বিতর্ক ওঠে, আবার চাপা পড়ে যায়। এই লেখাটি এই বিতর্কহীন সময়ে প্রসঙ্গটি আরেকবার শুরু করার উস্কানিমাত্র।
এই সব অবধারিত সময়-আলোচনার বাইরে এসে, এইমুহূর্ত যখন মৃত্যুদন্ড নিয়ে বিশেষ কোন প্রেক্ষিত বা গুরুত্ব আরোপ করছে না, যখন বিষয়টি, অধিকাংশের প্রথম বা দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয় পছন্দও নয়, তখনই হয়তো এরকম একটা বিষয় নিয়ে কাটাছেঁড়া করার সময়।
মৃতুÉদন্ডের সপক্ষে কিছ যুক্তি ও তার সাথে তর্ক:
যে কোন শাস্তির বিধান তা যতোই কঠোর হোক না কেন ,অপরাধ কমাতে সাহায্য করে না ।
তা হলে মধ্যপ্রাচ্যের যে সব দেশে শরিয়তী আইনে শাস্তিবিধান হয় - যাকে কঠোর বললেও বেশ মোলায়েম মনে হয় - সেখানে অপরাধের অস্তিতÆই থাকতো না । একজন অপরাধী যখন অপরাধ সংঘটিত করে, তখন আইন বা শাস্তির কথা মাথায় রাখে না । বেশিরভাগ সময় অপরাধ ঘটে যায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে ,চিন্তা-ভাবনার অবকাশ থাকে না । এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় । তবে তা ব্যতিক্রমই ।
এমনকি ব্যতিক্রমী অপরাধের ক্ষেত্রেও (ঠান্ডা মাথায় একের পর এক হত্যা/গণহত্যা সংগঠিত করা) মাথায় রাখতে হবে কেন এই কাজ সে করল। প্রায় সবক্ষেত্রেই সেই মানুষটি কোন একটা আদর্শে বিশ্বাসী যা তার ভিতর কোন একটি জনগোষ্ঠী/ধর্মীয় সম্প্রদায়/জাতি/শ্রেণী সম্পর্কে বৈরীভাবের জন্ম দিয়েছে। তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং তা বেড়েই যাবে। আফগানিস্থান, ইরাক তা রোজ প্রমাণ করে চলেছে। দরকার এদের সাথে আলোচনার। আলোচনাই পারে ঐ ভুল বিশ্বাসকে একজনের ভিতর থেকে নির্মূল করতে।
তা না হলে মৃত্যুদন্ড নেহাৎই প্রতিশোধ।
অপরাধ কমা বা বাড়া আইনের ওপর নির্ভর করে না, করে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার ওপর ।
খুনি যদি অন্যের জীবনের অধিকার হরণ করে অন্যায় করে থাকে, তবে রাষ্ট্র সেই একই অন্যায় করবে কেন ?
প্রশ্ন উঠতে পারে যে অন্যের অধিকার হরণ করেছে, তার কি কোন অধিকার থাকতে পারে ?
দেখা যাক অন্য ধরণের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে কী ঘটে ।
প্রায়শ:ই উন্নয়ন বা নিরাপত্তা অথবা সন্ত্রাস দমনের নামে অসংখ্য মানুষ, হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বিকল্প বা কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই, বাস্তুচুÉত হয়ে বসবাসের অধিকার, জীবন-জীবিকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় । তাঁরা অনেকেই সু¤বিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন । আদালত অনেক ক্ষেত্রেই এই সব মানুষের পক্ষে রায় দিয়েছেন । এঁদের ঠিকঠাক পুনর্বাসন দিতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দিয়েছেন । কিন্তু কখনোই, যে বা যারা এই অন্যায়ের জন্য দায়ী তাদের বাস্তুচুÉত করার নির্দেশ দেন নি । এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া অবান্তর, তবু। যাঁরা উচ্ছেদ হচ্ছেন তাঁরা যে অবস্থায় বেঁচে থাকেন বা থাকেন না, তা মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণাময়। এ অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা থেকে মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম হয়ে কাশ্মীর।
চুরি প্রমাণিত হলে, তার শাস্তি কখনোই চোরের ঘরে চুরির নির্দেশ হতে পারে না ।
আধুনিক আইন প্রতিহিংসার কথা বলে না। আধুনিক আইন শাস্তিবিধান করে অপরাধীকে শুধরানোর জন্য, তাকে নির্যাতনের জন্য নয়। তাই ভারতে এবং পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই আজ আর কোন কারাগার নেই - আছে সংশোধনাগার। আধুনিক আইন মনে করে কোন মানুষই জনÈ অপরাধী নয় - প্রত্যকটি মানুষই সংশোধনযোগ্য।
সংশোধনের উপায় নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে । কিন্তু তার দায়, আর যারই হোক, নিশ্চিতভাবেই অপরাধীর নয়।
সাধারণ মানুষের ভাবাবেগের কথা তুললে, সতীদাহ প্রথা রদ, Ù»£ শিক্ষা এবং বিধবা বিবাহ চালু করা এবং এসবের পেছনের লড়াইকে ভুল বলতে হয় । এসব লড়াই, সাধারণ মানুষের ভাবাবেগের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছিলো ।
আজকের ভারতীয় বিচার ব্যবস্থায় (অন্য আর পাঁচটা দেশের মতোই) বিচার কিনতে হয় ।
বিচার নামে পরিষেবাটি ঠিকঠাক পেতে গেলে দক্ষ উকিলের প্রয়োজন । দক্ষ উকিল মানেই সাধারণভাবে যথেষ্ট টাকার ব্যপার । দক্ষ উকিল অনেক সময়েই তার মক্কেলকে (বাস্তবে দোষী হওয়া সত্ত্বেও) বেকসু¤র খালাস করে এনেছেন এমন ঘটনা নিশ্চই বিরল নয় । আবার উল্টো দিকের উকিল যদি তেমন দক্ষ না হন (সস্তার ত«তীয় অবস্থা) তবে ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে যায় । এমনকি একেবারে সব হারানো মামলাতেও শাস্তি লাঘব করিয়ে দিয়েছেন দক্ষ উকিল এমন উদাহরণও ভ¨রি ভ¨রি আছে । কলকাতার বণিকবাড়ির বড় কর্তা , তার সু¤যোগ্য পুত্রেরা , বাড়ির বৌকে কুচি কুচি করে কেটে, ট্রাঙ্কে পুরে, দিন তিনেক ধরে চর্ব-চোষ্য খেয়ে দেয়ে ধরা পড়লেন । দোষ প্রমাণও হলো । তবু তারা বেঁচে বর্তেই আছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বϾদ্বতাও করেছেন । রুনু হনিয়োগী অসংখ্য নকশাল ও সি.পি.এম. যুবক-যুবতীকে পিটিয়ে প¤ করে , এনকাউন্টরের গল্প বানিয়ে লি করে মেরে ফেলে; মাত্র দুই মহিলার উপর লকআপে নির্যাতনের অপরাধে , মাত্র এক বছরের সাজা পান । তার আগে পদোন্নতি এবং প্রশংসা সহকারে পুরো মেয়াদ চাকরী করেন । জামিনে থাকা অবস্থায় নিজের বাড়িতে পরিজন পরিবৃত হয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গলাভ করেন ।
আবার বিনা দোষে বছরের পর বছর বিচারাধীন বন্দী হয়ে পরে আছেন এমন উদাহরণে জেল (থুড়ি - সংশোধনাগার) ভর্তি । এমনকি কোনো অপরাধ না করেও সাজা খাটছেন (থুড়ি - সংশোধিত হচ্ছেন) এমন মানুষ বিরল নন । কাজেই আদালতে দোষী প্রমাণিত মানেই সে প্রক«ত দোষী এমনটা না-ও হতে পারে । তাই মৃতুÉদন্ড দিয়ে মানুষটিকে এবং কখনো বিচারকের সিদ্ধান্ত সংশোধনের জায়গাটি চিরতরে বন্ধ করে দেবার কোন যুক্তি নেই ।
নানান বিষয়ে আমরা প্রায়শই সোচ্চার হই - ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য (লিগ্যাসি) বহন করে চলেছে যে সব ব্যবস্থা , তা পাল্টাতে হবে । তার মধ্যে শিক্ষা , মূল্যবোধ , শাসন কাঠামো ইত্যাদি প্রভ«তি নানা বিষয় প্রাধান্য পেলেও ,ঔপনিবেশিক শাস্তি ব্যবস্থা নিয়ে কেউ বিশেষ কিছু বলেন না ।
কেন একজন খুনি, খুন হওয়া মানুষটির মানুষগুলির পরিবারের সেবাতে নিযুক্ত হবে না ? কেন একজন চোর কায়িক বা মানসিক শ্রম দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটির ক্ষতিপূরণ করবে না? ঠিক ঠিক এমনটিই হতে হবে তার কোন মাথার দিব্যি নেই , অন্য অনেক কিছুই হতে পারে যার মূলে থাকবে অপরাধী মানুষটির অপরাধবোধকে জাগিয়ে তোলা । কোন বিচার-আইন-শাস্তি ব্যবস্থা যতক্ষণ না অপরাধীকে মানসিকভাবে তার অপরাধের রুতÆ , সমাজে (বৃহত্তর এবং সংকীর্ণ সব অর্থেই) তার কুপ্রভাব সম্পর্কে সচেতন না করতে পারছে ততক্ষণ সে ব্যবস্থা অর্থহীন। অপরাধ লাঘব বা নির্মূল করার লড়াইয়ে তা চূড়ান্ত ব্যর্থ।
এই লেখাটি, এই প্রসঙ্গে বিতর্কহীন এই সময়ে, একটা আলোচনা শুরুর উস্কানীমাত্র।