আমি শামিম মোদী, শেষ ১৮ – ১৯ বছর ধরে মধ্যপ্রদেশের বেতুল, হরদা আর কান্দ্বা জেলার শ্রমিক আদিবাসী সংগঠন ও সমাজবাদী জনপরিষদের সাথে যুক্ত আছি। আমরা মানুষের অধিকার, বিশেষত আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করি। একসময়ে মধ্যপ্রদেশ সরকার থেকে আমার উপরেও কিছু মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছিলো। হরদা অঞ্চলে আমি খুবই জনপ্রিয় ছিলাম সেখানে তারা আমাকে তাদের নিজের ইচ্ছা মত অত্যাচার করতে পারছিল না তাই তারা আমাকে হরদা জেল থেকে হোসাঙ্গাবাদ জেলে ট্রান্সফার করে দিয়েছিল। তাই সোনি সোরির জেলের মধ্যে অত্যাচারের ব্যাপারটা আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি, কারণ আমাকেও সোনি সোরির মতো তারা অকথ্য অত্যাচার করেছিলো।
নতুন কেউ জেলের মধ্যে এলে বাকি বন্দীরা আসামীকে উল্টো দিক করে ঝুলিয়ে দিত, বসতে দিত না। একটা পেন নিয়ে কেউ ঢুকেলও তার জামাকাপড় খুলে সার্চ করত। ভাবত পেনটি হয়েতো একটি বোমা। পুলিশের লোকেরা তারা নিজেরা কিছু করত না। তারা বাকি বন্দীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিল অত্যাচারের জন্য। তারা সহজ ভাষায় বলত Straighten her আর সেই পিটিয়ে ঠিক করে দেওয়াটা আমার কাছে এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ছিল। মনে হয় সোনি সোরির প্রতিও ওরা ঐ একই রকমভাবে অত্যাচার করছে।
তারা নতুন নতুন অত্যাচার আবিষ্কার করাতে পটু ছিল।। মাঝেমধ্যে বন্দীদের জেলের বাইরে নিয়ে যেতে চাইত, তারা গর্ভবতী কিনা সেই অজুহাত দেখিয়ে। আমি জেলারকে বলেছিলাম শুধু মাত্র ইউরিন টেস্ট করলেই তো হয়ে যায়, তার জন্য জেলের বাইরে গিয়ে কঠিন পরীক্ষা নিরীক্ষার কি দরকার? কিন্তু পুলিশেরা রাজী হল না, বলল যা নিয়ম তাই মানতে হবে। পরে বুঝলাম ওদের মতলবটা। আসামী যদি একবার জেলের বাইরে চলে যায় তাহলে পুলিশের উপর কোনও দায় থাকে না, কিন্তু জেলের মধ্যে কিছু হলে পুলিশ কর্মচারীদের উপরই দোষ পরে, তাই তারা দায়মুক্ত হতে আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। আমাকে নিয়ে আরও প্রায় ৮ জন মহিলাকে ওরা ওপিডি তে নিয়ে গেল। ওপিডিতে একটা স্লাইডিং দরজা আর একটা জানলা ছিল মাত্র কিন্তু কোন পর্দা ছিল না। গাইনকোলজিকাল পরীক্ষা শুরু হতেই আমরা আপত্তি জানালাম। ওরা সেই সময়ে গার্ডদের ডেকে আমাদের জামা খুলে দিয়ে উলঙ্গ করে দেওয়া হল। সেই অঞ্চলের লোকেরা আমার অ্যারেস্টের কথা জানত। তারা সব কিছু জানতে খুবই উৎসাহিত ছিল।
কিন্তু সাধারণ মানুষরা এই ব্যাপারটাতে খুব বেশি সচেতন ছিল না। তারা জানত না আসামীদের নিয়ে আদৌ এই রকম কিছু করা যায় কিনা, তারা ভাবছিল অসুস্থততার কারণেই হয়তো আমাদের মেডিকেল চেক-আপ করানো হচ্ছে। তাই অগত্যা তাদের থেকেও কোন সাহায্য আমরা পেলাম না।
অনেক দিন ধরে মানুষের অধিকার নিয়ে কাজ করার ফলে আমার আত্মবিশ্বাস এখন অনেক বেড়ে গেছে। এখন আমরা সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত। এমনকি অত্যাচারের সময়ে নিজেদেরকে নিজেরাই সান্ত্বনা দিতাম। ওরা আত্মীয় পরিজনদের সাথেও আমাকে দেখা করতে দিত না, বলত কথা না শুনলে আমাদের উপর ন্যাশানাল সিকুইরিটি অ্যাক্ট জারি করা হবে। মিডিয়া কেন এই ছোট একটি ঘটনা নিয়ে এত হইচই করেছে তার ব্যাখ্যাও আমাদের কাছ থেকে জানতে চাইত। আমরা বোঝাতে চাইতাম সংবাদপত্র কি লিখেছে আমরা জেলের মধ্যে থেকে কি করে জানব? তারা বলত “এই যে তোমাদের জেলের মধ্যে অত্যাচার করা হয় তার কথা বাইরের লোক কি করে জানতে পারল? কি করে ওদের কাছে এই কথা ফাঁস হল?” এছাড়াও বাইরে আমাদের কোনও সহকর্মী বা কোনও সমাজসেবী এই নিয়ে যদি কোনও প্রতিবাদ করতো, তার জবাবদিহিও আমাদের করতে হত।
জঙ্গলের মধ্যে বেআইনি ভাবে বাড়ি বানানোর জন্য কিছু আদিবাসী এবং হার চুরি করার অভিযোগে সেইখানে আরও কিছু মহিলা আসামীও ছিল। তাদের মুক্তি পাওয়ার দিন ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। তারা জেলের মধ্যে কোনও সাহস দেখাতেই পারত না। এমনকি বাইরে বেরোলেই তারা কথা কোনও প্রতিবাদ করত না। তবে জেলের মধ্যে বসে থেকে নিজেদের অধিকার বজায় রাখাটা সত্যিই খুব কঠিন কাজ ছিল। জেলের মধ্যে কি হচ্ছে কেউ কিছুই দেখতে বা জানতেও পারত না যেহেতু বাইরেরে কোনও মানুষের যাতায়াত ছিল না। একটি বন্ধ দরজার পিছনে তারা যা খুশি করতে পারত, শুধু খেয়াল রাখত বাইরের পাবলিকের কাছে যেন এই সব কথা কোনভাবেই না পৌঁছয়।
আমি জেলের মধ্যে মহিলাদের উৎসাহ দিতাম এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে । ১৫ দিন বাদে কোর্টে উঠলে সেইখানে এই নির্যাতনের কথা বলতে বলতাম কিন্তু পুলিশরা তাকে অন্য কথা শুনিয়ে ভয় দেখাত, বলত “ও তো কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যাব কিন্তু তারপর তোমরা তো জেলেই থেকেই যাবে তখন তোমাদের কে রক্ষা করবে?”
সেখানে ৫৫ বছর বয়সী মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত এক মহিলাও ছিলেন। তিনি নিজেকে সর্বদাই দোষী মনে করতেন। হঠাৎই একদিন মাঝরাতে বাকি বন্দীরা তাকে দাঁড় করিয়ে জামা কাপড় টেনে খুলে দিল। আমি সহ্য করতে পারতাম না , আমার খুব রাগ হত। আমি জেলারকে বলেছিলাম যে আমি একজন মনোবিদ, আমি বুঝতে পারছি ওনার মানসিক কিছু রোগ আছে ওনার চিকিৎসার প্রয়োজন, ওনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তার উত্তরে জেলার বলল “দু গালে দুটো চর মারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”। জেলের মধ্যে এইভাবেই মেয়েরা রোজ রোজ নির্যাতিত হত। কিছু বললেই তাদের জামা কাপড় টেনে খুলে দিত, সেই ভয় অনেকেই চুপ করে থাকত। মনুষ্য অধিকারের কোনও অস্তিত্বই ছিল না সেখানে।
কেউ কেউ বলছে সোনি সোরির উপর অত্যাচারের কথাটা হয়েতো একটু বেশি বানিয়ে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমি বলছি মোটেই তাই নয়। এমনকি হয়েতো আরও অনেক বেশীই অত্যাচার ওকে সহ্য করতে হচ্ছে। ওর ব্যাপারটা আমি খুব ভাল করেই অনুভব করতে পারছি। এমনকি সোনি সোরি নিজেও তার অত্যাচারের সব কথা নিজে মুখেও ব্যাখ্যা করতে পারবে না।
পরে আমাকে অন্য মহিলারা বলেছিল যে আমি জেলের মধ্যে আসতে না আসতেই নাকি ওদের কাছে অর্ডার ছিল আমাকে ‘পিটিয়ে সোজা করে’ দেওয়ার। নতুন কেউ জেলের মধ্যে এলেই বাকিদের বলত তোমাদের সব রাগ এর উপর ঢেলে দাও। তাই জেলের মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে নিজের মনকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হত, সমস্ত রকমের সামাজিকতা, মানবিকতা ভুলে যেতে হত। এছাড়া টিকে থাকার আর কোনও উপায়ই ছিল না।
প্রতিবাদী আন্দোলনের জন্য ৫০ – ১০০ লোকের সাথে আমি আগেও জেলে অনেকবার থেকেছি। তখন একটি বিশাল ঘরে তারা আমাদের একটা দল করে দুই কি একদিন জেলে বন্দী করে রাখত কিন্তু এই ঘটনাটা একেবারেই আলাদা রকমের ছিল। তখন জেলের মধ্যে এই নির্যাতনের কথা আমরা একটুও বুঝতে পারিনি। আমি যখন নিজে জেলের মধ্যে গেলাম তখন দেখলাম ওরা কীভাবে জেলের ভিতরের সব কথা লুকিয়ে রাখে।
জ্বালানীর মত শক্ত শুকনো রুটি দিত আর তোবড়ানো প্লেটে খতে দিত। জেলাররা এই কাজ সব জেনেবুঝেই করত।উলঙ্গ করে দেওয়া ছাড়াও ওরা অন্য আর এক ধরনের শাস্তিও ওরা আবিষ্কার করেছিল। পোকামাকড়ে ভরা অন্ধকার ময়লা এমন একটি ঘরে জামাকাপড় খুলিয়ে দিয়ে মিষ্টি রস গায়ের উপর ঢেলে সারারাত সেই ঘরে বন্দী করে রেখে দিত।
পরিস্থিতি খুবই কঠিন হয়ে উঠছিল। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ আর মুখ খুলছিল না। আমি মাঝে মাঝে এর প্রতিবাদ করলে ন্যাশানাল সিকুইরিটি অ্যাক্ট দেখিয়ে আমাকে চর মারত, ডিস্ট্রিক্ট কলেক্টরের অনুমতি ছাড়া এই কাজ সম্ভব ছিল না। তাছাড়া, বাইরের পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
শেষ পর্যন্ত পাওয়া খবর থেকে আমি শুনেছিলাম আমার ছেলের জন্ডিস হয়েছে। আমি জেলারকে বলেছিলাম বন্দীদের কারোর সাথে এমনকি নিজের পরিজনদের সাথেও কেন দেখা করতে দেওয়া হয় না?। তার উত্তরে এক জেলার আমাকে বলেছিল “আমার নিজের ফোনটাও ট্যাপড আছে। তুমি যদি তোমার ছেলের সাথে কথা বল তাহলে মন্ত্রীরা জেনে যাবে, সেইটা তো ভাল হবে না”।
আমার নামে কিছু মিথ্যে তথ্যভিত্তিহীন অভিযোগ ছিল, যেমন ডাকাতি, লুঠ, অপহরণ এবং খুনের জন্য অপহরণ, তাই আমার বেল বাতিল হয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম যেহেতু আমার নামে ওইসব বাজে অভিযোগ লাগানো হয়েছে তাই বেল হয়েতো খুব সহজেই পেয়ে যাব, কিন্তু ওরা লোকাল কোর্টে কেস্টাকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পরে বুঝলাম ওরা অযথা আমাকে বিরক্ত করবার জন্যই এইসব করছে।
ইঁদুর আমাদের সারা গাময় ঘুরে বেড়াত, পায়ের পাতার কাছে খুঁটে খুঁটে কামড় দিত। সকালে উঠে রক্ত পড়ে থাকতে দেখলে আমরা সবাই ভীত হয়ে যে যার নিজেদের পায়ের দিকে তাকাতাম। একদিন ১৬ ঘণ্টা ধরে হোসাঙ্গাবাদে লোডশেডিং ছিল, আমরা সেই অন্ধকারেই বসে খাচ্ছিলাম। সেই সুযোগে ইঁদুর এসে আমাদের রুটি নিয়ে চলে গেল।ও আমরা হাঁ করে বসে রইলাম।
হরদা জেল ইঁদুরে ছেয়ে গিয়েছিল। আমাদের চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে হতো তাতেও আমাদের চুলের কাছে এসে ইঁদুর গুলো জটলা পাকাত। আমি জেলারকে বলেছিলাম এই ইঁদুরের উপদ্রবের কথা। জেলার তার উত্তরে বলল,
-এইটা জেল ম্যাডাম, ফাইভ স্টার হোটেল নয়।
- তা বলে কি বন্দীরা এইভাবে ইঁদুরের কামড় খাবে, এইরকম কথা কোথাও লেখা আছে নাকি? দেখাতে পারলে আমারা আপনার কথা মেনে নেব। তা অন্ততপক্ষে আমাদের তো একটা মশারী দিতে পারেন? মশা না হোক ইঁদুরের থেকে তো আমরা রেহাই পেতে পারি।
- জেলের মধ্যে মশারী এলাউ নেই। কোনও রাজনীতিবিদ যদি জানতে পারি আমি আপনাদের মশারী দিয়েছি, তাহলে আমার চাকরি নিয়েও টানাটানি পরে যাবে।
অগত্যা আমরা আর কি করি ওইভাবেই সারারাত শুয়ে থাকলাম। ইঁদুরকে আমার আগে খুব ভয় লাগত, কিন্তু এই ২৬ দিন জেলে থেকে এখন আর কিছুই ভয় লাগে না।
এরই মধ্যে একদিন কিছু পুলিশ ২ টি গাড়ি করে আমাকে মাঝরাতে বার করে নিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এত রাতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? তার উত্তরে ওরা বলল চুপ করে “আমাদের সাথে হাঁটতে থাক”। আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভাবলাম হয়েতো ওরা আমাকে ফেক এনকাউন্টার করে দেবে এইবার। আমার সাথে সব সময়ে একটা পেন থাকত আর যেতে যেতে একটা কাগজও পেয়ে গেলাম। তাতে কোনও রকমে হিজিবিজি করে লিখলাম “ আমি জানিনা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা” আর তার নীচে সই করে দিলাম। যেখান থেকে গাড়িটা ছেড়েছিল সেইখানে ঐ কাগজটাকে ফেলে দিলাম, পরে কারোর চোখে পড়বে সেই আশায়। তারপর বুঝলাম ওরা আমাকে সেই হোসাঙ্গাবাদ জেলে নিয়ে যাচ্ছে। সেইখানে আগে থেকেই বাকি বন্দীদের দিয়ে আমাকে পেটানোর আদেশ ছিল। জেলে নিয়ে যেতেই ওরা আমাকে আর আমার ব্যাগকে সার্চ করতে লাগল, তারপর আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল।
আর ভিতরে নিয়ে যেতেই অন্য এক গল্প শুরু হল। ওরা সেখানে ৩২ জন মতো আসামী ছিল তার মধ্যে ২০ জন প্রচন্ড নিষ্ঠুর ছিল। নতুন যে সব বন্দীরা আসত তাদের সার্চ করার নাম করে তাদের উপর সব রাগ ঢেলে দিত। তার মধ্যে একজন আমার ব্যাগ টেনে নিয়ে ভিতর থেকে তোয়ালে, আমার জামা,অন্তর্বাস বের করে রাস্তায় কাদার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সার্চ করার নাম করে তারা যা খুশি করছিল, ২-৩ জন আমার জামা ধরে টানছিল, কেউ চুড়িদারের প্যান্টের দড়ি টেনে খুলে দিচ্ছিল, কেউ অন্তর্বাসের মধ্যে হাত ধুকিয়ে দিচ্ছিল, কেউ বা আবার আমার কুর্তা খুলে দিচ্ছিল। আমি প্রতিবাদ করলাম “ এইটা আবার কেমন ধরনের সার্চ করার পদ্ধতি”? তার উত্তরে বলল “অপরাধ শাখার অফিসার আমাদের আদেশ দিয়েছে। এইবার আমরা তোমাকে ভাল করে ব্যাখ্যা করে দেব সার্চ করা কাকে বলে। ওকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে দাও আর আমাকে একটা রুলার দিয়ে যাও, আমি ওকে বোঝাবো জেলের মধ্যে কীভাবে সার্চ করা হয়”। যেহেতু ওদের সাথে কোনও মারপিট করা যাবে না তাই আমি ভাবলাম চুপ করে থাকাই ভাল। আমি ওদের একবার বললাম, যে আমি সারাজীবন মানুষের অধিকার নিয়ে বিশেষত তোমাদের অধিকার রক্ষার স্বার্থেই কাজ করে এসেছি, আমার সাথে এই রকম ব্যবহার করবে না। কিন্তু ওরা তখন এমন নিষ্ঠুর হয়ে গিয়েছিল যে কোনও কথাই কানে ঢুকচ্ছিল না ওদের।
কোনও বন্দী জেল থেকে মুক্তি পাবে শুনলে বাকিরা তার উপর রেগে যেত, তার জিনিসপত্রগুলো নিয়ে নিত। ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়ে জিনিসগুলো পাবে সেই আশায় তারা খুবই উৎসাহী হয়ে থাকত। জানতে চাইত কারা কে কি জিনিস নিয়ে আসছে জেলে মধ্যে। আর যদি কোনও শিক্ষিত মহিলা হয় তো তার কাছে কিছু টাকা থাকবে আশা করত। এই সব কথা অথরিটি কে বলেও কোনও কাজ দেয় নি। প্রথম ২-৩ দিন আমি খুবই স্ট্রেসড ছিলাম। আমি একজন প্রতিবাদী তাই মৃত্যুকেও ভয় পাই না, সব রকম পরিস্থিতির জন্যই আমি প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে এই অত্যাচার বা অকথ্য গালাগালি দেখে মুখ বুজে থাকতে পারছিলাম না। বাইরের পরিস্থিতি বলছিল “চুপ করে বসে থাক”, কিন্তু আমার মনের ভিতরটা বলছিল “ উঠো, প্রতিবাদ করো”।
আমার নামে কী অপরাধ আছে তা না জানিয়েই হঠাৎই একদিন পুলিশ আমার বাড়িতে এসে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। আমার ছেলে কেমন আছে বা আমার স্বামী কেমন আছে বা ওরা তাকেও জেলে নিয়ে গেছে কিনা আর জেলে নিয়ে গেলেই বা আমার ছেলেকে কে দেখবে এইসব নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। খুবই টেনশনে ছিলাম। আর এইসব চিন্তা ভাবনা আমার শরীরের উপরেও প্রভাব ফেলেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই আমার বুকে ব্যাথা শুরু হয়। আমি ওদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার কথা বললাম । ওরা আমাকে সরবিট্র্যাট দিয়ে বলল “এটাই যথেষ্ট আর সন্ধেবেলা যদি ডাক্তার আসে তখন তার কাছে নিয়ে যাব”। আমার আগে থেকেই হাই ব্লাড প্রেশার ছিল তাই সেই ওষুধ খাওয়া আমার উচিত নয়। সন্ধে বেলা ডাক্তার আসে আমাকে চেক আপ করল, প্রেশার তখনও কিছুটা বেশিই ছিল। ১৫ দিন বাদে আমাকে যখন কোর্টে তোলা হল আমি জাজ সাহেবের কাছে অনুরোধ করলাম আমাকে যেন একটি পেন, কাগজ, কিছু পড়ার জিনিস আর ওষুধ নিয়ে জেলের মধ্যে থাকতে দেওয়া হয়, আর সেই নিয়ে কোনও পুলিশ যেন কোনও আপত্তি না জানায়।
জেলের মধ্যে কতিদন থাকতে হবে জানি না কিন্তু আমি যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ি সেইটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। প্রায় ১৫ জনের জায়গার মধ্যে ৩৫ জন মহিলাকে রাখা হয়েছিল আরা তাদের অনেকেরই গাইনকোলজিকাল অসুখ ছিল। এমনকি মাসিকের সময়েও তাদের কোনও স্যানিটারি প্যাড দেওয়া হতো না, ছেঁড়া কোনও চাদর বা ন্যাকরা মতো কোনও জিনিস দিয়ে কাজ চালাত। কিছু কিছু আদিবাসী মহিলারা ৯ ইয়ার্ড শাড়ি পরে থাকত, তারা সেই শাড়ির একদিকটা স্যানিটারি তোয়ালে হিসেবে ব্যবহার করত পরে সেটাকে ধুয়ে নিত তারপর আবার আর এক দিকটা ব্যবহার করত। শাড়িটিই ছিল তাদের স্যানিটারি প্যাড। আর জেলের মধ্যে একটি মাত্র দরজাহীন বাথরুম ছিল, ব্যাক্তিগত লজ্জা বলে তো কিছুই ছিল না। নতুন যারা আসত তারা ঐ বাথরুমের পাশে শুতো আর পুরনো বন্দীরা অন্য এক প্রান্তে শুতো। এইরকম একটা বদ্ধ পরিবেশে অনেকের ডাইরিয়া বা অনেকেরই মধ্যে যোনি থেকে সাদা স্রাব ক্ষরণ অসুখও শুরু হল। আমাদের এই যন্ত্রণার কথা শোনার মতো কেউ ছিল না। নিজেদেরকে মানুষ বলে মনে হচ্ছিল না। অনেক দিন জেলে থাকলে সবারই হয়েতো এইরকম মনে হয়, কিন্তু তবুও আমাদেরকে বাঁচতে হবে এইটুকুই লক্ষ্য ছিল।
কেউ একজন জানত আমি পেঁপে খেতে ভালোবাসি, পাঠিয়েছিল আমার জন্য। কিন্তু অবশেষে আমার কাছে যখন আসে তখন দেখি একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে পেঁপেটা চটকানো অবস্থায়। আমি জিজ্ঞাসা করতে তার উত্তরে বলল “ আমরা পেঁপেটাকে সার্চ করেছি যাতে সেটা কোনো অস্ত্রশস্ত্র না হয় তাই”। আমি বললাম একটা ছুরি দিয়ে কাটলেই তো দেখা যেত তার জন্য এইরকম চটকানোর কি দরকার ছিল? ওরা বলল আগেও নাকি এইরকম ঘটনা ঘটেছে। বুঝলাম আমাকে শুধুমাত্র হয়রান করবার জন্য বা আমার সাথে শয়তানী করবার জন্য ওরা নতুন নতুন সব প্ল্যান বাতলায়। আমার নামে আসা সব জিনিসই জেলারের বাড়িতে যেত, আমার কাছে কিছুই এসে পৌঁছত না। শুধুমাত্র আমি না এই হয়রানির শিকার বাকি বন্দীরাও হয়েছিল।
১৫ দিনের মাথায় আমি যখন কোর্টে উঠি আমি জাজ কে বলি ওরা মেয়েদের মাসিকের সময়ে যেন ঠিকমত স্যানিটারি প্যাড দেয় তার আদেশ দিন। তারপরেই দেখলাম ৫০০টাকার প্যাড ওরা কিনে দিল আমাদের। কিন্তু উপযুক্ত অন্তর্বাস না থাকায় কেউই সেটা আর ব্যবহার করত পারল না।
সকল মানুষের উচিৎ জেলের মধ্যে এই নির্মম প্রহসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
শামিম মোদীর বক্তব্য () থেকে শ্রুতিলিখন ও অনুবাদ করেছেন প্রিয়াঙ্কা বরপূজারী ও চৈতালি চ্যাটার্জি।