গৌরচন্দ্রিকা
সম্প্রতি পত্র পত্রিকা খুললেই একটা খবর সবার চোখে পড়বে। মাত্র কদিন আগেই ইউরোপে সার্ন গবেষণাগারে পাওয়া গেছে নতুন একটি মৌলিক কণা। এর সাথে এটাও জানা যাবে, যে নতুন কণাটির হদিস মিলেছে সেটি নাকি হিগস বোসন কণিকার মতো। আর এখানেই তো বিতর্ক। ভারতীয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম যেখানে কিনা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই কণাটির সাথে, সেখানে পশ্চিমী দুনিয়ায় তার অবদানকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? অনেকেরই ধারণা প্রাচ্যের এই বিজ্ঞানীর অবদানকে বোধহয় পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের আঁতুড় ঘরেই সুপরিকল্পিত ভাবে খুন করা হল। ব্যাপারটা সত্যিই তাই কি ?
বিতর্ক কী ও কেন আর কী তার সমাধান
সাম্প্রতিক কালের এই আবিষ্কারের সাথে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেনবাবুর সম্পর্ক অনেকটাই রেসিং কারের সাথে চাকার আবিষ্কারের সম্পর্কের মতো। চাকা ছাড়া গাড়ি চলে না ঠিকই আবার এটাও ঠিক ইঞ্জিন ছাড়াও চলে না গাড়ি। কিন্তু, মনে রাখতে হবে গাড়ির আবিষ্কার যেখানে আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় সেখানে চাকা কিম্বা ইঞ্জিনের আবিষ্কারের কথা অপ্রাসঙ্গিক তো বটেই, কিছুটা হলেও অবাঞ্ছিত যদিও আগের এই আবিষ্কারগুলো ভবিষ্যতের আবিষ্কারের পথকে সুগম করেছে। এতেও যদি পুরোটা বোঝা না যায় তাহলে বিজ্ঞান বইয়ের পাতা থেকে আর একটি উদাহরণ রাখি সকলের জন্য। অতিপরিবাহী চুম্বক বা সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটের কথা কে না শুনেছে? কিন্তু এর আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা কি কখনও ফিরে তাকাই অতীতের সেই বিজ্ঞানীদের দিকে, যাঁরা প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন চুম্বকত্ব (ম্যাগনেটিসম) বা ভেবে দেখেছিলেন অতিপরিবাহিতা (সুপারকন্ডাক্টিভিটি) কি? না মোটেই না। বিজ্ঞান তো এগিয়ে চলে এভাবেই। ভবিষ্যতের প্রত্যেকটা আবিষ্কারেই থেকে যায় প্রথমের ছায়া। সেদিন যিনি ম্যাগনেটিসম কী, তা আবিষ্কার করেছিলেন বোধহয় তাঁর কোন ধারণাই ছিলনা সুপারকন্ডাক্টিভিটি সম্বন্ধে, আবার এটাও ঠিক যে সুপারকন্ডাক্টিভিটির আবিষ্কারক ম্যাগনেটিসম কী বা কেন তা জানলেও এটা বোধ হয় কখনই ভাবতে পারেননি যে একদিন এসে যাবে সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট নামক এই বস্তুটি যা কিনা আজকের অনেক অত্যাধুনিক যন্ত্রের জন্ম দিয়েছে যেমন চিকিৎসা শাস্ত্রের এম আর আই মেশিন বা দানবাকার ঐ কণিকা এক্সালারেটরগুলো। দ্রুতগামী মনোরেলই বা বাদ যায় কেন? তার মানেটা কী দাঁড়ায়? মানেটা দাঁড়ালো এটাই, যে বর্ণ কাকে বলে তা না শিখে শব্দ কী তা যেমন জানা যায় না, শব্দ কি তা না জেনে যেমন বাক্য গঠন সম্ভব নয় ঠিক একই ভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও, প্রথমেই জানতে হয় গোড়ার কথা। তারপর সেখান থেকেই একদিন আমরা এতটা দূরে চলে যাই যে কোথা থেকে শুরু করেছিলাম বা কে শুরু করেছিল তা জানাটা সত্যিই অপ্রাসঙ্গিক শোনায়। তাই এইটা বোধ হয় নেহাতই পাগলামি হবে, প্রতিটি নতুন আবিষ্কারের পরেই আমরা যদি খুঁজতে বসে যাই যে কত শত বিজ্ঞানীর নাম ঐ আবিষ্কারের সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত। এই একই ঘটনা ঘটেছে এবারেও। কণা বিজ্ঞানের মূল নায়ক নায়িকারা মানে কণিকারা তাদের ঘূর্ণি বা স্পিন অনুযায়ী “স্পিন সাংখ্যায়ন” (spin statistics) তত্ত্বানুসারে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এদের একদল হল বোসন যাদের স্পিন পূর্ণ সংখ্যার যেমন ০, ১, ২...... ইত্যাদি আর এক দল হল ফারমিয়ন যাদের স্পিন অর্ধ পূর্ণ সংখ্যা যেমন ১/২, ৩/২, ...... ইত্যাদি। আর এটাও এইখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এমনই নয় যে এই প্রথম আমরা কোন কণা খুঁজে পেলাম যেটা বোসন গোত্রীয়! এর আগে এমন অনেক কণা খুঁজে পাওয়া গেছে যেগুলোর প্রত্যেকটাই বোসন গোত্রের এবং এরা প্রকৃতির চারটি প্রাথমিক বলের কোন এক প্রকারের বাহক। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে ফোটনের কথা, যেটা তড়িৎ চুম্বকীয় বলের ( Electro -magnetic Interaction ) বাহক। যার স্পিন ১ আর তাই এটা একটা বোসন। আরও রয়েছে W এবং Z বোসনেরা। এদেরও স্পিন ১ এবং এরা ক্ষীণ বলের (Weak Interaction) বাহক এবং প্রত্যেকেই বোসন। রয়েছে গ্লুওনেরা যাদের স্পিন ১ , তাই এরা বোসন, এরা হল শক্তিশালী বলের (Strong Interaction) বাহক। এই প্রত্যেকটি আবিষ্কারেই আবিষ্কারক বিজ্ঞানীটি নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন, যেমন মনে পড়ছে সার্ন গবেষণাগারের এককালীন অধ্যক্ষ কার্লো রুব্বিয়ার কথা, ১৯৮৪ সালে W এবং Z বোসনের আবিষ্কারের জন্য যিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। এদের প্রত্যেকের আবিষ্কৃত কণাটিই বোসন গোত্রের এবং তাই বোস আইনস্টাইন সাংখ্যায়ন তত্ত্ব মেনে চলে। কিন্তু তখন আমরা তো ‘বোস’ ‘বোস’ বলে গলা ফাটালাম না, আর তার কোন দরকারও বোধহয় ছিল না। সত্যি যদি সত্যেন বোসের নাম কখনও উপেক্ষিত হয়ে থাকে তা হয়েছিল এই শতাব্দীরই শুরুর দিকে, ২০০১ সালে যখন ‘বোস আইনস্টাইন কন্ডেন্সসেশন’ আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সম্মানটি দেওয়া হল কেটারলি এবং তার বন্ধুদের। তাই শেষ কথা বলি ভুল শুনবেন না, ভুল শোনাবেন না, ভুল বুঝবেন না, ভুল বোঝাবেন না।
হিগস বোসন নিয়ে কয়েকটি কাজের কথা
আসুন বরং কাজের কাজ করি। হিগস নিয়ে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যাক।
প্রঃ হিগস বোসন কি আর হিগস ক্ষেত্রই (Higgs Field) বা কী?
উঃ এই মহাবিশ্বে সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে এই হিগস ক্ষেত্র। ১৯৬৪ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সমস্ত পারমাণবিক কণিকাগুলিই যেমন কোয়ার্ক বা লেপ্টন এরা সবাই এই ধ্রুবক (constant) হিগস ক্ষেত্রের ক্রিয়াধীন। এর ফলে কী হয়? এরা সবাই ভারী হয়ে পড়ে। হিগস ক্ষেত্র যদি না থাকত এদের ভর হতো শূন্য। আলোর বেগে ছুটে বেড়াত এদিক ওদিক, অণু, পরমাণু, পদার্থ, মহাবিশ্ব কিছুই থাকত না। হিগস ক্ষেত্রকে মাপা না গেলেও প্রফেসর হিগস সেদিন হিগস ক্ষেত্রের সাক্ষ্য বহনকারী একটি কণিকার কথাও বলেছিলেন, তার নামই হল ‘হিগস বোসন’।
প্রঃ হিগস বোসন না থাকলে কি হত?
উঃ কণা তত্ত্বের শেষ কথা হল স্ট্যান্ডার্ড মডেল (নীচের দ্বিতীয় ছবিটি দেখুন)। এই মডেল অনুসারে প্রত্যেকটি পদার্থের ভর আসে হিগস বোসনের জন্য ইউকাওয়া মিথষ্ক্রিয়া Interaction এর ফলে। পায়নের মধ্যস্থতায় নিউক্লিয়ন গুলির মধ্যে যে শক্তিশালী নিউক্লিয় বলের আদান প্রদান ঘটে তা ব্যাখ্যা করতে জাপানী বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়া নিয়ে এলেন ইউকাওয়া interaction এর ধারণা। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এই ইউকাওয়া interaction এর সাহায্যেই ব্যাখ্যা করা হয় ভরহীন কোয়ার্ক এবং লেপ্টনের সহিত হিগস ক্ষেত্রের যোগসূত্র (Coupling)। নীচের ছবিটিতে হিগস বোসনের সাথে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের বোসন ও ফারমিওন গুলির মিথষ্ক্রিয়া (interaction) দেখানো হল। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় একে Spontaneous symmetry Breaking বলে। হিগস না থাকলে কোন কণিকারই ভর থাকতো না আর ভরহীন পদার্থ আলোর বেগে ছুটত।
স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কণাগুলির বিষয়ে আরও জানতে চাইলে দেখতে পারেন Jorge Cham এর তৈরি এই কার্টুনটি।
http://www.youtube.com/watch?feature=player_embedded&v=EtrOSf297sw#!
ছবিতে স্ট্যান্ডার্ড মডেল
প্রঃ Sponteneous Symmetry Breaking কি? এর সাথে কণিকাদের ভরের সম্পর্কটাই বা কি? এটাকে কি একটু সহজ করে বোঝানো যায়?
উঃ Mass was given to particles without explicitly breaking the symmetry of the laws of physics that determine forces. I admit the sentence I wrote is quite confusing for a layman. Its mathematical account is fairly simple, but its explanation and ensuing philosophical or intuitive significance are complex and hard to understand.
The 2004 Wolf Prize scroll states that the prize was awarded to Englert, Brout and Higgs “for their pioneering work that has led to the insight of mass generation, whenever a local gauge symmetry is realized asymmetrically in the world of sub-atomic particles.” If you ask me why the wording is so vague, I will say otherwise it wouldn’t look serious…
বিখ্যাত সেই মেক্সিকান টুপির গল্প
একেবারে উপর থেকে নীচের দিকে দেখলে টুপিটিকে perfectly circular symmetric মনে হয়। তাই টুপির মাথায় বসে থাকা যে কোন মানুষের কাছে নীচের দিকটা একই রকম মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে তার দশা মোটেই স্থিতিশীল নয়, একটু আঘাতেই কিন্তু মানুষটি উপর থেকে গড়িয়ে নীচের দিকে রিমের কাছে এসে পড়তে পারে, কিন্তু কোনদিকে সে গড়িয়ে যাবে তা আগে থেকে জানা কিন্তু অসম্ভব। কারণ বলবিদ্যার সূত্রগুলি সেই Circular Symmetry এর অধীন। কিন্তু যে মুহূর্তে টুপিটি অল্প নড়ে ওঠে ও লোকটি নীচের দিকে গড়িয়ে যায় এবং টুপিটির রিম এর কাছে এসে পড়ে, তখন লোকটি আর সেই Symmetry দশায় থাকে না। যদিও পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলি কিন্তু তখনও সেই Circular Symmetry মেনে চলে। আসলে লোকটি যখন গড়িয়ে পড়ছে তাকে তো কোনও একটা দিকেই পড়তেই হবে, আর পড়ে যাবার পরে সে যখন পাশাপাশি বা ওপরের দিকে তাকায় তখন সে কিন্তু এক এক দিকে এক এক রকম দেখে কারণ আমরা বলি লোকটির symmetry was spontaneously broken.
যদিও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলি সেই বৃহৎ symmetry এর অধীন কিন্তু সিস্টেম এর যেটি ন্যূনতম শক্তিদশা (Ground State) অর্থাৎ যখন কিনা লোকটি রিম এর ধারে বসে সেই দশাটি কিন্তু আর কখনই পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলির সেই symmetry মেনে চলে না। ঠিক এরকম ভাবেই কল্পনা করা যাক যে space-time এর প্রত্যেকটি বিন্দুতে একটি করে মেক্সিকান টুপি রয়েছে। টুপির অপরে বসে থাকা লোকটি আসলে হিগস ক্ষেত্রের প্রতিভূ এবং সেই ক্ষেত্রের শক্তি বোঝায়। লোকটির horizontal location on the hat (টুপিটির ব্যাসার্ধ) সেই হিগস ক্ষেত্রের intensity বোঝায়। মহাবিশ্ব সৃষ্টির লগ্নে প্রচুর শক্তি ও তাপের উৎপত্তি হয়। মেক্সিকান টুপির মাথায় বসে থাকা লোকটি বেজায় অস্বস্তি বোধ করে। সে উপর নীচ আর বামে ডানে এদিক ওদিক করতে থাকে একটু আরামের জায়গা খুঁজে পেতে। প্রচণ্ড তাপমাত্রায় সে টুপির একেবারে মাথায় বসে থাকে এবং এই অবস্থায় mean field intensity হয় শূন্য। যদিও এই দশা উচ্চ শক্তির দশা। ধীরে ধীরে আমাদের মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হতে থাকে এবং বিগ ব্যাং এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই টুপির মাথায় বসে থাকা লোকটি টুপি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং শেষমেশ টুপিটির রিমের ধারে এসে স্বস্তিজনক অবস্থা খুঁজে পায়। এই অবস্থায় হিগস ক্ষেত্রের শক্তি হয় ন্যূনতম যদিও এর intensity শূন্য নয়,অর্থাৎ এই অবস্থায় হিগস ক্ষেত্রের উপস্থিতি বোধ করা সম্ভবপর হয়। প্রকৃতির সূত্রগুলি থেকে যায় Symmetry র অধীন। যদিও টুপির মাথাটি যেটা কিনা লোকটির প্রাথমিক অবস্থা ছিল সেটি সেই Symmetry হারায়। যে মুহূর্তে হিগস ক্ষেত্র একটি নির্দিষ্ট দিককে পছন্দ করে নেয় ঠিক তখনই Spontaneous Symmetry Breaking হয়। শেষে এই কথাটি বলতেই হয়, হিগস ক্ষেত্রের Weak তেজস্ক্রিয় চার্জের জন্য কোয়ার্ক বা লেপ্টনেরা এর উপস্থিতি অনুভব করে এবং শেষ পর্যন্ত ভর পায়। কিন্তু ফোটনের মতো কণিকারা যাদের Weak তেজস্ক্রিয় চার্জ নেই তারা হিগস ক্ষেত্রের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে না এবং ভরহীন থেকে যায়। এভাবেই W এবং Z কণিকারাও ভর পায়। এমনকি হিগস কণাটি নিজেও এভাবেই ভারী হয়। সার্নের নতুন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী এর ভর ১২৫.৩
GeV।যদি হিগস ক্ষেত্রের Intensity শূন্য হয়ে যেত তাহলে কোনও পারমাণবিক কণিকারই কোন ভর থাকত না, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হত না। তাই সব কিছুর অস্তিত্বের মূলে রয়েছে এই হিগস কণা।
ভর কী আর তার সাথে হিগস বোসনের ই বা কী, এনিয়ে আরো জানতে আগ্রহী হলে, এই লিঙ্কটাও টুক করে দেখে নিতে পারেন।
http://www.youtube.com/watch?feature=endscreen&NR=1&v=9Uh5mTxRQcg
.
প্রঃ হিগস কণার খোঁজ শুরু হল কবে থেকে?
উঃ তাত্ত্বিকের কথায় খাতায় কলমে ‘হিগস বোসন’ রয়েছে সেই ১৯৬৪ সাল থেকে। কিন্তু পরীক্ষাগারে এর সাক্ষ্য মেলে নি অনেকদিন। ১৯৮৪ সাল থেকে ইউরোপের সার্ন এবং আমেরিকার ফার্মিল্যাবে বিজ্ঞানীরা উঠে পড়ে লাগলেন হিগসকে experimentally খুঁজে পেতে। তার মানে দীর্ঘ তিন দশক ধরে চলছে ‘হিগস বোসন’ খুঁজে পাওয়ার এই নিরলস প্রয়াস।
প্রঃ এই যে হিগসের সন্ধান পাওয়া গেল এতেই কি সব গবেষণার শেষ?
উঃ না না, একেবারেই শেষ নয় । এত সবে শুরু। হিগস আছে এইটা জানতে পারলে বিজ্ঞানীরা আরও এক কদম এগিয়ে যাবে মহাবিশ্বের রহস্য জানার উদ্দেশ্যে, হয়তো আরও কত অজানা তত্ত্বের সন্ধান পাবে। যেমন সম্প্রতি যে হিগস কণাটি পাওয়া গেছে সেটি যদি স্ট্যান্ডার্ড মডেলের হিগস কণিকার মতো না হয় তাহলে হয়তো সেটা অন্য প্রকারের হিগস। স্ট্যান্ডার্ড মডেল ছাড়াও আরও একটি তত্ত্ব রয়েছে যেখানে একটি নয় এক জোড়া হিগসের কথা বলেছেন বিজ্ঞানীরা। আর এই এক জোড়া হিগসের সন্ধান মিললে জানা যেতে পারে মহাবিশ্বের ৯৬% হারিয়ে যাওয়া পদার্থের কথা অর্থাৎ Dark Matter এর কথা। ‘Neutralino’ নামক একটি কণিকা নাকি সেই Dark Matter এর ব্যাখ্যা দিতে পারে। তবে এ সব কিছু খাতায়ে কলমে, অনেক কিছুই এখনও বাকি।
প্রঃ হিগস বোসন কিভাবে পাওয়া গেল?
উঃ Large Hadron Collider নামক যন্ত্রে আলোর বেগে ধাবমান প্রোটন কণিকাদের সংঘর্ষ ঘটল। এই সংঘর্ষের ফলে বিপুল পরিমাণের শক্তির সৃষ্টি হল। ভিতরকার অবস্থাটা হল ঠিক সেই রকম যেমনটা ঘটেছিল ‘বিগ ব্যাং’ এর কয়েক মুহূর্তের পরে মহাবিশ্বের জন্ম লগ্নে। প্রোটন প্রোটন কণিকার সংঘর্ষের ফলে হিগস বোসনের সৃষ্টি হয়। যদিও জন্মের সাথে সাথেই এরা স্বল্প ভারী স্থিতিশীল (light and stable) কোন পারমাণবিক কণিকায় রূপান্তরিত হয়। এই রকম অনেক Decay Channel দেখে, CMS বা ATLAS এ অনেক Data সংগ্রহ করে ও পরে তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পান তাদের সাধের কণাটিকে। এই কণাটির ভর ১২৫.৩ GeV এবং এটি পাওয়া গেছে ৫ সিগমা লিমিটের মধ্যে। কণাবিদদের ভাষায় ৫ সিগমার মধ্যে কিছু পাওয়া গেলে তা যুগান্তকারী আবিষ্কার।
প্রঃ হিগস বোসনের নাম God Particleহল কেন?
উঃ ফার্মি ল্যাবের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিও ল্যাডারমান ঠিক করলেন হিগস বোসন নিয়ে একটি বই লিখবেন। বই তিনি লিখলেনও। অনেক চেষ্টা করেও তখনও পাওয়া যায়নি হিগস বোসন কণা, তাই রাগ করে সে বইয়ের তিনি নাম রাখলেন God Damn Particle.পরবর্তীকালে প্রকাশকেরা Damn শব্দটি ছেঁটে দিলেন, বইয়ের নাম হল God Particle যদিও বিজ্ঞানীদের অনেকে এই নামটির বিরুদ্ধে।
আর প্রশ্ন উত্তর নয়। এনিয়ে আরো প্রশ্ন থাকলে, আরো গভীরে যেতে চাইলে নাহয় আবার কখনো হবে।
ফলেন পরিচীয়তে
শেষ করার আগে আর একটা কথায় আসি। ইদানীং একটা প্রশ্ন খুবই শুনছি। ‘হিগস বোসন আবিষ্কারে কী লাভ হল বা হবে’? একটাই উত্তর দিতে পারি। অবাক বিস্ময়ে সেদিন ফ্যারাডে যখন কাঁটা ঘুরিয়ে ইংল্যান্ডের রানীকে তড়িৎ চুম্বকীয় তত্ত্ব আবিষ্কারের কথা জানালেন, আপনাদের মতো রানীও সেইদিন এই একই প্রশ্ন করেছিলেন এইটা দিয়ে কী হবে? কিন্তু আজকে ভেবে দেখুন তো তড়িৎ বা চুম্বক এর কোন একটি ছাড়া আমরা কি এক মুহূর্তও চলতে পারি ? কি অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল ফ্যারাডের সেই আবিষ্কারের মধ্যে তা আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কারোর অজানা নয়। বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি আবিষ্কার ঠিক এই ভাবেই হয়। প্রসূতি লগ্নে সেই ভ্রূণকে দেখে অনেকেই চোখ কোঁচকায়, বলে এইটা দিয়ে কি হবে? সেই ভ্রূণ ফুটতে সময় নেয়। কুঁড়ি থেকে ফুল হতে লেগে যায়ে এক দশক কিংবা এক শতক, তখন সেই আবিষ্কারক কোথায়? রিলে রেস খেলাতে যেমন হয়, সেইরকম সেইদিনের সেই বিজ্ঞানী তার ব্যাটনখানি দিয়ে যান ভবিষ্যতের হাতে। সেই পথ ধরেই আসে নতুন কোন আবিষ্কার, নতুন কোন আশা , নতুন কোন স্বপ্ন। এভাবেই আমরা ঋদ্ধ হই , এগিয়ে চলে বিজ্ঞান ও তার সাধনা। তাই হিগস বোসন আবিষ্কারে আমি, আপনি বা আমরা এক্ষুনি কোন সুযোগ বা সুবিধে পাব এমনটা দাবী করতে পারি না , কিন্তু এইটা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতেই পারে যে, সৃষ্টির ইতিহাস জানার যে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে চলেছেন বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে সেই অধ্যায়ে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে চলেছে।
“The true goal is not to reach the uttermost limits,
but to discover a completeness that knows no boundaries.”