১) কোলকাতা মেডিকেল কলেজে হোস্টেল নিয়ে ঠিক কি হয়েছে?
২০১০ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে এম বি বি এস এ আসন সংখ্যা ছিল ১৫৫. হোস্টেল ছিল চারটি। ২০১১ থেকে আসন বেড়ে হয় ২৫০. কিন্তু হোস্টেল বাড়েনি। মেইন বয়েস হোস্টেলের ছাদ এ একটি নতুন তল করে দেওয়া হয়, শুরু থেকেই বারবার যার ফলস সিলিং ভেঙে পড়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত হোস্টেলে বেডের জন্য সিনিয়রিটি আর দূরত্বের ভিত্তিতে অথরিটি থেকে কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করা হত। ২০১৬ থেকে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। গত তিন বছরের তিনটি ব্যাচের ছাত্রছাত্রীরা এর ফলস্বরুপ কলেজের বাইরে মেস ও পিজি নিয়ে থাকতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ১১ তলার একটি নতুন হোস্টেল বানানো হয়। তাতে ৩ টে ফ্লোরে এম ডি, এম এস পাঠরত মহিলা ডাক্তারদের (পিজিটি) থাকার ব্যবস্থা হয়, ৩ টে ফ্লোরে পুরুষ পিজিটি দের রাখার কথা হয়, ১ টি করে ফ্লোরে হাসপাতালের কিচেন, আর ক্যান্টিন চালু হয়। ১ টি ফ্লোর বেসমেন্টে পার্কিং জায়গা করা হয়, দু'টো ফ্লোরে গেস্ট দের জন্যে ২ বি এইচ কে ফ্ল্যাটের মত সুবন্দোবস্ত করা হয়। এটা ২০১৭ সালের জুন মাসের কথা। তারপরেই হঠাৎ যে তিনটে ফ্লোরে পুরুষ পিজিটি দের থাকার কথা, সেটা এম বি বি এস প্রথম বর্ষের জন্যে দেওয়ার কথা হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়- ক) এম সি আই এর রুলে আছে ফার্স্ট ইয়ারদের সিনয়রদের থেকে আলাদা রাখতে হবে। না হলে র্যাগিং হবে। খ).সিনিয়র দের থেকে গাঁজা, মদ খাওয়া শিখবে ফার্স্ট ইয়ার। গ). একই হোস্টেলে মহিলা ডাক্তারদের বয়েসে নিতান্তই ছোট ফার্স্ট ইয়ারদের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। সিনিয়র দের রাখলে সেই সম্ভাবনা বেশি। দ্বিতীয় যুক্তি দু'টো আনওফিশিয়াল, কিন্তু বিবেচ্য।
স্বাভাবিকভাবেই এতদিন হোস্টেল না পাওয়া দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ বর্ষের ছাত্ররা এটার প্রতিবাদ করে।
২. ছাত্রদের দাবিটা ঠিক কি?
ঠিক আগে যেমন হত, সেই নিয়মে পুরোনো এবং নতুন হোস্টেলের কাউন্সেলিং করতে হবে, সিনিয়রিটি আর দূরত্বের ভিত্তিতে নতুন হোস্টেলে সবাই কে জায়গা দিতে হবে।
যাকে হোস্টেল সুপার করা হয়েছে, তাকে সরিয়ে যোগ্য কোন শিক্ষক কে সুপার করতে হবে।
র্যাগিং এর অযুহাতে সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্কে ফাটল ধরানো যাবে না। কারণ মেডিকেল কলেজে ১৮৬ বছরের ইতিহাসে সে নিদর্শন নেই।
৩. কে এই হোস্টেল সুপার?
নাম পার্থ প্রতিম মন্ডল। ২০১৬ তে এম বি বি এস পাশ। এক বছর ফেল করার পর, এবং প্রায় সব বিষয়ে একবার করে সাপ্লি পাওয়ার পর। কোন উচ্চতর ডিগ্রী নেই। বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ। মেডিকেলের সি সি ইউ তে ডেপুটি ইনচার্জ। এন আর এস মেডিকেলে ক্লিনিক্যাল টিউটর, এনাসস্থেসিয়া তে, অথচ তাতে এম ডি করা নেই! আরো জানতে চাইলে ওনার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখে আসুন। কয়েকটা ছবি দেখাই যথেষ্ট।
৪. অথরিটি কি বলছে?
প্রথমত অথরিটি নানা সময় নানা কথা বলেছে। কিন্তু যেটা বারবার বলেছে, ফার্স্ট ইয়ার ছাড়া ওই হোস্টেল আর কাউকে দেওয়া যাবেনা।
বলেছে সিনিয়র যাদের হোস্টেল দরকার, তাদের জন্যে আরেকটা নতুন হোস্টেল বানানো হবে। কিন্তু এটা ফার্স্ট ইয়ারের।
বলেছে মেইন হোস্টেলের ফলস সিলিং সারিয়ে দেওয়া হবে।
বাট নতুন হোস্টেল ইজ নন নেগোশিয়েবেল।
৫. অথরিটি কি করেছে?
প্রথম কয়েক দিন ছাত্ররা কথা বলতে গেলে, ডেপুটেশন দিতে গেলে, সরাসরি অবজ্ঞা করেছে।
ছাত্রদের হোস্টেলের দাবিকে তুচ্ছ করেছে।
ছাত্ররা প্রিন্সিপ্যাল কে অবস্থান ঘেরাও করলে সাদা, খাকি, গেঞ্জি পুলিশ ডেকে পিটিয়ে তুলে দিয়েছে।
নতুন হোস্টেল এই আন্দোলনকারিরা দখল করে নিতে পারে, এই ভয়ে তড়িঘড়ি কোন রকম নোটিশ ছাড়াই তিন-তিন ছটা ফ্লোর ভর্তি করে দিয়েছে, মহিলা পিজিটি আর ফার্স্ট ইয়ার এম বি বি এস ছাত্রদের দিয়ে। কিভাবে শুনুন। মহিলা পিজিটিদের রাত ৮ টায় কেবল মাত্র মোবাইলে মেসেজ করে বলছে, এখুনি গিয়ে হোস্টেল দখল করো, চাদর, ব্যাগ, গামছা, যা হোক কিছু একটা রেখে এস, না হলে আর কোনদিন হোস্টেল পাবেনা।
১ লা আগস্ট থেকে ফার্স্ট ইয়ার এম বি বি এসের ক্লাস শুরু হবে, অথচ ৮ই জুলাই ওদের বাড়ি তে হুমকি দিয়ে ফোন করে ডেকে এনেছে, রাতারাতি। সেখানে প্রায় ১২০ জনকে বেড দিয়েছে, তাদের মধ্যে বেশ কিছু জনের বাড়ি কলকাতায়, যাদের হোস্টেল লাগবেই না।
এরপর আন্দোলনকারিরা অনশনে বসলে প্রথম দুদিন কোন কথাই বলতে আসেনি। তারপর এসে বলেছে, যারা অনশন করছে, তাদের কোন একটা হোস্টেল এখনই দিয়ে দেবে, কিন্তু নতুন হোস্টেল নয়। তারপর একদিন অনশনকারিদের বাড়িতে ফোন করেছে, গার্জেনদের হুমকি দিয়েছে, আপনার ছেলের কেরিয়ার নষ্ট করে দেব অনশন না তুললে।
গার্জেন, সিনিয়র ডাক্তারদের চাপে পড়ে দু'বার কলেজ কাউন্সিলের মিটিং ডেকেছে।
প্রথম মিটিং এ বলেছে, নন নেগোশিয়েবেল-- এটা হল কলেজ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় মিটিং এ বলেছে, হোস্টেলের ব্যাপারে কাউন্সিল কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। (যে কাউন্সিল তৈরি হয়, প্রিন্সিপ্যাল, মেডিকেল সুপার, ডিন, আর সমস্ত ডিপার্টমেন্টএর হেড দের নিয়ে) আমাদের "হাইয়ার অথরিটির" সাথে কথা বলতে হবে।
বৃহস্পতিবার বলেছে, ২১ শে জুলাইয়ের মিটিং এ বাইরে থেকে লোক এসে তোমাদের কিছু করে গেলে আমার দায়িত্ব নেই। সেদিনই রাতে পুলিশ পাঠিয়ে জোর করে অনশন তোলার পরিকল্পনা করেছে। আর গোটা ১০ দিনের অনশন জুড়ে বলে গেছে, তোমরা আর যাই কর, অনশন কোরো না। আমরা ১০-১৫ দিন পর তোমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।
৬. হোস্টেল কাউন্সেলিং এর মত একটা অতিসাধারণ দাবি আজ কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে?
৬ টা ছেলে অনশন করছিল, দুজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, আরো দুজন তারপর যোগ দিয়েছে।
হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা একদিন ডেপুটেশন দিয়েছে।
৯ইই জুলাই একটা মিছিল করে ধর্মতলা অব্ধি গিয়ে হেলথ সেক্রেটারিকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে।
মেডিকেল কলেজেই একটি কনভেনশন করা হয়েছে।
গার্জেনরা এসে ১২ ঘন্টার প্রতিকী অনশন করে, প্রিন্সিপ্যাল কে ডেপুটেশন দিয়েছেন।
২০ জন সিনিয়র ডাক্তার এর পরের দিন ১২ ঘন্টার প্রতিকী অনশন করে প্রিন্সিপ্যাল কে ডেপুটেশন দিয়েছে ও কথা বলেছেন। বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
বৃহস্পতিবার থেকে ইন্টার্ন ও হাউসস্টাফরা ককর্মবিরতি শুরু করেছেন।
আরো ১৫ জন ছাত্রছাত্রী বুধবার রাত থেকে আমরণ অনশনে যোগ দিয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অসংখ্য শুভবুদ্ধি সম্পন্ন, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ জন পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
ছোট (নাকি বড়!) করে বললে অথরিটির অবজ্ঞা আর দলদাসত্বের কারণে আজকের এই আন্দোলন একটা গণ আন্দোলন এর রুপ নিয়েছে।
৭. মেডিকেল কলেজের কি সব ছাত্রছাত্রী আছে এই আন্দোলন এর সাথে?
না।
২০১১ থেকে স্টুডেন্টস ইউনিয়নে আছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। সংগত কারণেই তারা নেই এই আন্দোলনের পাশে, তাদেরই সহপাঠী অনশন করে অসুস্থ হয়ে গেলেও নেই। তারা কোনো "ঝামেলায়" জড়াতে চায়না। তারা "পড়াশোনা" করতে চায়। তারা এই আন্দোলন এর সমর্থনে আসবেনা, কিন্তু তাকে সোশ্যাল মিডিয়ার যেন তেন প্রকারে কালিমালিপ্ত করতে চায়। কলেজে তৃণমূলী গুণ্ডারাজ তাদের চোখে পড়েনা, কিন্তু প্রেসি, যাদবপুর থেকে লোকজন সলিডারিটি তে এলে তাদের এলিটিজম এর গায়ে ছ্যাঁকা লাগে। জনৈক সার্জারির অধ্যাপক একটি অত্যন্ত দুখ:জনক মন্তব্য করলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে আন্দোলনকারিরা তার কৈফিয়ত চাইতে গেলে তাদের স্যার কে অপমান করা হয়েছে বলে ওই টি এম সি পি ছাত্রদের গাত্রদাহ হয়। এর বেশি আর এই পরিসরে বলতে চাইনা, বলা সম্ভব ও নয়। মহাভারত হয়ে যাবে। তারা এখনও বিশ্বাস করে আন্দোলনকারি রা নকশাল এবং মাওবাদী।
৮. অনিকেতরা কেমন আছে?
ভালো নেই। দিনদিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে। আন্দোলনকারিদের পক্ষে অনেক চিকিৎসক ওদের ২৪ ঘন্টা দেখভাল করে যাচ্ছেন। রক্তপরীক্ষা করে যাচ্ছেন। খেয়াল রাখছেন।
৯. আপনি কি করতে পারেন?
আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান। সোশ্যাল মিডিয়াতে নয়। সশরীরে। গণ ডেপুটেশন দিন, অথরিটি কে, হেলথ সেক্রেটারিকে, স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে।
সমস্ত রাজনৈতিক রঙ ফেলে রেখে আসুন। এটা স্বাধীন ছাত্রছাত্রী আন্দোলন।
কনভেনশন করুন, নাটক করুন, গান করুন, কবিতা লিখুন। সবাইকে জানান। আসতে বলুন মেডিকেলে।
১০. এই আন্দোলন অন্যন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোকে কি বার্তা দিতে চায়?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন রাজনৈতিক দলের দালালি নয়, ছাত্রস্বার্থে অথরিটির হাজারটা খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে স্বাধীন ছাত্রছাত্রী আন্দোলন গড়ে উঠুক।
এই বাংলা জুড়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কল্লোলিত হোক একটাই ভাষা। স্বাধীন ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের ভাষা। আর কারোর না।