শিমুল - পলাশ- জঙ্গল - সরল আদিবাসী - (বঙ্কিম-অগ্রজ) সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় - বিভূতিভূষণ - কালকূট - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- "অরণ্যের দিনরাত্রি" - সৌমিত্র - শর্মিলা- কাবেরী দত্ত- রবি ঘোষ- পাহাড়ী সান্যাল - বুদ্ধদেব গুহ - ন্যাশনাল পার্কে বন্যপ্রাণির উঁকিঝুঁকি = আমাদের মধ্যচিত্ত বাঙ্গালী মানসে পালামৌ।
পালামৌর বেতলাবাসী মৌলবী মিয়া চাষবাষ করেন, চাষের কাজ না থাকলে গাইড, বেতলা ন্যাশনাল পার্কের জঙ্গলে এবং বাইরে। ভালো দস্তানগো। গাড়ীর পেছনের সিটে বসে ভুভুজেলা-ভোলানো গল্প ছাড়েন অ্যাডাল্ট মোড়কে, নব রসের সবকটার সঠিক ককটেল বানিয়ে।
"ওয়সে তো মৈ মৌলবী নহি হুঁ। ক্যা করে, এয়সা নাম দে দিয়া মা-বাপ নে।"
'তাথা' উষ্ণ জলের কুণ্ডে ছেঁকা দেওয়া গরম জলে হাত ছুঁইয়ে, ডাউন স্ট্রীমে পালামৌয়ের কর্মব্যস্ত রামী রজকিনী দের বিরক্তি উৎপাদন না করে, ব্যাক করার সময়ে, মৌলবি সাহেব বললেন, "মণ্ডল ড্যাম দেখিয়েগা সাহেব।"
- ড্যাম! জরুর দেখেঙ্গে। কব বনি ইয়ে?
- বনি কাঁহা স্যার, বন রহা হ্যায়, ইন্দিরাজী কা টাইম সে! কাম বন্ধ হ্যায় আভি! লেকিন জগহ বহুত সুন্দর হ্যায়।
- ইন্দিরাজী কে টাইম কে মতলব কম সে কম পঁয়তিশ সাল?
- উস সে ভি যাদা হোগা স্যার! লেকিন শুনা হ্যায় ফির সুরু হোনে ওয়ালা হ্যায়। উঁচাই ছোটা করকে।
- ছোটা কিঁউ?
- কুচ গাঁও বচ জায়গা স্যার।
- লেকিন ফির ভি বহুত আদমী কো ঘর ছোড়না পড়েগা।
- সো তো পড়েগা স্যার, লেকিন ইঁহা ভি কুছ হোনা চাহিয়ে।
ড্যামের পথে ছোট্ট একটা বাজার। বন্দুক কাঁধে ক্লান্ত সি আর পি রা দাঁড়িয়ে। অল্প স্টক, ভাঙ্গা চেয়ার, কাঠের উনুন, কোনো দোকানেই বড় কনস্ট্রাকশন সাইটের উপচে পড়া "সারপ্লাস ভ্যালু"-র কোনো লক্ষণই নেই।
মস্ত সব থাম্বা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অর্ধনির্মিত ড্যাম। অনেক নীচে বয়ে যাচ্ছে কোয়েল নদী।
বেজায় পিকচারাস্ক চারপাশ। দাঁড়িয়ে শোভা দেখতে দেখতেই হঠাৎ মৌলবি সাহেবের চিৎকার "ভাগো, ভঁওড়া"। ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসছে মৌমাছির দল।
ছবি তোলা হয়ে গেছে কিছু ইতিমধ্যে। কিন্তু বাকি ইতিহাস?
১৯৭২ সালে শুরু হয়ে ১৯৯২-এ বিহারের বন বিভাগ আদেশে বন্ধ হয় কাজ, এবং তখন থেকেই বন্ধ আছে এই বাঁধের কাজ, এরকমই জানাচ্ছেন ভারত সরকারের এপ্রিল ২০১৭র প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর বিজ্ঞপ্তি। বাঁধের প্রস্তাবিত উচ্চতা ৬৭.৮৬ মি আর দৈর্ঘ ৩৪৩.৩৩ মিটার। জল ধারণ করবে ১১৬০ কিউবিক মিটার। আর এখান থেকে ৯৬ কিমি দূরে মহম্মদগঞ্জে তৈরি হবে ৮১৯ মি দীর্ঘ ব্যারাজ। মহম্মদগঞ্জে ব্যারাজ থেকে বাম ও দক্ষিণ দিক থেকে দুপাশে দুটি খাল বয়ে নিয়ে যাবে সেচের জল।
ভারত সরকার গত বছর নতুন করে অনুমোদন দিলেন এই নর্থ কোয়েল প্রজেক্ট-এর। প্রাথমিক প্রস্তাবিত উচ্চতা এবং জলাধারের আকার খানিকটা কমিয়ে। কাজ শেষ হলে সেচের ব্যবস্থা হবে ঝাড়খণ্ডের পালামৌ আর গারওয়া জেলা, বিহার-এর গয়া আর আওরঙ্গাবাদ জেলার ১২২৫২১ হেক্টেয়ার জমিতে। এই অর্ধসমাপ্ত প্রকল্পটি থেকে অবশ্য এক্ষণে সেচ হচ্ছে ৭১৭২০ হেক্টেয়ার জমিতে। অর্থাৎ বাঁধ সম্পুর্ণ হলে আরো ৩৯ ৮০০ হেক্টেয়ার সেচের আওতায় আসবে।
থেকে থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে কেন কাজ? এর উত্তর অন্তর্জালে রাখা কোনো সরকারী দলিলে খুঁজে পাইনি। কিছু ব্যাখ্যা আছে Coordination for Democratic Rights (CDRO) - এর Living in the shadow of Terror নামক ২০১৩ সালের একটি রিপোর্টে। তাঁরা জানাচ্ছেন, "আশীর দশকে এই প্রজেক্টে জমির ক্ষতিপূরণের অঙ্কটি নির্ধারিত হয়েছিল ১৯১৬-১৭ র একটি জরিপের ভিত্তিতে। ইতিমধ্যে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে তা হিসাবের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অর্থাৎ অনেক কম মানুষ ক্ষতিপূরণের হকদার হতে পেরেছেন। ১৯৭৪ এ একর প্রতি ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ধার্য হয়েছিল ১৪০০০ টাকা। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কেবল নির্ধারিত জনসংখ্যার অর্ধেক ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। স্থানান্তরিত মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল রামদার-মির্দায়, ভাণ্ডারিয়ার জেলা সদর থেকে ৪ কিমি দূরে।
যে ৩২ টি গ্রামকে ভাসিয়ে দেবে এই প্রকল্প তার অন্যতম "সানিয়া", ১৮৫৭ এর সিপাহী বিদ্রোহের সমকালে, ব্রিটিশ সরকারের জমির অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়েঝাড়খণ্ডের দুই শহীদ নীলাম্বর আর পিতাম্বরের গ্রাম। এই ৩২ টির সঙ্গে আরো ১৩ টিও ভেসে যাবে বলে CDRO প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে।
ধুমায়িত অসন্তোষ বারবারই ব্যাহত করেছে এই প্রকল্প।
গ্রামবাসীদের প্রতিবাদে বহুবার বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রজেক্টের এক ইঞ্জিনিয়ার, বৈজনাথ মিশ্র, ১৯৯৭ এর আগষ্ট মাসে ঠিক করলেন প্রতিবাদীদের উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে।
বাঁধের কাজের জন্য তৈরি অস্থায়ী স্লুইসগেট গুলো খুলে দিলেন এক রাতে। ৩২টা গ্রাম ভেসে গেল রাতারাতি, ১১০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হল। তাদের গবাদি পশু ও ঘরবাড়ি ভেসে গেল। ডুবে গেছিলেন ২১ জন মানুষ।
১৬ই আগষ্ট নিহত হলেন বৈজনাথ মিশ্র, তথাকথিত মাওবাদীদের হাতে। তখন থেকেই একদম স্তব্ধ কাজ এই প্রকল্পে।
আয়তনে কমিয়ে আনা প্রকল্পেও কাটা পড়বে বেতলা জাতীয় পার্কের কোর এরিয়ার ৩.৪৪ লক্ষ গাছ। ভেসে যাবে বহু একর বনভূমি আর গ্রাম।
থমকে থাকা থাম্বা গুলোর এটাই গল্প।
হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের ঘরটি তছনছ করেছে কেউ।আমার যাবতীয় ওষুধ, অমিতের খোলা ব্যাগ থেকে যাবতীয় জামাকাপড়, দামী সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে যাবতীয় সিগারেট, ছড়িয়ে রয়েছে ঘরে ও ঘরের বাইরে।
সবকিছু কুড়িয়ে জড়ো করে স্টক টেকিং করতে গিয়ে দেখলাম, থার্মোমিটারের পারা, দুরকম আই ড্রপ, রক্তচাপ কমানোর ওষুধ, অ্যাসপিরিন ও স্ট্যাটিন, খানকয়েক ফিল্টার যুক্ত সিগারেট, চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে অনুপ্রবেশকারী।
পরে বোঝা গেলো ঘরের জানলার স্লাইডিং পাল্লার লকটা অকেজো। বাঁদর ঢুকেছিলো ঘরে! বাঁচবে না সম্ভবত এত কিছু খেয়ে।
প্রশ্ন হলো, আসলে অনুপ্রবেশকারী কারা? অরণ্যচারী বাঁদর আর আমাদের বাঁধের ওপর তাড়া করা মৌমাছির ঝাঁক? নাকি আমরা? "অরণ্যের দিনরাত্রি"-র নির্মাতা এই চত্বরটিকে পর্যটনের ম্যাপে তুলে উপকার করলেন, নাকি............?