খুব সহজ মনে হচ্ছে ঘটনাটা। মানে যেভাবে এখন বর্ণনা হচ্ছে তাতে খুব সহজ বলেই মনে হচ্ছে। যে একজন ছাত্রী পরীক্ষার হলে মোবাইল দিয়ে নকল করছিল আর তাই তাকে পরের দিন বাবা মা সহ অপমান করেছে কর্তৃপক্ষ। বাবা মার অপমান সহ্য করতে না পেরে অরিত্রী নামের সেই মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। মানুষ এখন ঝাঁপিয়ে পড়ছে স্কুল কর্তৃপক্ষের ওপরে। সর্বশেষ সংবাদ সরকার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৗস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা এবং শ্রেণীশিক্ষক হাসনা হেনা কে স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছে। তাদের এমপিও বাতিল করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ঝামেলা যেন তৈরি না হয় নতুন করে তাই সরকার নির্বাচনের আগে এই নাজুক সময়ে কোন প্রকার ঝুঁকিতে না গিয়ে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যাটার কি কোন সমাধান হবে এতে? আপনাকেই বলছি স্যার বইয়ের ভাষায় বললে বলতে হয়, আমাদের স্কুল গুলো অনেকটা এমন হাসপাতালের মত যারা শুধু সুস্থদের নিয়েই কাজ করতে চায়, অসুস্থ দুর্বলদের টিসি দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয় এখানে। এই যখন অবস্থা তখন সমাধান দুই একজন শিক্ষক কে বহিষ্কার বা আইনের হাতে তুলে দিলেই কি সমাধান হবে? অরিত্রী তো ওই স্কুলের সিস্টেমের জন্য যতখানি শিকার তার থেকে বেশি শিকার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার, সরকার সেই সিস্টেম নিয়ে কোন কাজ করবে কি?
ভিকারুননিসা স্কুল দেশের অন্যতম সেরা স্কুল। অভিভাবকগণ দিবারাত্রি স্বপ্ন দেখে তাদের সন্তান কে ভিকারুননিসায় পড়ানোর। যারা সুযোগ পায় তারা নিজেদের অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করে। এত যে আরাধ্য বিদ্যালয়, সেখানে কি হচ্ছে? কেন একজন ছাত্রী নকল করার মত অপরাধ করল এমন নামী স্কুলে? ওর জীবনটা কি একবারের জন্য পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে? কড়া শাসন ব্যবস্থার জন্য সুপ্রসিদ্ধ এই স্কুলে একজন মেয়ে নকল করার সাহস করল তাও ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষায় এসে। একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না সমস্যাটা শুধু নকল করা না, আরও বেশি কিছু?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এতই কুৎসিত যে এখানে নকলের মত অপরাধ করে হলেও ক্লাস নাইনের মেয়ে কে বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হয়। আর আমাদের শিক্ষকগণ এতই মহান যে এতে নিজেদের অপরাধ, নিজেদের নৈতিকতা কে একবারের জন্যও প্রশ্ন না করে সেই ছাত্রী কে, তার বাবা মা কে অপদস্থ, অপমান করে। এমন ঘটনা যদি দেশের মফস্বল শহরের অখ্যাত কোন স্কুলে ঘটত তাহলে এটা হয়ত মানুষজনের নজরেও আসত না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটে বসে আছে দেশের সেরা স্কুলে।সেরা স্কুলের চেহারা যদি এমন হয় আশা করি বাকিদের অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়। তাই বাকিদের নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য আজ পর্যন্ত হয়নি, সম্ভবত আর হবেও না।
অনেকে বাবা মাকে দোষারোপ করছেন। খুব ভুল করছে না সম্ভবত। তাদের সন্তান হারিয়েছে, তাদের প্রতি পূর্ণ সমবেদনা রেখেই বলছি এর দায় বাবা মা কোন মতেই এড়াতে পারেন না। সন্তান কে চাপ দিতে দিতে আমদের দেশের অভিভাবকগণ ভুলেই যান উনার সন্তান রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, রোবট ভাবতে শুরু করে হয়ত। এটাও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার চমৎকার নমুনার ফসল। এখানে গোল্ডেন এ প্লাসের নিচে আর কিছু নাই, তুমি হয় গোল্ডেন এ প্লাস পাইছ না হয় তুমি ফেল করছ, এর মাঝে আর অন্য কোন কিছু নাই। বাবা মা সন্তানকে অপশন দিচ্ছে হয় ডাক্তার আর নয় ইঞ্জিনিয়ার, ভিন্ন অন্য কোন পথ খোলা নাই। দুনিয়া সুদ্ধ মানুষ ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য দৌড় শুরু করছে। কেউ কোন মতে জীবন নিয়ে বেঁচে যাচ্ছে আর কেউ চাপ নিতে না পেরে ভিন্ন পথে হাঁটছে।
শিক্ষকের দায়িত্ব কতটুকু একজন ছাত্রের প্রতি? শিক্ষক কোন ভাবে দায় এড়াতে পারে কি অরিত্রীর মৃত্যুর? কোন মতেই পারে না। শিক্ষক যদি নাই জানে তার ছাত্রের পরিস্থিতি কী তাহলে তিনি শিক্ষক থাকেন কিভাবে? এখানে আবার অন্য প্রসঙ্গ এসে যায়। একজন শিক্ষক কতজন ছাত্রের খেয়াল রাখতে পারে একসাথে? নিশ্চয়ই একটা বৈজ্ঞানিক সংখ্যা আছে কিন্তু ভিকারুননিসার মত স্কুল তেমন কোন সংখ্যার তোয়াক্কা করছে বলে জানা যায়নি। এমন নামী স্কুলের একটা ক্লাসে ৮০ জনের ওপরে ছাত্রী এক সাথে ক্লাস করত। শিক্ষার পরিবেশ বলে যে একটা কথা আছে তা সম্ভবত উনাদের অভিধানে নেই। থাকলেও ব্যবসার প্রতিষ্ঠান হিসেবে যখন স্কুল স্বীকৃত হয়েছে তখন থেকে আর কেউ তার খোঁজ করেনি।
ভিকারুননিসা নুন স্কুলে এর আগেও ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল। সেবার ছাত্রীকে অপমান করা হয়েছিল। সেই ছাত্রী চেয়েছিল নবম শ্রেণীতে উঠার পর বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। স্কুলের শিক্ষক নামের যারা ছিলেন তারা তাকে তার মেধা নিয়ে কুৎসিত ভাবে আক্রমণ করেন, অপমান করে ছোট্ট মনটা ভেঙ্গেচুরে দেন। ফলাফল নবম শ্রেণীর একটা বাচ্চা মেয়ে তীব্র মনঃকষ্ট নিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। তখন যদি আমাদের টনক নড়ত তাহলে আমাদের আজকের দিন হয়ত নাও দেখতে হতে পারত। কিন্তু সত্য হচ্ছে ওই ঘটনা যেমন আমরা বেমালুম ভুলে গেছে, অরিত্রীও তেমনই চুপ চাপ হারিয়ে যাবে আমাদের মন থেকে।
ভিকারুননিসা স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সম্ভবত মধ্যযুগের রাজা বাদশা মনে করতেন নিজেদের। যার কারণে দিনের পর দিন অভিভাবকদের, ছাত্রীদের যখন তখন যা তা ভাষায় গালাগালি করে গেছেন। এখন নানা অভিভাবক মুখ খুলছেন। একজন তো বললেন তার দ্বিতীয় শ্রেণীর বাচ্চাকে নাকি অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে শিক্ষক! সেই স্কুলের এত নাম? এত চাহিদা? সেই স্কুল থেকে বের হওয়া সকল হাঁস বুঝি সোনার ডিম দেয়?
এই সব কুৎসিত কিচ্ছা কাহিনী বের না হলে ভিকারুননিসা নুন যে মাপের স্কুল আমাদের দেশে আমার মত লোকজন কোনদিন সাহসই পেতাম না তাদের দিকে আঙ্গুল তোলার। এর কারণ হচ্ছে আমরা এতেই অভ্যস্ত। দেশের সেরা স্কুল সম্পর্কে মন্তব্য করতে সাহস তো দরকারই। তার মধ্যে আমরা হচ্ছি এমন সব স্কুলের ছাত্র যাদের কাছে এই পুরো বিষয়টাই হয়ত অদ্ভুত বলে মনে হবে। আমাদের এই সব স্কুলের শিক্ষকরা হয়ত এখনো বুঝতেই পারছে না কী এমন হল যে মেয়েটা জীবন দিয়ে দিল? এখানে কিছুদিন আগেও অভিভাবক ছাত্রকে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় হেড মাস্টারকে হাতে ধরে বলে দিয়ে যেত, স্যার, দিয়ে গেলাম, চোখ দুইটা শুধু আমরা, বাকি সব আপনার!! তাই আমাদের শিক্ষকদের জন্য কষ্টকর, পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে পারা।
ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যতটুকু বুঝি তা হচ্ছে শিক্ষকদের বা অভিভাবকদের দোষারোপ সমাধান না। এদেরকে শাস্তি দিলাম কিন্তু তাতে পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হবে না।শাস্তি দিলে ভিকারুননিসা স্কুল হয়ত সাময়িক ভাবে একটু সতর্ক হবে তবে তাতে সামগ্রিক সমাধান হবে না।শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনলে হয়ত পরিবর্তন হতে পারে পরিস্থিতির। এখন অবস্থা এতই নাজুক যে কোরামিন ইনজেকশনে কাজ হবে কিনা তাও সন্দেহ। আর কাজ না হলে অরিত্রীদের জীবন ঝুঁকিতেই থেকে যাবে, বেঁচে থাকলেও বেঁচে থাকা বলা যাবে না হয়ত।