এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ক্রম-উন্মোচিত করোনা – বায়োলজি, নিওলিবারাল অর্থনীতি এবং আমরা

    ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০২ এপ্রিল ২০২০ | ৭৩৬৫ বার পঠিত
  • এই মুহূর্তে রাজপুরুষদের খবরের বিচারে ইংল্যান্ডের প্রিন্স চার্লস এবং প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দুজনেই করোনা পজিটিভ বলে চিহ্নিত। ১.০৪.২০২০-র ওয়াশিংটন পোস্ট-এর খবর হুবহু তুলে দিই। শিরোনাম - White House task force projects 100,000 to 240,000 deaths in U.S., even with mitigation efforts। এরপরে একই খবরে জানাচ্ছে - he White House coronavirus task force on Tuesday presented a grim picture of where the U.S. could be heading over the next couple of months, even with interventions like physical distancing. The task force projects 100,000 to 240,000 deaths from the virus, with mitigation. The death toll in the U.S. grew by more than 800 on Tuesday, surpassing 3,700. Confirmed cases worldwide is more than 800,000.


    নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর (২৭ মার্চ, ২০২০) খবর ছিল - “Coronavirus in the U.S.: Latest Map and Case Count” অনুযায়ী অন্তত ৮৫,৩৮১ জন মানুষ আক্রান্ত এবং অন্তত ১,২৭১ জনের মৃত্যু ঘটেছে। আর CDC (Centers for Disease Control and Prevention)-র মতো আন্তর্জাতিকভাবে মান্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী ৩০ মার্চ, ২০২০-তে আক্রান্তের সংখ্যা ১৪০,৯০৪ এবং মৃত ২,৪০৫ জন। ৩১.০৩.২০২০-তে এসে সিএনএন সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী - The United States has the most confirmed cases globally at over 160,700. More than 3,000 people have died in the US -- over 1,200 in New York State. একই সাথে আরেকটি সতর্কবাণী করেছে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার ব্যাপারে - A new World Bank report warns the spread of Covid-19 could bring recession to countries in East Asia and the Pacific and push 11 million people into poverty. এর মানে হল, পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মন্দার ফলে ১ কোটির বেশি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়বে। ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদপত্রের ৩১.০৩.২০২০-র শিরোনাম – “Americans told to brace for 200,000 coronavirus deaths as world leaders push crisis response further”। WHO তথা বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার পরপর ৪ দিনের “সিচুয়েশন রিপোর্ট এরকম। ২৮.০৩.২০২০ – ৫৭১,৬৫৯টি পজিটিভ কেস (বেড়েছে ৬২,৯৪৫) এবং মৃত্যু ২৬,৪৯৩ (বেড়েছে ৩১৫৮)। ২৯.০৩.২০২০ – ৬৩৪,৮১৩টি পজিটিভ কেস (বেড়েছে ৬৩,১৬০) এবং মৃত্যু ২৯,৮৯১ (বেড়েছে ৩৩৯৮)। ৩০.০৩.২০২০ – ৬৯৩,২২৪ (বেড়েছে ৫৮,৪১১) এবং মৃত্যু ৩৩,১০৬ (বেড়েছে ৩২১৫)। ৩১.০৩.২০২০ – ৭৫০,৮০৯টি পজিটিভ কেস (বেড়েছে ৫৭,১৬০) এবং মৃত্যু ৩৬,৪০৫ (বেড়েছে ৩৩০১)। আমরা ৩১ তারিখে এসে দেখতে পাচ্ছি নতুন সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোর হারই আগের দিনগুলোর তুলনায় সামান্য হলেও কমেছে। হু-র বয়ানে - No new countries/territories/areas reported cases of COVID-19 in the past 24 hours। 


    একইসাথে আমরা নজর করবো কিভাবে দ্রুত সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বদলাচ্ছে। এর মধ্যে খানিকটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে ইতালিতে – একেবারে ক্ষতবিক্ষত, বিধ্বস্ত দেশে মৃত্যুহারের রেখাচিত্র একটু হলেও নিম্নগামী। চিনে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। সিঙ্গাপুর, জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম সফলভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণের মোকাবিলা করেছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরের মডেল নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে গভীর আলোচনা হচ্ছে। ল্যান্সেট-এর মতো জার্নালে (২৩.০৩.২০২০) সুদীর্ঘ গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে “Interventions to mitigate early spread of SARS-CoV-2 in Singapore: a modelling study”। এই স্টাডিতে দেখার বিষয় ছিল স্থানীয়ভাবে রোগ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অবরুদ্ধ করে রাখা বা containment কতটা সফল হয়। এদের সিদ্ধান্ত - Implementing the combined intervention of quarantining infected individuals and their family members, workplace distancing, and school closure once community transmission has been detected could substantially reduce the number of SARS-CoV-2 infections. এ পেপারে আরও বলা হয়েছে একটি অঞ্চলের জনসংখ্যার মাঝে কতজন উপসর্গহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে নিরপেক্ষভাবে “all the proposed interventions should be used in addition to other measures, such as rapid diagnosis and appropriate case management, if local containment fails.”


    ল্যান্সেটে (২৬ মার্চ, ২০২০) প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম – “COVID-19 gives the lie to global health expertise”। সে রিপোর্টে খুব তীক্ষ্ণ ভাষায় বলা হয়েছে - The US and UK Governments have provided among the world’s worst responses to the pandemic, with sheer lies and incompetence from the former, and near-criminal delays and obfuscation from the latter. শুধু এটুকু নয়, বলা হয়েছে - Neither country has widespread testing available, as strongly recommended by WHO, alongside treatment and robust contact tracing. দুটি দেশের কোনটিতেই স্বাস্থ্যকর্মী এবং ডাক্তারদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পিপিই (personal protective equipment) নেই। পৃথিবীর স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং ডাক্তারির ধরন হয়তো কোভিড-১৯ পরবর্তী পৃথিবীতে হয়তো চিরকালের জন্য বদলে গেলো -   Global health will never be the same after COVID-19—it cannot be.


    এতদিনে আমরা সবাই জেনে গেছি চারপাশে সূর্যের ছটার মতো প্রোটিনের গঠন থাকার জন্য এর নাম করোনাভাইরাস।

     
     (করোনাভাইরাস – চারপাশে সূর্যের ছটার মতো – এজন্য এই নাম)


    এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ভাইরাসের শরীরের ওপরে এক বিশেষ ধরনের “স্পাইক প্রোটিন” থাকে। এই প্রোটিনের সাহায্যে মানুষের কোষের রিসেপ্টরের ওপরে ভালোভাবে গেঁথে গুছিয়ে বসতে পারে। এবং ভাইরাসটি এর নিজের ইচ্ছেমতো কোষের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে যার ফলে যে যে উপসর্গ মানুষের শরীরে দেখা যায় (জ্বর, শুকনো কাশি, গলা এবং শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি) সেগুলো তৈরি হয়।



    (স্পাইক প্রোটিনের চেহারা)


    নেচার মেডিসিনের মতো গ্রাহ্য পত্রিকায় (১৭.০৩.২০২০) একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপ্রসূত চিঠি প্রকাশিত হয় “The proximal origin of SARS-CoV-2” শিরোনামে। সে চিঠিতে স্পষ্ট করে জানানো হয়  - Our analyses clearly show that SARS-CoV-2 is not a laboratory construct or a purposefully manipulated virus. মূল কথা, এ ভাইরাসটি কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়নি। তার কারণও নিহিত আছে স্পাইক প্রোটিনের বৈশিষ্ট্যের মাঝে। গবেষকদের বক্তব্য - the high-affinity binding of the SARS-CoV-2 spike protein to human ACE2 is most likely the result of natural selection on a human or human-like ACE2 that permits another optimal binding solution to arise. This is strong evidence that SARS-CoV-2 is not the product of purposeful manipulation. এর বাংলা করা প্রায় দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে সহজভাবে বললে এটুকু বলা যায় স্পাইক প্রোটিন যে পদ্ধতিতে প্রবল আসক্তি নিয়ে কোষের রিসেপ্টরের সাথে লেগে যায় (ACE2 রিসেপ্টর যা আমাদের কিডনি, ফুসুফুস ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে থাকে, সেসব অঙ্গের কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কিছু উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ এই রিসেপ্টরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তৈরি করা হয়) তাতে দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয় এটা ভাইরাসের বিবর্তনের ফলে তৈরি হয়েছে। কোন জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে নয়। ফলে মহাশক্তিধর ট্রাম্পের বলা “Chinese virus”-কে কেন্দ্র করে যেসব কন্সপিরেসি থিওরি বাজারে গুজব হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এ ভাইরাস সেরকম কল্পবিজ্ঞানের মতো ল্যাবরেটরিতে তৈরি একেবারেই নয়। প্রাকৃতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া একটি অসীম শক্তিশালী, ক্ষতিকর ভাইরাস যে এখন প্রাণীদের শরীরের বদলে মানুষের শরীর পেয়ে গেছে নিজের অসম্ভব সব কাণ্ড ঘটানোর জন্য। 


    প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন বাদুড়ের দেহে বাস করা ভাইরাস (সম্ভবত মধ্যবর্তী আরেকটি প্রাণী প্যাঙ্গোলিনকে পেয়েছিল নিজের জিনের চরিত্র বদলের জন্য) মানুষের শরীরে এলো কি করে? এর কোন সরল, একরৈখিক, একমাত্রিক উত্তর নেই। এখানেই আমাদের ভাবতে হবে নিওলিবারাল অর্থনীতি, পুঁজির সর্বময় অস্তিত্ব এবং কর্পোরেট পুঁজির প্রয়োজনে কিভাবে বছরের পর বছর ধরে প্রাকৃতিক অঞ্চলগুলো মুনাফার লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এবং তার ফলে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্য ভেঙ্গেচুড়ে গেছে, প্রকৃতির নিজস্ব বাসিন্দারা মানুষের দেহে এদের নতুন বাসস্থান খুঁজে নিয়েছে। আমরা নিত্যনতুন মারণ রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। এ বিষয়ে পরে আরেকটু বিস্তৃত আলোচনা করবো।


    বিজ্ঞানী যখন ডিটেক্টিভ


    নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় (২৭.০৩.২০২০) ক্যারোলিন করম্যান একটি সুদীর্ঘ, তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখলেন “From Bats to Human Lungs, the Evolution of a Coronavirus”। লেখাটি শুরু হচ্ছে এভাবে - For thousands of years, a parasite with no name lived happily among horseshoe bats in southern China. The bats had evolved to the point that they did not notice; they went about their nightly flights unbothered. One day, the parasite—an ancestor of the coronavirus, SARS-CoV-2—had an opportunity to expand its realm. Perhaps it was a pangolin, the scaly anteater, an endangered species that is a victim of incessant wildlife trafficking and sold, often secretly, in live-animal markets throughout Southeast Asia and China. হাজার হাজার বছরে ধরে দক্ষিণ চিনের ঘোড়ার খুড়ের মতো দেখতে বাদুড়ের মধ্যে এই ভাইরাসেরা সুখে বাস করছিল। বাদুড়েরা রাতে মহানন্দে উড়ে বেড়াতো। (এখানে উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন স্তন্যপায়ীদের মধ্যে একমাত্র বাদুড় জোরে উড়তে পারে বলে সম্ভবত বিভিন্ন ভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ইমিউনিটি গড়ে তুলতে পারে, যেটা আমাদের নেই।) তারপরে বাজারের নিয়ম মেনে এরা অ্যানিম্যাল মার্কেটে চলে এলো মানুষের সর্বগ্রাসী খিধে মেটানোর জন্য। এবং ভাইরাস বাসা বাঁধলো আমাদের শরীরে – তার এক নতুন আশ্রয় মিললো।


    ২০০৩-এ যে সার্স-কোভ-১ আবিষ্কার হয়েছিল। অন্যতম আবিষ্কারক ছিলেন জোনাথান এপস্টাইন। সে এক রূদ্ধশ্বাস কাহিনী। চিনের গুয়াঙ্গডনের বাজারে যে বাদুড় খাদ্য হিসেবে বিক্রি হত তাতে এপস্টাইনের সন্দেহ হয় বাদুড় থেকে সার্স-কোভ-১ উৎস। এপস্টাইন ঐ অঞ্চলের চুনাপাথরের গুহায় ক্যাম্প করে থেকেছিলেন। আর রাত্রিবেলা ডজন ডজন বাদুড়ের লালারস সংগ্রহ করতেন। এভাবে বাদুড়ের চারটি প্রজাতিকে খুঁজে পান যাদের জিনের সাথে সার্স-কোভ-১-এর জিনের ৯০%-এরও বেশি মিল আছে। ২০১৩ সালে এপস্টাইন এবং সহ-গবেষিকা শি ঝেং-লি বাদুড় থেকে পাওয়া জিনের সিকোয়েন্সিং করে সার্স-কোভ-২-র জিনের সাথে ৯৬% জিনগত সাদৃশ্য পান। কিন্তু যেহেতু দুটির মধ্যে ১০০% সাদৃশ্য পাননি সেজন্য তাঁদের ধারণা মাঝে এই ভাইরাসের আরেকটি মিউটেশন হয়েছে অন্য কোন প্রাণীর মাঝে (সম্ভবত প্যাঙ্গোলিন)।


    ভাইরাসের বায়োলোজি


    একেবারে অজানা এই মারণান্তক ভাইরাসকে বোঝার জন্য শ্রেষ্ঠ মেধার বিজ্ঞানী, চিকিৎসক-চিকিৎসাকর্মী, এপিডেমিওলজিস্ট সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জানুয়ারি (২০২০) থেকে প্রায় হাজারখানেক প্রকাশিত, প্রাক-প্রকাশিত, অপ্রকাশিত গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে এবং BIOxiv-তে (একটি প্রাক-প্রকাশনা গবেষণাপত্রের পোর্টাল) পোস্টেড হয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে ১০০০-এর বেশি করোনাভাইরাস জিনোম সিকোয়েন্স public darabase-এ পারস্পরিক লেনদেন করার জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথায় - SARS-CoV-2 behaves like a monstrous mutant hybrid of all the human coronaviruses that came before it. It can infect and replicate throughout our airways. এর আগে যে ACE-2 receptor-এর কথা বলেছিলাম বর্তমানের করোনাভাইরাস ২০০২-০৩-এর সার্স ভাইরাসের ১০ গুণ বেশি কার্যকরীভাবে এই রিসেপ্টরগুলোর সাথে বেঁধে যেতে পারে। এজন্য শ্বাসকষ্টের প্রাবল্য এত বেশি হয়। আরও কথা হল যে এদের অতি দ্রুত এবং ঘন ঘন মিউটেশন হতে থাকে। শ্বাসনালীতে পৌঁছনোর পরে আরও বেশি ঘটে এটা।


    বর্তমানে Real-time quantitative fluorescence polymerase chain reaction (RT-qPCR) testing of respiratory specimens for SARS–CoV-2 RNA ব্যবহার করা হয় সংক্রমিত কে তাকে চিহ্নিত করা এবং কতদিন হাসপাতালে থাকা প্রয়োজন সেটা নির্ধারণ করার জন্য। অ্যানালস অফ ইন্টার্নাল মেডিসিন-এ প্রকাশিত একেবারে সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র (৩০.০৩.২০২০) “ARS-CoV-2–Positive Sputum and Feces After Conversion of Pharyngeal Samples in Patients With COVID-19”-এ ১৩৩ জন রোগীর ওপরে পরীক্ষা করে বলা হয়েছে যে ২২ জন রোগীর ক্ষেত্রে “who had positive RT-qPCR results for SARS–CoV-2 in the sputum or feces after pharyngeal swabs became negative.” ভাইরাস বায়োলজির এ হল আরেক গভীরতর সমস্যার কথা। থুতু কিংবা মলে কোন ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছেনা, অথচ যে এনজাইমের সাহায্যে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার খোঁজ মিলছে ভাইরাস মুক্ত রোগীর রক্তে। এবার একে কি সংক্রমণ মুক্ত বলা যাবে? এরকম নিত্যনতুন গবেষণালব্ধ তথ্য উঠে আসছে। ফলে ভাইরাস বায়োলজি আমাদের কাছে এখনো অধরা।


    জার্মান গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে সংক্রমিত রোগীরা উপসর্গ পরিস্ফুট হবার আগে প্রচুর পরিমাণে ভাইরাস চারপাশে ছড়ায়। এমনকি ৩৭ দিন পর্যন্ত এরকম ভাইরাস ছড়ানো চলতে পারে। এবার ভাইরাস যে ছড়িয়ে পড়বে তার দুটো মাধ্যম – (১) এরোসল বা কফ, থুতু, কাশি, হাঁচি ইত্যাদি এবং (২) fomite বা কোন শক্ত বস্তু যেমন পিচবোর্ড, ধাতব বস্তু, কাঁচ, প্লাস্টিক ইত্যাদি। প্রথম ক্ষেত্রে ৩ ঘন্টা মতো সংক্রমক অবস্থায় থাকতে পারে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তামার ওপরে ৪ ঘণ্টা, পিচবোর্ডে ২৪ ঘন্টা, প্লাস্টিকে ৩ দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকতে পারে। যদিও প্রথম ১০ মিনিটে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়। তারপরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে।


    সমাজের যে অংশের মানুষেরা বেশি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে তারা হল – (১) ৬০ বা এর চেয়ে বেশি বয়সী, (২) ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা নিউমোনিয়ার মতো অন্য কোন রোগে আক্রান্ত, (৩) যারা ইমিউনোসাপ্রেসিভ ওষুধ খাচ্ছে ইত্যাদি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা দেখাচ্ছে ৩০ দিনের শিশু এবং মা থেকে শিশুতে সংক্রমপণের ঘটনাও ঘটছে। কম্বয়সীরা তুলনায় নিরাপদ। তবে বিপন্মুক্ত নয়। করোনাভাইরাসে যাদের মৃত্যু ঘটে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ দুটি – (১) ডাক্তারি পরিভাষায় বললে “cytokine storm syndrome” যখন অত্যন্ত মাত্রাছাড়াভাবে শরীরের আভ্যন্তরীন ইমিউন রেস্পন্স তৈরি হয় যার ফলে আক্রান্তের ফুসফুস চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক গবেষকের কথায় – “It is almost like an autoimmune disease; the immune system is attacking parts of the body that it should not.” এবং (২) “fulminant myocarditis” যার ফলে অতি দ্রুত এবং মারাত্মক হার্ট ফেইলিউর হয় যাকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসাধ্য। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ACE2 inhibitor নিয়ে বিতর্ক। কিন্তু ১৭ মার্চ, ২০২০-তে প্রকাশিত জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন-এর একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম “Patients taking ACE-i and ARBs who contract COVID-19 should continue treatment, unless otherwise advised by their physician”। ব্যথা কমানোর ওষুধ ইবিউপ্রোফেন নিয়েও একই কথা। একমাত্র তাড়াহুড়ো করে লেখা ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটি চিঠি ছাড়া আর কোথাও একে নিষিদ্ধ করা হয়নি। এ নিয়ে ১৭ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে।


    আমেরিকান জার্নাল অব হেমাটোলজি-তে ৪ মার্চ, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম – Hematologic parameters in patients with COVID-19 infection। সেখানে গবেষকরা দেখেছেন রক্তে শ্বেত কণিকা, লিম্ফোসাইট, এমনকি অণুচক্রিকার পরিমাণও কমে যাচ্ছে - On admission, leukopenia was observed in 19 patients (29.2%) with only one patient presenting with severe leukopenia (WBC < 2 × 109/L). Lymphopenia featured in 24 patients (36.9%) with 19 having moderate lymphopenia (absolute lymphocyte count [ALC] 0.5‐1 × 109/L), and five with severe lymphopenia (ALC < 0.5 × 109/L). Most patients had normal platelet counts, with 13 patients (20.0%) having mild thrombocytopenia (platelet count 100‐150 × 109/L). এর পরিণতিতে থ্রম্বোসিস, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্ক্যুলার কোয়াগুলেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।


    বিখ্যাত জার্নাল সায়ান্স-এ (২৭.০৩-২০২০) একটি গবেষণাপত্রের শিরোনাম - How sick will the coronavirus make you? The answer may be in your genes। ঐ প্রবন্ধে বলা হয়েছে – “Variations in the ACE2 gene that alter the receptor could make it easier or harder for the virus to get into cells. আরও অনুমান করা হচ্ছে (চিনা গবেষকদের একটি প্রাক-প্রকাশ গবেষণাপত্রে) যে যাদের ব্লাড গ্রুপ O (+ বা - বলা হয়নি) তাদের ভাইরাস সংক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এখানে সর্বশেষ মন্তব্য – “The catastrophic spread of the coronavirus should soon increase the number of COVID-19 patients available to these gene hunts.” 


    আমরা জিন হান্ট বা জিন শিকার শব্দটিতে নজর করি একবার। আমরা আমাদের নিজেদের দেহের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে প্রকৃতি এবং আমাদের চারপাশের জীবজগৎ সবার ওপরে শুধু প্রভুত্ব করে যাবার উদগ্র আকাঙ্খা পোষণ করি। সবার সাথে আমাদের যুদ্ধ। আমরা জিনকে শিকার করি। আমাদের ঘিরে রাখা সহনশীল বাস্তুজগৎ বা ম্যাক্রোকজম (macrocosm)-কে আমরা যতদিন মমতার সাথে, ভালোবাসার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করে গ্রহণ করতে না পারবো ততদিন আরও মহামারির (এর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়তো) জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। শিল্পবিপ্লব-উত্তর পৃথিবীতে প্রকৃতিকে পুঁজির দাস এবং ক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে দেখার যে মানসিকতা ৩০০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী মানসিকতায় সঞ্চারিত হয়েছে – যার চূড়ান্ত রূপ কর্পোরেট পুঁজির যুগে এসে আরও গভীর এবং সর্বব্যাপী হয়েছে – তার গোড়া ধরে টান না মারলে আমাদের মুক্তি ও পরিত্রাণের কোন সম্ভাবনা নেই। এ লড়াই করোনার সাথে লড়াইয়ের চেয়েও শক্ত, দীর্ঘস্থায়ী।


    করোনার চিকিৎসা


    ২০ মার্চ, ২০২০-র নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টের শিরোনাম – Covert coronavirus infections could be seeding new outbreaks। আমাদের বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়, একজন আপাত-উপসর্গহীন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ এই বিপজ্জনক ভাইরাস তার শরীর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। কি অসম্ভব এক পরিস্থিতি! নেচার-এর মন্তব্য - As coronavirus outbreaks surge worldwide, research teams are racing to understand a crucial epidemiological puzzle — what proportion of infected people have mild or no symptoms and might be passing the virus on to others. Some of the first detailed estimates of these covert cases suggest that they could represent some 60% of all infections. অর্থাৎ, প্রাথমিক যে হিসেব পাওয়া যাচ্ছে তাতে অনুমান করা যায় জনসমাজের ৬০% সংক্রমণ এভাবে ঘটতে পারে। জাপানের এক জাহাজ থেকে উদ্ধার করা টেস্ট-পজিটিভ ১৩ জনের মধ্যে ৪ জনের অর্থাৎ ৩১%-এর কোন উপসর্গ ছিলনা। 


    ভাইরাসের প্রজনন সংখ্যা (রিপ্রোডাকশন নাম্বার) দিয়ে এর গতিপ্রকৃতি এবং সংক্রামিত করার ক্ষমতা মাপা হয়। একে বলা হয় R0 – যা দিয়ে বোঝা যায় একজন সংক্রমিত মানুষ ক’জনের মাঝে এই ভাইরাসকে পৌঁছে দিতে পারে। সংক্রমণের সময় সাধারণভাবে এ সংখ্যা ২-২.৫। চিনের য়ুহানে একসময়ে এটা ৪ অব্দি পৌঁছেছিল। এখন এ সংখ্যা ০.৩২-এ এসে পৌঁছেছে। এপিডেমিওলোজির ভাষায় সংখ্যাটি ১-এর নীচে গেলে সংক্রমণমুক্ত বলা যেতে পারে।


    এখনো অবধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোন ধাপেই কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। অতি মারাত্মক ক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে সার্স, এইচআইভি-তে ব্যবহৃত অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ এবং ক্লোরোকুইন বা ক্লোরামফেনিকলের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত প্রয়োগ ফল দিচ্ছে। কিন্তু ১৮ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত ট্রায়াল রিপোর্ট (র‍্যান্ডমাইজড, কন্ট্রোলড, ওপেন লেবেল ট্রায়াল) “A Trial of Lopinavir-Ritonavir in Adults Hospitalized with Severe Covid-19” জানাচ্ছে - In hospitalized adult patients with severe Covid-19, no benefit was observed with lopinavir–ritonavir treatment beyond standard care. ১৯ মার্চ, ২০২০-তে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় হল – Covid-19 – The Search for Effective Therapy. এ লেখায় খানিকটা বেদনার স্বরেই বলা হয়েছে - What we lack is a specific antiviral agent to treat the infected and, optimally, decrease viral shedding and subsequent transmission. ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় (১৮.০৩.২০২০) একটি খবর বেরিয়েছে “Flu drug Avigan speeds up coronavirus recovery in early trials”। কিন্তু যতক্ষণ না একটি ওষুধ র‍্যান্ডমাইজড, কন্ট্রোলড, ওপেন লেবেল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাকে মান্যতা দেওয়া মুশকিল। যদিও চরম আতঙ্কের সময়, পরম আর্ততার মুহূর্তে মানুষ যেকোন অবলম্বনকে আঁকড়ে ধরে – এমনকি গোমূত্রও!


    নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর (২৬.০৩.২০২০) সম্পাদকীয়র শিরোনাম – Covid-19 Navigating the Uncharted. শিরোনামেই স্পষ্ট যে আমরা অজানা পথে হাঁটছি, খুঁজে বেড়াচ্ছি। সম্পাদকীয়তে লেখা হচ্ছে – “A robust research effort is currently under way to develop a vaccine against Covid-19. We anticipate that the first candidates will enter phase 1 trials by early spring. Therapy currently consists of supportive care while a variety of investigational approaches are being explored. Among these are the antiviral medication lopinavir–ritonavir, interferon-1β, the RNA polymerase inhibitor remdesivir, chloroquine, and a variety of traditional Chinese medicine products. Once available, intravenous hyperimmune globulin from recovered persons and monoclonal antibodies may be attractive candidates to study in early intervention.” অর্থাৎ, সম্ভাব্য যতরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মানুষকে সুস্থ করে তোলার জন্য। কিন্তু এর সাথে বিজ্ঞানের কঠোর পরীক্ষাকে (open label, randomized controlled trial) যুক্ত করতে হবে, যুক্ত করতে হবে নৈতিকতাকে। সম্পাদকীয়র মন্তব্য – “Critical to moving the field forward, even in the context of an outbreak, is ensuring that investigational products are evaluated in scientifically and ethically sound studies.”


    হু-র তরফে Solidarity Trial বলে একটি আলাদা সাইট খুলেছে যেখানে পৃথিবী জুড়ে যেসমস্ত ট্রায়াল হচ্ছে – সে ৫ জন রোগীকে নিয়েই হোক বা বড়ো কন্ট্রোলড ট্রায়ালই হোক – সমস্ত ট্রায়ালকে আপলোড করা যাবে। পৃথিবীর এবং হু-র বিজ্ঞানীরা সেগুলো খতিয়ে দেখবেন। “পেলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন” – বাস্তবিকই এরকম ভয়ঙ্কর এক অজানা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যার যা অভিজ্ঞতা আছে সব দুনিয়ার মানুষের সামনে আসা দরকার। কিন্তু গুজব এবং ভ্রান্তি যেন তৈরি না হয়। হু-র সাইটে আমেরিকা এবং বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত যেসব ওষুধগুলোর নাম উল্লেখ করা আছে সেগুলো হল – Remdesivir, Mavrilimumab, Convalescent plasma, Hydroxychloroquine (Plaquenil) and chloroquine (Aralen), Lopinavir-ritonavir (Kaletra), Tocilizumab, Sarilumab, Favilavir। এর মধ্যে Convalescent plasma বা করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা রোগীর রক্তের প্লাজমা ছাড়া বাকি সবগুলো ওষুধ নিয়েই নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে মতামত দেওয়া হয়েছে। 


    JAMA (Journal of American Medical Association – ২৭.০৩.২০২০)-তে একটি “Preliminary Communication”-এর শিরোনাম – “Treatment of 5 Critically Ill Patients With COVID-19 With Convalescent Plasma”। করোনা সংক্রমণমুক্ত রোগীর রক্তের অ্যান্টিবডি প্রবল শ্বাসকষ্টের রোগীকে দেবার পরে তারা সেরে উঠেছে - In this preliminary uncontrolled case series of 5 critically ill patients with COVID-19 and ARDS, administration of convalescent plasma containing neutralizing antibody was followed by improvement in their clinical status. কিন্তু সতর্ক করা হচ্ছে - The limited sample


    size and study design preclude a definitive statement about the potential effectiveness of this


    treatment, and these observations require evaluation in clinical trials. অর্থাৎ, এত কম স্যাম্পেল এবং দুর্বল ট্রায়াল ডিজাইনের জন্য এ চিকিৎসার পরবর্তী এবং উপযুক্ত মূল্যায়ন দরকার। যেকোন চিকিৎসার কথা যে কেউ বললেই সেটাকে ধর্ম বিশ্বাসের মতো সাথে সাথে গ্রহণ করার প্রশ্ন। নানারকম উপকথা, অতিকথার বাইরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিধি, পদচারণা।



    করোনাভাইরাস এবং কর্পোরেট পুঁজির রাজনীতি 


    ১৬ মার্চ, ২০২০-র খবর হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউটস অব হেলথ-এর তরফে করোনাভাইরাসের প্রথম ভ্যাক্সিন সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে mRNA-1273। 




     একটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে – Trump reportedly offered $1 B to poach coronavirus vax for US use only। জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি CureVac জানুয়ারি মাস থেকে ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এই CureVac-এর ভ্যাক্সিন কেনার জন্য ট্রম্পের এই প্রলোভন দেখানো। আমেরিকায় বিতর্ক শুরু হয়েছে – জনসাধারণের ট্যাক্সের টাকায় যে রিসার্চ হয় সে রিসার্চের ফল কেন বাণিজ্যিকভাবে বিপুল মুনাফার জন্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হবে? রয়টার্স-এর খবর (১৫ মার্চ, ২০২০) অনুযায়ী – Germany tries to halt U.S. interest in firm working on coronavirus vaccine। সে খবরেই বলা হয়েছে যে CureVac-এর প্রধান লগ্নীকারী Horst Seehofer জানাচ্ছেন যে তিনি ভ্যাক্সিন বিক্রি করবেন না এবং এই ভ্যাক্সিনের লক্ষ্য হবে “help people not just regionally but in solidarity across the world”।


    আমেরিকার আরেকজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন তিনি নির্বাচিত হলে এই ভাক্সিনকে সম্পূর্ণত বিনামূল্যে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-তে ৪৬ জন ডেমোক্র্যাটের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি ট্রাম্পকে দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে - We write to ask you to ensure that any vaccine or treatment developed with U.S. taxpayer dollars be accessible, available, and affordable. That goal cannot be met if pharmaceutical corporations are given authority to set prices and determine distribution, putting profit-making interests ahead of public health priorities. Americans deserve to know that they will benefit from the fruits of their public investments.
     মানুষের বাঁচার জীয়ন কাঠিও কর্পোরেট পুঁজির আবর্তে পড়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বর্তমান অর্থনীতির এই ধ্বসের মাঝেও আমেরিকান বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানি ইলি লিলি-র শেয়ার লাভের মুখ দেখেছে কারণ এরা সর্বসাধারণ্যে বিবৃতি দিয়েছে যে করোনাভাইরাসের নতুন চিকিৎসা নিয়ে আসছে। 


    ১৯ মার্চ, ২০২০ – নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ খবরের শিরোনাম “Search for Coronavirus Vaccine Becomes a Global Competition”। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে - What began as a question of who would get the scientific accolades, the patents and ultimately the revenues from a successful vaccine is suddenly a broader issue of urgent national security. বিশ্ব কি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে? না কি জাতীয়তাবাদ এবং মুনাফার উদগ্র বাসনা প্রধান বিষয় হয়ে উঠছে?


    মানুষের বাঁচার জীয়ন কাঠিও কর্পোরেট পুঁজির আবর্তে পড়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বর্তমান অর্থনীতির এই ধ্বসের মাঝেও আমেরিকান বহুজাতিক ফার্মা কোম্পানি ইলি লিলি-র শেয়ার লাভের মুখ দেখেছে কারণ এরা সর্বসাধারণ্যে বিবৃতি দিয়েছে যে করোনাভাইরাসের নতুন চিকিৎসা নিয়ে আসছে।


    এই মুহূর্তে ৩৫টি ওষুধ কোম্পানি এবং অ্যকাডেমিক প্রতিষ্ঠান ভ্যাক্সিন তৈরির লড়াইয়ে রয়েছে। গার্ডিয়ান পত্রিকার (২৭ মার্চ, ২০২০) রিপোর্ট “Coronavirus vaccine: when it will be ready?” বলছে - About 35 companies and academic institutions are racing to create such a vaccine, at least four of which already have candidates they have been testing in animals. The first of these – produced by Boston-based biotech firm Moderna – will enter human trials imminently. এরপরেই যোগ করছে - This unprecedented speed is thanks in large part to early Chinese efforts to sequence the genetic material of Sars-CoV-2, the virus that causes Covid-19. China shared that sequence in early January, allowing research groups around the world to grow the live virus and study how it invades human cells and makes people sick. অর্থাৎ, এই অসম্ভব দ্রুত গতির আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে চিনের তরফে প্রথম থেকেই জেনেটিক উপাদান বিশ্ববাসীর হাতে তুলে দিয়েছে।


    উল্লেখযোগ্য খবর হল, ভারতের ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অগ্রগতি - Researchers from the King George’s Medical University in Lucknow have discovered that the novel coronavirus (2019-nCoV) has new sites in the proteins in its outer layer. (Nature India, ২৮.০৩.২০২০)।


    মন্থলি রিভিউ পত্রিকায় (২৭ মার্চ, ২০২০) সুবিখ্যাত জীববিজ্ঞানী রব ওয়ালেস এবং অন্যান্যরা একটি গবেষণাপত্র লিখেছেন - COVID-19 and Circuits of Capital। এঁদের বক্তব্য পুঁজির জন্মলগ্ন থেকে সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য প্রকৃতির ওপরে প্রভুত্ব করার যে উদগ্র বাসনা তার থেকে বিভিন্ন মহামারির জন্ম – কোভিড-১৯-ও ব্যতিক্রম নয়। এঁদের বিনীত পরামর্শ - Can we fundamentally adjust the modes by which we appropriate nature and arrive at more of a truce with these infections?


    নিউ ইংল্যান্ড জার্নালে (২৬.০২.২০২০) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো – “Escaping Pandora’s Box – Another Novel Coronavirus”। এ প্রবন্ধে লেখকেরা বলেছিলেন - We have created a global, human-dominated ecosystem that serves as a playground for the emergence and host-switching of animal viruses, especially genetically error-prone RNA viruses, whose high mutation rates have, for millions of years, provided opportunities to switch to new hosts in new ecosystems. It took the genome of the human species 8 million years to evolve by 1%. Many animal RNA viruses can evolve by more than 1% in a matter of days. It is not difficult to understand why we increasingly see the emergence of zoonotic viruses. ভাইরাসের লক্ষ লক্ষ বছরের জীবনযাত্রা আমাদের লোভের এবং মুনাফার তাড়নায় ভেঙ্গে দিয়েছি। এর ফলে “a combination of altered human behaviors, environmental changes, and inadequate global public health mechanisms now easily turn obscure animal viruses into existential human threats.”


    আগ্রহীরা মাইক ডেভিসের “The Monster is Finally at the Door” কিংবা সারা ক্লিফ এবং বব ওপেনহেইমার-এর “What the Coronavirus Means for the UN, IMF, and World Bank” দেখতে পারেন। দেখতে পারেন ইয়ুভাল নোয়া হারারির দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ – “The World After Coronavirus (Financial Times, 20.03.2020) এবং “In the Battle Against Coronavirus, Humanity Lacks Leadership (Time, 15.03.2020)। যদিও রাষ্ট্রপন্থী হারারির প্রতিপাদ্য ভিন্ন, কিন্তু অনেক চিন্তার খোরাক জোগায়।


    একই সাথে ভাবতে হবে আইএমএফ এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চাপে প্রতিটি দেশের, বিশেষ করে গরীব দুর্বল ও ছোট দেশগুলোতে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে। এর জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট হেলথ সেক্টর যেখানে স্বাস্থ্য নেই, রয়েছে বহুমূল্যে কেনা স্বাস্থ্য পরিষেবা। এ কারণে আফ্রিকার দেশগুলোতে এবোলা মহামারির চেহারা নিয়েছিলো যখন তখন স্বাস্থাকর্মীদের বেশিরভাগের কাছে একটি গ্লাভস কিংবা মাস্কও ছিলো না। এখনো ইতালি, স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকার মতো দেশে জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত হবার বিষময় ফল ২০২০-র পৃথিবী দেখছে। বিবিসি নিউজ-এর ৩০.০৩.২০২০-র খবর হল “Coronavirus: India's pandemic lockdown turns into a human tragedy”। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয়েছে – “The next few days will determine whether the states are able to transport the workers home or keep them in the cities and provide them with food and money. নিওলিবারাল অর্থনীতির নামমাত্র মূল্যে উৎপাদন এবং মুনাফা সচল রাখার বড়ো হাতিয়ার হল এই পরিযায়ী লক্ষ কোটি মানুষ। কিন্তু বর্তমান রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এদের অবস্থান কোথায়? গণবন্টন ব্যবস্থায় এদের অবস্থান কোথায়? অথচ এদের অনিবার্য অবস্থানের জন্যই এরা জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে ভাইরাসের জতুগৃহও বটে।


    বুঝ জন, যে জানো সন্ধান!


    লেখক একজন চিকিৎসক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০২ এপ্রিল ২০২০ | ৭৩৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সে | 162.158.***.*** | ০২ এপ্রিল ২০২০ ১৪:৪৪91962
  • সাধারণের জন্য বোধগম্য লেখা।
  • S | 162.158.***.*** | ০২ এপ্রিল ২০২০ ১৫:০৯91963
  • সত্যের খাতিরে একটা কথা বলে দিই। আই এম এফের থেকে মাত্র ৫-৬ বিলিয়ন ডলারের মতন ধার রয়েছে ভারতের। আর ওয়ার্ল্ড ব্যান্কের ক্ষেত্রে সেটা হবে ১২ বিলিয়ন ডলার মতন (যদিও ভারত ওয়ার্ল্ড ব্যান্কের অন্যতম বড় বরোয়ার)। ভারতের অর্থনীতির সাইজের তুলনায় এগুলো ঠিক পলিসি নির্ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। সেইসব দিন বহুদিন হল গেছে যখন এই দুটো সংস্থার দিকে তাকিয়ে থাকতে হত।

    ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য ভারতের সরকারগুলই দায়ী। অন্যদের দোষ দিয়ে খুব বেশিদূর এগোনো যাবেনা।
  • একলহমা | ০৩ এপ্রিল ২০২০ ০৯:৫০91982
  • এই মহামারী আজকের সভ্যতার যে সব সর্বনাশী দুর্বলতাকে হাট করে মেলে ধরল, সেগুলো কি কিছুটা হলেও এর ফলে সংশোধন হবে?
  • একলহমা | ০৩ এপ্রিল ২০২০ ১১:০৫91987
  • PittCoVacc নিয়ে কোন কথা?
  • জয়ন্ত ভট্টাচার্য | 162.158.***.*** | ০৩ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৫৭91994
  • PittCoVacc পিটসবার্গ ইউনিভার্সিটির মিক্রোনিডল অ্যারে পদ্ধতি প্রয়োগ করে একটি ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা। এ পদ্ধতিতে ভ্যাক্সিন নিয়ে গতকাল ল্যান্সেটে পেপার পাবলিশড হয়েছে।
    প্রাথমিক স্তরে আছে।

    লিংক দিলাম

    Yes. Here is the link

    Look what I shared: Microneedle array delivered recombinant coronavirus vaccines: Immunogenicity and rapid translational development - EBioMedicine @MIUI| https://www.thelancet.com/journals/ebiom/article/PIIS2352-3964(20)30118-3/fulltext#main amens
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন