লেখাটি শুরু হয়েছিল ২৫শে ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যায় যখন সদ্য ঘনিয়ে আসা আঁধারে আমরা বিভিন্ন মনন ও সৃষ্টিশীলতার ২৫-৩০ জন মানুষ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক সংলগ্ন "স্মরণ মৎস্যবীজ খামারে' একত্রিত হয়ে কোরাসে গাইছিলাম, "ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা...', তখন আমার মনে হয়েছিল অজানা এক ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি আমি, আর পে?ঁছে যাচ্ছি নাড়ির টানের গভীরে, আর বহুবছর ধরে যততত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভাবনার সূক্ষ্ণ সুতাগুলো জুড়ে যাচ্ছিল কোনো এক অমোঘ টানে।
এভাবেই শুরু হয়েছিল এবারের "শিল্প ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র' (CRAC)-এর ইন্টারন্যাশনাল আর্টক্যাম্প। গতানুগতিক ধারার বাইরে, কর্পে?রেট দুনিয়ার ছে?ঁয়া বর্হিভূত ব্যতিক্রমী এই আর্ট ক্যাম্পের আয়োজন ও আমন্ত্রণের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি দীর্ঘসময় ধরে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা শিল্পী দেলোয়ার হেসেনকে, যিনি এই ক্যাম্পের পৃষ্ঠপোষণকারী। সেই সাথে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি ক্যাম্পের সমন্বয়ক শিল্পী শাওন আকন্দ-কেও, যারা কেবল এমন একটি উদ্যেগ শুধু গ্রহণই করেননি, বরং সম্পূর্ণ নিজেদের একান্ত প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবেই আয়োজন করে আসছেন এই ব্যতিক্রমী সমাবেশের। শহর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, গাছ-গাছালির নির্জন ছায়ায়, শান্ত পরিবেশে আয়োজিত এই ক্যাম্প সত্যিকার অর্থেই যেন শিল্পীদের জন্য পীঠস্থান, যাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে খামারকে প্রায় চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা জল, মাঠ আর গ্রামের অবস্থান, যা স্বভাবতই শিল্পীর মনে বিশেষ ধরনের বোধ তৈরী করে যাতে সে খুব সহজেই একাত্ব হতে পারে নিজস্ব সৃষ্টিশীল মননের সাথে।
মহিষ প্রজাতির বিলুপ্তি নিয়ে শিল্পী অসীম হালদার সাগরের ইন্সটলেশন আর্ট।
টানা সাতদিনের হৈ-হুল্লোড়, গান-বাজনা, নানাবিধ সৃষ্টিশীল কাজ, আলাপ-আলোচনা, ভাবনার আদান-প্রদান ইত্যাদির মাঝে কখন যে দিনগুলো কেটে গেল টেরই পেলাম না। ২৪ তারিখ সকালে যখন যাত্রা শুরু করেছিলাম কুষ্টিয়ার উদ্দ্যেশে, তখন ভাবতেও পারিনি এমন একটা আসরে যোগ দিতে যাচ্ছি যেখানে হয়ত বারবার ফিরে আসার জন্য প্রাণ ব্যাকুল হবে, কেননা স্মৃতির গোপনশালা এমনই কিছু ঐশ্বর্য্যে ভরে দিয়েছে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন, যা হয়ত আজীবন রোমন্থনের আলোয় উজ্বল হয়ে থাকবে।
চিত্রশিল্পী ছাড়াও শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে যারা কাজ করেন, অর্থাৎ চলচ্চিত্রকার, নাট্যকর্মী, সংগীত-শিল্পী, কবি, সাংবাদিক, মনোবিজ্ঞানী, গবেষক প্রমূখ সবমিলিয়ে এবারের ক্যাম্পে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও ভারত থেকে মোট ২৯জন শিল্পী যোগ দিয়েছিলেন। তারা হলেন দেলোয়ার হোসেন, শাওন আকন্দ, আব্দুস সালাম, কনক আদিত্য, রাহুল আনন্দ, আবু নাসের রবি, আ.ছা.ই.ম. সায়েম হোসেন, সবুজ সিদ্দিকী, পলাশ চৌধুরী, অনন্ত কুমার দাস, সঞ্জয় চক্রবর্তী, তানজিনা ফেরদৌস, অসীম হালদার সাগর, পলাশ ভট্টাচার্য, সুমনা আখতার সুমা, তানজিনা খানম, ওয়াহিদুজ্জামান, আসিফ-উজ-জামান, শেখ সাব্বির আলম, আসিফ, মাকসুদা স্বপ্না, তানজিম আহমেদ বিজয়, সৈয়দ তৌফিক রিয়াজ (ভারত), শ্রাবণী কর (ভারত), সন্দীপ সোমাদ্দার (ভারত), কমল (ভারত), মানস আচার্য্য (ভারত)।
শিল্পী সৈয়দ তৌফিক রিয়াজ ও মাকসুদা স্বপ্নার পারফর্মিং আর্ট।
প্রথমদিনটা যদিওবা শুরু হয়েছিল কিছুটা ঢিমে তালে, কেননা দূর-দূরান্ত হতে আসার ক্লান্তি ও স্থানীয় হাড় কাঁপানো শীত, যার সাথে ধাতস্থ হতে সবারই প্রয়োজন ছিল বিশ্রামের, তাই শুরুর দিনটা ছিল একে অপরের সাথে আলাপ-পরিচয়ের ও টুকি-টাকি আলোচনার। ক্যাম্প পুরোদমে জেগে ওঠেছিল পরেরদিন অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর। এইদিনটি ছিল সত্যিকার অর্থেই যেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠার এবং পরবর্তী ৬দিনে নিজেদের কার্যকলাপ, ধরন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিস্তারিত। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবাই একত্রিত হয়ে বসত আলোচনার আসর, যেখানে শিল্পীদের দৈনন্দিন কাজের অগ্রগতি, সমস্যা, পরবর্তী পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা ছাড়াও ছিল নিজেদের এযাবৎ করা কাজগুলো একে অপরের সাথে শেয়ারের উদ্যেশ্যে প্রজেকশনের ব্যবস্থা, ফলে শিল্পীদের পারস্পরিক শিল্পভিত্তিক কমিউনেকশন হয়ে উঠেছিল সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ।
শিল্পী রাহুল আনন্দ ও পলাশ চৌধুরী "ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড-টু ডিয়ার ফাদার' শিরোনামের ইন্সটলেশন আর্টে।
পরের ৬ দিন সবাই ছিল নিজেদের পরিকল্পনা ও কাজ নিয়ে দারুণ সক্রিয়, আর তাদের এই ব্যস্ততাকে সারাটাসময় সুর আর গানের মূর্ছনায় ভরিয়ে রেখেছিলেন শিল্পী রাহুল আনন্দ ও কনক আদিত্য। তবে যার কথা উল্লেখ না করলেই নয় সে হলো সন্দীপ সোমাদ্দার, কেননা ভারত থেকে আগত এই শিল্পী তার যন্ত্র সংগীতের মাধুর্যে শুধু ক্যাম্পের পরিবেশ ভরিয়েই রাখেননি, বরং কী খমক, কী হারমোনিয়াম, দো-তারা, ব্যাঞ্জো, এমনকী গিটার, যাই তার হাতে উঠে আসুক না কেন, তা এমনভাবে বেজে ওঠত যে সীমাহীন মুগ্ধতাছাড়া অন্যকিছুই কাজ করত না। একটানা সাতদিন সে ক্যাম্পের পরিবেশ মাতিয়ে রেখেছিল সুরের সুললিত ধ্বনিতে। বিশেষ করে বাউল গানের সাথে তার অতলস্পর্শী খমক, যা অনেকের মত আমাকেও বাধ্য করেছিল তাকে পুনরায় বাজানোর অনুরোধ জানাতে। এছাড়াও স্থানীয় বাউল শিল্পীদের গাওয়া লালনের গান, দিন অথবা রাতের যে কোনো সময়েই ছিল ক্যাম্পের মূল উদ্দীপক এক অনুষঙ্গ। যেনবা বাউল গানের তালে তালেই কেটে যাচ্ছিল প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত।
১ জানুয়ারী ২০১১ ছিল ক্যাম্পের শেষ দিন এবং সাতদিন ধরে শিল্পীদের সৃষ্ট নানাবিধ শিল্পকর্মগুলো নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল উন্মুক্ত প্রদশর্নীর, যার মধ্যে ছিল চিত্রশিল্প, পারফর্মিং আর্ট, ইনস্টলেশনসহ, অডিও-ভিডিওর প্রদশর্নী। দুপুর ২টায় ক্যাম্প সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় এবং দর্শনার্থীরা শিল্পীদের কাজসমূহ প্রত্যক্ষ করেন। প্রদর্শিত কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, শিল্পী তানজিনা খানমের "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী' চিত্রকর্মটি, যা ক্যাম্পের প্রবেশপথের পাশ ঘেষেই শূন্যে ভাসমান সিঁড়ির আকারে টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। কাজটির মূল থিম ছিল পূঁজিবাদী বিশ্বে নারীদের পণ্যায়ন ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে কল্পিত অদৃশ্য উর্ধ্বগামী সিঁড়ি।
পূঁজিবাদী বিশ্বে নারীর পণ্যায়ণ ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে কল্পিত সিঁড়ি এই নিয়ে "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী' শিরোনামে শিল্পী তানজিনা খানমের চিত্রশিল্প।
এছাড়াও ছিল শিল্পী আব্দুস সালামের "শূন্যের মাজার' শিরোনামে পুকুরের মাঝখানে মশারি ও কাগজের সমন্বয়ে করা ইনস্টলেশন। মূলত: লালন দর্শনে অপরূপ রূপের যে অনুসন্ধান আধ্যাত্মবাদের সেই স্বরূপকেই উপস্থাপনের প্রচেষ্টা এটি, যেখানে "বাবার ছায়া' যা ধরতে গেলে ধরা দেয় না, যা কখনও বাস্তব ও ছায়ার অতিবাস্তবতা, তাই প্রকাশের আন্তরিক প্রয়াশ এই শিল্পকর্ম।
অন্যান্য ইনস্টলেশনগুলোর মধ্যে ছিল শিল্পী পলাশ চৌধুরী ও অনন্ত কুমার দাসের "স্ব-শরিক', সঞ্জয় চৌধুরীর "স্মৃতি ও সংস্কৃতি', "প্রকৃতি আর আমি', অসীম হালদারের "বিলুপ্ত প্রজাতি', "আরবান সিটি', স্যাক্রিফাইসিং মাইসেলফ, পলাশ ভট্টাচার্যের "পাখির জন্যই', সুমনা আক্তার সুমার "সম্পর্ক', ওয়াহিদ-উজ-জামানের "কথোপকথন', মানস আচার্য্যরে ও সৈয়দ তৌফিক রিয়াজের "আমার লালন', সায়েম হোসেনের "একটি তুচ্ছ চিন্তার পরিণতি এবং অত:পর', আসিফ-উজ-জামানের "আশ্রয়', শেখ সাব্বিরের "অদৃশ্য'।
এছাড়াও ছিল কনক আদিত্যের "একবার আপনারে চিনতে পারলে রে' শিরোনামে সাউন্ড আর্ট, যা শুনতে শুনতে একসময় হারিয়ে যেতে হয় ধ্বনির সুললিত ঝংকারে। ভিডিও আর্টসের মধ্যে ছিল অসীম হালদারের "পারাপার' আর রাহুল আনন্দের "এ্যাবিউজ', "ইনভিজিবল লাইন', "ইনার আই' ইত্যাদি কাজগুলো। সর্বে?পরি রাহুলের স্বর্গীয় পিতার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলীতে মাটির সরা, মোমবাতি ও কাগজের ঠোঙা দিয়ে পুকুরের জলে ভাসানো "ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড-টু ডিয়ার ফাদার' শিরোনামের ইনস্টলেশন কাজটি ছিল সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সন্ধ্যার অন্ধকার ছাপিয়ে পুকুরের জলে দৃশ্যমান শত শত ভাসমান আলো সত্যিকার অর্থেই ক্যাম্পের পরিবেশকে করে তুলেছিল অতুলনীয়।
স্থানীয় শিশুদের বানানো কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো জলাধারের একাংশ ও শিল্পী আব্দুস সালামের শুন্যের মাজার শিরোনামের ইন্সটলেশন আর্ট।
এতসব কাজের ব্যস্ততা আর হৈ-হুল্লোড়েই কেটে গেছে সাতটি দিন, আর তাই শেষদিনে অন্যান্যদিনের তুলনায় সবাই একসাথে ফেটে পড়েছিল উল্লাসে। একটানা কাজ শেষে আনন্দ, গান, যন্ত্র-সংগীত সবকিছু একসাথে মিলেমিশে এদিন যেন ছিল শুধু বাধাভাঙা আনন্দের। তাই সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই ক্যাম্প জুড়ে শুরু হয়েছিল উৎসবের আমেজ। একদিকে গান-বাজনা, অপরদিকে রাহুল আনন্দ ও আবু নাসের রবির গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরী বৃত্তকে ঘিরে দ্বৈত নৃত্য, যাকে বিশেষ মাত্রা প্রদান করেছিল সন্দীপের বাজানো মন-মাতানো খমক। এভাবেই শুরু হয়েছিল শেষদিনের সন্ধ্যা আর রাত যত বাড়তে থাকল ততই যেন সবার প্রাণে উপচে পড়তে থাকল আনন্দের ঢেউ।
অবশেষে রাত যখন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গভীরভাবে জেকে ধরল খামারকে, আর আচমকা হিম বাতাস কাঁপিয়ে দিতে থাকল শরীর, তখন সবাই ঘন হয়ে বসেছিলাম অগ্নিকুন্ডের চারপাশে। হয়তবা গভীর রাতের প্রকৃতি আর কুয়াশার চাদর ঘুমের কোলে ঢলে পড়া মানুষগুলোর প্রাণে বাজতে থাকা আনন্দধ্বনি কিছুটা হলেও থিতিয়ে এনেছিল, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার চারপাশে মেলে ধরা হাতগুলো বেয়ে শরীরের দিকে অগ্রসরমান উষ্ণতা কেনজানি থিতিয়ে আসা সেই উত্তেজনাকেই পুনরোজ্জীবিত করছিল বারবার আর কয়েকদিন ধরে ক্রমশ: জমতে থাকা দারুণ স্মৃতিগুলো নিজেদের অজান্তেই থরে থরে সাজিয়ে পড়ছিল প্রাণের গভীরে। কেউ কেউ কিছুক্ষণ পরপরই উসকে দিচ্ছিল আগুন আর আমি গনগনে শিখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এমন প্রকৃত অবকাশই শিল্পীদের একান্ত প্রয়োজন, যেখানে সে খুব ভালভাবেই তার বোধের গভীরে প্রবেশ করে অনুধাবণ করতে পারে শিল্প, প্রকৃতি আর শব্দের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা নৈ:শব্দের বিপুল কলরোলের অদৃশ্য যোগসূত্র, যা তাকে হয়ত আরও বেশ কিছুদিন রশদ যোগাবে সামনে এগিয়ে যাবার।
০২.০১.১১
বিস্তারিত জানতে লগ ইন করুন