ইন্টারস্টেলার সিনেমায় ক্রিস্টোফার নোলান ফিফথ ডাইমেনসন বলতে কি বুঝিয়েছেন সে নিয়ে নেট দুনিয়া সরগরম। আইভি লীগ ফিজিসিস্ট থেকে শুরু করে নতুন সায়েন্স জার্নালিস্ট, তাবড় চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে শুরু করে চোখে আঙ্গুল দাদা সবাই কিছু না কিছু বক্তব্য রাখছেন - তবে আমার জন্য প্রাপ্তির দিকেই পাল্লা বেশী ঝুঁকে সুতরাং সব বক্তব্যই বেশ মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছি। দেখলাম 'ওয়্যারড' পত্রিকায় জন মুয়াল্লেম আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন মৃত্যুকেও এক হিসাবে টাইম ট্র্যাভেলের সঙ্গে তুলনা করা যায়। সায়েন্স ফিকশনে যে ধরণের টাইম ট্র্যাভেলের কথা পড়ে থাকি তার সঙ্গে অবশ্য এর তফাত আছে - অতীত বা ভবিষ্যৎ এ পৌঁছনোর বদলে এক দিগশূণ্য অনন্তসীমায় পৌঁছনোর কথা এখানে কল্পনা করা যায়, ত্রিমাত্রিক পৃথিবী থেকে সেই স্থবির সময়-মাত্রায় যাতায়াত করা সাধ্যের বাইরে।
কেন সাধ্যের বাইরে সে নিয়ে অবশ্য জন ভেঙ্গে কিছু লেখেননি; তর্কের খাতিরে হয়ত বলা যায় একমাত্র মৃত্যুতেই আমরা এ ত্রিমাত্রিক বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি, ফিফথ ডাইমেনশন যদি থেকেই থাকে তবে সেটা বোঝার জন্য অবশ্যই এই থ্রী ডাইমেনশনের বেড়া ভেঙ্গে বেরনো দরকার। মৃত্যুর পরেও আত্মার অস্তিত্ব আদৌ থাকে কিনা সে নিয়ে তর্কের মধ্যে যাচ্ছি না, কিন্তু জন মুয়াল্লেমের চিন্তাধারাটি বেশ অন্যরকম এ কথা অনস্বীকার্য। আজকের ব্লগপোস্টে এরকমই কিছু আইডিয়ার কথা শোনাবো; হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে এই সমস্ত আইডিয়া মানুষকে ভাবিয়েছে, যদিও প্রথাগত বিজ্ঞানের সূত্র ধরে সে সমস্ত চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করার কথা ভুলেও ভাববেন না। উর্বর কল্পনার রস আস্বাদন করাই হোক আপনার একমাত্র অভিপ্রায়।
২০১৪ তে এসে আত্মার টাইম ট্র্যাভেলের কথা উঠলেও শুরুতে কিন্তু ভরসা ছিল শুধুই মই। বাইবল জানাচ্ছে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য জেকবের দরকার হয়েছিল শুধুমাত্র একটি মই। জেকবের মই নিয়েই অবশ্য ব্যাখ্যা হাজারখানেক - কেউ বলছেন ওই মইতে চড়া মানে সচেতন ও অচেতন অবস্থার মাঝামাঝি কোথাও একটা পৌঁছে যাওয়া, আজকের দিনে 'আর্টিফিশিয়ালি ইনডিউসড কোমা' বলতে যা বুঝি, হয়ত তাই। কেউ বলছেন স্বর্গে পৌঁছনোর আগে নরকদর্শন টা ওই মইয়ে চড়েই করে ফেলতে হবে। অষ্টাদশ শতকের শিল্পী উইলিয়াম ব্লেক অবশ্য সব থেকে চিত্তাকর্ষী ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন - ব্লেকের আইডিয়া অনুসারে জেকবের মইটি প্যাঁচালো, আমাদের কানের ভেতরের জটিল অ্যানাটমির মতনই এ মই ঘুরে ঘুরে উঠেছে। তাই মইয়ে চড়া মানে এক হিসাবে অন্তর্য়েন্দ্রিয়ের উন্মোচন, উচ্চতর জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একমাত্র রাস্তা।
সচেতন-অচেতনের দ্বন্দ্ব বারেবারেই ফিরে এসেছে দার্শনিক, শিল্পী এমনকি অ্যালকেমিস্টদের দেওয়া থিয়োরীতে। বোহেমিয়ার ড্যানিয়েল স্টোলজ ভন স্টোলজেনবার্গের কথাই ধরা যাক, এই বিখ্যাত অ্যালকেমিস্ট বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর মুহূর্তটিতে লড়াই চলে মানুষের সচেতন সত্ত্বার সঙ্গে অবচেতন (অচেতন নয়) সত্ত্বার - সচেতন সত্ত্বাটি লড়াইয়ে হেরে গেলেই চেতনা ডুবে যায় নিকষ, গভীর অন্ধকারে। এই কালো অন্ধকারের মধ্যে দিয়েই আত্মার নির্গমন ঘটে এরকমটি দেখানোর জন্য ষোলোশ-সতেরশ শতকে বহু শিল্পী রূপক হিসাবে আঁকতেন দাঁড়কাক। এবার থেকে হলিউডি হরর ফিল্মে দাঁড়কাক দেখলে মনে রাখবেন বেচারা পাখিটি মোটেই অশুভের প্রতীক নয়, নেহাতই আপনার আত্মাকে বয়ে নিয়ে চলেছে।
ষোলোশ-সতেরশ শতকে টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে ধারণা না থাকলেও অনেকেই বিশ্বাস করতেন মৃত্যু এক ধরণের সরণ, এক বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে আর এক বিন্দুতে পৌঁছনো। আর সেই সূত্রেই বহুদিন ধরে বৃত্তকে ধরা হয়েছে পুনর্জন্ম বা অমরত্বের প্রতীক। 'হ্যারি পটার অ্যান্ড ডেথলি হ্যালোজ'-এ ডেথলি হ্যালোজ এর প্রতীকটি মনে পড়ছে? ত্রিভুজ, ত্রিভুজের একটি মধ্যমা এবং ত্রিভুজের অন্তর্বৃত্ত - অন্তর্বৃত্তটি বোঝাত রেজারেকশন স্টোন কে অর্থাৎ যে যাদুপাথর ব্যবহার করে আবার বেঁচে ওঠা যাবে। সপ্তদশ শতকে ফিলোথিয়াসের 'সিম্বলা ক্রিস্টিনা' তে দেখতে পাচ্ছি এই অনন্ত বৃত্তকে। তারও আগে অবশ্য জার্মান শিল্পী ড্যানিয়েল ভন জেপকো দাবী করেছেন ত্রিভুজের বহির্বৃত্তের কেন্দ্রেই আদি ব্রহ্মের অবস্থান, যে কোনো সচেতন মানুষের উচিত ওই কেন্দ্রবিন্দুতে লক্ষ্য স্থির রাখা। যাই হোক, অমরত্বের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। মধ্যযুগের বহু ধর্মবিদ বিশ্বাস করতেন অমরত্বের কল্পনা অবাস্তব তো বটেই, উপরন্তু এ নেহাতই শয়তানি প্রতিশ্রুতি - আত্মাকে বিকিয়ে দেওয়া বই কিছু নয়। তাই অমরত্বের বৃত্ত এনাদের কাছে দেখা দিল এক নতুন প্রতীকে।
প্লেটো আবার বললেন উলটো দিকটাও ভাবা দরকার - যারা ভাবছেন একবার মরেই বেঁচে গেলেন তাদের জন্য প্লেটো রীতিমতন দুঃসংবাদ বয়ে এনেছেন। প্লেটোর হিসেব মতন হাজার বছর ধরে আপনার আত্মা ঘুরে বেড়াবে অনন্ত ব্রহ্মে বিলীন হওয়ার আগে, আর ওই হাজার বছর ধরেই জন্ম-মৃত্যু বৃত্তাকারেই ঘুরে আসবে। আসা এবং যাওয়ার চিরন্তন প্রবাহ বোঝাতে গিয়ে মধ্যযুগীয় বিদ্বজনরা অবশ্য শুধু বৃত্ত নয়, অগুন্তি আরো জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাহায্য নিয়েছেন। আর একটি কৌতূহলোদ্দীপক নকশার কথা বলি - মই!
আবার মই? কি বলি বলুন, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে মই নিয়ে সে সময় ভারী উৎসাহ ছিল - সত্যজিত রায়ের ট্রেন যেমন অপু-দুর্গার কাছে বৃহত্তর পৃথিবীর প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছে সেরকম ভাবেই হয়ত ঊর্ধ্বগামী মই দেখলেই লোকে দো'তলা তিনতলা ছাড়িয়ে সোজা ছায়াপথের কথা ভাবতে শুরু করতেন। যাই হোক, এ মই নিয়ে এসেছিলেন ইংলিশ চিকিৎসক রবার্ট ফ্লাড। ফ্লাড অবশ্য শুধু চিকিৎসক নন - জ্যোতিষী, গণিতবিদ, অতিপ্রাকৃত-বিশারদ, একই অঙ্গে অনেক রূপ। ফ্লাডের তত্ত্ব অনুযায়ী মইয়ে উঠে গুনে গুনে ঠিক ন'টি সিঁড়ি চড়লেই আপনার আত্মা পৌঁছে যাবে সূক্ষ্মতর ব্রহ্মান্ডে, কিছু সময় বিশ্রাম, তারপর ফের পাশে রাখা দ্বিতীয় মই দিয়ে নেমে আসা। আবারো জগৎসংসারের ঠ্যালা সামলানোর পালা, তারপর ফের মইয়ে চড়া। ফ্লাডের যেহেতু অঙ্কে ছিল বিষম উৎসাহ, উনি দাবী করেছিলেন এই ন'টি স্টেপ নেহাত গাঁজাখুরি ব্যাপার নয়। রীতিমতন পাইথাগোরিয়ান গণিতের সাহায্য নিয়ে তৈরি হয়েছে এ মই, প্রতিটি সিঁড়ি কতটা চওড়া, কতটাই বা লম্বা সবেরই ফিরিস্তি দেওয়া যাবে অঙ্কের হিসাবে।
পাইথাগোরাস (বা পিথাগোরাস) জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কম চর্চা করেন নি, পাইথাগোরাসের সব গবেষণা একত্র করে প্লেটো একটি বই লিখেছিলেন - 'টাইমিয়স'। তো সেই টাইমিয়স বইয়ের একটি প্রধান বিষয়বস্তু হল ল্যাম্বডা। ল্যাম্বডা তো জানেনই কি বস্তু, প্লেটোর বইয়ে ল্যাম্বডা কিন্তু শুধু একটি গ্রীক বর্ণ নয় - গাণিতিক বিস্ময়। প্লেটো এবং তৎকালীন বহু দার্শনিক বিশ্বাস করতেন জাগতিক বিশ্বের স্রষ্টা ( যাঁর নাম ডেমিয়ারজ) বিশ্বব্রহ্মান্ড বানাতে গিয়ে ব্যবহার করেছেন একটি বিশেষ গাণিতিক সূত্র। এ সূত্র পরে ফিরে এসেছে সঙ্গীতের সরগমে।
স্বরমূর্ছনা বা আরো সহজ করে বললে গানের স্কেল নিয়ন্ত্রিত হয় সংখ্যার অনুপাতের হিসাবে। গ্রীক বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখিয়েছিলেন ওপরের দশটি সংখ্যাই এই অনুপাত গণিতের প্রধান চরিত্র। প্লেটো বললেন (যদিও প্লেটোর বক্তব্য অনুযায়ী আদতে বলছেন পাইথাগোরাস) শুধু সঙ্গীত নয়, জন্ম-মৃত্যু-পুনর্জন্ম এই চক্রটিকে বুঝতে গেলেও ওই সংখ্যাগুলিই ভরসা। সংখ্যাগুলিকে 'টাইমিয়স' বইতে এমন ভাবে সাজালেন যে দুই এবং তিন এর উচ্চতর বর্গগুলি যেন ত্রিভুজের দুই বাহু ধরে নেমে এল, আর মনে হল ঠিক যেন ল্যাম্বডা অক্ষরটিই উঠে এসেছে - বিশেষ এক জ্যামিতিক আকৃতির জন্য এর নাম ল্যাম্বডা টেট্রাকটিস।
টেট্রাকটিস তত্ত্ব অনুযায়ী অনাদি কাল ধরে আত্মার যাতায়াত চারটি স্তরেই সীমাবদ্ধ (৮-২৭, ৪-৯, ২-৩ এবং ১)। চতুর্থ স্তরে (৮-২৭) আত্মা জাগতিক পৃথিবী এবং দেহের মধ্যে আটকে, পঞ্চেন্দ্রিয় যা যা অনুভব করছে সম্ভবত সে সব কিছুই ভৌতবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব । দ্বিতীয় স্তরটি সূক্ষ্মতর - এখানে আত্মা শরীরের ঘেরাটোপে আটকে নেই, স্বভাবতই ভৌতবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাও খাটবে না । বলা বাহুল্য যে তৃতীয় স্তরটি দ্বিতীয় এবং চতুর্থর মাঝামাঝি অবস্থিত, যেখানে আত্মা যা ছিল থেকে যা হতে চলেছে এরকম একটি ট্র্যানজিশন পিরিয়ডে রয়েছে (সম্ভত 'near death experience' ধরণের কিছু বোঝাতে চেয়েছেন প্লেটো) । আর প্রথম স্তরটি হল গিয়ে সুপ্রীম, সেখানে কি আছে, কি নেই, কি হয়, কি হয় না এ নিয়ে চিন্তা করার মতন স্কিলসেটই আমাদের নেই।
ইহুদী ধর্মমত কাবালাতেও এই টেট্রাকটিস দেখতে পাই আমরা, সেখানে অবশ্য এর নাম 'ট্রি অফ লাইফ'। আরো বলা হয়েছে টেট্রাকটিসের প্রতিটি বিন্দুতে আত্মচেতনার উপলব্ধি আলাদা আলাদা , আপনি চতুর্থ স্তরে থেকেও ৮-এ আছেন নাকি ২৭-এ সেটাও দেখার বিষয়। কল্পনাকে আরেকটু লাগামছাড়া হতে দিলে মনে হতেই পারে এ নেহাতই 'মাল্টিভারস থিয়োরী'র-ই আরেক রূপ, একই সময়ে একাধিক বিশ্বে থেকে যাচ্ছে একাধিক আমি। আর যদি চতুর্থ থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে দ্বিতীয়ে উত্তরণ ঘটে? আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় আপনি ডাইমেনসনের বাধা টপকে এগোচ্ছেন।
আধুনিক অতিপ্রাকৃতবিদ রা আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন ল্যাম্বডা টেট্রাকটিস নিয়ে বিজ্ঞানীদের আরেকটু মাথা ঘামানো উচিত, ওর মধ্যেই লুকিয়ে আছে সার সত্য। কেন বলুন তো? সুপারস্ট্রিং থিয়োরীকে ভ্যালিড দেখাতে গেলে দরকার দশটি ডাইমেনসন, টেট্রাকটিস-ও তো তাই বলছে!
বিজ্ঞানীরা আদৌ মাথা ঘামাবেন কিনা জানি না তবে কল্পবিজ্ঞান লেখকরা ভেবে দেখতে পারেন; সত্যি বলতে কি ইন্টারস্টেলার-ও দিনের শেষে নিছক কল্পবিজ্ঞানই, কিছু জায়গায় তো ফিকশন নয় ফ্যান্টাসি পর্যায়েই পৌঁছেছে - না হলে আর ব্ল্যাক হোলের মধ্যে দিয়ে হৈ হৈ করে নেমে আসা যায়?