গ্রামবাংলায় দুর্গাপুজোই প্রধান উৎসব ৷ নানা বিতর্কের অবকাশ রয়েছে এই পুজোকে কেন্দ্র করে। পুরাণ মতে, বিন্ধ্যাচলের কোল বংশীয় রাজা সুরথ প্রথম মৃন্ময়ীমূর্তিতে দুর্গা পুজো করেন৷ সে-পুজো শরৎকালে হয়েছিল? মনে হয় না! তার নানা কারণ আছে। প্রত্যেক সেনা বাহিনীর রণযাত্রার নিজস্ব নিয়ম আছে। বর্ষার পর যুদ্ধযাত্রা মানেই চলাচলে সমস্যা। তখন যুদ্ধ করা যায় না।
তা হলে, শ্রীরাম কি শরতে যুদ্ধ করেন নি? এই নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে৷ কারণ, বিন্ধ্যের দক্ষিণে এই পুজো করলেও তার আগে অযোধ্যায় দুর্গাপুজোর উল্লেখ কোনও রামায়ণে নেই৷ বাল্মিকী রামায়নে অকালবোধনই নেই৷ এমন কি, বনবাসের আগে বা পরেও কখনও তিনি অযোদ্ধায় দুর্গা পুজো করেছেন বলে কোনো উল্লেখ নেই।
নদীয়ার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ প্রথম লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মাটির মূর্তি পুজো করেন বলে প্রচারিত৷ কিন্তু,বারো ভূঁইঞার এক ভূঁইঞা, যিনি মোগলদের কর দেন, তাঁর পক্ষে কি এত টাকা ব্যয় করা সম্ভব ছিল! কংসনারায়ণ পুজো শুরু করেন ১৫৮৩ খ্রীস্টাব্দে। বাংলায় তার চেয়েও প্রাচীন পুজো হল বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবাড়ির। শুরু হয়েছিল ৯৯৭ খ্রীস্টাব্দ বা ৪০৪ বঙ্গাব্দে। কংসনারায়ণের বাড়িও এই বাংলায় নয়, বাংলাদেশে, বর্তমানে রাজশাহীর তাহেরপুরে।
দুর্গাপুজোর ইতিহাসে দেখা যায়, আগে বসন্তকালেই হত মূল দুর্গাপুজো৷ তার নাম ছিল ‘বাসন্তী’ পুজো৷ বাংলার রাজ়নৈতিক ইতিহাস বলছে, রাজা শশাঙ্কর আমলে বাংলার ধর্মমত ছিল শৈব৷ কিন্তু, তখনও দুর্গার পুজো হত না৷ রাজা গোপালের পর থেকে পাল আমলে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রাধান্যে দুর্গা কেন, কোনও মূর্তিপুজোরই চল ছিল না৷ তা সত্বেও সুবচনী, মঙ্গলচণ্ডী, শীতলা, মনসা-র মতো অ-কুলীণ দেবীরা নিচু শ্রেণির মানুষের পুজো পেয়েছেন, মূর্তি ছাড়াই৷ সিংহবাহিনী দশভূজা তখনও নেই৷ বল্লাল সেনের আমলেই ফের মূর্তি পুজার চল৷ তখনও বাসন্তীই প্রধান দেবী৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে বাণীকুমার রচিত মহিষাসুরমর্দিনী’, যা মহালয়া মানেই পরিচিত, তাও কিন্তু প্রথমে বসন্তকালেই প্রচারিত হত, ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে, শরতে নয়৷
দুর্গা পুজোয় ‘নবপত্রিকা প্রবেশ ও কুল্পারম্ভ’ বলে একটি প্রথা আছে। এই নবপত্রিকাকে আমরা ‘কলাবঊ’ বলেও বলে থাকি। আসলে, নয় রকমের গাছের চারাকে ‘নবপত্রিকা’ বলে পুজো করা হয়। বাংলার ঋতুচক্রে শরৎ ছিল কৃষকের অভাব ও দুযোর্গের মাস৷ বাংলায় বন্যার সময় হল আগস্ট এর শেষ থেকে সেপ্টেম্বর মাস। ফলে এই সময় ফসল নস্ট হত৷ তার আগেই হলকর্ষণ, বীজবপন, কৃষিশ্রমিকের খোরাকি মেটাতে কৃষক সর্বস্বান্ত হতেন কৃষকেরা ৷ তাঁদের মজুত শষ্যও শেষ হয়ে যেত৷ অনেক সময় ঋণের দায়ে মহাজনের কাছে জমি বাঁধা পড়ত বা বিক্রি হয়ে যেত৷ শরতে তাঁর জীবনে কোনও আনন্দই ছিল না৷ বরং, বর্ষা-পরবর্তী ধান ও শীতের সব্জি তাঁকে দু’টো পয়সার মুখ দেখাত, মনে আনন্দ আনতো৷ সে অন্নপূর্ণা ও বাসন্তীর পুজোয় মেতে উঠতে পারতো৷ তাই জমিদার-মহাজনদের কাছে শরৎ ছিল উৎসবের মাস, আপামর বাঙালীর তা নয়৷ বাংলায় শরতে দুর্গা পুজো শুরুর সঙ্গে এই জমিদার-মহাজনদের সম্পর্কি প্রধান, চাষের সাঙ্গে যুক্ত মানুষদের নয়।
কলকাতার পুজোর ইতিহাসেও দেখা যায়, জগৎ শেঠ-উমিচাঁদ-ঘসেটি বেগম-মির জাফরদের সহযোগিতায় ইংরজেরা সিরাজ-উদ-দৌল্লাকে পরাস্ত করায় ইংরেজদের ‘মুন্সি’ রাজা নবকৃষ্ণ দেব প্রথম জাঁকের সঙ্গে দুর্গাপুজো করেন৷ তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক হিসাবে চাকরি শুরু করে প্রথমে ‘মুন্সি’ ও পরে ‘রাজা’ উপাধি পান৷ তাঁদের বাড়ির পুজোয় আসতেন ইংরেজ কর্তারা, জুতো পরেই৷ সেই উপলক্ষে মদ ও বাঈজীদের আসর বসতো, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে কামান দাগা হত, ভাসানে আর্মি ব্যান্ড আসতো৷ তাই, দেশপ্রেমিকরা এই পুজোকে ‘বেইমানের পুজো’ আখ্যা দিতেন৷ কলকাতার আরেক পুরানো পুজো হল বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের বাড়ির পুজো, ৪০০ বছরের বেশী পুরানো। কলকাতার প্রত্যেকটি সাবেকি পুজোর ইতিহাসেই এই কাহিনী।
ধীরে ধীরে ঋতুর বদলে, কৃষির চরিত্র বদলে, নিবিড় চাষের ফলে শরতেও কৃষক কিছুটা পয়সার মুখ দেখতে থাকল৷ পাশাপাশি, রাজা-জমিদার মহাজনদের বাড়ির পুজোর রেওয়াজ তাঁদেরকেও প্রভাবিত করল৷ এই প্রথার প্রচলনে সহায়ক হল মধ্যসত্ত্বভোগী অনুকরণপ্রিয় কর্তাভজার দল৷ গ্রামীণ মানুষ তাকেই মানতে বাধ্য হল৷ পুজোর ইতিহাসে তাই দেখা যায় শারদার পুজো শহরে থেকেই গ্রামে ছড়িয়েছে৷ ধীরে ধীরে সুবচনী, মঙ্গলচণ্ডী, শীতলা, মনসা-র মতো লৌকিক দেবীরা কৌলিন্য হারিয়েছে, তাদের জায়গা নিয়েছে দেবী দুর্গা৷ গ্রাম বাংলায় পুজোয় সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতকে পাওয়া যেত ভক্তির প্রাবল্য৷ তার খানিকটা উল্লেখ বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে “মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন, মা যা হইবেন”-এর কথা পাওয়া যায়৷ গ্রামের পুজায় পরিবর্তনের চালচিত্র প্রসঙ্গে এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ৷
পুজোর জন্য থাকত স্থায়ী পুজামণ্ডপ৷ আটচালায় তৈরি হত একচালা প্রতিমা, তা দেখতে গুরুমশাইর পাঠশালার ছাত্রদের অবস্থা পাওয়া যায় সনৎ সিংহের গানে - ‘মন বসে কি আর?... না না না, তাক তা ধিনা, তাক তা ধিনা, তাক কুড়কুড়, কুড়ুর কুড়ুর তাক’৷
যৌবনের প্রতিকী দেবী দুর্গা
বহু শাস্ত্রে ও পুথিতে দেবী দুর্গাকে প্রজননের, উদ্দাম যৌবনের ও অবাধ মদ্যপানের দেবী বলে বর্ণনা করা হয়েছে৷ তার একটি নিদর্শণ তামিল মহাকাব্য শিলপদ্দিকারম। তামিলভাষায় প্রধান পাঁচটি মহাকাব্যের অন্যতম এটি ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এ লেখা ৷ আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীতে এটি লেখেন চের সাম্রাজ্যের রাজা সেঙ্গুত্তুভান-এর ‘ভাই’ হিসাবে পরিচিত পণ্ডিত ইলাঙ্গো আডিগাল৷
শিলপদ্দিকারম এর কাহিনিতে আছে, কারুর বা তাঞ্জাভুরের কাছে এক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা কান্নাগি ওরফে কানাক্কির সঙ্গে তারই আশৈশব বন্ধু স্থানীয় ধনী মৎস্যজীবীর পুত্র কোভালম-এর জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ে হয়৷ সুখেই চলছিল তাঁদের সংসার। হঠাৎই তাতে ছন্দপতন ঘটে৷ কোভালমের নজর পরে মাধবী নামে এক নর্তকীর দিকে৷ কান্নাগিকে ভুলে মাধবীর প্রেমে বিভোর হয়ে কোবালম তার সঙ্গেই রাত কাটাতে থাকে, মাধবীর প্রেমে নিজের সব সম্পদও বিলিয়ে দেয়৷
একদিন সম্বিত ফেরে, তখন সে কপর্দকশূণ্য৷ নিজের ভুল বুঝে সে ফিরে আসে পতিব্রতা কান্নাগির কাছে। কান্নাগি তাঁকে গ্রহণ করেন৷ কোবালম চায় অন্যত্র চলে গিয়ে নিজে ব্যবসা করবেন৷ ব্যবসার পুঁজির জন্য কান্নাগি নিজের পায়ের একটি মুক্তো বসান মল কোবালামকে দেন৷ দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে একের পর দুর্গম বন পার হয়ে তিরুচিরাপাল্লি থেকে মাদুরাই যাওয়ার পথে তাঁরা পৌঁছন শবর যোদ্ধা মারবারদের এলাকায়৷ রাতে কোভালম-কান্নাগি দেখেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগে এক নগ্ন দেবীর পুজা করছেন যোদ্ধারা৷ সেই দেবীর নাম ‘কোররাবাই’৷ সেই দেবীর দু-পাশে বাহন সিংহ ও হরিণ৷ দেবীর চার হাতে শূল, শঙ্খ, চত্রু ও বরাভয়৷ পায়ের নিচে মহিষের মুণ্ড। যুদ্ধে বিজয় প্রার্থণায় মদ্যপ যোদ্ধারা নিজেদের গলা চিরে স্ব-রক্তে দেবীর অঞ্জলি দিচেছন, মদ ও মাংসে ভোজ সারছেন এবং অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হচেছন৷
ভয় পেয়ে যান কোবালাম ও কান্নাগি। কিন্তু মারবার যোদ্ধারা তাদের আভয় দেন। পাশাপাশি তারা কোবালম-কান্নাগিকে নিজেদের এলাকা নিবির্ঘ্নে পার করে দেন। এ কাহিনি ষষ্ঠ শতাব্দীর। কোবালম-কান্নাগির দেখা সেই মূর্তিই এখনো আছে তামিলনাডুর তানজোরের পুণ্ডমঙ্গেশ্বর ও পুজাইয়ের মন্দিরে৷ ‘শিলপদ্দি’ বা পায়ের মল খুলে দিয়েছিলেন কান্নাগি, সেই কারনেই কাহিনির নাম ‘শিলপদ্দিকারম’। শিলপদ্দিকারম আজও সমাভ জনপ্রিয়৷ গান, নাচ, নাটকের মাধ্যমে আজও তামিল শিল্পীরা দেশে-বিদেশে এটি অভিনয় করেন। শিলপদ্দিকারম যে প্রশ্নের উদ্রেক করে, তা হল, দুর্গার পুজো কি তবে সত্যই অবাধ মদ্যপান ও যৌনতার উৎসব?
এ-প্রসঙ্গে প্রাচীন স্মার্ত পুথিকার জিমূতবাহনের ‘কালবিবেক’, রঘুনন্দনের অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব’, শূলপাণির দুরগোৎসববিবেক আলোচিত হতে পারে ৷ খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিহারের সহরসার রাজা শালিবাহনের পুত্র জিমূতবাহন লিখেছিলেন কালবিবেক ৷ চতুর্দশ শতকে নবদ্বীপে জন্মানো পণ্ডিত শূলপাণির লেখা অনেক গ্রন্হের অন্যতম হল দুরগোৎসববিবেক ৷ এই তিনজনের লেখাতেই দেখা যাচেছ, দুর্গা পুজোয় আমোদ-প্রমোদই প্রধান এবং মদ্যপান বিধেয়৷ তাঁরা লিখেছেন, “আদিম রিপুর প্রবৃত্তি এবং অবাধ যৌনাচারের হুল্লোড় না থাকলে দেবী প্রসন্না হতেন না ৷ বরং, কুপিতা এই দেবী উপাসকদের প্রাণভরে অভিশাপ দিতেন৷”
মার্কণ্ডেয় পুরাণ এর অংশ শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুযায়ী দেবী নিজেই মহিষাসুর বধের আগে ‘তিষ্ঠঃ তিষ্ঠঃ ক্ষণং তিষ্ঠঃ’ বলে ‘মধু’পান করছেন। লোকসংস্কৃতির গবেষক সনৎ মিত্র জানাচ্ছেন, এই মধুপান আসলে মদ্যপান ৷ কারও কারও মতে, অসুররা রুদ্র বংশ-জাত বলেই রুদ্রানী দুর্গা মদ্যপান করছেন আপন শক্তিকে সংহত করতে। মহাভারতের পরিশিষ্ট ‘হরিবংশ’-র
‘আযার্স্তব’-এ বলা হয়েছে, ‘শিখীপিচ্ছধ্বজাধরা’ ও ‘ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনী’ এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মদ্য ও মাংসে ছিল অপরিসীম আসক্তি। সপ্তম ও অষ্টম শতকের কবি বাণদেব ভট্ট ও বাকপতিও এই মতেই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পুজোর উল্লেখ করে বলেছেন, দেবী পশু ও নররক্তের পিপাসু ছিলেন। কথাসরিþৎসাগর-এর ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ অংশে একাদশ শতকের পণ্ডিত সোমদেব ভট্ট বলেছেন, রাজা যশকেতুর রাজ্যে মহিষের কাটা মুণ্ড-র উপর নৃত্যরতা আঠারো হাত বিশিষ্ট এক দেবীর কথা, দস্যু ও ডাকাতরা যার কাছে নরবলি দিত। শাস্ত্র মতে এই দেবীর নাম ‘পাতালভৈরবী’। একই সঙ্গে তারা লিখেছেন দেবীর পুজোয় অবাধ যৌনাচারের কথাও।
এই হিসাবে দেবীকে যৌনতার দেবী ভেবে নিলে ভুলই হবে। আসলে তিনি ফসল ও মানব প্রজননের প্রতীকি দেবী৷ মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার যুগে ভারতীয় সভ্যতায় পৌরাণিক সব দেবীই এই প্রজননের প্রতীক৷ আফ্রো-এশিয় সংস্কৃতিতেও এমন আরও অনেক উদাহরণ আছে৷ দুর্গা মূর্তি তৈরিতে যৌনকর্মীর ঘরের মাটির ব্যবহার আবশ্যিক করার পিছনেও সম্ভবত এই যুক্তিই গ্রাহ্য হয়েছে ৷
দুর্গা পুজোর রীতি ও অনুষঙ্গেও আছে প্রজননেরই প্রতীকিকরণ৷ পুজোর আবশ্যিক উপকরণ জলভরা ঘট ও সশীষ ডাব মাতৃগর্ভের প্রতীক – বাইরে কঠিন, ভিতর জলে পূর্ণ, যার ভিতরে বীজ বপন হয়, সন্তান বাঁচে ও বাড়ে৷ তার উপরে থাকে রক্তবস্ত্র, যা ‘রজস্বলা’ নারীর প্রতীক৷ দেবীর বোধনে নবপত্রিকার প্রবেশ ও স্থাপন, বেলগাছের সঙ্গে জোড়া বেল বেঁধে দুর্গার স্তনদ্বয়ের প্রতিরূপ সৃজন তারই উদাহরন। ৷ বেল শিবের প্রতীক, তাই বেলগাছের সঙ্গে জোড়া বেল শিব-দুর্গার মিলন চিহ্ন৷ জলপূর্ণ ঘট-এ হয় প্রাণপ্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ মাতৃগর্ভে প্রাণসঞ্চার৷ তার চার পাশে লালসুতোর ঘেরা চতুষ্কোণ-এ সেই ঘটস্থাপন অর্থাৎ সূতিকাগৃহ নির্মান। আর থাকে চিৎ করা কড়ি যা জন্মদ্বারের প্রতীক৷
পুরাণ মতে, দুর্গা পর্ণশবরী ৷ তিনি শবরদের দেবী। পর্ণশবরী ৷ দেবী ভাগবতে হলেন ‘সর্বশবরানাং ভগবতী’৷ ঝাড়খণ্ডের বনবাসী শবর মেয়েরা এখনও দুর্গা মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আকণ্ঠ মদ্যপানের পর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রেখেই নাচতে নাচতে বিসর্জনে যান৷ এখনও এটাই দস্তুর ৷ তার আগে তাদের বেশির ভাগই মদ্যপান করে থাকেন। তাতে আর যাই থাক, যৌনতার নামে অশ্লীলতা নেই। উন্মুক্ত শরীর হলেও তা অশ্লল্লীতার অনুষঙ্গে নয়। শিলপদ্দিকারম-এও দেখা গেল, অবাধ মদ্যপান ও যৌনাচারে লিপ্ত থাকলেও মারবাররা কিন্তু কান্নাগিকে স্পর্শও করলেন না। পূর্ণ সম্ভ্রমে তাদের বন এলাকা পার করে দিলেন।
বাবু কালচারে উৎসব বদলে গেল অনাচারে
যৌবনের দেবীর উৎসবে যৌবনের স্বাভাবিক উল্লাসকেই এখন বদলে দেওয়া হচ্ছে যৌনতার অনাচারে ৷ উৎসব বদলে যাচ্ছে অশ্ললীতায়। মুসলিম শাসনে ধর্মীয় গোঁড়ামীর কারণে বাংলায় যৌনতার উপর চেপে বসেছিল কড়া বিধিনিষেধ। ইংরেজ শাসনে সেই নিষেধ যেন উঠে গেল। সেই পথে তৎকালীন পয়সাওয়ালা বাবুসমাজে ঢুকে পড়ল যৌনতার অনাচার।
রবীন্দ্রনাথের ভাইপো ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় সেকালের দুর্গা বিসর্জনের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “চিৎপুর রোডের এই অংশের দুই পার্শ্ব সেকালে বড় অধিক পরিমানে বারবণিতাদিগের অধিকৃত থাকিত৷ ...আরও মনে হয়, সেকালে একাল অপেক্ষা মদ্যপানের কিছু বেশি প্রাবল্য ছিল৷ যাঁহাদের গৃহের প্রতিমা বিসর্জন হইত, সেই সকল বাবু ও তাঁহাদের সাঙ্গোপাঙ্গো নকল বাবুরাও প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গী করিতে করিতে কানে খড়কে দিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে চলিতেন৷ ... যাঁহাদের পয়সা ছিল, তাঁহারাই প্রতিমার সম্মুখে বাঁশের ময়ূরপঙ্খীতে খেমটার নাচ নাচাইতে কুণ্ঠিত হইতেন না৷’ এর ‘নির্লজ্জ বা বেহায়া ভাব আছে’ সে কথা জানিয়ে তিনি লিখছেন, “তাঁহারা ও তাঁহাদের সাঙ্গোপাঙ্গো সকলেই নূ্যনাধিক মদ্যপান করিয়া বাহির হইতেন কেহ কেহ নেশার ঝোঁকে ঢলিয়া পড়িতেন৷ ... বাবুরা তো এইরূপে ঊর্দ্ধনেত্রে নানাবিধ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গী করিতে করিতে চলিতেন৷”
শোভাবাজার রাজবাড়ির কর্ণধার আলোককৃষ্ণ দেব কয়েক বছর আগে বলেছেন, “আগের আমলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে সারা রাত নাটক হত। বড়রা বসতেন সামনের দিকে, কম বয়সী যুবকরা তাদের পিছনে এবং ছোটরা একেবারে পিছনে। নাটক চলাকালে যৌনতাগন্ধী অংশে পরিবারের নেশায় মত্ত যুবকরা বারবার ‘এনকোর’ বলে সেই অংশ পুরাভিনয়ে বাধ্য করত ৷ এমনও হয়েছে যে, একই দৃশ্য বহুবার অভিনয়ের ফলে ভোর হয়ে এলেও নাটক শেষই হয় নি৷”
ব্রিটিশ আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলির ‘ফুলবাবু’দের দ্বারা এর কুৎসিত রূপায়ণ শুরু ৷ শোভাবাজারে মদ্যপান করতে করতে বাঈজি নাচ দেখেছেন লর্ড কার্জন৷ ব্রিটিশদের উৎসাহে বাবু কালচারের আমলে যৌনতার অনাচার আরও বাড়ে৷ এখন দুর্গাপুজোয় মদ্যপান ও অশ্ললীলতার ব্যাপকতার সঙ্গে সেদিনের সেই যৌব-অভিষেকের কোনও সম্পর্ক নেই৷ পণ্যায়নের দৌলতে সবর্নাশের পিচ্ছিল পথগামী শত শত রোমিও তাই এখন প্রতি পুজোয় শ্রীঘরে যায়৷ ক্ষিতিন্দ্রনাথের ভাষাতেই তাই বলা যায়, “সে বাবুও নাই, সে ঢাকীও নাই, সে উৎসাহও নাই, কাজেই পূজার আর সে রসকস নাই!”
ছবিঃ লেখক।