এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  খবর  টাটকা খবর

  • জলাভূমির জন্য শহীদ তপন দত্ত

    শশাঙ্ক দেব লেখকের গ্রাহক হোন
    খবর | টাটকা খবর | ১৭ মে ২০১১ | ৯৫৮ বার পঠিত
  • রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতায় পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন ঘটতে চলেছে - তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনসাধারণ যখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, বিধানসভার নির্বাচনের পর্ব চলছে, এমন সময় হাওড়ার বালি জগাছা এলাকার হাওড়ার প্রাক্তন যুব তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি তপন দত্ত গত ৬ মে রাত্রি ৯-৪০-এ বালি ষ্টেশনের কাছে ঘোষ পাড়া রেল গেটে প্রকাশ্যে খুন হলেন। কয়েকজন আততায়ী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক দূরত্বে বুকে, হাতে, পায়ে তাঁকে গুলি করে বিনা বাধায় চলে গেল। সাধারণত: এই স্তরের কোনো রাজনৈতিক কর্মী খুন হলে বেশ আলোড়ন ওঠে। দলীয় নেতা নেত্রীরা এলাকায় হাজির হন। পরিবারের প্রতি সমবেদনা, নানা প্রতিশ্রুতি, কখনো সি আই ডি কখনো সি বি আই কখনো বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি, আস্ফালন, শপথ ইত্যাদি চলতে থাকে। আজকাল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও রাজনৈতিক কোনো কর্মী হত্যা হলে নেতা নেত্রীরা ছুটে যান কেননা ইলেকট্রনিক মিডিয়া তা সম্প্রচার করে। এমনকি অরাজনৈতিক কোনো সাধারণ মানুষ নিহত হলেও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে তাঁকে নিজেদের প্রমাণিত করার। এক্ষেত্রে তেমন কিছুই হল না। শুধুমাত্র দলের স্থানীয় নেতৃত্ব বিবৃতি দিয়ে দায় সারলেন - নির্বাচনে কারচুপিতে বাধা দেওয়ায় সি পি এম এই খুন করেছে। অবশ্য এরকম অভিযোগ নিয়েও প্রতিকার চাওয়ায় কোথাও কোনো সক্রিয় উদ্যোগ নিতে তাঁদের দেখা গেল না। পরিবর্তনের উৎসব চলাকালীন তপন দত্ত হয়ত দ্র¦ত বিস্মৃত হবেন।

    কিন্তু কেন এমন নীরবতা, কেন এই বিস্মরণের প্রচেষ্টা? কারণ জানতে আমরা একটু পিছনে ফিরে তাকাব।

    হাওড়া, হুগলি জেলায় রয়েছে এক বিস্তীর্ণ জলা ভূমি। পূর্বে গঙ্গা এবং পশ্চিমে রূপনারায়ণ নদীর অববাহিকায় এই প্রকান্ড জলাভূমিতে রয়েছে অসংখ্য খাল, বিল, জলাশয়। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় এখনও ছোটো নৌকা চলে, মৎস্যজীবীরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কোথাও কোথাও সরাসরি জল দেখা যায় না, জলের উপর জলাভূমির বিশিষ্ট উদ্ভিদে ভরে থাকে। কোথাও কোথাও প্রায় মানুষ সমান ঘাস বছরের বেশ কয়েকমাস গবাদি পশুর খাদ্য যোগায় তারপর জলে ভরে যায়। জলাভূমির বহু বিশিষ্ট কীটপতঙ্গ সেখানে পর্যাপ্ত জীবন ধারণের রসদ পায়। বছর বছর গঙ্গা ও রূপনারায়ণের বন্যার জল এই জলাভূমি ধারণ করে। এই জলাভূমির মধ্যেই কয়েক শতক ধরে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে গড়ে উঠেছে নানা জনপদ, শহর, গ্রাম, লোকালয় ইত্যাদি। ফলে এই জলাভূমির আর নিরবচ্ছিন্ন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু টানা একসঙ্গে না থাকলেও বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় ৭৫ বর্গ কিমি অঞ্চল বিভিন্ন খালের দ্বারা সংযুক্ত হয়ে এখনও অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। উৎসাহী যে কেউ ইন্টারনেটে গুগ্‌ল ম্যাপ দেখে এই বিস্তীর্ণ জলাভূমির এক আন্দাজ পেতে পারেন।

    ১৯৭১ সালে ইরানের রামসারে জলাভূমি রক্ষার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলির মধ্যে চুক্তি (রামসার কনভেনশন) স্বাক্ষরিত হলেও আমাদের দেশে সরকারী বেসরকারী স্তরে চেতনা অনেক পরে এসেছে। জনসংখ্যার চাপ, কল কারখানার দূষণ, নদী খাল বিল বুজে যাওয়ার ফলে পরিবেশের উপরে ক্রমাগত যে চাপ এসে পড়ছে, সেখানে জলাভূমি রক্ষার প্রয়োজন ১৯৯০-এর দশক থেকে এ রাজ্যে কিছুটা গুরুত্ব পেতে শুরু করে। ২০০২-এর আগষ্ট মাসে পূর্ব কলকাতার ১২৫০০ হেক্টর জলাভূমি "রামসার সাইট' হিসাবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়। কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে এই জলাভূমি সংরক্ষণের কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যদিও রাজারহাটে "নিউটাউন' নামে নগর পত্তন, জলশোধন প্রকল্প থেকে শুরু করে হাউজিং কমপ্লেক্স তৈরির ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিরন্তর চাপে রেখেছে এই জলাভূমিকে তবুও এর সংরক্ষণের গুরুত্ব এখন অন্তত: প্রকাশ্যে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।

    কিন্তু এর থেকেও আকারে অনেক বড় হাওড়া-হুগলির বিস্তীর্ণ জলাভূমি সংরক্ষণের কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাই গৃহীত হয় নি। এর উপর দিয়েই তৈরি হয়েছে মুম্বই রোড, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে-র মত বিশাল বিশাল হাইওয়ে। জনসাধারণের প্রয়োজন ছাড়াও ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ব্যপক পরিমাণ জলাভূমি বুজিয়ে তৈরি হয়েছে কলকারখানা এবং হাউজিং কমপ্লেক্স। জলাভূমি রক্ষার চেতনা যখন তেমন গুরত্ব পেত না তখন এই উদ্যোগ এবং প্রকল্পগুলির বেড়ে ওঠা ছিল অনেকটা স্বত:স্ফূর্ত। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে যখন এই চেতনা যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে, তখনও রাজ্য সরকার বা স্থানীয় কতৃপক্ষগুলির তরফে কোনো উদ্যোগ তৈরি হল না এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি রক্ষা করার। একদিকে যখন পূর্ব কলকাতা জলাভূমি রক্ষা নিয়ে ব্যাপক আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছে, হাওড়া-হুগলির এই জলাভূমি গুরুত্বহীন হয়ে রইল।

    এই সময় থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে জলাশয়, জলাভূমি, খালবিল, নদীর নাব্যতা রক্ষায় অসংখ্য স্বত:স্ফূর্ত উদ্যোগ তৈরি হল। শৌখিন পরিবেশবাদী উদ্যোগ নয়। এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণের প্রয়োজনে এর দরকার হয়েছিল। একদিকে পৌরসভাগুলির জল সরবরাহের সঙ্কট, অন্যদিকে জলাশয়ের জলের নানা ব্যবহার, জল নিকাশির সুযোগ ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যাবার জন্য স্থানীয় মানুষ সরাসরি জলাশয় রক্ষায় সামিল হলেন। একটু অস্বাভাবিক হলেও রাজ্য সরকারের মৎস্য দপ্তর আইন করে এই ভরাট যজ্ঞ বন্ধ করার কিছুটা ব্যবস্থা নিলেন। অস্বাভাবিক, কারণ কাজটি করার কথা ছিল প্রথমত: পরিবেশ দপ্তরের কিন্তু মৎস্য দপ্তর এই উদ্যোগ নিল। মৎস্যজীবীদের স্বার্থ রক্ষা এবং মৎস্য চাষ বাড়ানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও জলাশয়, জলাভূমি রক্ষায় উদ্যোগীদের তা অনেকটা সাহায্য করল। ওয়েষ্ট বেঙ্গল ফিশারিজ আইন ১৯৯৩ বলা হল ৫ কাঠা বা ০.০৩৫ হেক্টর-এর সমান বা তার বেশি যে কোনো জলে নিমজ্জিত এলাকা, তা সে প্রাকৃতিক বা সরাসরি যেভাবেই তৈরি হোক না কেন, কোনো কারণেই বুজিয়ে ফেলা যাবে না।

    জনসংখ্যা বেড়ে চলায় বাসস্থানের জন্য জমির চাহিদা বাড়বে - এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হল না। বহু চর্চিত "ল্যান্ড ইউজ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ক®¾ট্রাল প্ল্যান' কখনো আকার নিল না। অন্যদিকে সমগ্র বিষয়টি ছেড়ে দেওয়া হল জমির দালাল, মাফিয়া, প্রোমোটার চক্রের উপর। অগত্যা যা হবার তাই হল। সংরক্ষণের স্বত:স্ফূর্ত উদ্যোগ এবং আইন থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য জলাশয়, খাল, বিল ভরাট হতে থাকলো। এক সময় যা ঘটেছিল দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী এখন তা ঘটতে থাকল আইন ভেঙ্গে, রাতারাতি, মুনাফার পাহাড় তৈরি করার প্রক্রিয়ায়।

    তপন দত্ত বালি জগাছা এলাকায় তাঁর রাজনৈতিক দলের সঙ্গীসাথিদের নিয়ে এর প্রতিবাদ করতে থাকেন। এইসময় তিনি ছিলেন হাওড়া জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি। তাঁর বক্তব্য ছিল খুব স্পষ্ট। "দেখুন, আমি পরিবেশের কিছু বুঝি না। আমি পরিবেশপ্রেমী বা পরিবেশবাদী নই। আমার চাহিদার জায়গাটা খুব সঙ্কীর্ণ। আমাদের বালি জগাছা এলাকায় প্রতি বছর বর্ষার জল দাঁড়ানোর পরিমাণ বাড়ছিল। নিকাশি নালাগুলি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। একটু বৃষ্টি হলেই ব্যপক অঞ্চলে পূতিগন্ধময় পরিবেশ তৈরি হত। বাড়ি থেকে বেরোনো যেত না। কেন এরকম হচ্ছে খোঁজ নিতে চেয়ে জানতে পারি এই এলাকায় যে ২০০০ বিঘা জলাভূমি রয়েছে তার এক বড় অংশ বিভিন্ন কর্পোরেট সেক্টর কারখানা এবং হাউজিং বানানোর জন্য বেআইনিভাবে বুজিয়ে ফেলছে। ফলে প্রতিবাদ করাটা জরুরি হয়ে পড়ে।'

    ]প্রথমে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, পঞ্চায়েত, বিডিও, ভূমি দফতর, জেলা প্রশাসন ইত্যাদির কাছে আবেদন নিবেদন বিক্ষোভ চলতে থাকে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক কর্মী হওয়ার সুবাদে তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী আবেদন নিবেদন ছাড়াও সভা সমিতি অবরোধ ইত্যদি শুরু হয়। এসব কাজে তাঁর দলের সবাই না হলেও বেশ কিছু কর্মী এবং স্থানীয় নেতাও তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতা করেন। এই আন্দোলন সফল করার উদ্দ্যেশ্যে এবং আন্দোলনকে আরও ব্যপক চরিত্র দেওয়ার জন্য জয়পুর বিল, জগদীশপুর, চামরাইল এবং বাইগাছি মৌজার অধিবাসীদের নিয়ে তাঁরা "বালি জগাছা জলাভূমি বাঁচাও কমিটি' তৈরি করেন। পঞ্চায়েতের কাছে তথ্য জানার অধিকার বলে তাঁরা জানতে পারেন যে ঐ এলাকার সেচ নিকাশি খাল ছাই দিয়ে বোজানো হয়ে গেছে। এর পরেও অভিযোগের প্রতিকার তো দূরের কথা জেলা প্রশাসন অভিযুক্তদের হয়ে সাফাই গাইল যে জমি ভরাট হচ্ছে তা কৃষি জমি অতএব বেআইনি কাজ হচ্ছে না। জমির প্রকৃত বর্তমান চরিত্র কি তা নিয়ে সমীক্ষা না করে শুধুমাত্র জলাভূমি রেকর্ড করা নেই এই সাফাই গেয়ে প্রশাসন এমনকি খালগুলি বুজিয়ে ফেলার পক্ষে গেল। এই অবস্থায় তপন দত্ত ও তাঁর সহযোগীরা হাইকোর্টে যেতে বাধ্য হন। ২০০৯-এর ৩০ অক্টোবর একটি অন্তর্বর্তী নির্দেশে শ্রী অনিরুদ্ধ বসু ও শ্রী সঞ্জীব ব্যানার্জির ডিভিশন বেঞ্চ ঐ এলাকার জলাশয়গুলি বোজানো বন্ধ করতে বলে। সম্পূর্ণ জলাভূমি ভরাট নিষিদ্ধ করার নির্দেশ না পেলেও অন্তত: জলাশয়গুলির ভরাট বন্ধের নির্দেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশকে কাঁচকলা দেখিয়ে শুধুমাত্র তথাকথিত "কৃষি জমি' নয়, সরাসরি জলাশয়গুলিও বোজানো অব্যাহত থাকে। পুলিশ প্রশাসন নিষ্ক্রিয় নীরব থাকে। তপন দত্তের নেতৃত্বে স্থানীয় যুবকেরা হাইকোর্টের নির্দেশ পালন করানোর জন্য রাস্তা অবরোধ করেন, ট্রাক থেকে ছাই ফেলা বন্ধ করে দেন। স্বভাবতই জমি মাফিয়াদের স্বার্থে বাধা দেওয়ার জন্য তপন দত্ত চিহ্নিত হন।

    এতদিন এই জলাভূমির এক প্রান্ত থেকে বোজানোয় সক্রিয় ছিল আনমোল ইনফ্রাষ্ট্রাকচার লি., মারলিন, ডি এল এফ, ফ্রাঙ্করস ইত্যাদি বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টর। হোসিয়ারি পার্ক গড়ে তোলার কথাও শোনা যাচ্ছিল। এই ছাই ফেলে ভরাট করার বরাত পাওয়া ঠিকাদারেরা জোট বেঁধে গড়ে তোলে সিন্ডিকেট। স্পষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র না থাকলেও (মাফিয়া-দের আবার রাজনীতি কি!) একথা সহজবোধ্য যে শাসক দলের ছত্রছায়ার আশ্রয় তারা ভালই পাচ্ছিল। নতুন আর একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এই জলাভূমির অন্য প্রান্ত ছিল রেলের দখলে। ২০১০ -এ সেখানে রেলের কোচ ফ্যাক্টরি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল। সেদিকেও দ্র¦ত শুরু হল ভরাটের পালা। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ডানকুনি রেল ষ্টেশন থেকে রেল লাইনের সমান্তরাল বিস্তীর্ণ এলাকা ভরাট হয়ে গেল। হাইকোর্টের নির্দেশের কোনো গুরুত্ব কেউ দিল না। স্বভাবতই তপন দত্ত "জলাভূমি বাঁচাও কমিটি'র পক্ষ থেকে এই ভরাটেরও বিরোধিতা করলেন। কিন্তু ঘটনা হল তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী আর তাঁর নির্দেশে এই কোচ ফ্যক্টরির কাজ শুরু হয়েছে। ফলে সমীকরণ বদলে গেল। এবার তপন দত্ত দলের নেতৃত্বের বিরাগভাজন হলেন। প্রচুর চাপ আসতে থাকল আন্দোলন তুলে নেবার। মুষ্টিমেয় কয়েকজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া দলের অন্য সবাই দ্বিধা এবং ভয়ে দূরত্ব তৈরি করল। অবশ্য তাঁদের দূরে সরার আরও একটি কারণ ছিল। সিন্ডিকেট নামক মাফিয়া জোট তাঁদের মাটি ভরাটের কাজে অংশ নিয়ে দ্র¦ত আর্থিক লাভের সুযোগ করে দিল। তপন দত্তের পক্ষে এসব কিছুই দেওয়া সম্ভব ছিল না। রেলের এই জমি ভরাটের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আরো একটি মামলা দাখিল হয়। সেখানেও হাইকোর্টের নির্দেশে জমির চরিত্র পরিবর্তনের উপর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ মেনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। মজার বিষয় তৃণমূলের যে বিখ্যাত আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তপন দত্তের জলাভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে মামলাটি হাইকোর্টে তুলেছিলেন তিনিই রেলের জলা বোজানোর মামলায় রেলের হয়ে জলাভূমি ভরাটের স্বপক্ষে মামলা লড়ছেন। এ থেকেই বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান বোঝা যায়।

    স্বভাবতই তপন দত্ত খুব স্বস্তি বোধ করছিলেন না। ২০০৯ সালে তপন দত্তের ভাই মাফিয়াদের হাতে খুন হন। তিনি নিজে ও তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুরা যেভাবে জমি হাঙর এবং মাফিয়াদের স্বার্থে বাস্তবে এবং সরাসরি আঘাত করছিলেন, তাতে তাঁর প্রাণহানির আশঙ্কাও খুব বেশি পরিমাণে ছিল। অথচ লড়াইটা তিনি কিছুতেই ছাড়তে চাননি। জানতেন এটা অসম লড়াই। জানতেন এ থেকে তাঁর ব্যক্তিগত লাভ কিছুই নেই। আছে শুধু পরিশ্রম, আর্থিক দায়, টেনশন। তবু মাথা উঁচু করে বলতেন "এর শেষ দেখে ছাড়বো'। এরকম নির্ভীক এবং নিজের স্বার্থ ভোলা মানুষ আজকের দিনে সত্যি বিরল।

    রাজনৈতিক দলের কর্মী হয়েও দলতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর একটা সহজাত প্রতিক্রিয়া ছিল। তাই গড়ে তুলেছিলেন আর একটি সংগঠন - সিটিজেন্স রাইটস্‌ অ্যান্ড প্রোটেক্সন ফোরাম। এই সংগঠনের ব্যানারে রাজনৈতিক হিংসা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে "আর নয় রক্তপাত' এই বিষয়ের উপর সভা করার অনুমতি চাইতে সেদিন ৬ মে তিনি বালি থানায় গিয়েছিলেন। ফেরার পথে নিজেই রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। এরপরে নিশ্চয় ব্যখ্যা করার অবকাশ নেই কেন তপন দত্তের হত্যা কোনো আলোড়ন তুলল না, কেন তাঁকে বিস্মৃতির আড়ালে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। যারা তাকে গুলি চালিয়ে মারল তারা কি প্রকৃত দায়ী? যদি পুলিশ তাদের ধরে এবং শাস্তিও দেয় আসল অপরাধী কি আড়ালে থেকে যাবে না? ফলে যথার্থ তদন্তের দাবি তুলেছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, কিছু পরিবেশ ও মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার সংগঠন। সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়ে যাওয়া ছাড়া এই ঘটনার কোনো যথার্থ প্রতিকার পাওয়া যাবে না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • খবর | ১৭ মে ২০১১ | ৯৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন