জর্জ অ্যাকেরলফ্ মানুষটির আমুদে চেহারাটা দেখলে মনে হয় বেশ হাসতে হাসতেই বাজার অর্থনীতির চৌহদ্দিতে একটা বোমা ফেলে দিয়েছিলেন।প্রথমে অবশ্য লোকজন বেশি পাত্তা দেয়নি আগুনে অঙ্কের তীব্র বিস্ফোরণ নেই দেখে; গণ-বুদ্ধি-বুদ্বুদের বুজকুড়ি যখন কাটতে শুরু করল তখন অবশ্য মনে হল "ওয়েপন অফ্ মাস ডেস্ট্রাকশন' কথাটা নেহাত বুজরুকি নয়।আদত কথাটা কি? এই ধরুন আপনি একটা গাড়ি কিনতে চান; কিন্তু যিনি বেচবেন তিনি যে একেবারে ধর্মপুত্র এ কথা মনে করার কোনো কারণ আছে কি? সাজিয়েগুজিয়ে একটা রদ্দিমাল আপনাকে ধরিয়ে দিলে আপনি বুঝবেন কি করে? ভেবে দেখুন এই ধুকপুকুনি ৮০-র গড়িয়াহাট থেকে ২০১০-র সাউথ সিটি মলে আপনার সঙ্গে সঙ্গে ছিল কিনা? অ্যাকেরলফ্ দেখালেন বাজার এই রদ্দিমালে ভরে গেলে ভালো জিনিস পুরোপুরিই হটে যেতে পারে, যদিও বাজে জিনিসের দামটা বেশ সস্তাই পাবেন (টুপি পরাতে গেলে দামটা স্বভাবতই কম রাখা শ্রেয় যদিও খেয়াল রাখবেন দামটা দেওয়ার সময়েও জানেন না লটারি লাগল কিনা)।এই একতরফা ইনফরমেশনের আধিক্য কতশত বার যে ক্রেতা-বিক্রেতা, দাতা-গ্রহীতা দের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দ্যায় তার সাতকাহন নিয়েই আস্ত বই হয়ে যায়।পরের বার ব্যাঙ্ক লোনের চড়া সুদ মেটানোর সময় ভেবে দেখতে পারেন কেন আপনার শ্রীমুখটি দেখেও ব্যাঙ্ক ম্যানেজার টলছেন না - উত্তর লুকিয়ে আছে ঐ পচা লেবুর মধ্যেই(ঐ যা:, বলতে ভুলে গেছি যে দু'নম্বরী গাড়ির মার্কিনী পরিভাষা হল "লেমন')। আর হ্যঁ¡, "বছরের শ্রেষ্ঠ' বাংলা চলচ্চিত্রটি দেখতে দেখতে যখন অযুত নিযুত বারের জন্য ভাববেন সত্যজিত-অপর্ণার দরকার নেই, পীযূষ বোস-অরবিন্দ মুখার্জ্জীদের পেলেও বর্তে যেতাম তখনও বাস্তবটা চেনার জন্য ভরসা ওই পচা লেবু।
একটা কথা প্রায়ই শুনি - চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে কলকাতার আর মফস্বলের(ও তাবত্ বাংলার)রসগ্রাহিতার নাকি বেজায় ফারাক (এ প্রসঙ্গে পরে আসছি)। আর তাই বক্সঅফিস বাঁচিয়ে রাখার জন্য ভরসা নন্-আঁতেল ছবি; যেখানে ভাল গল্প,নিটোল চিত্রনাট্য আর সাবলীল অভিনয়ের অভাবকে দমিয়ে রাখতে পারে বলিউডি আইটেম নাম্বর, দাক্ষিণী অ্যাকশন (ইদানিং দাক্ষিণী গপ্পোও) আর পাশ্চাত্ত্যর সমুদ্রতট।সময় সময় পরিচালক আরেকটু স্ট্র্যাটেজাইজ করেন নিজেকে "ডাউন টু আর্থ' রেখে - এঁদো গলি, পাড়া ক্রিকেট আর ফুচকাওলার গামছা দেখিয়ে; কিন্তু গল্প-অভিনয়-চিত্রনাট্য দেখলে হাতে রইল সেই পেন্সিল। আপনি বলবেন "বাজার যার, মুলুক তার - বাজারে ডিমান্ড থাকলে আলবাত্ বানাবে, আপনার নিক্তিতে সেটা ভাল অভিনয় হল কিনা সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না'। হক্ কথা, কিন্তু এটাও তো সত্যি যে কোয়ালিটি ডিমান্ড বাড়ায়। আমরা কি তাহলে ধরে নেব- বাংলা সিনেমার বাজার স্যাচুরেটেড? "বিশ্ব পরিবেশনা' টা নেহাতই কথার কথা সেক্ষেত্রে, আদতে বৈদ্যবাটি ছাড়িয়ে যেতে পারলাম না।কিন্তু এহ বাহ্য, আসল কথাটা চাহিদা নয়, যোগান নিয়ে। এই প্রসঙ্গেই পচা লেবুর কথা বলছিলাম - রদ্দি সিনেমার ছড়াছড়িতে ভালো ছবির বাজারটাই হারিয়ে যাওয়া।এখানে প্রাইমারি ভিকটিম কিন্তু আপনি (দর্শক) নন।কোয়ালিটি নিয়ে যদি নাছোড়বান্দা হন, তাহলে একবার ঠকবেন, হয়ত দু'বার কিন্তু তৃতীয়বার আর হলমুখো হবেন না।আপনাকে নিয়ে সমস্যা নয়, সমস্যা প্রযোজকদের নিয়ে।বাঁধা গত- চেনা ছক - সরল সাফল্য ব্যাপারটা এতই প্রলোভনীয় ওনাদের কাছে, মধ্যমানের পরিচালকরা হয়ত "গেমচেঞ্জার'দের এই বাজারে ঢুকতেই দিচ্ছেন না।তাহলে উপায়? অর্থনীতিবিদদের দাওয়াই - "স্ট্রং সিগনাল্' (যেমন ওয়্যারান্টি বা ক্রেডিট স্কোর রিপোর্ট)। ওই একই লাইনে আমি বলি "ষাঁড়ের গুঁতো'। এটা বুঝতে আমাদের একটু পশ্চিম পানে তাকানো উচিত।
আঞ্চলিক চলচ্চিত্র জগতে মারাঠি সিনেমার ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের কিছু শিক্ষা দিতে পারে হয়ত।যে সিনেমা ৩ কোটির ব্যবসা করছে স্থানীয় বক্সঅফিসে, সেটিই আবার প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে - সুখের কথা একাধিক মারাঠি সিনেমা এই গোত্রে পড়ে।লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল প্রায় সব কটি সফল সিনেমারই একটি নির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজি আছে - "আউট অফ্ দ্য বক্স' কাহিনীসূত্রকে একটি সাবলীল চিত্রনাট্যে ফেলে ভীষণ ঘরোয়া একটি পটভূমিকায় উপস্থাপন করা।এর ফলে তথাকথিত "নেইভ' দর্শকদের সঙ্গেও পরিচালকের কোনো দূরত্ব তৈরী হয় না; প্রেক্ষাপটও এমন যে পেশাদার অভিনেতার অসংলগ্ন অভিনয়ের সুযোগই নেই। এমনই একটি সিনেমা হল "ভালু'(দ্য বুল্) - এই গল্পের প্রটাগোনিস্ট একটি ধর্মের ষাঁড় (আক্ষরিক অর্থেই); নিরুপদ্রব একটি গ্রামে (যেটি আসলে অচলায়তনের প্রতীক)এর উপস্থিতি ধুন্ধুমার কান্ড বাধিয়ে তোলে।গ্রামবাসী থেকে শহুরে সরকারী বড়কর্তা, যে গুঁতো খেয়েছে আর যে খায়নি, যে স্বচক্ষে দেখেছে অথবা যে শুধুই গুজব রটাচ্ছে সবাই এই উটকো ঝামেলায় বিব্রত।আপাততুচ্ছ একটি ঘটনা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ,রাজনীতি ও কুসংস্কার নিয়ে গ্রাম্য চাপানউতোর মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফুটে ওঠে পর্দায়।মারাঠি দর্শকের গ্রহণক্ষমতা কত সে নিয়ে কোনো বক্তব্যপ্রকাশের অবকাশই থাকে না। আসলে কি জানেন তো, ওই কথাটাই যুক্তিহীন। মফস্বলি দর্শককে প্রধান্য দিয়ে প্রকারান্তরে তাঁদের আন্ডারএস্টিমেট করাটা পরিচালক- প্রযোজকদের ব্যর্থতা। সিনেমা বাদ দিন, বাংলা সাহিত্যে মানব জীবনের চরম টানাপোড়েনগুলো যাঁরা আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তাঁদের মধ্যে মফস্বল আর বহির্কলকাতার লোক কম? গুনতে শুরু করলে হয়ত কলকাতার ভাগেই কম পড়বে,তাই ওই কাজটা নয় এখানে করলামই না। ফিরে আসি ষাঁড়ের গুঁতো-য়। "ভালু',"গন্ধ', "শ্বাস' বা "তিঙ্গ্যা' যে কাজটা মহারাষ্ট্রে করেছে সেটা আমাদেরও দরকার। আক্ষরিক অর্থেই ষাঁড়ের গুতো (বা সাহেবী কেতায় "বিগ্ পুশ') দরকার চেনা ছকের অচলায়তন ভাঙ্গতে।যদিও ওই "স্ট্রং সিগনাল্' দিতে গেলে কিছু শিক্ষালাভ বাঞ্ছনীয়। প্রযোজকদের চোখ থেকে ঠুলিটা খুলে দেওয়ার জন্য দরকারী চিত্রনাট্যও লিখতে শেখা দরকার, দরকার ভালো সংলাপের।বাজারচলতি স্যাম্পল দেখে মনে হয় টলিউডের কম পরিচালকই সেটা অনুধাবন করেন।হাতে-কলমে কাজ শেখাটাও একইরকম জরুরি কিন্তু গল্প-চিত্রনাট্য যথোপযুক্ত মর্যাদা না পেলে সেই শিক্ষানবিশীর লাভ কি?কিন্তু শুনতে সহজ হলেও কাজটা কঠিন; "থোড় বড়ি খাড়া, লিখে তাড়া তাড়া' এখন কি আর কলম সহজে মোড় ঘুরতে চায়?
মোড় ঘোরার আগে একটা প্রাসঙ্গিক আলোচনা দরকার - সত্তরের টলিউডও যেখানে পর পর "নিশিপদ্ম', "থানা থেকে আসছি', "এখানে পিঞ্জর', "ধন্যি মেয়ে'র মতন সিনেমা দিয়েছে সেখানে বছর তিরিশের মধ্যে "পিওর আর্টহাউস' আর "পিওর ট্র্যাশ' এই dichotomyতৈরি হল কি করে? মার্জনা করবেন "পিওর ট্র্যাশ' শব্দসঞ্চয়নের জন্য কিন্তু এই মুহূর্তে পলিটিক্যালি কারেক্ট হওয়ার কোনো দায় নেই আমার।হাতে গোনা ব্যতিক্রম আছে কিন্তু সেগুলো থিয়োরিটার ভিতটাই জোরদার করে। আরও একটা কথা, সিনেমার নামগুলো এমনি নেওয়া নয়, একটা যোগসূত্র আছে। এই সব কিছু নিয়েই পরের কিস্তি।