ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসের মতন সার্স-কোভ২ ভাইরাসও সম্ভবত আমাদের সঙ্গে অনেক, অনেক দিন থাকবে:
ভাইরাস-শিকারী পিটার পিওট এর সঙ্গে আলাপচারিতা ~ প্রথম পর্ব
১) টেডমেডঃ একদম গোড়ার থেকে শুরু করা যাক। ভাইরাস কি?
ভাইরাস হল প্রোটিনের মোড়কের মধ্যে RNA বা DNA জেনেটিক কোডের একটা ছোট্ট কণা।
২) কতটা common এই ভাইরাস?
ভাইরাস সর্বত্র আছে। শুনতে অবাক লাগবে যে পৃথিবীর সব ভাইরাস একসঙ্গে ধরলে তাদের মোট ওজন সব গাছ-পালা, প্রাণী, ব্যাক্টেরিয়া শুদ্ধু পৃথিবীর সব জীবন্ত বস্তুর মোট ওজনের থেকেও বেশি। মানুষের জিনোমের ১০% ভাইরাসের ডিএনএ’র থেকে পাওয়া। পৃথিবীটা সত্যি বলতে একটা “ভাইরাস প্ল্যানেট”।
৩) ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করা এত কঠিন কেন ?
ভাইরাস কণাগুলি এতই আশ্চর্যরকমের ছোট যে, মাত্র একবার কাশলেই কোটি কোটি ভাইরাস ড্রপলেটে চেপে বেরিয়ে এসে বাতাসে ভাসতে পারে।
৪) এই ভাইরাস ঠিক কতটা ছোট ?
একদম ছোট্ট। এমনকি সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও আপনি ভাইরাস দেখতে পাবেন না। নভেল করোনাভাইরাসের ১০ কোটি ভাইরাল কণা, একটি আলপিনের মাথায় ধরে যাবে। এতটাই অবিশ্বাস্যরকমের ছোট।
৫. ভাইরাসের কণাগুলো কি করে ?
ভাইরাস কণাগুলো কোন জীবিত কোষে ঢুকতে চেষ্টা করে যাতে সে নিজের সংখ্যাবৃদ্ধি করতে পারে আর অন্য কোষ বা অন্যান্য হোস্টদের সংক্রামিত করতে পারে।
৬) ভাইরাসেরা জীবন্ত কোষে ঢোকার চেষ্টা করে কেন ?
ভাইরাসেরা আসলে ওইভাবেই অন্য ভাইরাসের জন্ম দেয়। ভাইরাস পরজীবীর মতো কাজ করে। প্রতিটি কোষকে আরও ভাইরাস তৈরি করতে বাধ্য করার জন্য তারা জীবন্ত কোষগুলি হাইজ্যাক করে। একটা কোষ হাইজ্যাক করলে, ভাইরাস শত শত বা হাজারে হাজারে নিজের মত ভাইরাস তৈরি করে চারপাশে পাঠিয়ে দিতে পারে। যার ফলে প্রায়ই হাইজ্যাক-হওয়া কোষটি মরে যায়।
৭) বিজ্ঞানীরা যাকে “ SARS-CoV2 " নাম দিয়েছেন, সেই নতুন করোনাভাইরা সে সংক্রামিত হওয়ার অর্থ কি?
এর মানে হল, SARS-CoV2 আপনার দেহে আরও ভাইরাসের জন্ম দিতে শুরু করেছে।
৮) SARS-CoV2 আর COVID-19 এর মধ্যে তফাৎ কি?
ভাইরাস হল SARS-CoV2 আর COVID-19 হল এই ভাইরাসের ছড়ানো অসুখ।
একটি করোনা ভাইরাসের চেহারার ত্রিমাত্রিক মেডিক্যাল অ্যানিমেশন আর ভাইরাসের একটি ক্রস-সেকশনের ছবি মিলিয়ে ছবিটি তৈরি করা। এখানে স্পাইক এস প্রোটিন, এইচই প্রোটিন, ভাইরাসের আবরণ, হেলিকাল মানে স্ক্রুর মত প্যাঁচালো গড়নের আরএনএ ইত্যাদি ভাইরাসের মূল অংশগুলো দেখানো হয়েছে। Wikimedia Commons এর থেকে নেওয়া।
৯ ) একটা ভাইরাসের পক্ষে কোনও জীবন্ত কোষে প্রবেশ করা কি সহজ ?
প্রথমতঃ প্রতিটা চাবির যেমন খোলার জন্য একটা নির্দিষ্ট চাবির ফুটো লাগে, ঠিক তেমন এটা নির্ভর করে, জীবকোষে ওই বিশেষ ভাইরাসটার জন্য সঠিক রিসেপ্টর আছে কিনা তার উপর । আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশিরভাগ ভাইরাসকে আটকে দেয় অথবা আমাদের কোষের মধ্যে ওই সঠিক রিসেপ্টরগুলো নেই। অতএব ৯৯% ভাইরাস মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর নয়।
১০ ) কত ধরণের ভাইরাস রয়েছে আর এর মধ্যে কতগুলি মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক ?
লক্ষ লক্ষ ধরণের ভাইরাসের মধ্যে মাত্র কয়েক'শ ভাইরাস মানুষের ক্ষতি করে বলে জানা। নতুন ভাইরাস সব সময়ই তৈরি হচ্ছে। এদের বেশিরভাগই নিরীহ।
১১ ) একজনকে সংক্রামিত করতে গড়ে ভাইরাসটির কতগুলি কণা লাগে?
SARS-CoV2 এর জন্য আমরা এখনও সত্যিই জানি না। সাধারণত খুব সামান্য সংখ্যক ভাইরাসই লাগে।
১২) এটি কেমন দেখতে ?
একটা স্প্যাগেটির বা চাউএর সরু সুতলিকে গোল্লা পাকিয়ে একটা প্রোটিনের খোলের ভিতরে পুরে দিলে যেমন হয়, SARS-CoV2 ও অনেকটা সেরকম দেখতে। খোলের গায়ে আবার স্পাইকের মত বেরিয়ে আছে যাতে এটা সূর্যের গায়ের করোনার বা সৌরমুকুটের মত লাগে। এই পরিবারের সব ভাইরাসের চেহারা একই রকম; তাদের সবার করোনার মত চেহারা।
১৩) কতগুলো আলাদারকমের করোনা ভাইরাস আছে যারা মানুষকে সংক্রামিত করে ?
সাত রকমের করোনভাইরাস রয়েছে যা একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষে ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে চারটের জন্য হালকা সর্দি হয়। বাকী তিনটে মারাত্মক, যার মধ্যে আছে SARS আর MERS আর এই হালের করোনা ভাইরাস SARS-CoV2।
১৪) এটাকে “নভেল” করোনভাইরাস বলা হচ্ছে কেন ?
“নভেল” মানে হ'ল এটা মানুষের কাছে নতুন, মানে এই বিশেষ ভাইরাসটি আমরা আগে কখনও দেখিনি। কুড়ি লক্ষ বছর ধরে আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার বিবর্তন চলছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের দেহ এই ভাইরাসটি আগে কখনও দেখেনি, তাই মানুষের শরীরে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে ওঠে নি। এই প্রতিরোধক্ষমতার অভাব, ভাইরাসটির দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা এবং এর আপেক্ষিক মারণক্ষমতা এই সব কারণগুলোর জন্য SARS-CoV2 র হাজির হওয়াটা এত গোলমেলে ।
১৫) আমাদের চিন্তায় ফেলার মত এক একটা নতুন ভাইরাস কত ঘনঘন আসে ?
আসে, তবে বিরল। যেমন ধরুন HIV, SARS, MERS এবং আরও কিছু এই রকমের অসুখ ঘটানোর জন্য দায়ী ভাইরাসগুলো। আবারও নতুন ভাইরাস আসবে। তবে নতুন কোন ভাইরাস যদি খুব সহজে লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আর সেটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর হয়, তাহলে সেটা দেখা গেলে একটা বড় সমস্যা হয়।
১৬) নতুন ভাইরাসটি কতটা সহজে ছড়ায় ?
SARS-CoV2 কাশি আর ছোঁয়ার মাধ্যমে খুব সহজেই একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ে। এটা একটি শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ( “respiratory transmitted”) ভাইরাস।
১৭) আর কোন উপায়ে ভাইরাস ছড়ায় কি?
সাম্প্রতিক খবর থেকে মনে করা হচ্ছে যে এটি হয়তো মল ও মূত্রের দূষণের মাধ্যমেও ছড়াচ্ছে, তবে সে বাবদে আগে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
১৮) আগের পরিচিত করোনভাইরাসগুলি যার থেকে SARS বা MERS ছড়ায় তাদের থেকে এই নতুন ভাইরাসটি কিভাবে আলাদা ?
SARS-CoV2 মুলতঃ চারটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে আলাদা। প্রথমত, অনেক সংক্রামিত লোকের অনেক দিনের জন্য কোনও রোগলক্ষণ থাকে না, ফলে তারা নিজের অজান্তেই অন্যকে সংক্রামিত করতে পারে। কাদের যে আলাদা করে রাখতে হবে তাও বোঝা যায় না। এটা খুব উদ্বেগজনক কারণ SARS-CoV2 অত্যন্ত ছোঁয়াচে। দ্বিতীয়ত, ৮০% সময়ে, COVID-19 হ'ল একটি হালকা সর্দি বা কাশির মত একটা সামান্য অসুখ, তাই আমরা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করি না আর অন্যদের সংক্রামিত করি। তৃতীয়ত, এর রোগলক্ষণগুলি সহজেই ফ্লুর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যায়, তাই অনেকেই ভাবেন তাঁদের ফ্লু হয়েছে বলে আর অন্যান্য সম্ভাবনাগুলির কথা বিবেচনা করেন না। চতুর্থ এবং সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, এই ভাইরাস মানুষের থেকে মানুষের মধ্যে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে এটি গলার উপরের দিকে জমা হতে থাকে। গলা ভাইরাল কণায় ভর্তি ফলে আমরা যখন কাশি বা হাঁচি, তখন এই কোটি কোটি কণা গলা থেকে বেরিয়ে অন্যদের কাছে পৌঁছে যায়।
১৯) আমি ভেবেছিলাম এই ভাইরাস থেকে নিউমোনিয়ায় হয় – তাহলে এর মধ্যে গলা এল কি ভাবে ?
এই রোগটি প্রায়শই গলায় শুরু হয় (এজন্য বেশিরভাগ পরীক্ষাগুলোতে গলা থেকে একটি সোয়াব নেওয়া হয়।) তারপরে যত রোগ বাড়ে, এটা ফুসফুসের দিকে নামে আর শ্বাসযন্ত্রের নীচের অংশে সংক্রমণ হয়।
২০) “এসিম্পটোমাটিক” শব্দটি প্রচুর ব্যবহার হচ্ছে দেখছি।
এর মানে কী? এর সহজ অর্থ যার কোনও রোগলক্ষণ নেই।
২১) তাহলে আপনি কি বলছেন যে কেউ নতুন ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত হতে পারে অথচ কখনোই রোগলক্ষণগুলি না ফুটে উঠতে পারে ?
দুর্ভাগ্যবশত হ্যাঁ। অনেক সংক্রামিত মানুষের ক্ষেত্রেই প্রথম কয়েক দিন কোনও উপসর্গ দেখা যায় না আর তারপরে হালকা কাশি বা সামান্য জ্বর দেখা দেয়। এটি SARS এর উল্টোরকম, সেখানে আপনার কয়েক দিনের জন্য পরিষ্কার রোগলক্ষণ থাকে আর শুধুই অসুস্থ থাকাকালীন সংক্রমণ ছড়ায় ।
২২). যদি আপনার কোনও রোগলক্ষণ না থাকে তাহলেও কি আপনি অন্য লোককে সংক্রামিত করতে পারেন ?
দুর্ভাগ্যবশত হ্যাঁ. আর সেজন্যই এই রোগের ছড়িয়ে পড়া কমানো মুশকিল।
২৩) বিজ্ঞানীদের সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য একটি টিকা তৈরির সম্ভাবনা কতটা ?
যুক্তি বলে এটা করা যাবে, তবে কোন গ্যারান্টি নেই যে আমরা আদৌ কোন টিকা তৈরি করতে পারব। আমরা নাও পারতে পারি। যেমন ধরুন গত ৩৫ বছর ধরে আমরা HIV র টিকা খুঁজে যাচ্ছি, এখনো পাই নি। আমি আশাবাদী যে SARS-CoV2 র একটা টিকা পাওয়া যাবে। তবে তার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করতে হবে। তাতে লোকবল এবং সময় দুই-ই লাগবে।
সিয়াটলের Kaiser Permanente Washington Health Research Institute এ জেনিফার হালারকে COVID-19 র সম্ভাব্য টিকার প্রথম ধাপের নিরাপত্তা নির্ধারণের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার প্রথম শটটি দেওয়া হচ্ছে।
২৪). করোনভাইরাসটির একটি টিকা বের করা সম্ভব এটা ধরে নিয়ে আর এও ধরে নিয়ে যে এটা মোটামুটি তাড়াতাড়িই বের করে ফেলা যাবে , মোটামুটি কতদিনের মধ্যে আমরা একটা টিকা পাবো যেটা আমরা লক্ষ লক্ষ লোককে দিতে শুরু করতে পারব ?
এক বা দুই মাসের মধ্যেই একটা ক্যান্ডিডেট টিকা আমরা পেয়ে যাব। তবে যেহেতু সেটার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা প্রমাণ করার জন্য বিস্তৃত পরীক্ষার দরকার, তাই কোন বড় নিয়ামক সংস্থার অনুমোদিত টিকা পেতে পেতে কমপক্ষে এক বছর। প্রকৃতপক্ষে, টিকার লক্ষ লক্ষ মাত্রা তৈরি করে উঠতে ১৮ থেকে ২৪ মাস লাগবে আর এটা খুবই আশায় ভর করে বলা।
২৫). এই রকম জরুরী অবস্থায় একটা টিকা তৈরি করতে এত দিন লাগবে কেন ?
টিকা আবিষ্কার করতে সময় লাগার ব্যাপার না, তবে টিকা পরীক্ষা করতে সময়টা লাগবে। একবার "প্রার্থী" টিকা ল্যাবে তৈরি হলে, প্রথমে প্রাণীদের উপর আর তারপরে ক্রমাগতভাবে ছোট থেকে বড়, তার থেকে আরেকটু বড় গোষ্ঠীর মানুষদের উপর, একাধিক ক্লিনিকাল ট্রায়াল প্রয়োজন।
২৬). আমরা কি ইতিমধ্যে কিছুটা এগিয়েছি ?
ভালো খবর এই যে ২০২০ সালের জানুয়ারির শুরুতে SARS-CoV2 ভাইরাস আবিষ্কার আর তাকে আলাদা করতে পারার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটুও দেরী না করে টিকা তৈরির কাজ শুরু করা হয়েছিল। অনেক দেশের সরকার টাকা দিয়েছেন আর বিশ্বজুড়ে অনেক সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা খুবই তৎপরতার সঙ্গে এর উপরে কাজ করছেন।
২৭). এই দেশগুলির বিজ্ঞানীরা কি একে অপরের সাথে সহযোগিতা করছেন , না কি তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন ?
দুটোই অল্প অল্প, আর সেটা খুব খারাপও নয়। সাধারণভাবে আন্তর্জাতিকস্তরে যথেষ্ট পারস্পরিক সহযোগিতা চলছে। এটা আশার কথা।
২৮) আমরা কি তাড়াতাড়ি একটা টিকা তৈরি করতে পারি না ?
দুর্ভাগ্যক্রমে, এখানে কোনও শর্টকাট নেই। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জটিল আর সে নিয়ে আগে থাকতে কিছু বলা যায় না। ভাইরাল মিউটেশন হতে পারে। শিশুরা বড়দের থেকে আলাদা। মহিলাদের প্রতিক্রিয়াও পুরুষদের চেয়ে আলাদা হতে পারে। এটা নিশ্চিত হতে হবে যে কোনও টিকা যাঁদের দেওয়া হবে তাঁদের জন্য সেটা যেন ১০০% নিরাপদ হয়। সেটা নিশ্চিত করার জন্য, সযত্নে নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবান মানুষ স্বেচ্ছাসেবীদের বিরাট দলের উপর বিভিন্ন মাত্রায় ওষুধ আর টিকা পরীক্ষা করতে হয়।
দারূণ লেখা। একেবারে মনের মতো। খুব উপযোগী আর সহজ সরল।
Corona = মুকুট
Helical = প্যাঁচালো