এই পৃথিবীর বৈচিত্রের কোন শেষ নেই , কত বিষম পরিবেশ আছে ; যে পরিবেশ আমাদের পরিচিত পৃথিবী থেকে কতটা আলাদা , পরিচিত প্রাণের পরিবেশের কতটা বিরুদ্ধ ৷ কোন জায়গা সাগরের দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটার তলায় , সেখানে ভূ-ত্বকের ফাটল থেকে ঝলকে ঝলকে বেরিয়ে আসছে লাভা , মিশছে সাগরের জলের সঙ্গে ; তৈরি করছে কালো-ধোঁয়ার চিমনির শহর ৷ কোথাওবা সাগরের জল বিক্রিয়া করছে আদিম শিলার সঙ্গে , তৈরি করছে সাপবাজির ছাই-এর মতো সার্পেন্টাইন খনিজ ; সেখানকার পরিবেশ ক্ষারিয় ৷ তবু প্রাণের বিকাশ হয়েছে , এই পরিবেশেই তারা শিখে নিয়েছে জীবন ধারণের উপযুক্ত শক্তি উৎপাদন করে বেঁচে থাকতে ৷
মরুভূমির বিরূপ পরিবেশে অল্প বৃষ্টি পেলেই সেখানকার ঝোঁপ , লতা , গুল্ম ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেয় প্রান্তরের পর প্রান্তর ৷ মেরু-প্রদেশের শীতলতম হিমবাহের ভেতর কিভাবে জেগে থাকে প্রাণ কোটি কোটি বছর ধরে ৷ আলাস্কার সমুদ্রের খাঁড়িতে জীবনের জোয়ার আসে ঋতুর পরিবর্তনে যখন সাগরের বুকের ভেতর পৌঁছে যায় সূর্য্যের আলো , বসে যায় প্রকৃতির মহাভোজ ৷ কালাহারির বুক যখন ভাসিয়ে দেয় ওকাভাঙ্গো নদীর জল , সেখানে তৈরি হয় জীববৈচিত্রের এক টুকরো স্বর্গ ; সে স্বর্গ ভঙ্গুর , তবু প্রত্যেক বছর চলে জীবনের এই খেলা ৷ টাপুই-এর হাজার মিটার ওপরের পাহাড়ের ছাতে বাস করে একদল আমাদের অপিরিচিত প্রাণীরা , পাখিরা ৷ আমাজনের ফুটন্ত নদীর অববাহিকার পাড়ে পাড়ে সংসার পেতেছে অণু-জীবের দল ৷
আমাদের পৃথিবীর কোনায় কোনায় সংসার পেতে জীবনের ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণ ৷ তবে , এই পৃথিবীরই একটা জায়গা আছে যেখানে প্রাণের কোন চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা ৷ জায়গাটা যে পৃথিবীর কোন এক কোনায় তাও নয় , প্রায় বুকের কাছে ; মানে বিষুবরেখার কাছাকছি ইথিওপিয়ার ডালোলে ৷ পূর্ব আফ্রিকার ‘আফার ত্রিভুজ’ ; এলাকাটা ‘গ্রেট রিফট উপত্যকার’ একটা অংশ ৷ পশ্চিমে ইথিওপিয়ার সমতল আর পাহাড়ি এলাকা , উত্তর-পূর্বে ডানকালির নিচু অঞ্চল ( ইথিওপিয়া আর লোহিত সাগরের মাঝে ), দক্ষিণে সোমালির সমতল আর পাহাড় ৷ এখানকার প্রধান নদীর নাম আওয়াস; তবে বছরের বেশিরভাগ সময় শুকনোই থাকে ৷ এ নদী শেষ হয় একগুচ্ছ নোনাজলের হ্রদে ৷ আফার ত্রিভুজের উত্তরের এই অংশের নাম ডানকালি নিচু এলাকার জলা ( Dankali Depression ) ৷
সূর্য্য এখানকার ফুটিফাটা মাটিকে আরও গরম করে দেয় , খালি চোখে চারধারে ভাসতে থাকে শুধু মায়াময় মরিচিকার প্রেত নৃত্য ৷ শুকনো হাওয়া আর ধুলোতে আর্দ্রতা শুষে নেবে আপনার চোখ আর গলা ৷ এই অঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলের মধ্যে অন্যতমদের দলে পড়ে ৷ এখানকার গড় বার্ষিক উষ্ণতা ৩৪.৪˚ সেন্টিগ্রেড ৷ বছরে বৃষ্টির পরিমাণ ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার মাত্র৷ আর , এই এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪১০ ফুট তলায় , পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু এলাকা ৷ ডানকালির জলার সীমানায় আছে এরিত্রিয়া , জিবুতি আর ইথিওপিয়ার আফার অঞ্চল ৷ এলাকাটা পূর্বআফ্রিকার বিখ্যাত রিফট উপত্যকার একটা অংশ ৷
আপনি যদি পায়ে হেঁটে ঘোরেন এখানে , মনে হবে আপনি আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে হাঁটছেন না ; হাঁটছেন অন্য কোন গ্রহে ৷ চারদিকে বুড়বুড়ি কাটছে আশেপাশে জেগে থাকা আগ্নেগিরির লাভা , নানা রঙের হাইড্রোথারমাল ( জলতাপবাহী ) ক্ষেত্র ৷ এটাই শেষ নয় , এই এলাকার তলার ভূ-ত্বক তিনটে গভীর ফাটল ধরে এখানকার ভূভাগ বছরে ১ থেকে ২ সেন্টিমিটার করে দূরে সরে যাচ্ছে ; ঠিক যেমনটা হয়েছিল কোটি কোটি বছর আগে , যখন ভারতবর্ষ আফ্রিকা ছেড়ে এসে মিশেছিল এশিয়ায় ৷ এখানকার গতিপ্রকৃতি দেখে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন , আজ থেকে ১০ বা ২০ লক্ষ বছর পরে ভাগ হয়ে যাবে আফ্রিকা ; এখান দিয়ে বয়ে চলবে লোহিত সাগর ৷ ডুবে যাবে এই অদ্ভুত প্রান্তর ৷ গড়ে উঠবে নতুন সাগর , নতুন মহাদেশ বা কোন বড় দ্বিপ৷ তাই আজ এখানকার এই ফাটল , উষ্ণ-প্রস্রবণ আর গরম-ঝর্ণার ভেতর থেকে গলন্ত লাভার আলোয় রাতের আকাশ এখানে লাল হয়ে থাকে ৷
পৃথিবীর ভূতাত্বিক ইতিহাসে অনকবার স্থলভাগ ভেঙে গিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন মহাদেশ ৷ আগে স্থলভাগ ছিল একটাই ; সেটা ভেঙে তৈরি হয়েছিল ‘নতুন পৃথিবী’ বা আমেরিকা আর আন্টারটিকা ৷ আফ্রিকা ভেঙে ভারত চলে এসেছিল এশিয়ায় , আবার আমেরিকা ছিঁড়ে ব্রিটেন চলে এসেছিল ইউরোপে ৷ এইরকমই আরও একটা মহাদেশ ভাঙার কাজ চলছে ডালোলের ফাটলগুলোতে ; বলছে অনেক দূরের ভবিষ্যতের এক অন্য ভুগোলের রূপরেখা ৷
চিরদিন কিন্তু এলাকাটা চিরকাল এরকম ছিল না ৷ ১৯৭৪ সালে ডোনাল্ড জনসন আর তাঁর দল এখান থেকেই খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগের এক পূর্বসূরির প্রায় পুরো কঙ্কাল , যার নাম রাখা হয়েছে লুসি ৷ এ ছাড়াও আদিম মানবের বেশ কছু জীবাস্ম খুঁজে পাওয়া গেছে এখান থেকেই ৷ অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন মানুষের আদি শৈশবের অন্যতম ধাত্রীভূমি ছিল এই ডানকালির জলা ৷ তখন এ অঞ্চলে ছিল জঙ্গল আর তৃণভূমি ৷
গত বছর ( ২০১৯ ), আগের গবেষণাকে নস্যাত করে একদল বিজ্ঞানী এই এলাকার নোনজলের জলাগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছেন ৷ এ জায়গা তীব্র অ্যাসিডিক , কোথাও কোথাও নোন জলের pH মাপলে মান আসে শূন্যেরও তলায় ৷ শীতকালেও দিনের উষ্ণতা উঠে যায় ৪৫˚ সেন্টিগ্রেডের আশেপাশে ৷ ডালোলের এইসব ভয়ঙ্কর গরম , নোনতা , অম্ল জল যা ছড়িয়ে আছে সমস্ত আগ্নেয়ফাটল জুড়ে ; যেখানে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই ৷ অণুজীবও ( microorganism ) বাস করে না এইসব এলাকায় ৷
ডালোল ভূতাপ প্রভাবিত ক্ষেত্রের তথ্যগুলো পরপর এভাবে বলা যায় :
১ ) ডালোল একটা স্থলজ জলতাপবাহী মণ্ডল যেটা পূর্ব আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় অবস্থিত ৷
২) এলাকাটি , তার বৃহত্তর পারিপার্শক নিয়ে পৃথিবীর উষ্ণতম এবং শুষ্কতম অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ৷ দিনের তাপমান এখানে শীতকলেও ৪৫˚ সেন্টিগ্রেডের ওপর চলে যায় ৷
৩) এই এলকাটি এতটাই অম্ল বা অ্যাসিডিক যে কখনো কখনো pH ঋনাত্মক মান দেখায় , যদিও মাপের মাপদন্ডটা শুরু হয়েছে ০ থেকে ৷
৪) ডালোলের ভূ-তাপবাহী ক্ষেত্র বিখ্যাত তার অদ্ভুত রঙ আর খনিজের বিচিত্র আলপনার জন্যে ৷
৫) ডালোলের ক্ষেত্রটি অবস্থিত একটা ভীষণ লবনাক্ত , আগ্নেয় ফাটলের ওপর ৷
৬) অম্ল রস বেরিয়ে আসছে এখানকার ভূ-তাপবাহী ক্ষেত্র থেকে ; সেটা বেরোচ্ছে উষ্ণ, লবনাক্ত আর ভীষণরকম অ্যাসিডিক প্রস্রবনগুলো থেকে ৷
৭) পৃথিবীর বসবাসঅযোগ্য এলাকাগুলোতে চলছে ক্রমাগত তীব্র জলতাপীয় কার্যকলাপ চলছে ৷
৮) ডালোল পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু ক্ষেত্র , সাগরপৃষ্ঠ থেকে ৪১০ ফুট তলায় এর অবস্থান ৷
তাঁরা , তাঁদের আবিস্কার প্রকাশ করেছেন নেচার ইকলজি এন্ড এভলিউশনের পাতায় নভেম্বর ২০১৯ ৷
বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে তাঁরা আগের যে কোন সমীক্ষার চেয়ে অনেক অনেক বেশি নমুনা সংগ্রহ করেছেন ৷ নমুনা সংগ্রহের সময় ভালোভাবে যত্ন নিয়েছেন যাতে তাতে কোন বাইরের সংস্পর্শ না থাকে ৷ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো সঠিক পদ্ধতিতে ক্রমাঙ্কন বা ক্যালিব্রেট করেছেন ৷ পরীক্ষা প্রতিষ্ঠিত আর পূর্ব-প্রমাণিত পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন ৷ তাঁরা দাবি করেছেন ডানকালি উপত্যকার এই আগ্নেয়-জলার তীব্র-অ্যসিডিক বা পাশের ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ পাশের জলায় কোনরকম জীবাণুর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি ৷ যদিও জলার ঠিক পাশের শুকনো ডাঙার ছবিটা কিন্তু অন্য রকম ৷ সেখানে বাস করে এক প্রজাতির আর্কিয়া নামের অণুজীব , যাদের নোনা জায়গা খুব পছন্দ ৷
গবেষকরা ব্যবহার করেছেন পরীক্ষার আধুনিকতম পদ্ধতিগুলো ৷ দেখা হয়েছে , সম্ভাব্য অণুজীবের জিনের গঠনের বিশ্লেষণ ৷ এখানকার জল নিয়ে অণুজীবের আসর বসানো বা কালচার করা হয়েছে ৷ আলাদা আলাদা করে এক একটা কোষ খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে ৷ নোনা জলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে ৷ ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আর এক্স-রে বর্ণালি বিশ্লেষণ করা হয়েছে ৷ কোন অণুজীবের কোন উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায়নি ৷
প্রাথমকভাবে মনে হচ্ছিল এখানকার বালিসমৃদ্ধ খনিজ হয়ত অণুজীবের মত আচরণ করছে ; কিন্তু তাদের বিশ্লেষণ করে এটা পরিষ্কার বোঝা গেছে এগুলো জীবিত কোষ নয় ৷ হতে পারে আশে পাশের ডাঙা থেকে আর্কিয়া সে মিশেছে এই জলে ৷ তবে গবেষকদের মনে হয়েছে এখানকার খনিজ পদার্থের ধরণ বা গঠন এমনই যে তাদের জীবাণুর জীবাস্ম বলে মনে হয় , যদিও সেগুলো জীবিত কোষ নয় ৷ ডালোলের জলা আসলে জীবন সৃষ্টিতে বাধা দেয় , কারণ সেখানে আছে এক ধরণের ম্যাগনেসিয়াম লবণ যা জলের ভেতর বিভিন্ন রাসায়নিক বন্ধন তৈরি হতে বাধা দেয় ; এদের ক্যাওট্রপিকং সল্ট বলে ৷ এখানকার বিশেষ ধরণের লবণ , অম্ল জল আর উষ্ণতা , সব মিলিয়ে প্রাণ সৃষ্টি বা লালনের কোন পরিস্থিতিই এখানে এখন আর নেই ৷
পৃথিবীর অনেক বিরূপ পরিবেশ আছে , যেখানকার উষ্ণতা ডালোলের চেয়ে বেশি , অ্যাসিডিক বা লবণ সমৃদ্ধ ; সেখানে প্রাণের উপস্থিতির প্রমাণ থেকে অনেকে মনে করেন অন্য কোন গ্রহে , যার উষ্ণতা পৃথিবীর মতো , জল আছে , লবণ আছে , সেখানে জীবন থাকতে পারে ৷ ডালোলের জলা প্রমাণ করে এমনটা নাও হতে পারে ৷ অন্তত না হওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে ৷
ডালোলের জলা নিয়ে গবেষণা চলছে ৷ বিজ্ঞানিরা বুঝতে চাইছেন জীবন সৃষ্টির সবচেয়ে বিরুদ্ধ পরিবেশ কি হতে পারে ৷ তা থেকে হয়ত বোঝা যাবে সত্যি কিভাবে জীবনের সৃষ্টি হয়েছিল ৷