"লোকসাধারণ বলিয়া একটা পদার্থ আমাদের দেশে আছে এটা আমরা কিছুদিন হইতেই আন্দাজ করিতেছি এবং এই লোকসাধারণের জন্য কিছু করা উচিত হঠাৎ এই ভাবনা আমাদের মাথায় চাপিয়াছে। যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী। এই কারণে, ভাবনার জন্যে ভাবনা হয়।"
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (লোকহিত)
সরকারি পালাবদলের পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খুব উৎসাহিত। নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। এক নতুন সমাজ বানানোর আশায় বিভিন্ন মহলে এখন দাবিসনদ বানিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো চলছে, নানান সংবাদপত্রে এ নিয়ে প্রতিদিন আলাপ-আলোচনা চোখে পড়ছে। এই সবকিছুর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন না-বলাই থেকে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নগুলি তুলে ধরার জন্যেই এই নিবন্ধের অবতারণা।
নীতি-যোজনা সংক্রান্ত গোটা আলোচনাটির মধ্যে একটি স্বতঃসিদ্ধ কাজ করছে, সেটি হল উন্নয়ন-এর সংজ্ঞা। উন্নয়ন বলতে আমরা কী ধরে নিচ্ছি? উন্নয়ন যখন ভাবা হয় তখন রাজ্যের কতজন খেতে পান না, কতজন দারিদ্র্যসীমার নিচে, কতজনের চাকরি নেই এইসব সবার আগে বলা হয়, উন্নয়নের প্রয়োজনের যুক্তি হিসেবে। কিন্তু যাঁরা এই যুক্তিজালের আড়ালে থেকে যান, যাবতীয় নীতি, যোজনা, সরকারি আয়-ব্যয়ের খতিয়ান, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পুঁজি লেন-দেনের জটিল আঁক কষাকষিতে সবসময় নিষ্ক্রিয় গ্রহীতা, অর্থাৎ receiving end-এই থেকে যান, তাঁরা উন্নয়ন বলতে কী বোঝেন বা ভাবেন বা ভেবে এসেছেন তার সাথে সংযোগের কোনো চেষ্টা চোখে পড়ে না। উন্নয়নের ধারণাকে কেবল জ্ঞানের ক্ষমতার একমুখী সরবরাহ ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেওয়াটা বেশ গোলমেলে।
কৃষি নিয়ে কী হবে, কেমন শিল্প হবে এইসব ভাবার অধিকার শ্রেণী-পরম্পরায় আমরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছি, কারণ আমাদের বিশ্বাস যে আমাদের বুদ্ধি, জ্ঞান, শিক্ষা এইসব "সংকলিত জিনিষের ভিড়" (জীবনানন্দ দাশ, '১৯৪৬-৪৭ সাল' কবিতায়) বাকি সকলের হিতসাধনের কাজে লাগানো উচিত। কিন্তু যাদের গরিবিকে কুমীর-ছানার মত দেখিয়ে এই উন্নয়নের সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছে, তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে পলিসি ভাবার আগে তাদের অনুমতি নিয়েছি কি? আলুর ফলন বেশি হলে গ্রামের মানুষ তা নিয়ে কী ভাবেন, বা সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাঁরা নিজের জমিকে তিনফসলি করেই রাখতে চেয়েছিলেন কিনা, কিম্বা যাঁদের পাঁপড় বেলে বা চটের থলে বানিয়ে রোজগারের নিদান দিচ্ছি, নিজেরা ভাবার আগে তাঁদের মতামত নিয়েছি কি? তাঁদের হয়ে নীতি-নির্ধারণ করার সময়ে প্রত্যেক আলুচাষকারী, প্রত্যেক পাঁপড়-আচার প্রস্তুতকারী আর প্রত্যেক চটের থলে প্রস্তুতকারীর স্বেচ্ছা-অনুমতি নিয়ে তবে নীতি বানানোর কথা ভাবছি তো? যাদের আমরা এই গোটা discursive exercise of policy making-এর নিষ্ক্রিয় ভোক্তা করে রাখছি (যেটা ছাড়া দূর থেকে পলিসি করে দেওয়া সম্ভবই নয়) তাদের বক্তব্য শুধু রাজ্যের রাজার দরবারে নালিশ জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমরা অন্যের হয়ে যেমন খেতে পারিনা, তেমনি অন্যের হয়ে বাঁচতেও পারিনা, তাই হয়তো শুধু অন্যের হয়ে সরকার নামক আরেক অন্য-কে সিদ্ধান্ত নিতে এমন সাহায্য করতে চাই। কিন্তু 'গরীব' বা 'আদিবাসী' দের জল-জঙ্গল-জমিনের 'ownership' পাইয়ে দেওয়ার বা তাদের জন্যে অভয়ারণ্য বানানোর কথা ভাবার অধিকার আমাদের কে দিল? আমরা ভেবে দেখছিনা যে আসলে হিতৈষী হয়ে উঠে আমরা এইসব মানুষের আত্মসম্মানকে সুদ হিসেবে আদায় করে নিতে চাইছি। "সেইজন্য, লোকহিত করায় লোকের বিপদ আছে সে-কথা ভুলিলে চলিবে না। লোকের সঙ্গে আপনাকে পৃথক রাখিয়া যদি তাহার হিত করিতে যাই তবে সেই উপদ্রব লোকে সহ্য না করিলেই তাহাদের হিত হইবে" – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (লোকহিত)।
কথা চলছে যে যাঁদের কথা ভেবে এমন সচেষ্ট সুশীল সমাজ, তাঁদের কী বলার আছে জেনে, তাঁদের জিজ্ঞাসা করেই নীতি-নির্ধারণ হবে। যদি নির্ধারিত নীতি প্রত্যেক কৃষক, শ্রমিক, গরীব প্রভৃতি subject population-এর কথামতই হয়, তাহলে সে তো আর সরকারি নীতি রইলো না, তাহলে আর বাকি সকলের হয়ে সরকারের হাতে এমনতরো ক্ষমতা তুলে দেবার তোড়জোড় কিসের? আর তাঁদের জিজ্ঞাসা করে এগোনোর প্রসঙ্গে আরো একটি জরুরি কথা রয়েছে। জিজ্ঞাসার যদি কোনো ঐতিহাসিক দায় না থাকে, তাহলে তা করা কেবল সুশীল সমাজের শিক্ষা ও জ্ঞানের মান্যতাকেই প্রতিষ্ঠা দেয়, তার বেশী কিছু হয়না। আমরা কোনো সামগ্রিক বর্গকে (যেমন বাজার, যেমন পিতৃতন্ত্র, যেমন ক্ষমতা) নিয়ে তেমন ভাবিত নই, উলটে ডান-বাম নির্বিশেষে দশকের পর দশক ধরে এই বর্গগুলিকে বৈধতা দিয়ে বসে আছি। কারণ এই বর্গগুলির কোনো বাহির বা outside আমাদের ধারণার অতীত। এই প্রশ্ন করার রীতি-রিচুয়ালের মধ্যে কোনো ঐতিহাসিকতার স্থান নেই। বহু বছর ধরে একটু একটু করে তিনফসলী জমির কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রম হরণ করে আজ আমরা শিক্ষিত-সুশীল, elite। জমির তিনফসলী হয়ে ওঠার ইতিহাসকে ঐ মৃত কৃষকদের জীবাশ্ম দিয়ে চাপা দিয়ে আজ আমরা রপ্ত করেছি অনুপম বাচনের রীতি, তাই আমরা প্রশ্ন করি, "বলুন আপনি ঐ বাড়তি বিশ বস্তা আলু দিয়ে কি করতে চান। আপনি যা চান তা-ই হবে"। এর উত্তর মিলে যাবার পর আমাদের বিবেক শান্ত হয়ে রাতে ঘুমোতে যাবে, ঐ মৃত কৃষকদের শ্রম, চিন্তা, জ্ঞানের প্রতি অপমানকে বজায় রেখেই।
আরেকটি কথাও এখানে তলিয়ে দেখা জরুরি। সরকার আর জনগণের সম্পর্কটি কি শুধু অর্থনৈতিক? মানুষ সকালে উঠে টাকা রোজগার করতে বেরোবেন/ঢুকবেন, আর ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন – মানুষের জীবন শুধু এই? রাজ্যের সব মানুষকে হোমো ইকনমকাস (Homo Sapiens নয়, Homo Economicus) হিসেবে ধরে নেওয়ার মধ্যে নিও-ক্লাসিকাল অর্থনীতির হেজিমনিকে মান্যতা দেওয়া স্পষ্ট। জন স্টুয়ার্ট মিলের 'ইকনমিক ম্যান'-এর (উওম্যান তো নয়ই) প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা। এই চরম অর্থনীতি-কেন্দ্রিকতা (জীবনে, উন্নয়ন-ভাবনায় সর্বত্রই) নিয়ে আমাদের সতর্কতার বড় অভাব।
সরকারি দৃষ্টির দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে উন্নততর গভর্নেন্স-এর দাবি উঠেছে, যা দেখে মনে হয় যেন মিশেল ফুকো-র মৃতদেহের সৎকার-গাথা। অসংগঠিত শ্রমিক, কৃষক, আরো অন্যান্য সকলকে সরকারি পরিচয়পত্র দেওয়া হবে, যায়গায় যায়গায় ক্যামেরা লাগিয়ে আর আরো সব প্রযুক্তির সাহায্যে, উন্নত ম্যানেজমেন্ট-জ্ঞানের সাহায্যে সরকার (বা সরকারের হয়ে বরাত পাওয়া অন্য কেউ) নজরদারি করবে, চোখে চোখে রাখবে। তাতে নানান স্তরে দুর্নীতি কমবে। দক্ষতা দিয়ে সমানাধিকার উৎপন্ন করার এ এক অসাধারণ কল, তা সে কল চলুক আর না-ই চলুক। প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে দুর্নীতি দূর করার প্রত্যয়ের ভিতটি যে নড়বড়ে শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার panopticon বানিয়ে এক দক্ষতর controlled society বানানোর তোড়জোড় আমাদের চিন্তার দৈন্যের এক চোখ-ধাঁধাঁনো প্রকাশ।
টাটা-সালিমদের বৃহৎ শিল্প-ভিত্তিক বাজারের সমস্যার চর্চার সাথে সাথে কৃষি-ভিত্তিক শিল্পের (যেমন বেশী আলুর থেকে পটেটো চিপ্স্, পাটচাষের ক্ষেত্রে পাটজাত সামগ্রী বা মহিলাদের জন্যে নানান গৃহ-উদ্যোগ) বাজারের কথাও শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। দুটি ক্ষেত্রেই বাজারের সারপ্লাস চুরি করার ফিকিরটি কিন্তু থেকেই যায়। তাছাড়া ওয়াশিংটন কনসেন্সাস পরবর্তী সময় থেকেই এই সরকার বনাম প্রাইভেট পুঁজির দ্বিত্বটি স্পষ্টতই নড়বড়ে হয়ে গেছে। পুঁজির চরিত্র বদল হবার সাথে সাথে, আরো বেশী বেশী করে, সরকার পুঁজির বশম্বদ সহকারী হয়ে গেছে। প্রাইভেট পুঁজির বদলে সরকারের এক্তিয়ার বাড়িয়ে দেবার উপায়গুলো খুঁজে দেবার মধ্যে দিয়ে আমরা ঐ দ্বিত্বে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছি যার আজ কোনো স্পষ্ট অস্তিত্বই নেই। আসলে, অর্থনীতি কেইনসিয়ান হবে না নিও-ক্লাসিকাল হবে এই নিয়েই ছায়াবাজি চলছে। অর্থাৎ, capitalism with a human face (কথাটি স্লাভোয় জিজেক-এর কাছ থেকে ধার নেওয়া) এর আকাঙ্খায় capitalism-কে legitimize করে দেবার "পলিসি মেকিং" চলছে। উদ্বৃত্ত শ্রম চুরির বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যাথা নেই। তাই আমরা অবলীলায় রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো তৃতীয়পক্ষ যে ভাড়া খেত সেটি যেন সরকার খায় সেই বন্দোবস্তের কথা বলতে পারি।
আমরা স্বীকার করতে ভয় পাই যে হেজিমনির দাসত্ব আমরাও করে চলেছি, উদ্বৃত্ত শ্রম চুরি করে উন্নত হচ্ছি, বাজার-ব্যবস্থার উপস্থিতিতেই সরকার-রাজাবাহাদুরের প্রধানমন্ত্রী (অথবা সরকার-ভগবানের পুরোহিত) হয়ে বসেছি আমরা। তাই এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের কী করণীয় আছে সেই চিন্তাকে সবেগে একদিকে চালিত করে এক চ্যারিটেবল সোসাইটি বানানোর জন্যে মেতে উঠেছি। এতে আমাদের দায় শুধু "গবর্নমেন্টের কোর্তা ধরে টান দেওয়া"-তেই (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অচলিত সংগ্রহের 'নব্যবঙ্গের আন্দোলন' প্রবন্ধে) সীমাবদ্ধ হয়ে আমাদের পরম আত্মশ্লাঘা আর গভীর প্রশান্তি দেয়। উদ্বৃত্ত চুরি অথবা জ্ঞান-ক্ষমতার রাজনীতি, কোনোটিরই কোনো বিকল্প আপাততঃ আমাদের জানা নেই (TINA – There is No Alternative), তাই প্রতিনিয়ত এই বর্গগুলিকে বৈধতা দিয়ে চলেছি। একথা নিশ্চিন্তে ভুলে যেতে পারছি যে বৈধতা দেবার এই একমুখী খেলায় কোনো "আপাততঃ" বা আব্বুলিশ হয় না। বুলবুলিকে 'আপাততঃ' ধান খেতে দিয়ে, খাজনা কে কতটা দেবে তা নিয়েই আমাদের সব চিন্তা। আর এর মাঝে সেই খাজনা নিয়ে রাজামশাই বর্গীকে আপ্যায়ণ করছেন, আমরা চোখ বন্ধ করে ভাবতে চাইছি যে বর্গী আর বুলবুলির কোনো আঁতাত নেই। আর যাদের ধান অর্ধেক খায় বুলবুলিতে আর বাকী অর্ধেক খায় খাজনায়, তাদের হয়ে রাজার সাথে রফা করতে গিয়ে যে তাদের স্বয়ম্ভরতার পথকেই রোধ করছি, সে জন্যে আমাদের কোনো গ্লানি নেই।