একটু লেখাপড়া শেখা মধ্যবিত্ত বাঙালির বাচ্চার মদ্যপান ও নেশাভাঙ করার হাতে-খড়ি গত শতকের ঘটনা। উত্তাল সত্তর দশকে তার সঙ্গে নার্কোটিক্স বা নৈরাজ্যবাদের পলিটিক্স সুকৌশলে বা প্রকৌশলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল মহান সাম্রাজ্যবাদীরা। সোনালি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল ও পরিধি বিস্তারের সঙ্গে যুগপৎ যুবশক্তি যাতে নেশাভাঙে ডুবতে থাকে, নিজেদের গড়ে তোলার সময়টাতে যাতে গোল্লায় যাওয়ার রাস্তা সুপ্রশস্ত তার সবরকম ব্যবস্থাই তৈরি করেছিলেন দক্ষ কারিগররা। ২০ শতকে, ষাট দশকের অর্থনৈতিক সঙ্কট তখন কাটিয়ে উঠে, রাজনৈতিক ডামাডোলের সুযোগ তারা সদ্ব্যবহারে সক্রিয় ছিলেন।
ইয়োরোপের রেনেসাঁর ছিটেফোঁটা যখন আমাদের বঙ্গভুমিতে চুঁইয়ে হলেও কিছুটা এসেছে, সাহেবদের আমলে গড়ে ওঠা সেই নেশার চক্করে বিলেতি মদ বা ভারতে তৈরি বিলাতি মদ্যের প্রসার ঘটেছে। তারও বেশ কিছু আগে পার্বত্য এলাকায় বিশেষত হিমাচলের সিমলা যাওয়ার মাঝপথে ইংরাজ কাপ্তেনগণের উদ্যোগে উনিশ শতকেই "সোলান" এলাকায় প্রাচীনতম বৈজ্ঞানিক ভাটিখানা বা ব্রুয়েরি তৈরি হয়। মদ তৈরিতে আমাদের দেশে হাজির হলেন বিদেশী শুঁড়িখানা শিল্পের উদ্যোগপতিরা। বাংলাও তার ব্যাতিক্রম ছিল না। কিন্ত তার আগে কি আমাদের মদ ছিল না বা অন্যকোন নেশাভাঙ চালানোর বন্দোবস্ত?
মোটেই তা নয়। আমাদের ভুমিপুত্ররা, বিশেষত উপজাতি নামে যারা চিহ্নিত, মদ্য তৈয়ারি বা মদ্যপানেও কমতি ছিলেন না কেউ। যে স্কচ হুইস্কির গর্বে অধুনা কর্পোরেট জগতের মানুষজন, উচ্চবিত্ত এবং ধনিক শ্রেণী, কলিকাতার বিশিষ্ট বাবু সম্প্রদায়, জোড়াসাঁকোয়, ঘাঁটি গেড়ে বসা পিরালি ব্রাহ্মণ পরিবার তথা জাহাজ কোম্পানি চালানো রবি ঠাকুরের পূর্বপুরুষগণ অনেকে যেমন ধ্যান সাধনায় সাধুসন্ত ঋষিপ্রতিম গোছের মানুষ ছিলেন আবার বিলাত ফেরত, বিলাস ব্যসনে নিমজ্জিত মদ ও অন্য নেশাভাঙের সমঝদারও ছিলেন কেউ কেউ। দীনেশ চন্দ্র সেন বা নীহাররঞ্জন বাবুরা সে কথা না লিখলেও সুখপাঠ্য বাঙালির ইতিহাসে তাও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকার কথা, আপনারা আমরা সবাই জানি। তেনাদিগের বাঈজি কুট্টিনী বিলাস, গাঁজা-ভাঙ-গোলির প্রতিও যে অনাসক্তি ছিল, এক গলা গঙ্গাজলে ডুবে বল্লেও কেহ বিশ্বাস করিবে না আদিবাসী ও অন্ত্যেবাসীদের হাতে তৈরি, শুদ্ধাচারে মহুয়া, হাঁড়িয়ার সুখ্যাতি কি রথসচাইল্ড, জনি ওয়াকার বা গ্লেনটেকের চেয়ে কম কিছু?
কথা হইল আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী ভুমিপুত্রদের, জঙ্গলমহলে বসবাসকারী তথাকথিত উপজাতি বা হরিজনদেরও কি আমরা "বাঙালি" গণ্য করিব? যদি অসভ্যতা বা সভ্যতার বিবর্তনের দিক মাথায় রেখে তাদের অস্বীকার না করি তা হলে দিদিমণির কাছে তাহাদের মধ্যে কাউকেই বা "মদ্য বিভূষণ", "তেঁড়েল-চূড়ামণি" জাতীয় কোন পুরস্কার প্রদানের জন্য কেনই বা নাম সুপারিশ করিব না ? সে প্রশ্ন ও সংশয় নিয়ে নিয়ে কুটকচালি শুরু হলে অবশ্য সমুহ হ্যাপা। মাননীয় সমাজ চিন্তক, বাম-অবাম, দক্ষিণ-উত্তরপন্থী রাজনীতিক, মায় মন্ত্রীরাও ধন্দে পড়িবেন। সুতরাং, অতএব ও তাহলে বঙ্গভুমেই পুনরাবতরণ। এখনে যেমন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সী এমনকি বিশ্বভারতীর মদ-গাঁজা-চরসসেবী ছাত্রছাত্রী, অছাত্রছাত্রী সমাজবিরোধী বহিরাগতদের উদ্ধার ও সংস্কারকর্মে, চরিত্র সংশোধনে বরং তারা ব্যাপৃত থাকুন। বাঙালি জাগ্রত হউন, আমরা নেশায় ফিরি আপাতত।
তামাকু এবং অহিফেন সেবনের নেশা বাঙালির দীর্ঘকালের সঙ্গী ছিল। এখন বরং কিছুটা কমেছে। ভাল আফিং-তামাক পাওয়াও যায় না। কলিকাতার সিমলা পাড়ার দত্তবাড়ির ছেলে শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ একদা হুঁকো টানলে জাত যায় কিনা দেখার অভিলাষে ছেলেবেলাতেই পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। পোস্তর ঢেড়ি ভেজানো জলপান করতে আমরা আমাদের অনেক দাদু ঠাকুমা-দিদিমাদেরও দেখেছি। এখনও সস্তায় এমন নেশা করা যায়। মানালি বা আফগানিস্তানের গাঁজা ( গ্রন্স নামে ও যার সুখ্যাতি) অবশ্য বহুমূল্য এখন। একদা সাধু সন্ত বাউল থেকে শুরু করে, শিল্পীদের মধ্যে গঞ্জিকা সেবন, পঞ্চমুখী কল্কেতে টান দিয়ে আগুন তুলে দেওয়া বিখ্যাত ছিল। শহরের উল্লেখযোগ্য কবি ও ইন্টেলেকচুয়াল রূপচাঁদ পক্ষীর নামও আমরা জানি। নাম বদলের চেষ্টা করলেও গাঁজা পার্ক আজও স্বমহিমায় অবস্থান করছে। কিন্ত গেঁজেলদের সংখ্যা খুব একটা বেড়েছে বলা যায় না। ছাত্রাবস্থায় মধ্যবিত্ত বাঙালি, হয়ত অর্থনৈতিক অসুবিধার জন্য শুখা নেশায় বহুলাংশে অভ্যস্ত ছিল। গাঁজা-ভাঙ-চরস-চণ্ডু-মাজুম-ফুটুস-বাদামী চিনি, স্ম্যাক-ক্র্যাক প্রভৃতি নেশারও বেশ চল ছিল। মধ্যবিত্তের বিকাশ ঠিকমত হচ্ছিল না বলেই, অভিভাবকরা সন্তান সন্ততিদিগের পর্যাপ্ত রাহা খরচ জোগাতে না পারায় - কালির সিরাপ, ফিনাইল-ডেনড্রাইট জাতীয় বস্ত শুঁকে নেশা করার রেওয়াজ এখনও চালু আছে। সেদিক থেকে মদ্যপানের নেশায় খরচও বেশি হয়। বঙ্গজীবন থেকে গত চার দশকে অন্তর্হিত হয়েছে বুনিয়াদী এবং কোয়ালিটি শিক্ষা, হয়তো নেশার বস্তুর প্রসারের কারণেই। শিক্ষায় জাতীয় স্তরে বাংলার স্থান এখন পিছন থেকে তিন নম্বরে। নেশার প্রসার তার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় পানশালা বা মদের দোকানের সংখ্যা যত বেড়েছে তার সামান্য ভগ্নাংশেও বাড়েনি নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাঙালি রাজনীতিবিদ বহু চেষ্টায় সমর্থ হয়েছেন "অ্যাল-কোলাহল" তৈরি করে, নেশার চক্রে ছেলে-ছোকরাদের ভিড়িয়ে দিয়ে, তাদের, বিশেষত বাঙালিদের আরও অকর্মণ্য ও অলস করে তুলতে। গাঁজা প্রসঙ্গে একটি কহাবত লাগু আছে দীর্ঘকাল। তা হল "গাঁজা পীয়ে রাজা.... বিড়ি পীয়ে চোর"। ক্যানাবিস বা গাঁজার অপকারী দিকের তুলনায় উপকারী দিকই বেশি। আমাদের শিক্ষকমশাই প্রফেসর জি সি চট্টোপাধ্যায় তার ক্যানাবিস সংক্রান্ত সেমিনারে এই গবেষণার কথা তুলে ধরেছিলেন। আর মদ্য?
মদ্যপানের খরচপাতি অনেকটাই বেশি। হারামের পয়সায় মদ্যপানের কথা অবশ্য আলাদা বাঙালির ধূমপানের নেশা কমেছে (বিশেষত পুরুষদের মধ্যে বিড়ি-সিগারেট) নাকি শোনা যায়, বেড়েছে অন্যান্য মাদকদ্রব্য সেবনের সঙ্গে মদ্যপান। মাত্র কিছু কাল আগেও, আমরা যখন বাম শাসনে ছিলাম তখনি অর্থাৎ সেই আমলেই গ্রামে গ্রামান্তরে মদের দোকান ও মদ পরিষেবা প্রায় কোণে কোণে পৌঁছে গেছে। মদ শিল্পে আজ সাধারণ সাহাবাবুরা ছাড়াও, দারু ব্যবসায়ীদের রমরমা যেন গৃহনির্মাণকারী সিন্ডিকেট সংস্থাগুলিকেও হার মানায়। গ্রাম বাংলার অলিতেগলিতেও তারা "ঠেক" খুলে দিয়েছেন সামাজিক মদ্যপান তথা সোশ্যাল ড্রিঙ্কিং এর ব্যবস্থা। দোল-দুর্গোৎসব-খুশির ঈদ বা ক্রিসমাসে সমাজতন্ত্রের স্বাদ হিসাবে তাঁরা সমর্থ হয়েছেন সুবিধাভোগী এবং মধ্যসত্ত্বলোভীদের মধ্যেও দারু বাসনার সম্প্রসারণে। আমাদের কলকাতা শহর এই আমল থেকেই গুরগাঁও বা পঞ্জাবকেও এক ধাক্কায় পিছিয়ে দেয়।
কতো গেস্টাপোদের (সিন্ডিকেট রাজকর্মীবৃন্দ) তারা বোঝাতে সমর্থ ছিলেনঃ দারুসেবন না করলে, খুল্লাম-খুল্লা মাগী ও মদ্দাবাজ না বনিলে, মার্কসবাদীদের ভবিষ্যৎ কৃষ্ণ গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হইবেক। সেমত যাবতীয় বামুন-কায়েত-বদ্যি মন্ত্রীমহোদয় বা সম্পাদকেরা বামাচার ও কামাচারে জড়িয়ে পড়েন। সুতরাং এই যুগসন্ধিক্ষণের রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের "মদনা"দের আবির্ভাবও সূচিত হইল। বাঙালির এখন মদ-onn চলিতেছে। এহ বাহ্য।
সাহিত্য মহলে বাঙালির নেশা তথা মদ্য পান নিয়ে কিঞ্চিৎ না বললে পক্ষপাতদুষ্টতার শিকার হই যে। বাংলার শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক প্রবোধ বাবুর কথাই ধরা যাক (সান্যাল নহেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)। পরবর্তীকালে সমরেশ বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় অথবা একদা শহর কাঁপানো কবি শ্রদ্ধেয় শক্তি চট্যোপাধ্যায় যাঁদের পানাহার আজ ইতিহাসের পাতায়। আবার তাদের সঙ্গে ঘোরাফেরা, হাঁটাচলা করেও লেখক সমাজে পাত্তা পাননি বা ব্রাত্য হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। সাংবাদিক হামদি বে কে দেখেছি অনেকবার। তাকে ভালোবেসে অনেকেই বলতেন moving barrel, চলমান পিপে। কিন্ত তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন শক্তিশালী। হামদি অবশ্য ছাপরার মানুষ হয়েও বাঙালি হয়ে গেছিলেন। প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে লুকিয়ে মদ্যপান করার ঘটনাও কিছু কম নয়। এই শ্রেণী মনে করতেন পাবলিকলি মদ্যপান লজ্জাকর, নিন্দনীয় অথবা ইমেজ হত্যাকারী। সুতরাং তাঁদের কথা পাঠকের সঙ্গে সাক্ষাতে কখনো বলা যাবে। শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদারদের মত প্রখ্যাত সাহিত্যিকদেরও কিশোরবেলায় দেখেছি, কি ভয়ঙ্কর রকমের চওড়া হৃদয় ছিল তাঁদের আর লিখন ক্ষমতা। সেই সঙ্গে তাঁরা ছিলেন কেবল কেবল ভারতে তৈরি বিলাতি মদ" নয় বঙ্গদর্শনেও বিশ্বাসী। বাংলার দেশীয় মদ বা কান্ট্রি লিকার "বাংলা" নামেই ভারত বিখ্যাত। সেজন্য জাতীয় সংহতি বা National Integration - এ বাঙালির গৌরবের সীমা নেই। দারুপ্রেমীদের "অখণ্ড ভারত" এই বঙ্গভুমিতেই ধরা পড়ে।
একদিন ছিল যখন গরীবগুর্বো, শ্রমজীবী মানুষ ও উচ্চবিত্ত বাবু শ্রেণীর বাঙালিরাই নিয়মিত মদ্যপানে অভ্যস্ত। আজ মধ্যবিত্তও নেশাড়ু। গোয়ালা দুধ বেচে মদ্যপান করে। যৌনকর্মীদের কাছে না গেলেও বহুলোক বাড়িতে বসে সুযোগ পেলেই মদিরায় আসক্তি প্রদর্শন করে। শ্রমিকদের মালিকরা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন একটু দামি মদ্যপান করালেও, তারা বাংলা, চোলাই কিংবা ধেনোই গ্রহণ করে স্বভাবত। বাংলার বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক নাকি মদ্যপান করেই অকালে প্রয়াত হন এমন কথা চালু আছে। শিল্পী রামকিংকরও নাকি সেরকম। আমার মনে হয় এরকম আঙবাঙ কথার কোন অর্থ নেই। যদি কোন বাঙালি মদ্যপান (অত্যধিক) তথা বিষপান করেও অমৃত উগরে দেবার ক্ষমতা রাখেন, আমাদের উচিত তাদের "সাধুবাদ" জানানো। একটা মধুসূদন থাকলে দু-একজন বিদ্যাসাগর থাকতেই হবে। অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ সম্পর্কে সুরাপান বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্যই নেই।