতে পারে, এই ভাবনায় ভাবিত হতে বাধ্য হই। এবং যখন এরকম কোন রোগ যা সারা পৃথিবীকে শঙ্কিত, চিন্তিত করে তুলতে পারে, তখন তা নিয়ে এভাবেই আমাদের ভাবার কথা – একে সাম্প্রদায়িক রঙে না রাঙিয়ে। যে কেউ যে কোন মুহুর্তে যেখানে সংক্রামিত হতে পারি, জীবন যখন অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে মুহুর্তের নোটিশে। যারা দাবী করতেন সমকামিতা পাপ, তারাই আজ চিকিৎসাধীন। যারা নিরাপত্তার ব্যবস্থাদি করে থাকেন (মোসাদদের প্রধান) তারা কোয়ারান্টাইনে। অতিমারীর সম্মুখীন কেউই আমরা নিরাপদ নই। কামু বলছেন, এরকম অসহায় সময়ে আমরা আর কী বা করতে পারি প্রতিটি মানুষকে, মানবজাতিকে ভালবাসা ছাড়া? অনাথকে জীবন দেবার আহ্বান জানান তিনি – তাকে হাসপাতালে পাঠানোর বদলে। সেই যাপনের কথা বলেন যা অর্থপূর্ণ, দয়াশীল, সহিষ্ণু – সেই জীবন, পুঁজিবাদ এবং তার সহযোগী অন্যান্য ব্যবস্থা যার থেকে আমাদের অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন করেছে।
অনেকেই ভেবেছিলেন এই মহামারী হয়তো আমাদের যাবতীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ভেদজ্ঞান মুছে দিল - কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বারে বারে কালে কালে অতিমারী, মহামারীরা এসে প্রমাণ করে দিয়ে যায় যে আমরা নেহাৎই রাজনৈতিক জীব এবং আমাদের যাপন থেকে এই রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার কোন পথ নেই। কে বাঁচবে এবং কে মরবে, দিনের শেষে তা আর নেহাৎই সম্ভাবনা নয়, স্পষ্টতই তা রাজনৈতিক। আমেরিকার অভ্যন্তরে কালো মানুষদের নিয়মিত মৃত্যু এটা বারেবারে প্রমাণ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। এই সময়ের এক অতি সময়োপযোগী স্লোগান কেউ লিখেছেন, " করোনাভাইরাস একটি অসুখ মাত্র, পুঁজিবাদ হল অতিমারী"। এবং সেটাই যদি হয়ে থাকে তবে রাজনীতি করার এটাই সবচেয়ে সঠিক সময়। প্রশ্ন করার এটাই সবথেকে সঠিক সময়। সেই সব প্রশ্ন যা আমরা আগে কখনো করিনি - আমাদের স্বাস্থ্য (অ)ব্যবস্থা নিয়ে, মুনাফার গতি নিয়ে, জীবনবীমা সংস্থাগুলি যে আমাদের মৃত্যুর পরে জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয় তাই নিয়ে। আসুন সেই মৃতপ্রায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলি যেখানে স্বয়ং ডাক্তারেরাই নিরাপদ নন, রোগী তো দূরস্থান। না তাঁদের মৃত্যুর জন্য সংক্রমণ দায়ী নয়, দায়ী এই ব্যবস্থা, দায়ী সরকার, রাষ্ট্রের অপরিসীম উদাসীনতা এবং অবজ্ঞা। কিন্তু এসব প্রশ্ন কে তুলবে? যাদের তোলার কথা, প্রশ্ন করার কথা, সেই সংবাদ মাধ্যম তো নিজের বিবেক বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে। বিবেকবোধকে ফুৎকারে উড়িয়ে এই রক্তপিপাসু ভারতীয় মিডিয়া এখন বলির পাঁঠা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই মুহুর্তে সেই বলির পাঁঠাটি হল তাবলিগি জামাত। যারা এখন হিন্দু রাষ্ট্রেরও বলির পাঁঠা, যাদের সামনে রেখে কোটি কোটি মুসলমানকে এই বিপদের জন্য দায়ী করে দেওয়া যাচ্ছে সহজেই।
সংখ্যাগুরুর বলির পাঁঠা
ফরাসী সমালোচক রেনে গার্দঁ প্লেগ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, "প্লেগের বিশেষত্ব হল এই যে এ সমস্ত বিশেষত্বকে অবান্তর করে দেয়"। অতিমারী তাই হতেই পারত সমতা ফেরানোর এক মহাবাহক - কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এক্ষেত্রে ব্যপারটা সেরকম নয়। না, অতিমারী কখনোই সমতা আনতে পারে না - উলটে তার হাত ধরে আরো বেশী বেশী করে এসে পড়ে ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা এবং কোন মনগড়া সম্ভাব্য শত্রুর বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষ। ইউরোপে প্লেগের বিস্তারকালে ইহুদিরা অস্পৃশ্য হয়ে পড়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার পশ্চিম উপকূলে কলেরা এবং মেনিনজাইটিস ছড়িয়ে পড়ায় একঘরে করা হয়েছিল হিন্দু এবং শিখদের। হিটলারের জার্মানি " জিপসি প্লেগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" ঘোষণা করে জিপসিদের প্রায় বিলুপ্তই করে দিয়েছিল সে দেশ থেকে। সুজন শুক্লা তাঁর লেখায় দেখিয়েছেন বিভিন্ন সমাজ কিভাবে করোনা ভাইরাসের মুখে পড়ে নিজের নিজের মত করে তাদের দোষারোপের বলির পাঁঠা খুঁজে নিয়েছে। আমেরিকানরা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দোষ দিচ্ছে প্রবাসী চিনাদের, চিনারা উইঘারদের, পাকিস্তান দোষ দিচ্ছে হাজারাদের, ভারত মুসলিমদের, আর মুসলিমরা জাহিল মুসলিমদের। স্প্যানিশ ফ্লু এর দোষ চাপানো হয়েছিল স্প্যানিশদের ঘাড়ে, আবার স্প্যানিশরা একে বলতেন "ফ্রেঞ্চ ফ্লু" - অর্থাৎ দোষটা ফরাসীদের। রাষ্ট্রের চোখে পরিযায়ী শ্রমিকেরা সবাই সন্দেহভাজন। বড় বড় "বহুজাতিক" শহরগুলি এই শ্রমিকদের তাড়িয়ে দিয়েছে, আর গ্রামের অভিজাতেরা যারা এদের আগেই দূর করে দিয়েছিলেন, দরজা জানলা বন্ধ করার নতুন বাহানা পেয়ে গেছেন। অতিমারীর সময়ই এরকম পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য সেরা সুযোগ নয় কি? উপরন্তু মুসলিমদের ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দিতে পারলে, উচ্চবিত্ত শ্রেণী, যারা বিমানে দেশে বিদেশে যাতায়াত করে এবং যাদের এই ভাইরাসের প্রাথমিক এবং প্রধান বাহক বলে ভাবা হচ্ছে, তাদের দিক থেকে আলোচনাটা সরিয়ে নেওয়ারও সুবিধা হয়, তারা দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে। কর্পোরেট মিডিয়া এবং রাষ্ট্র উভয়ের পক্ষেই তাদের মতাদর্শের বিপরীতগামী এই ন্যারেটিভ থেকে মনোযোগটা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুবই জরুরী ছিল।
মুসলিমরূপী বিপজ্জনক সংবাহকঃ "লাভ জিহাদ" থেকে "করোনা জিহাদ"
এই সময়ে আমরা সর্বক্ষণ ভেবে চলেছি সেই মহা-সংক্রমণকে নিয়ে, যে আমাদের সমাজকে রোজ দু কদম পিছনে ফেলে দিচ্ছে। এখন তাই আর শুধুই শারিরীক সংক্রমণ নিয়ে ভাবার উপায় নেই, আমাদের ভাবতে হচ্ছে আমাদের সমাজ-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক, আমাদের রাজনৈতিক জীবন নিয়েও। সংক্রমণের বহু রূপ - প্লেগ ভাইরাস থেকে ফ্যাসিজম। সবসময়ে দৃশ্যমান না হলেও একথা অনুমান করা চলে যে শারিরীক সংক্রমণ আর আদর্শগত সংক্রমণ - এই দুইএর মধ্যে একটা চিরকালীন পারস্পরিকতা রয়েই গেছে। সেই সম্পর্ক খোঁজার জন্য এখন আর আমাদের ইউরোপ যাবার প্রয়োজন নেই, এই মুহুর্তে আমাদের চোখের সামনেই তা জাজ্বল্যমান। করোনাভাইরাস যদি শারিরীক সংক্রমণ হয়ে থাকে তবে অন্য "বিপজ্জনক" সংক্রমণ হল মুসলিম জাতি। যখন এদের জুড়ে দেওয়া হয়, একটা তরঙ্গের (রিপল এফেক্ট) সৃষ্টি হয়। রোগ যখন "শয়তান", একটা গোটা জাতকে দাগিয়ে দেওয়া হয় সংক্রমিত বলে। তাবিলিগি জামাতের দুর্ভাগ্যজনক জমায়েতকে চিহ্নিত করা হয় ষড়যন্ত্র বলে, " বিশ্বাসঘাতকতা" বলে, "ইসলামের অপকর্ম" বলে। রাষ্ট্র স্বয়ং যখন জামাতের সদস্যদের, যারা নিজেরাই অনেকে কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত এবং চিকিৎসাপ্রার্থী, বিরুদ্ধে জাতীয় সুরক্ষা আইন প্রয়োগ করে তখন আমরা আর অবাক হই না এদেশে। ইসলামোফোবিয়ার বহু নাম এদেশে - কখনো "লাভ জিহাদ" তো কখনো "করোনা জিহাদ"। ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি এটাও স্পষ্ট প্রমাণ করে যে শুধুমাত্র ইসলামোফোবিয়া শব্দটুকু আর যথেষ্ট থাকছে না এদেশে, কারণ যে ঘৃণা এবং হিংসার চাষ চলছে, মুসলিমদের ঘেটোর মধ্যে ঠেলে দেবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চলছে তার তুলনায় ওই শব্দবন্ধ নেহাৎই নরম শোনায়। অস্পৃশ্যদের চিরস্থায়ী পৃথকীকরণ" নিয়ে আম্বেদকর যা বলেছিলেন তার সঙ্গে বরং এই ঘৃণার মিল পাওয়া যায়।
মুসলিমদের “বিপজ্জনক সংক্রমণ” বলে দেগে দেওয়ার এই ধারণার অন্যভাগে রয়েছে হিন্দুদের “পবিত্র সংক্রমণ” এর ধারণা - এরা একে অপরের পরিপূরক।এই পবিত্র সংক্রমনবাহী হিন্দুত্বের অধিকার রয়েছে সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার - বাতাসে, ভূমি তে, পশুপাখী থেকে প্রতিটি ধুলিকণায়। কারণ এই সংক্রমণের স্পর্শে যারা আসবে তারা হয়ে উঠবে বিশুদ্ধ - সে ধর্ষণে অভিযুক্ত হোক বা দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা। অর্থনীতি থেকে বিচারবিভাগ - সমস্ত কিছুই পবিত্র হয়ে যায় এর স্পর্শে। সত্য এটাই যে এমনকি এই বিশ্বজোড়া অতিমারীও হিন্দু সামাজিক মহামারীর কবল থেকে রক্ষা পায় না। বরং সম্ভাবনা এটাই যে এই অতিমারী শেষ অবধি হিন্দু সমাজবিধির হাতই আরো শক্ত করে যাবে।
যদিও দাবীটি বিতর্কিত এবং হয়তো ভবিষ্যতের গবেষণার বিষয়, তবুও আমাদের অভিজ্ঞতা বলে ভারতে কোভিড-১৯ কমিউনিটি স্তরে সেভাবে ছড়িয়ে না পড়ার পিছনে অন্যতম কারণ হল আমরা এমনিতেই নানারকম সামাজিক দূরত্ব এবং জাতপাতভিত্তিক, জাতিভিত্তিক বিধিনিষেধের ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দী থাকি আগে থেকেই।
ইসলামোফোবিয়াকে ব্রাহ্মণ্যবাদের থেকে আলাদা করে দেখার বিশেষ কোন জায়গা নেই। হিন্দু সমাজব্যবস্থায় দলিতেরা হল নোংরা আর মুসলিমরা নিজেরাই সংক্রমণ। মুসলিমদের এই সংক্রমণ হবার ধারণা করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার সাথে বেশ খাপে খাপ মিলেও যাচ্ছে বেশ। মেরী ডগলাস লিখছেন “প্রান্তে থাকার অর্থ বিপদের সংস্পর্শে থাকা এবং একই সঙ্গে ক্ষমতার উৎস হবার সম্ভাবনা থাকা”। নরেন্দদ্র মোদী সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় বলেছেন গণতান্ত্রিক “নাগরিকতা” আসলে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রকাশ। সুতরাং যা কিছু সেই নাগরকদের পক্ষে ক্ষতিকর তা অবশ্যই খারাপ, শয়তানের পথবাহী। ধর্মনিরপেক্ষ চোখে, যাঁরা ভারতবর্ষের সংবিধান বিষয়ে ওয়াকিবহাল তাঁরা বলেন বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকত্ত্বের বোধ নিশ্চিতভাবেই হিন্দু রীতিনীতিগুলির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, যেমন আইনসভা বা বিচারবিভাগ - সকলেই এই “পবিত্র” নাগরিকত্বের অংশ। হিন্দুত্বের এই পবিত্র সংক্রমণই কেন্দ্রকে এবং তার সমাজকে ধরে রেখেছে এবং এই কিংবদন্তীসম শক্তির জেরেই পবিত্র নিরাপত্তাব্যবস্থা আমাদের রক্ষা করে চলেছে, কোভিড ১৯ এর বিরুদ্ধে এই পবিত্র যুদ্ধে সেই কিংবদন্তিই আমাদের নিরাপত্তার প্রধান ভরসা।
এর পিছনের রাজনীতিটা খুব পরিষ্কার। ভারত সরকারের কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই লড়াই শুধু ভাইরাসকে পরাজিত করা নয়, একই সাথে চিরদিনের মত ভারতের মুসলমান সমাজকেও আবদ্ধ করা। ব্রাহ্মণ্যবাদের পবিত্র সংক্রমণ এর মুক্ত প্রসারের জন্য এই দুই শয়তানকেই চিরতরে বন্দী করা হিন্দু রাষ্ট্রের চোখে একই রকম প্রয়োজনীয়। সুতরাং অতিমারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীনই একই সাথে মুসলিম অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ এনে তাদের গ্রেপ্তার করা মোটেই অবাক করার মতো কোন বিষয় নয়। এবং কোভিড-১৯ কে সীমিত রাখার প্রয়াস যত ব্যর্থ হয়েছে, সেই ব্যর্থতার হতাশা ক্রমশই বাড়িয়ে তুলেছে মুসলিম সমাজের প্রতি ঘৃণা এবং দ্বেষ। ভক্তেরা দেখতে চায় রাষ্ট্র তাদের জন্য কতটা ভাবিত - তাদের তা দেখানো রাষ্ট্রের প্রয়োজন। ফর্মুলা খুব সহজ এবং পরিষ্কার - কোভিড-১ যদি না প্রতিহত করতে পারো, মুসলিমদের করো। সে যুদ্ধ করোনা যুদ্ধের চেয়ে সর্ব অর্থেই বেশী লাভজনক।
(২৩শে এপ্রিল, ২০২০)
-----------------
ব্রহ্ম প্রকাশ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ এর সহকারী অধ্যাপক
ডিসক্লেইমারঃ এই লেখায় প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত, রাইটার্স ফোরামের প্রতিভূ নয়।
মূল লেখাটি 'ইন্ডিয়ান কালচারাল ফোরাম' নামক ওয়েব্সাইটে প্রকাশিত এবং অনুমতিক্রমে অনূদিত।
অনুবাদঃ রৌহিন ব্যানার্জী
বা! ভিন্ন চোখে স্পষ্ট চোখা লেখা। এ বিপদ সামনে আরও বড়ো হয়ে আসছে।
খুব ভাল লেখা।
অনুবাদটাও ভারী ঝরঝরে হয়েছে রৌহীন।
খুব ভাল রৌহীন। যেমন লেখা, তেমনি ভাল অনুবাদ।
Bhishon bhalo lekhata hoyeche. Kintu duti proshno. 1. China wuighur der ebong Pakistan Hazara der corona eer jonyo dosh dicche eei ta bolchen jakhon takhon please aapni ektu links deben eer proman hisebe? 2. USA ebong India eer sombondhe jeta likhchen seite ekdom swathik. Kintu eer samaadhaan ki ?
"বিভিন্ন সমাজ কিভাবে করোনা ভাইরাসের মুখে পড়ে নিজের নিজের মত করে তাদের দোষারোপের বলির পাঁঠা খুঁজে নিয়েছে। আমেরিকানরা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য দোষ দিচ্ছে প্রবাসী চিনাদের, চিনারা উইঘারদের, পাকিস্তান দোষ দিচ্ছে হাজারাদের, ভারত মুসলিমদের, আর মুসলিমরা জাহিল মুসলিমদের। স্প্যানিশ ফ্লু এর দোষ চাপানো হয়েছিল স্প্যানিশদের ঘাড়ে, আবার স্প্যানিশরা একে বলতেন "ফ্রেঞ্চ ফ্লু" - অর্থাৎ দোষটা ফরাসীদের।"
এই-ই হচ্ছে দিকে দিকে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে হিংসার ভাইরাস। এ -ও করোনার চেয়ে কম প্রাণ সংহারক নয়। এরই মধ্যে পশ্চিম বংগে সাম্প্রদায়িক হানাহানির খবর আসছে।...
জিপসি ফ্লু তাড়ানোর নামে জিপসি নিধন সহজেই বটে।
বিশ্লেষণ ভাল লাগলো, অনুবাদ তো বটেই। ব্রেভো রৌহিন দা।