উন্নয়ন, দারিদ্র্য, শিল্পায়ন জাতীয় অর্থনৈতিক বর্গগুলির কথা উঠলেই আমরা, তথাকথিত উচ্চবর্গীয়, শহুরে এবং উচ্চশিক্ষিতরা নীতি-যোজনা বানানো আর সেকাজে মদত দেওয়াতেই আমাদের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রাখি। জমিকে কীভাবে কতটা অধিগ্রহণ করতে হবে কোন কাজের জন্য, জলকে কতটা সময় ধরে বেঁধে ফেলতে হবে, কোন চাষকে কীভাবে কোন বাজারে বেচা উচিত, রেশনের দোকানের খাবারের বদলে বাজারে খাবার কেনার কুপন দেওয়া উচিত কিনা, সবাইকে আয় অনুযায়ী ঠিকঠাক দাগানো হল কিনা, এইসব বিষয় নিয়ে আমরা খুব ভাবি, গবেষণা করি, মিডিয়ায় বলি-লিখি, সরকারকে চাপ দিই। একাজ তো শিক্ষিত মানুষের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এক অর্থে এ হল দেশ-সমাজের প্রতি ঋণস্বীকার। আবার পক্ষান্তরে এ আমাদের ভ্যানগার্ডিজ্মের সগর্ব ঘোষণাও বটে।
আপত্তি উঠতে পারে, আজকাল আর এভাবে কোনো বিশেষজ্ঞের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় না, বরং যাদের জন্য যোজনা, তাদের দাবি-দাওয়া, বক্তব্য শোনা হয়। আজকাল অনেক বেশী করে ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেসি পালন করা হয়। অনস্বীকার্য, কিন্তু প্রশ্নটি সব সাবল্টার্ণকে আক্ষরিক অর্থে বলতে দেওয়া হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে নয়। ইনক্লুসিভ ডেমোক্রেসির আচার পালন করা হচ্ছে কিনা, আমার প্রশ্নটি তার চেয়েও মৌলিক। প্রশ্নটি আমাদের পলিসি বানিয়ে দেবার নৈতিক অধিকারের। আমাদের শহুরে অস্তিত্ব গ্রামে যে শোষণব্যবস্থাকে বজায় রেখে গ্রামের রক্তাল্পতা ঘটিয়ে চলেছে, তাকে কি আমরা চিনতে পারি না, নাকি চিনতে চাই না? 'চিনতে যদি পেরেই থাকো', তাহলে সে রক্তাল্পতার দায় আমরা কিভাবে নেব? মাঝে মাঝে কিছু আয়রন টনিকের মত নীতি নির্ধারণ করে বা করিয়ে?
একথাও উঠতে পারে, যে গরীব-গুর্বোরা তো আদতে নিজের কথা নিজেরা বলতে পারে না, তাই এ দায় এবং দায়িত্ব আমাদেরই। আর যতদিন না সবটা ভালো করতে পারছি, ততদিন কি অল্প করেও ভালো করব না? যতদিন না সব সমস্যাকে চিহ্নিত করা যাচ্ছে এবং তার প্রতিকার করা যাচ্ছে ততদিন কি কিছুই করা চলবে না? এভাবে প্রশ্নটি আবারও নিশানা ভ্রষ্ট হয়ে সম্পূর্ণতার হয়ে পড়ে, 'ভালো করা' নিয়ে কোনো নৈতিক সমস্যা তৈরি হয় না। তাই তো ছোটর উপকার করতে হলে যে আগে ছোটর সমান হওয়া জরুরি একথা আমরা ভুলে থাকতে পারি সহজেই। থাকব বড়, ভুলব আমার বড় হয়ে ওঠা যে ছোটর ছোট থাকার মূল্যেই, আর তার ধার শুধব ছোটর ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে, ছোটর কাছ এ এক নিদারুণ বিড়ম্বনা। মানুষের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করে রেখে তার ভালো করতে যাওয়ার উপদ্রব না সইলেই মানুষের ভালো হবে, একথা রবীন্দ্রনাথ বহুবার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
তাহলে কি যতদিন না 'সুদিন' আসছে ততদিন হাত গুটিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবো? সমস্যার মূলোৎপাটন করতে পারছি না, এই অজুহাতে কি তাহলে আমাদের দিব্যি চুপচাপ বসে থাকা চলে? মানুষ খেতে পাচ্ছেন না, আয়ের সুবিধা পাচ্ছেন না, আর আমরা বসে বসে সমস্যার চুলচেরা বিচার চালিয়ে যাবার নামে স্টেটাস কুয়ো বজায় রেখে চলব? এই ধরণের যুক্তি বড়ই সহজলভ্য এবং এক ধরণের state of emergency বা জরুরি অবস্থার চিত্রণে সাহায্য করে (যদিও আমাদের দেশের খেতে না পাওয়া মানুষের সমস্যায় আমাদের রাতের ঘুম কখনোই নষ্ট হয়না, বরং আমাদের শহুরে ক্রেতাসভ্যতা দিন দিন ফুলে-ফেঁপে ওঠে) যাতে করে 'কী ভাবছি, কী করছি' ধরণের প্রশ্নের আড়ালে হারানো 'কেন ভাবছি, কেন করছি' প্রশ্নগুলি তোলা নিষ্ক্রিয়তার নামান্তর হয়ে পড়ে। আমেরিকায় অর্থনৈতিক মন্দার শুরুর দিকে মন্দা ঘটিয়ে তোলা ব্যাঙ্কগুলিকে রাতারাতি জনগণের টাকা নিয়ে ধার দেওয়া হয়েছিল এই একি যুক্তিতে, আগে কাজ পরে বড়ো বড়ো ভাবনা।
গত চৌত্রিশ বছর ধরে আমরা ঐ 'সুদিন'-কেই 'বিপ্লব' বলতে শিখেছি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার নাম বদলে হয়েছে 'সুদিন'। নাম যা-ই হোক, সুদিন বা বিপ্লব আমাদের কাছে এক স্ট্যাটিক বা স্থির ক্যাটেগরি, অনেকটা তিথি মেনে আসা পুজো-আচ্চা-র মত। ফলে, আমাদের ভাবনা, চিন্তা, দায়বোধ, রাজনীতি সবই আপাতত-র জন্য। যবে 'সুদিন' আসবে তবে আমাদের ভাবনা-চিন্তাও ঠিক বদলে যাবে, এই বিশ্বাসের শিকড় অত্যন্ত গভীর। আজকের আপাতত-র ভাবনা, রাজনীতি যদি সেই সুদিনকে সক্রিয়ভাবে পিছিয়ে দেবার কাজ করে চলে, তাহলেও সেই বিশ্বাসের ভিত টলানো যায় না।
একথাও শোনা যায়, যে ঘরে আগুন লাগলে তখন কি আর কুয়ো খোঁড়ার চেষ্টা করে লাভ আছে? তখন তো যা কিছু অগ্নি-নির্বাপক আছে সবকিছুকেই বিনা দ্বিধায় ব্যবহার করতে হয়, কারণ তখন আগুন নেভানোই আশু কর্তব্য। কিন্তু কুয়ো খোঁড়ার কাজটা তাহলে কখন হবে? যতবার আগুন লাগবে ততবার আমরা কেবল মাটির উপর ঘটি ঠুকে চলেছি। "আমরা মনে করিয়াছিলাম, মাটির উপরে ঘটি ঠুকিলে জল আপনি উঠিবে। জল যখন উঠিল না কেবল ধূলাই উড়িল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রহিল না। আজ পর্যন্ত সেই কূপখননের কথা ভুলিয়া আছি। আরও বারবার মাটিতে ঘটি ঠুকিতে হইবে, সেই সঙ্গে সে-ঘটি আপনার কপালে ঠুকিব।" (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লোকহিত) পলিসিকে আরও ভালো করে তোলার চেষ্টা ঐ মাটিতে ঘটি ঠোকারই সামিল, যতবার তাতে শুধু ধুলো উড়ছে, ততবার আমরা ভাবছি, আরও ভালো করে ঠোকা দরকার। নিজেরা একটা কুয়ো খোঁড়ার দায়িত্ব থেকে সযত্নে দূরে সরে থাকছি। আর দূর থেকে পলিসি-যোজনা করে দেওয়ার আত্মম্ভরিতাকে সবলে আঁকড়ে ধরে থাকছি। নাহলে হয়তো নিজেদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাবার সম্ভাবনা। সবাই মিলে 'গবর্নমেন্ট'-এর কোর্তা ধরে টান না মেরে সক্রিয়তার এক রাবীন্দ্রিক নির্মাণ নিয়ে একটু ভেবে দেখা যাক না, নিজেরা একটা কুয়ো খোঁড়ার কাজে হাত লাগানো যাক না।
এ ধরণের প্রশ্নের মুখে পড়লে সাধারণত আমাদের দায়বোধ সংকুচিত হয়ে পড়ে। আমরা বলতে থাকি, আমাদের আর কি-ই বা ক্ষমতা, আমরা সামান্য একটু ভালো করার কাজই করতে পারি, যা আপাতত মানুষের দুঃখে সান্ত্বনা দেবে। এই আপাত-বিনয়ের আড়ালে আমাদের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টাকে ঢেকে না রেখে সক্রিয়তার এক অন্য অর্থ (যেমন পূর্বোল্লিখিত রাবীন্দ্রিক অর্থ) সম্পর্কে সচেতন হওয়া যাক।