(১ম)
ঊনিশশো সাতান্ন কি আটান্ন সালের কোন সন্ধ্যা। হয়তো ফাল্গুন, বৈশাখ অথবা এমনই কোন বিবাহের মাস। সন্ধ্যায় রেডিওতে খবর পড়ছেন বিজন বোস। ক্লাস সেভেনের আমি একই টেবিলে বসে কারক বিভক্তি মুখস্থ করতে চেষ্টা করছি। এমন সময় পল্টুদার প্রবেশ। মুখে হাসি। পরনে হলুদ পাঞ্জাবী। পকেটে খাঁটি ক্ষীরের প্যাঁড়া। হাতে একটি খেয়া অথবা হতে পারে শিশু ভোলানাথ। আমার জন্যে, মাইনের টাকা থেকে কিনে আনা উপহার- খুকুকে পল্টুদা। আমার থেকে বছর কুড়ি কি বাইশ বছরের বড় দাদা আবদার এবং আদেশে ডগোমগ- “খুকু, একটা নিমন্ত্রণের লিস্টি কর। বরযাত্রী যাইব সব। পোলাপান কেউ বাদ না পড়ে। বউভাতের ফর্দটাও কইরা দেখা। লাউঘন্ট রাখিস, ধইন্যাপাতা দিয়া।” পল্টুদারই সমবয়সী আমার মেসোমশাই একখানা ব্যাগ হাতে বোধ হয় র্যাশন তুলতেই চলেছিলেন। বলেন “কার বিয়া রে পল্টু? মাইয়া ঠিক হইছে?” মুখে চাপা হাসি। পল্টুদা প্রত্যয়ী- “ক্যান, আমার। হইতে পারে না?”
তখন অন্য কাল। আমাদের ছোট শহর। কলিং বেলের নাম কেউ শোনে নি। গল্পের বইতে পড়ি কলকাতায় অতিথিরা কড়া নাড়ে। আমাদের শহরে কেউ অতিথি নয়। সবাই সবার কুটুম। সবার জন্য সব দ্বার অবারিত।
আমি খুশি। গুরুদায়িত্ব পালন করছি। বরযাত্রীর লিস্টে ভুল না থাকে। বৌভাতের ফর্দে লাউঘন্ট, নিজের প্রিয় কাঁঠালবিচি দিয়ে বড় চিংড়ি। মা’র আমার বড্ড পড়া পড়া বায়ু। তখন ছেলেরাই আলাদা পড়ার টেবিল পায়। তাও কয়েক ভাই বা মামা কাকা ভাগাভাগি করে। মেয়েরা মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছে। মানুষ হবার জন্য তাদের তত আয়োজন বিশেষ কেউ ভাবে না। কিন্তু আমার মা’র খুব ইচ্ছা আমি এম এ পাশ করে প্রফেসর হবো। আমার কপাল খারাপ বলেই এমন মা। মা পল্টুদাকে আমার বিদ্যালাভের অন্তরায় বলেই ভাবেন। ছড়া লিখে, গল্পের বইএর জোগান দিয়ে আমার মনকে পাঠ্যবইবিমুখী করছে সে, এই মায়ের ধারণা। মাকে দেখেই ফর্দ এবং লিস্টি আমি দাদুর চৈতন্যভাগবতের মলাটের তলায় গুঁজে রাখি।
সামনে অঙ্কখাতা। মনের মধ্যে পল্টুদার বিয়ের ছবি। টোপর মাথায়। পল্টুদা আমাদের শহরের সৌমিত্র। ওইরকমই একমাথা চুল। লম্বা। অমলিন হাসি। আর রঙ? একদম হলুদ ফর্সা। অপুর সংসার সাদাকালো ছবি। আসল সৌমিত্রের রঙ আমরা জানি না। তার বউ শর্মিলা ঠাকুরের মতো না হোক অনেকটা ওরকমই হবে। এই সব পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে অঙ্ক আর হয় না। না হোক।
(২য়)
বছর যেতে আর কি? আমরা এখন বড় হয়ে গেছি। আমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি জুটেছে। ওদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তিন ভুবনের পারে বলে একটা ছবিতে কি ইনোসেন্ট এক মস্তানের রোলে কী অসাধারণ অভিনয় করেছেন! তনুজা তাঁর শিক্ষয়িত্রী স্ত্রী। পল্টুদা অবশ্য মস্তান হতে পারে নি। তবে সুন্দরই আছে। সাধারণ একটা সরকারি চাকরি করে। পাত্র হিসেবে তেমন কিছু নয়, তবে বিয়ের আশা ছাড়ে নি। মা বাবা তো নেই। ধনমাসীমা বলে এক ধনবতী মাসীর পালিত পুত্র। ধনমাসীমা বলেন “জন্মকালে মা-হারা দুর্ভাগারে কে আর মাইয়া দিবো।” আমরা ভাবি আহা, পল্টুদা সাহিত্য ভালবাসে, মিশুকে, পরোপকারী। কেউ না কেউ ভালবাসবেই ওকে। কিন্তু তেমন কেউ দেখা দিল না।
আমার বিয়ের রাত। পল্টুদা নেমন্তন্ন খেয়ে পান মুখে প্রসন্ন চিত্তে বাসর ঘরে প্রবেশ করে আমার বরকে আশ্বাস দিল- “তোমার ভাইগ্য ভালো। মেয়েদের তো সেন্স অফ হিউমার বড়ো একটা থাকে না। খুকুর কিন্তু আছে।” তারপরেই আসল কথা বাসরঘরে উপস্থিত বৌদি দিদিদের উদ্দেশ্যে- “আর ত দেরি করন যায় না। পঁয়তাল্লিশ প্রায় হয় হয়। একটি বয়স্কা মেয়েই দেখেন। তবে মুখে যেন হাসি থাকে। গোমড়া মুখ আমার পছন্দ না।” ঘরে হাস্যমুখীর অভাব ছিল না, সবাই হাসল। পল্টুদার চোখ কি চিকচিক করছিল? আমার চোখ আবার জমকালো ওড়নায় ঢাকা।
(৩য়)
আরো বছর পঁচিশ গেছে। আমার ছেলেদের বিয়েতে পল্টুদা যথারীতি প্রসন্ন মুখে নেমন্তন্ন খেয়েছেন। পান মুখে দিয়ে বলে এসেছেন, “আমার না হয় না-ই হইল বিয়া, কিন্তু অন্যদের ভাল বিয়া হইলে আমি কিন্তু খুব খুশি হই। তোমরা ভাল থাইক্যো। হাসিখুশি থাইক্যো।” তেমনি সটান লম্বা। রঙ হলুদ ফর্সা। তবে মাথায় চুল কম। দাঁত পড়ে গেছে।
এদিকে কিছু নয় বেশ বড় রকমের বদনামও হয়েছে পল্টুদার। সারা শহর জেনে গেছে পল্টুদার বাড়িতে অধিষ্ঠান হয়েছে একাধিক সন্তান এমনকি নাতি নাতনি সহ এক মহিলার। তিনি পল্টুদাকে তাঁর পোষ্য কুকুর এবং সংগৃহীত বইপত্র সহ বৈঠকখানায় স্থান দিয়ে নিজে আস্তানা নিয়েছেন পল্টুদার ঘরে। ধনমাসিমার অবশিষ্ট হার, বালা, কানের দুল তাঁরই অধিকারে। মহিলা হয়তো নিঃস্ব। হয়তো পতিগৃহে নির্যাতিতা। কিন্তু নিরীহ নন। প্রয়োজনে চ্যালাকাঠ হাতে নেন। ভদ্রজনেরা এড়িয়ে চলেন পল্টুদাকে। এদিকে সামান্য পেনশন নিজের জন্য যথেষ্ট হলেও তাঁর আশ্রিতজনের জন্য অপ্রতুল।
একদিন বলেন, “এইবার জন্মদিনে একটা বেডকভার আর দুইটা ধুতি দিস রে খুকু।” বুঝি তাঁর অভাব কত দুর্বহ। মনে পড়ে যায় প্রতি বছর পল্টুদার জন্মদিনের নিমন্ত্রণে আম, কাঁঠাল আর কলার আয়োজন। সবই বাড়ির বাগানের। তখন পল্টুদা উপহার চাইতো না। ছোটদের নিজেই ছড়া লিখে উপহার দিত। পাঠিয়ে দিলাম বেডকভার আর ধুতি।
(৪র্থ)
কল্যাণীদির ফোন সকালবেলা- পল্টুদা গেছেন আজ শেষরাত্রে। আমাদের লাল ধূলায় কীর্ণ শহরের হৃতগৌরব সৌমিত্র। অপরাজিত নন। পরাজিত। ব্যর্থ মানুষ। তবু সাহিত্য পরিষদ মোটামুটি সসম্মান আয়োজন করেছে শবযাত্রার। কিন্তু প্রিয়বালা? ছবি তোলার সময় সেও সামিল হতে চায়।– ছিঃ ছিঃ- বটেই তো, কিন্তু শুধুই কি ছিঃ? আর কিছু নয়? দোষ কি শুধু প্রিয়বালারই? পল্টুদারও কি দুটি রাঁধা ভাতের লোভ, একটা পরিষ্কার বিছানা, একটা ধোয়া ধুতির আকর্ষণও ছিল না? প্রিয়বালা নাই বা হল কাব্যপ্রিয়া, বাস্তব চাহিদাগুলো কি মেটায় নি কোনোদিন- কে জানে? ভাবি না ওদের নিয়ে। বয়ে গেছে আমার।
দিন বয়ে গেছে। আমার সেদিনের পিঠে লুটোনো মুক্তবেনী এখন শীর্ণ, খর্ব এবং সাদা। চোখের তারায় লেন্স জুড়েছে। ব্যক্তিগত শোকে ভারাক্রান্ত। সবাই বলে একটু ধর্মের বই পড়ো। জপ করো। পূজাপাঠ। আমার পুরো টেবিল জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ। ধর্মগ্রন্থের খোঁজে দেরাজ হাতড়াই। এই তো চৈতন্যভাগবত! দাদুর বইটা। মলাট ওলটাতেই পল্টুদার না-হওয়া বিয়ের বরযাত্রীর লিস্ট। না-হওয়া বৌভাতের ফর্দ।