এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • রানির কথা, নীতার কথা

    তরুণ বসু লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১০ মার্চ ২০১৪ | ৬৩১ বার পঠিত
  • রানির কথা

     বড় অদ্ভুত জীবন রানির। আর পাঁচটা গাঁয়ের মেয়ের মতন মানুষ হওয়া রানি বিয়ের তিনমাসের মধ্যে বিধবা হয়। আর দুঃস্বপ্নের মধ্যে সেই সময় সে অনুভব করেছিল, স্বামী তার কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে শুধু রানির জীবন যন্ত্রণা।

    বলেছিল রানি , শ্রাবণে বাবা বিয়ে দিয়েছিল। কথা ছিল বাবা পণ দেবে। কিন্তু তার দরিদ্র বাবা কোনোভাবেই সেই পণের টাকা জোগাড় করতে পারেনি । সেই গঞ্জনা শ্বশুরবাড়িতে তো ছিলই তার মধ্যে বড় পূজোর আগেই স্বামী মারা গেল।

    কি হয়েছিল?

    সাপে কেটেছিল।

    আর তারপর" --শ্বশুরবাড়ির লোকজন পূজোর মধ্যেই অলক্ষী  অলক্ষী বলে সটান  বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

    ফেলে যাওয়া বাড়িতে ফিরে অনুভব করেছিল রানি যে খেতে পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা এখানে নেই। বাবা তো ঝালমুড়ি বিক্রি করত ট্রেনে ট্রেনে । পাঁচটা ভাইবোনের মধ্যে বড় রানি। এদিকে বাড়ি ফেরার পর মাও মরে গেল । এক অদ্ভুত নিস্পৃহতায় রানি কথা বলছিল।

    কী করব তখন! সেই পনেরো বছর বয়সেই পাড়ার লোকে ডাইনি বলে ডাকত। এই সব কারণে রানির ওপর ঝাড়ফুঁকের বন্দোবস্ত হয়েছিল কিছুদিন। সে অসহ্য যন্ত্রণার দিনগুলো ---" না না বাবা যে আমায় দেখতে পারতনা তা নয়--তবে ঐ--ও ই পাড়ার লোক!তারাই তো কানে মন্তর দিয়ে বাবাকে ওঝা আর ঝাড়ফুঁকের ব্যাবস্থা করেছিল। তবে কেউ একথালা ভাত দেয়নি--সেই ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারার---!

     কথাটা শুনে আমার মনে হয়েছিল , মাত্র পনেরো বছর বয়সে গ্রাম্য মেয়েটি সমাজের এই নিষ্ঠুর মহত্ত্বের কথাটা বুঝে গিয়েছিল।

    না, অমি জিজ্ঞেস করিনি রানি কে কি করে এলে এই সোনাগাছি তে। বরং বলেছিলাম  একটু ইতিবাচক ভাবে, তা'হলে ভালই আছ।

    তৎপর রনির উত্তর ছিল, "এখনও খারাপ নয় তবে ভবিষ্যতের কথা জানিনা। আর শেষের দুটো ভাইবোনকে মানুষ করে তুলতে চাই;

    কতই বা বয়েস হবে রানির --তিরিশের নীচেই। পাঁচ-ছ বছর ধরে পেশা করে ও এই ভাবেই দেখতে শিখেছে চারপাশকে। এখন ওর বড় আক্ষেপ একটা সন্তানের। ওর বাবুর কাছে মাঝে মাঝে আব্দার করে   একটা স্ন্তান চাই বলে , কিন্তু-  স্বামীর দেয়া যন্ত্রণা বলে ভেবেছিল যাকে সে তো পেটেই মরল  কী জানি সেই পাপেই কিনা! কি যে কপাল!

    ভাইবোন মানুষ ক’রে আর ওর বাবুকে নিয়ে বেশ সুখেই আছে রানি। নারীর ক্ষমতায়নের এক অদ্ভুত যুক্তি ও দেয়।

    জানতে চেয়েছিলাম  " তোমার বাবুই তোমার সব কথা শোনে , না তুমি বাবুর সব কথা শোন"

    বল্ল" কক্ষনো না, ওর সব কথা আমি শুনিই না। বরং ঐ আমার কথা শোনে। শুনবে নাই বা কেন ? আমি কি রোজগার করিনা!না আমি ওকে পয়সা দিইনা!"

    হ্যাঁ, আর্থিক ক্ষমতা ছাড়া যে কিছুই হয়না সেটা অর্থাভাবে রানি ঠাহর করতে পারেনি কিন্তু আজ --এই পয়সার মুখ দেখা সময়ে বরং ও পয়সার মাহাত্ম্য অনেক ভাল বুঝতে পারে।

    সত্যি তো , কোথায় গল্প! সমাজের আর পাঁচটা পেশ যেমন চলে ভালোয়-মন্দয়, তেমনই।কোনো শ্রমিক কিম্বা ব্যাঙ্কের কেরানির কাছে তো জিঞ্জেস করা হয়না " তুমি এই পেশায় কেন এসেছ?"

    আসলে জীবনের অনেক সত্য লুকিয়ে থাকে পাতার আড়ালে, ঢাকা পড়া শিশিরের মতো। দেখতে হয় নিবিড় মনোযোগে তবেই বোঝা যায় এই রানিদের কথা। ওরা আসলে উজ্জ্বল নক্ষত্রদের মাঝখানে থাকা ভ্রষ্ট সময়। যে সময়ের কোনো মূল্য নেই, যতক্ষণ না ঐ কৃষ্ণগহ্বর পেরিয়ে সে নিজেই নিজেকে জানান দিতে পারছে !!

    নীতার কথা

     নীতা এক নারী। যে তার নারী জীবনের ছন্দহীনতাকে ছন্দময়তায় পরিবর্তনে আগ্রহী। সাঁঝবেলায় ঘরে ফেরার টানে যখন ছুটতে থাকি---প্রতিদিনই দেখি--সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে নীতা। এবং নীতারই মতন আরও অনেক জন। একসঙ্গে। ওখনেই দাঁড়িয়ে ওরা ওদের খদ্দের ধরে। ইশারায় অনেকদিনই ও জানতে চেয়েছে --কি বাড়ি ফিরছ? আর আমিও একটু হেসে চলতে চলতে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে চলে গেছি।

     সেদিন তেসরা মার্চ। নীতাকে দেখলাম দুটো বাচ্চার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।আমার ব্যাস্ততার ফাঁকেও জিজ্ঞেস করি  টানছ কেন ওভাবে? নীতা বলে

    ছেলেগুলোকে মানুষই করতে পারলামনা--

    এই নীতারাও একটা তলের মানুষ, একটা সামাজিক তলের মানুষ  এবং সমাজের সবথেকে নীচের তলের। ওদের মাথার ওপর খাড়াই পাহাড়--ওপরে অববাহিকা। সেখানে থাকে সমাজের মাথারা। নীচের তলার এই মানুষগুলি জীবনের অনেক অনাকাঙ্খাগুলো নিয়ে এক তীব্র আবেগে আর অসন্তোষ নিয়ে বাঁচার তাগিদ খোঁজে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে ভবিষ্যত সুখের আশায়।

     নীতার দুটি ছেলে। সমাজ সংসারে আর কেউ নেই--জানতে চেয়েছিলাম 

    তোমার বাড়ি কোথায় ছিল?

    বলেছিল কেন--এই রবীন্দ্রসরণিতেই! বলি না না তো্মার বাড়ি কোথায় ছিল?

    ও বলে কোথাও না !আমি একটু দ্বন্দ্বে পড়ে বলি ,

    না না আগে কোথায় থাকতে?

    বেশ অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিল নীতা--

    চলার পথে কোথা থেকে এসেছি  কোথায় যাব সে কি কেউ জানে!

    আমি একটু অবাক অহি। আমার মনে পড়ে যায় টম হ্যাংকসের অভিনীত  ফরেস্ট গাম্প ছবির শুরুর দৃশ্যটার কথা। একটা পালক উড়তে উড়তে কোথায় চলেছে কেউ জানেনা। এমনকী পালকটাও নয়। নয়ক টম একটা পার্কের চেয়ারে বসে বলে চলছিল তার জীবনের কথা। শুধু কিছু সময় পরপর তার শ্রোতা পরিবর্তন হচ্ছিল। কি অদ্ভুত মিল। আসলে জীবন বোধহয় এইরকমই।

     অনেক কথার পর নীতা বলেছিল  হ্যাঁ জন্মেছি যখন বাবা-মা বাড়ি-ঘর-দোর কিছু তো ছিলই। তারপর ঘুরতে ঘুরতে এখানে যখন এসেছিলাম, পেশা করে যখন সংসারটা দাঁড়াচ্ছিল তখনো বাড়ি যেতাম। বাবা মাকে টাকা পয়সা পাঠাতাম। বাড়ি যখন যেতাম বাবুকে বর সাজিয়ে নিয়ে যেতাম সঙ্গে। একবার হল কি আমাদের গাঁয়ের  এক ধনীর দুলাল একটু ফুর্তি করতে এখানে এসেছিল   আমাকে দেখেও ফেলেছিল। যদিও আমি চেনা দিইনি । তারপর যখন বাড়িতে গেলাম  দেখলাম নানাভাবে বাবা মাকে অত্যাচার করতে শুরু করেছে গাঁয়ের মাথারা। আমাকে বাড়িতে দেখেই ওরা সেদিনই পাড়ায় সালিশি সভা বসিয়ে দিল। সেখানে সাব্যস্ত হল আমি খারাপ মেয়ে।  আমিও গেলাম খুব রেগে। ভাবলাম আমি এখানে থাকিনা  কারুর খাই ও না পরিও না   তবু কিনা আমার বিচার !সভায় দাঁড়িয়ে বলে দিয়েছিলাম, যা করেছি বেশ করেছি। যে আমায় দেখেছে সেও তো ওখানেই যায়। তাহলে তার কেন বিচার হচ্ছেনা?

    এরপর আর আমায় গ্রামে টিঁকতে দেয়নি। বাবা মাও আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি।। যাকগে সেসব কথা।

    আমি একটু চুপ করে থাকি, ভাবি আড়াল করা মিষ্টি মুখেও কী জেদ আর দৃঢ়তা । অথচ এমন শক্ত প্রতিবাদ আমরা যারা তথাকথিত ওপরতলায় বাস করি তারা করতে পারিনা। পারি না বোধহয় আমাদের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জড হবে বলে। আর নীতা একজন যৌনকর্মী, সমাজের সব থেকে নীচু তলার একজন তার মধ্যে কত সহজে এমন স্বাভাবিক প্রতিবাদ উঠে আসে।

    ঠিক। যে তলে দাঁড়িয়ে নীতার প্রতিবাদ সেখান থেকে নীচে পড়ার ভয় আর ওর নেই ।ওদের দাবিয়ে না রাখলে তাই একদিন ওরা এই সৌধটাকে ভেঙে দিতে পারে। সমাজের ওপরতলার মানুষেরা ওদের নষ্ট চরিত্র অ্যাখ্যা দিয়ে অনেক ধরণে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করে ওদের জীবন ওদের মানসিকতা। যাতে পরিবর্তনের হাওয়াটা ওদের দরজায় কড়া না নাড়ে !! চেষ্টা হয় যাতে ওরা কোনোদিন সচেতন না হয়। কারণ সচেতন হলে ওদের রাজনৈতিক অধিকার খানিকটা হলেও দিতে বাধ্য হয় সমাজ।  কিন্তু এই অবস্থাটা সত্যি আর বেশি দিন চলবে না।

    ওরা তৈরি হচ্ছে।।

    দুর্বারের ‘ভিন্ন নারী অন্য স্বর’ থেকে নেওয়া


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১০ মার্চ ২০১৪ | ৬৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন