এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • প্রিয় বইয়ের সাথে আলাপ

    কল্লোল দাশগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ১৯ এপ্রিল ২০১০ | ২৩৮৯ বার পঠিত
  • গিলবার্ট কীথ চেস্টারটন। জন্ম, লন্ডন, ১৮৭৪।

    পড়াশোনায় লবডঙ্কা। দু দু বার স্কুল বদলানোই সার। তবে মাস্টারেরা একবাক্যে বলতেন - লেখার হাত রয়েছে ছোঁড়ার।

    আড্ডা মেরে, "ট্রালালালা হুপ-লা-ব্যু" করে জীবন কাটানোর মহৎ উদ্দেশ্য বানচাল হয়ে যায় সাহিত্যিক আর্নেস্ট হডার উইলিয়ামসের পাল্লায় পড়ে। উইলিয়ামসের তাড়ায় সমালোচনা সাহিত্য দিয়ে হাতে খড়ি।

    ১৯০৪-এ প্রথম উপন্যাস (যদি তাকে উপন্যাস বলা যায়) নেপোলিয়ান অফ নটিং হিল। তখন তিনি সবে তিরিশ। আর ঠিক তার পিঠোপিঠি প্রকাশিত হলো দ্য ক্লাব অফ ক্যুইয়ার ট্রেডস। অনতিদীর্ঘ ছটি কাহিনী পর পর সাজিয়ে একটি উপন্যাস। একঝটকায় মনে হয় উদ্ভট রসের কারবারী। কিন্তু, রসে মজলে ও ডুবলে চেনা যায় স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা একটা মানুষকে। স্রোতকে অসাধারন বিদ্রুপে ফালা ফালা করে তার উল্টো দিকে অনায়সে হেঁটে যান তিনি, উত্তুঙ্গ, উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া এবং সরস ভঙ্গীতে।

    ওঁর সমসাময়িক জর্জ বার্নাড শ, গলসওয়ার্দী, এইচ জি ওয়েলস এবং অস্কার ওয়াইল্ড। গলসওয়ার্দী আর অস্কার পুরোনো সামন্ত-অভিজাত সমাজের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন, ফেবিয়ান শ সমাজতন্ত্রের কথা বলছেন, আর ওয়েলস বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে নতুন সময়ের স্বপ্ন বুনছেন।

    তার বেশ কিছু আগে থেকেই বিজ্ঞানমনস্কতা-যুক্তিনিষ্ঠা-মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের জয়ধ্বজা উড়িয়ে রাস্তা দেখাচ্ছেন জুলে ভের্ণ। চেস্টারটনের জন্মের বছরেই (১৮৭৪) প্রকাশিত হচ্ছে দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড - তার দুবছর আগে লেখা সেই দুনিয়া কাঁপানো টোয়েন্টি থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্য সী-এর পরের অধ্যায়। চেস্টারটনের প্রথম উপন্যাস প্রকাশের ঠিক দুই বছর আগে প্রকাশিত হচ্ছে আর্থার কোনান ডায়ালের হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলস (১৮৭২)। শার্লক হোমস তখন তাঁর মধ্যগগনে। ওঁর সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ-যুক্তিজাল-প্রমাণ থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতা নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন পশ্চিমী দুনিয়া। অন্য দিকে সেই সময়েই জার্মানীতে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁর যুগান্তকারী এনার্জী থিয়োরী (১৯০০) নিয়ে আসছেন যাতে "কোয়ান্টা"র অস্তিত্ব প্রমানিত হচ্ছে। অস্ট্রিয়ায় সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রকাশ করছেন তাঁর "দ্য ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিমস" (১৯০০)। প্রথম ডিস্ক রেকর্ড আসছে (১৯০৪)। চীনে ঘটে যাচ্ছে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে বক্সার বিদ্রোহ (১৯০১)। রাশিয়ায় প্রথম বিপ্লব চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে (১৯০৫)। ঔপনিবেশীক গ্রেট বৃটেনের সবচেয়ে বর্ণময় শাসক "মহারাণী ভিক্টোরিয়া" প্রয়াত হচ্ছেন (১৯০১)। হেনরী ফোর্ড শুরু করছেন ফোর্ড মোটর কোম্পানী (১৯০৩)। এডুইন পোর্টার তৈরী করছেন "দ্য গ্রেট ট্রেন রবারী" (১৯০৩)। স্তানিস্লাভাস্কি তার নতুন অভিনয়রীতির পরীক্ষা শুরু করেছেন মস্কো আর্ট থিয়েটারে (১৯০১)।

    এক কথায় আধুনিকতা যখন তার সমস্ত যুক্তি-তর্ক-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে দুনিয়া, কাঁপাচ্ছে; তখন একজন মানুষ তাঁর লেখা শুরু করছেন -

    বিচিত্র চিজ এই ফ্ল্যাট বাড়ি। কার মাথায় যে এর আইডিয়া ঢুকেছিল ইংল্যান্ড আর অ্যামেরিকায়, ঈশ্বর জানেন।

    এই হলেন চেস্টারটন। গিলবার্ট কীথ চেস্টারটন।

    ওঁর অন্য বিখ্যাত সৃষ্টি সকল :

    হেরেটিক্স (১৯০৫)
    চার্লস ডিকেন্স - আ ক্রিটিকাল স্টাডি (১৯০৬)
    দ্য ম্যান হু ওয়াজ থার্সডে (১৯০৮)
    অর্থোডক্সি (১৯০৮)
    ফাদার ব্রাউন শর্ট স্টোরিজ (১৯১২)
    দ্য ক্লাব অফ ক্যুইয়ার ট্রেডস

    বাংলা অনুবাদ আজব জীবিকা
    অনুবাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    প্রথম সংস্করণ - শ্রাবন, ১৩৫৯ / জুলাই, ১৯৫১
    প্রকাশক শ্রী শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বেঙ্গল পাবলিশার্স
    ১৪ বঙ্কিম চাটুজ্জে স্ট্রীট, কলিকাতা ১২

    মুদ্রাকর শ্রী কার্তিক চন্দ্র পান্ডা, মুদ্রণী
    ৭১ কৈলাশ বোস স্ট্রীট, কলিকাতা ৬
    প্রচ্ছদপট পরিকল্পনা আশু বন্দ্যোপাধ্যায়
    বাঁধাই বেঙ্গল বাইন্ডার্স
    তিন টাকা

    বড় গল্পের চেয়ে সামান্য বড়ো, ছোট উপন্যাসের চেয়ে সামান্য ছোট ছ'টি আখ্যানকে নিয়ে বইটার কারবার। এই স্বয়ংসম্পূর্ণ ছ'টি আখ্যান সমূহের মধ্যে ঘোরা ফেরা করেন তিনটি চরিত্র। লেখক নিজে, লেখকের প্রাণের বন্ধু বেসিল। বেসিল গ্রান্ট। আর বেসিলের ভাই রূপার্ট গ্রান্ট।

    আলাপ করা যাক।

    লেখক। মি: সুইনবার্ন। সারা বইটা জুড়ে মাত্র একটি বা দুটি আখ্যানে তিনি নামবাচক বিশেষ্যে, বাকিটা সময় সর্বনামেই থেকে গেলেন সরাক্ষণ। অবশ্য নিজের সম্পর্কে বলেছেন প্রচুর, খুব প্রাঞ্জল ভাবে।

    উনি একজন "ক্লাব কুড়িয়ে"। যতগুলো ক্লাবের সদস্য হওয়া সম্ভব, অবিলম্বে তাদের সদস্য হয়ে যাওয়াটাই ওনার কাজ বলা যায়। ক্লাব কুড়ানোই ওনার মরজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। সেই যৌবনে কবে প্রথম "এথেনিয়াম"-এর সদস্য হয়েছিলেন। তারপর থেকে কতো যে নতুন-পুরোনো ক্লাবের সদস্য হয়েছেন সে নিয়ে আর একটা অখ্যায়িকা ফেঁদে ফেলা যায়। ওনার কুড়িয়ে নেওয়া উল্লেখযোগ্য ক্লাবগুলির মধ্যে অন্যতম "মরা মানুষের পাদুকা সংগ্রহ ক্লাব", "বেড়াল ক্রিশ্চিয়ান ক্লাব", "টাইপরাইটিং সংঘ", "লাল টিউলিপ লীগ", "দশ পেয়ালা ক্লাব" ইত্যাদি। শহরের ফাজিল ছোকরারা ওঁকে আড়ালে ডাকে ক্লাব সম্রাট বলে। শোনা যায় কেউ কেউ ওনাকে "শয়তানের সাগরেদ"ও বলে। বুড়ো বয়সেও ওনার চেহারা টসকায় নি, এখনও অদম্য ফুর্তি - সেজন্যই হয়তো। সে যাক, তাতে ওনার নাপক্ক কদলী। ওনার একটাই চিন্তা, ইহলোকে যেমন ভালোমন্দ খানাপিনা জুটেছে, পরলোকেও যেন সেটা বজায় থাকে।

    বেসিল গ্রান্ট। পরম দার্শনিক, মরমী মহাপুরুষ - জীবনে সে কখনো তার আস্তানার চৌহদ্দির বাইরে বেরোয়নি। অর্থাৎ বেরিয়েছে, তবে খুব কম। তাই বলে বেসিল মোটেও হুঁকোমুখো নয়। আসলে সে খুবই মিশুকে। যে কোন অচেনা লোকের সাথেও সারা রাত আড্ডা মেরে যেতে পারে সে। কোন আগন্তুককে যখন সে অভ্যর্থনা জানায় তখন একটা নির্লিপ্তি থাকে তার চেহারায়। অনেকটা সূর্যাস্তের বং বদল দেখে যেমন একটা নৈর্ব্যক্তিক আনন্দ হয়, তেমন। সেই রং বদলে যেমন আমাদের কোন ভূমিকা নেই, বেসিলও ঠিক তেমনই। কেউ এলে খুশী হয়। তাই বলে উদ্যোগ নিয়ে এর ওর তার সাথে আড্ডা মারায় বেসিলের তেমন উৎসাহ নেই।

    বেসিল অবসরপ্রাপ্ত জজ। শেষের দিকে উনি আসামীদের শাস্তি দিতে শুরু করেন তাদের আত্মম্ভরিতা, রসবোধের অভাব এসবের জন্য; আইনঘটিত অপরাধের কারনে নয়।

    একটি হীরে চুরির মামলায় ওঁর এজলাসে সাক্ষী দিতে আসেন প্রধানমন্ত্রী। সাক্ষ্য চলাকালীন হঠাৎ তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ওঠেন - "আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করুন মশাই । আপনার আত্মার যা পরিচয় পেলুম, ও আত্মা একটা নেড়িকুত্তারও যোগ্য নয়।"

    শেষে দুই প্রচন্ড বিত্তবানের মধ্যে মানহানির মামলায়, যেখানে নামজাদা সব কৌঁশুলীরা তাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার পর রায়দানের অপেক্ষায়, তখন বেসিল ছড়াকাটার সুরে গেয়ে উঠেছিলেন -

    ও রাউটি-আউটি টিডলি-আউটি
    টিডলি-আউটি টিডলি-আউটি
    হাইটি-আইটি টিডলি-আইটি
    টিডলি-আইটি আও।

    এবং চাকরী ছেড়ে ল্যাম্বেথ অঞ্চলে একটা কুঠরী ভাড়া নেন।

    রূপার্ট গ্রান্ট। লাল চুলো এক শীর্ণ যুবক। নানান জীবিকায় ছিলেন। সাংবাদিক, বাড়ির দালাল, প্রকৃতিতত্ত্ববিদ, বৈজ্ঞানিক, প্রকাশক, স্কুল মাস্টার হয়ে আপাতত: প্রাইভেট গোয়েন্দা।
    সম্পর্কে বেসিলের ভাই।
    মেজর ব্রাউনের অ্যাডভেঞ্চার।
    প্রাইভেট গোয়েন্দা রূপার্ট গ্রান্টের এক মক্কেল মেজর ব্রাউনকে নিয়ে এই কিস্‌সাটি।
    মেজর ব্রাউনের পরিচয় দিচ্ছেন চেস্টারটন - লক্ষ্য করার মতো -

    মেজর ব্রাউন একজন ভাইসরয় কমিশনড অফিসার.....। বৃটিশশাসিত ভারতবর্ষের যাঁরা ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন সেই অসংখ্য চোয়ারে-চরিত্র ব্যক্তির মতই তাঁর মানসিক গঠন, বৃদ্ধা পরিচারিকার মত সহজাত সংস্কার এবং পুরোনো আমলের রুচিতেই তা সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত।

    এ হেন মেজর ব্রাউন এক রোমহর্ষক ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন। ঘটনা তো নয় একেবারে ঘটনার ঘনঘটা। এক ফুলওয়ালার উস্কানীতে একটি বাংলোর বাগান-লাগোয়া দেওয়ালে চড়ে বসেন। সেই বাগানে কারা যেন হলদে প্যান্সীফুলের গাছগুলোকে বিরাট বিরাট অক্ষরের আকারে সাজিয়েছে, আর তাতে লেখা হয়েছে "মেজর ব্রাউনকে হত্যা করো"। সে বাংলোয় এক পরমা সুন্দরী অসহায় নারী। ফুটপাথ থেকে কাটা মুন্ডু চেঁচিয়ে উঠছে - মেজর ব্রাউন, মেজর ব্রাউন খেঁকশেয়ালিটার বাসা কোথায়? আর শেষ পর্যন্ত এক রহস্যময় গুন্ডার সাথে মাটির তলার কয়লাকুঠুরীতে হাতাহাতি। এবং হঠাৎ করে সব উধাও। সেই নারী, সেই প্যান্সীগাছ, বাগানের মালী, এমনকি বাংলোর আসবাবপত্রও।

    আপাতত: সেই রহস্য সমাধানে রূপার্টের দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। হাতাহাতির মধ্যে পাওয়া গেছে একটা চিঠি। সে চিঠিতে জনৈক মি: প্লোভারকে বলা হয়েছে "পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী" মেজর ব্রাউন কে কয়লাকুঠুরীতেই "আক্রমণ" করতে । চিঠির লেখক মি: নর্টহোভার। চিঠিটা নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে মতবিরোধ। রূপার্টের মতে এটা পরিষ্কার একটা হত্যা পরিকল্পনার ছক। আর বেসিল বলছেন "গুন্ডারা কখনো এধরনের চিঠি লেখে না"। রূপার্ট চিঠিটাকেই প্রমাণ হিসাবে দেখতে চায়। তখনই উচ্চারিত হয় এক অমোঘ উক্তি - প্রমাণ ! এই প্রমাণ জিনিসটাই যে কতো সময় প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে ফেলে........। প্রমাণ তো আর নির্দিষ্ট পথ নয়, ডালপালার মতো নানান দিকে তার বিস্তার। তথ্য বহুমুখী, কিন্তু সত্য এক। একই সাথে আশ্চর্য প্রত্যয়ে বলে ওঠেন - সেই লোকটারও তো প্রমাণেরই ওপর সবকিছু ছেড়ে দেবার অভ্যাস; তা সত্বেও জেনে রাখো, তার বিচারবুদ্ধির ওপর আমার এতোটুকু আস্থা নেই। কি যেন তার নাম, ঐ যে সেই দারুণ দারুণ সব গল্পের নায়ক? হ্যাঁ, মনে পড়েছে - শার্লক হোমস।

    শেষ পর্যন্ত সেই চিঠিতে পাওয়া ঠিকানা খুঁজে তারা পৌঁছে যায় চিঠির লেখক মি: নর্টহোভারের আস্তানায়। সেখানে জানা যায়, গোটা ঘটনাটার লক্ষ্য ছিলেন অন্য এক ব্রাউন, যিনি আগে মেজর ব্রাউনের বর্তমান ডেরাতেই থাকতেন। সম্প্রতি সেই বাড়িতেই মেজর ব্রাউন থাকতে শুরু করায়, নাম বিভ্রাটে মেজর ঐ ঘটনার ঘনঘটায় জড়িয়ে পড়েন।

    ঐ মি: ব্রাউন, যিনি আগে মেজর ব্রাউন এখন যে বাড়িতে থাকেন সেখানেই থাকতেন, মি: নর্টহোভারের মক্কেল।
    আর মি: নর্টহোভারের পরিচয়? উনি একটি ব্যবসা চালান। অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড রোমান্স এজেন্সী লিমিটেড। ওনারা সঙ্গত দক্ষিণায় উঁচুদরের রহস্য ও রোমাঞ্চ সরবরাহ করিয়া থাকেন।
    প্রতিভার অপমৃত্যু।

    আখ্যানটির শুরু হচ্ছে আড্ডা বিষয়ক এক চূড়ান্ত উপলব্ধি দিয়ে। আড্ডা মারার শ্রেষ্ঠ জায়গা কোনটি? ভালো জায়গা - পর্বতশিখর। আরও ভালো প্রায়নির্জন ট্রামের দোতলা। পর্বতশিখরে আড্ডা নি:সন্দেহে সাংঘাতিক। কিন্তু চলমান পর্বতশিখর , সে তো রূপকথা! কলকাতার আড্ডাবাজ লোকজন, যারা ষাঠ থেকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাজের দিনে দুপুরবেলা দোতলা বাসের দোতলায় (প্রথম সিটটি হলে ক্যাবাৎ) চড়েছেন তারা জানেন এই উপলব্ধির মর্ম।

    আখ্যানটি ঠিক আড্ডা নিয়ে নয়। তবে আড্ডা বা বৈঠক এই আখ্যানে একটা নীরব ভূমিকা পালন করেছে।

    রাস্তায় একজন মানুষকে দেখে বেসিলের মনে হয় লোকটি অতিশয় নচ্ছার ও বদ। তার এই ধারনার পিছনে কারণ হিসাবে বেসিলের বক্তব্য - ওর ভ্রুভঙ্গীতে ফুটে উঠেছে অন্ধ অহংকার। ঐ অহংকারেই শয়তান একদিন স্বর্গকেও বিদ্রুপ করেছিলো। পাকানো ঐ গোঁফজোড়াও যেন আর পাঁচজনের গায়ে ব্যাঙ্গের বিষ ঢেলে দেবার জন্য ফণা তুলে আছে।

    বন্ধু যখন প্রতিবাদ করছেন। বলছেন বিনা প্রমাণে কারুর সম্পর্কে এইরকম মন্তব্য করা যায় না। তখনই ঝলসে ওঠেন বেসিল - প্রমাণটাকেই তুমি বড় করে দ্যাখো! তুমি কি এতই কুসংষ্করচ্ছন্ন! এতই অর্বাচীন! নেহাৎ কৌতুহল বশত: লোকটিকে অনুসরণ করতে থাকে বেসিল ও লেখক। লোকটি বেশভূষা বেশ কেতাদুরস্ত। লোকটির পিছু পিছু যেতে যেতে ওরা পৌঁছে যায় লর্ড ব্যুমেন্টের বাড়িতে। লর্ড ব্যুমেন্ট একজন প্রগতিবাদী। যা কিছু উদ্ভট তাকেই তিনি প্রগতির চিহ্ন বলে মেনে নেন। সেখানে তখন মজলিস চলছে। মজলিসে এইমাত্র এসেছেন মি:উইমপোল। যাকে অনুসরণ করে বেসিলদের এখানে আসা। অভিজাতদের মজলিসে উইমপোল এখন জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্ব। তিনি নাকি অসাধারণ কথা বলেন। শাণিত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়ে ফেলেন নিমেষে। সেই মজলিসেও তাইই হচ্ছিলো। উইমপোলের শিকার সেদিন স্যর ওয়াল্টার। স্যর ওয়াল্টার ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের আঘাতে যত ক্রুদ্ধ হচ্ছেন ততই মজলিস ফেটে পড়ছে হাসিতে।

    অথচ আশ্চর্য, মজলিস শেষে বেরিয়ে এসে তারা একই গাড়িতে ওঠেন। উইমপোল আর স্যর ওয়াল্টার কিছুদূর গিয়ে নেমে পড়েন গাড়ি থেকে। ওরা আলাদা আলাদা দিকে চলে যান। বেসিলের তৎপরতায় স্যর ওয়াল্টারকে পাকড়াও করে রাখা হয়। সেদিন লর্ড ব্যুমেন্টের ডিনার পার্টিতে উইমপোল কোন কথাই বলতে পারেনি।

    এরা দুজনে স্যাঙ্গাৎ। উইমপোলের বুদ্ধিদীপ্ত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের পিছনে আসলে পয়সার বিনিময়ে অপমানিত সেজে নাস্তনাবুদ হওয়া নকল স্যর ওয়াল্টার ।

    কারুর কথা মনে পড়ে কি পাঠক? ঐ ব্যাঙ্গ, ঐ বুদ্ধিদীপ্ত কথা বার্তা? চেস্টারটনের সমসাময়িক কেউ? উনি শার্লক হোমসের মতো নাম করে ধরেন নি কারুর। হয়তো বন্ধু ছিলেন তাই। আর এতে তার প্রতি অশ্রদ্ধাও প্রকাশ করা হতো, যা চেস্টারটন করতে চান নি। কিন্তু ঐ ঘরাণার বিরুদ্ধে তার মত ব্যক্ত করেছেন।

    উইমপোলের আড়ালের মানুষটির ব্যাঙ্গ, বুদ্ধিদীপ্ততা নিয়ে কিছু কিস্‌সা আজও চলে। তারই একটা পেশ করা যাক।

    উইমপোল গাড়ি চালিয়ে একটা সরু ব্রিজের অর্ধেক গেছেন, এমন সময়ে উল্টো দিকে গাড়িতে এসে গেছেন চার্চিল। দুজনের কেউই পিছু হটার বান্দা নন। শেষে চার্চিলেরই জয় হলো। উইমপোল পিছু হঠলেন। ব্রিজ পেরিয়ে পাশ দিয়ে যাবার সময় চার্চিল থামলেন উইমপোলের গাড়ির পাশে। মিষ্টি হেসে বললেন - "কোন গাধাকে আমি রাস্তা ছাড়ি না।" উইমপোল ততোধিক মিষ্টি হেসে জবাব দিয়েছিলেন - "কিন্তু কি আর করি বলুন, আমি তো এইমাত্র ছাড়লাম।"

    তাহলে উইমপোলের আড়ালে কে?

    যাঁর নাম স্বয়ং চেস্টারটন নেন নি, অম্মো নেই কোন সাহসে। আমি কি রাবন্দা!

    (পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

    ১৯শে এপ্রিল, ২০১০
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৯ এপ্রিল ২০১০ | ২৩৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন