ধর্মঘট হয়তো উঠে যেতে পারে, কিন্তু টিভি সিরিয়ালের ধরণ কি বদলাবে? দেখা হচ্ছে এই নিবন্ধে।
মান কী?
টিভি সিরিয়ালের ‘মান’ প্রায়শই পড়ে যাচ্ছে বলে বাঙালি ভদ্রমহলে হাহুতাশ শোনা যায়, নস্টালজিয়ার চর্চাও হয়। যদিও ‘উন্নত ‘মান’ এর টিভি সিরিয়াল কী, তার সুচারু সংজ্ঞা নির্ধারণ, আর পাঁচটা বর্গের মতই অসম্ভব। তবে সাধারণভাবে আশির দশকের কিছু সিরিয়ালকে সন্দেহাতীতভাবে এই মুকুটটি দেওয়া হয়। যেমন জাতীয় কার্যক্রমের ‘নুক্কড়’ বা কলকাতা দূরদর্শনের ‘তেরো পার্বণ’। এই সিরিয়ালগুলি (যাদের সংখ্যা আরও বাড়ানো যায়) ‘ভাল’ বা ‘উচ্চমান’এর কেন? এর শিল্পগত নানা দিক আছে। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে যদি স্রেফ লক্ষ্যবস্তু অর্থাৎ টার্গেট অডিয়েন্সের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই সিরিয়ালগুলি সাংস্কৃতিকভাবে একটি জায়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক চাহিদাকে পূর্ণ করত। আশির দশকে ভারতবর্ষে একটিই চ্যানেলের একাধিপত্য ছিল। তখনও খোলা বাজার দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতনা। ফলে বাজারের কারণে খুব সচেতনভাবে একটি লক্ষ্যবস্তুকে নির্দিষ্ট করেই এই সমস্ত পণ্যগুলিকে বানানো হত কিনা বলা মুশকিল। তবে টিভি সে সময় উচ্চ ও মধ্যবিত্তেরই বিলাস ছিল, এবং সিরিয়ালের সাংস্কৃতিক লক্ষ্যবস্তুটি যে ভারতীয় শিক্ষিত মধ্য বা উচ্চবিত্তই ছিল, সে নিয়ে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং আজ যখন ‘মান’ পড়ে গেছে বা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়, তার অবশ্যই শিল্পগত একটি দিক আছে। কিন্তু সেটিকে বাদ দিয়ে স্রেফ চাহিদার ভিত্তিতে দেখলে এই অনুযোগের অর্থ একটাই। যে, শিক্ষিত উচ্চ ও মধবিত্ত, বা বাঙালির ক্ষেত্রে ‘ভদ্রলোক’এর চাহিদাকে টিভি সিরিয়াল গুলি আর পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেনা।
মান নড়ছে কীভাবে?
এই লেখা মূলত ‘মান’ পড়ে বা নড়ে যাওয়ার, বা মতান্তরে ‘মান’ পরিবর্তনের ইতিহাস ভূগোল বিষয়ে ফাঁদা হয়েছে। ফলে মান পরিবর্তন হচ্ছে কেন, সে আলোচনা লেখার শেষ পর্যন্তই চলবে। কিন্তু এখানে শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভাল, যে, তার শিল্পগত দিক নিয়ে এখানে একটি কথাও বলা হবেনা। এখানে মূলত চাহিদা, যোগান ইত্যাদি গোদা ব্যাপার নিয়ে কথা হবে। কারণ, যদিও ‘মান’ পড়ে যাবার জন্য অনেকে সিরিয়াল নির্মাতাদের দোষ দেন, অনেকে সৃষ্টিশীলতার অভাবের কথা বলেন, তার কিছু বাস্তব ভিত্তি থাকাও খুবই সম্ভব (আবার নাও থাকতে পারে), কিন্তু মনে রাখা দরকার, যে, যতই শিল্পের তকমা দেওয়া হোক, আর পাঁচটি পণ্যের মতই, টিভি সিরিয়ালও একটি পণ্য। ঠিক কেমন মাল বানাতে হবে, এ নিয়ে টুথপেস্ট বা গাড়ি কোম্পানিরা যেমন বিস্তর গবেষণা করে একটি পণ্য বাজারজাত করে, টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও অবিকল তাই। তবে গবেষণা সঞ্জাত হলেই কোনো একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত যেমন বাস্তবতাকে ঠিকঠাক প্রতিফলিত করবে তা নাও হতে পারে। অনেক সময়ই বাস্তবকে ভুলভাবে বিশ্লেষণ করার জন্য পণ্য বাজারে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেটি গাড়ি বা টুথপেস্টের ক্ষেত্রেও যেমন, তেমনই সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আবার যেকোনো পণ্যের পরিকল্পনাতেই কিঞ্চিৎ সৃষ্টিশীলতার উৎকর্ষ প্রয়োজন। টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে এই আলোচনায় সিরিয়াল এবং তার মানকে নিছকই একটি পণ্য ও তার গুণাগুণ হিসেবে দেখা হবে। শৈল্পিক উৎকর্ষের মান নিরূপণ এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ফলত মানকেও দেখা হবে নিছকই তার লক্ষ্যবস্তুর নিরিখে। একটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। গাড়ির ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, যে, একদা গাড়ি নামক পণ্যটির লক্ষ্যবস্তু ছিল কেবল উচ্চবিত্ত, কিন্তু ন্যানো নামক গাড়িটি বাজারে এসেছে মধ্যবিত্তকে লক্ষ্যবস্তু করে। আমাদের আলোচনার সাপেক্ষে ন্যানোর ‘মান’ শব্দটির অর্থ গাড়িটির কুশলতা বা সৌন্দর্যের বিবরণ নয়, বরং উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের গাড়িতে পরিণত হওয়াটিকেই আমরা ন্যানোর ক্ষেত্রে মানের পরিবর্তন বলছি। খুব সুস্পষ্ট ভাবে টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও আমরা এই পদ্ধতিটিই অবলম্বন করব। এই লেখার পূর্বানুমান হল, ৮০ দশকের টিভি সিরিয়ালের লক্ষ্যবস্তু ছিল শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত, বা এক কথায় ভদ্রসমাজ। এই ২০১৮ সালে সেই লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তিত হয়ে কী দাঁড়িয়েছে, বা আদৌ পরিবর্তিত হয়েছে কিনা, সেটিই এই লেখার বিষয়বস্তু।
সিরিয়ালের লক্ষ্যবস্তুর অক্ষ পরিবর্তন
আমাদের পূর্বানুমান অনুযায়ী আশির দশকের শুরুতে সিরিয়ালগুলি বানানো হত তৎকালীন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তকে লক্ষ্য করে (সচেতন বা অচেতনভাবে)। লক্ষ্য যদি সরেই যায়, তো পরবর্তীকালে লক্ষ্যবস্তুটি সরে কী হয়েছে? আমরা এতক্ষণ সিরিয়ালকে অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে তুলনা করছিলাম। কিন্তু লক্ষ্যবস্তু নিরূপণের ক্ষেত্রে গাড়ি বা টুথপেস্টের সঙ্গে, অন্তত এই অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে, সিরিয়ালের একটি সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। তফাতটি এই, যে, গাড়ি বা টুথপেস্টের ক্ষেত্রে এই লক্ষ্য পরিবর্তন তথ্যগতভাবে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কারণ একটিই। গাড়ির বিপণনগত সিদ্ধান্ত, এবং তৎসংলগ্ন সমীক্ষা ও মাপজোক কখনই কোনো ভাবেই সাধারণ্যে লভ্য নয়। যেমন ন্যানো গাড়ি এবং বিএমডাব্লিউ এর লক্ষ্যবস্তু যে আলাদা, সেটা বাইরে থেকে আন্দাজ করা সম্ভব, কিন্তু ঠিক কোন লক্ষ্যবস্তুকে লক্ষ্য করে এগুলি বানানো তার নির্দিষ্ট মাপজোক পাওয়া সম্ভব নয়। সেই মাপজোক গাড়ি নির্মাতাদের সম্পত্তি। টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আলাদা। এখানে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণের জন্য আছে একটি নির্দিষ্ট রেটিং ব্যবস্থা, যাকে চালু লব্জে টিআরপি বলা হয়। কোন সিরিয়াল কে দেখছে, এবং কাকে লক্ষ্যবস্তু করে বানানো তার একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা সেখান থেকে পাওয়া সম্ভব। আমাদের অনুসন্ধান তাই এই রেটিং ব্যবস্থা থেকেই শুরু হবে। সেখানে যাবার আগে বলে রাখা ভাল, ভারতীয় রেটিং ব্যবস্থার বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। রেটিংএর বিভিন্ন ব্যবস্থা ভারতবর্ষে নানা সময় চালু ছিল। সে ইতিহাসে এখানে ঢোকা হচ্ছেনা। এই মুহূর্তের ব্যবস্থাটি কী সেটাই এখানে বিবেচ্য। একথাও বলে রাখা উচিত, এই লেখক কোনোভাবেই এই ব্যাপারটিতে বিশেষজ্ঞ নন, ফলে রেটিং সম্পর্কে যা যা তথ্য এখানে দেওয়া হয়েছে, তার সবই যেটুকু সাধারণ্যে লব্ধ, তা থেকে সংগ্রহ করা। ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কিছুটা অসম্পূর্ণও। 'ভিতরের খবর' যাঁদের কাছে আছে, তাঁরা এগিয়ে এলে এই লেখাটিকে সম্পূর্ণতর করে তোলা যেতে পারে।
রেটিং ব্যবস্থা
এই মুহূর্তে ভারতের রেটিং ব্যবস্থাটির নাম এনসিসিএস, যা চালায় বার্ক নামক একটি সংস্থা। এই ব্যবস্থাটি মূলত একটি চলমান সমীক্ষা। একটি নির্দিষ্ট নমুনায় প্রতি দিন কতজন মানুষ ঠিক কতক্ষণ কোন চ্যানেল এবং কোন অনুষ্ঠান দেখছেন, কতক্ষণ দেখছেন, কখন দেখতে-দেখতে উঠে যাচ্ছেন, কখন চ্যানেল বদলাচ্ছেন, সমস্ত তথ্য এই ব্যবস্থায় সংগ্রহ করা হয়। এবং তারপর তার ভিত্তিতে গোটা জনসমাজের কতজন কোন অনুষ্ঠান কতক্ষণ কীভাবে দেখছেন, তার সম্পর্কে কিছু যুক্তিসঙ্গত আন্দাজ বা এস্টিমেট তৈরি করা হয়। ব্যাপারটি অন্যান্য সমীক্ষার মতই। তফাত একটিই, যে, এর তথ্যাবলী প্রতি মুহূর্তে সংগ্রহ করা হয়, এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর সেই তথ্যাবলী পৌঁছে দেওয়া হয় বার্কের গ্রাহকদের হাতে। গ্রাহকরা টিভি চ্যানেল, বিজ্ঞাপনদাতা বা বিজ্ঞাপনী সংস্থা, যে কেউই হতে পারে।
এই পদ্ধতির কিছু প্রযুক্তিগত দিক আছে। সেখানে এই আলোচনায় ঢোকা হবেনা। আমরা এই চলমান সমীক্ষাটির তথ্য ও বিশ্লেষণগত জায়গাটি নিয়েই আলোচনা করব। এই তথ্য ও বিশ্লেষণগত জায়গাটি অন্যান্য সমীক্ষার চেয়ে খুব আলাদা কিছু নয়। যেকোনো শ্রেণীবিভাগ বা সেগমেন্টেশনের পদ্ধতির মতই, এনসিসিএসও জনসমষ্টিকে নানা ভাগে ভাগ করে। এই ভাগ মূলত তিন ধরণের হয়।
১। শহর-গ্রাম। দর্শক মেট্রো শহরের, নাকি ছোটো শহরের, নাকি গ্রামের, এই তথ্য এনসিসিএস জোগাড় করে।
২। লিঙ্গ। দর্শক পুরুষ না মহিলা। তৃতীয় লিঙ্গের তথ্য এখনও দেখা হয়না।
৩। আর্থ সামাজিক অবস্থান। সমস্ত শ্রেণীবিভাগের মধ্যে এইটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং হিসেবের পদ্ধতিটিও সে কারণেই কিঞ্চিৎ জটিল। আর্থ সামাজিক অবস্থান বিচারে, এনসিসিএস রেটিং ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে দুইটি নির্দিষ্ট সূচক অনুযায়ী দেখে। এক, শিক্ষাগত যোগ্যতা। দুই, পরিবারের স্থায়ী সম্পত্তিতে ভোগ্যপণ্যের সংখ্যা (যা, মোটা ভাবে অর্থনৈতিক অবস্থানের সূচক)। এর মধ্যে প্রথমটি সহজ। পরিবারের মূল আয়কারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী জনগোষ্ঠীকে ভাগ করা হয় সাতটি ভাগে, নিরক্ষর থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত। অন্য সূচকটি একটু জটিল। পরিবারের স্থায়ী সম্পত্তির মধ্যে কী কী আছে, তার একটা পরিমাপ এখানে করা হয়, কিছুটা ঘুরপথে। এই পরিমাপের জন্য মোট এগারোটি জিনিসকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ, সিলিং ফ্যান, টিভি থেকে শুরু করে গাড়ি এবং এসি পর্যন্ত। গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে যোগ করা হয়েছে কৃষিজমির মালিকানা।
|
এই এগারোটি জিনিসের মধ্যে একটি পরিবারের মালিকানায় ঠিক কটি জিনিস আছে মাপা হয়। সেই সংখ্যাটিই হল, ঘুরপথে পরিবারটির অর্থনৈতিক সঙ্গতির(বা ক্রয়ক্ষমতার) মাপকাঠি।
|
এবার, পরের ধাপে, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অর্থনৈতিক সঙ্গতির মানকে ধরে একটি ৭X৯ চৌখুপি বানানো হয়, যার একদিকে ৭টি শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যদিকে ৯ টি পর্যন্ত দ্রব্য মালিকানা (কারো ১০ টি দ্রব্য থাকলেও তিনি ৯ এর ঘরেই পড়বেন)। এই চোখুপির ঘর মোট ৬৩ টি। এই ৬৩ টি ঘরে এ১, এ২ থেকে শুরু করে ই২ এবং ই৩ পর্যন্ত নানা মান বসানো হয়। এগুলি হল এনসিসিএস অনুযায়ী একটি পরিবারের আর্থাসামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি।
ব্যাপারটি কীকরে মাপা হয়, তা উপরের সারণী থেকে পরিষ্কার। তবুও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা যাক, আপনি একজন উচ্চমধ্যবিত্ত ভ্দ্রলোক/মহিলা। বাড়িতে এসি, কালার টিভি, ফ্রিজ এবং কম্পিউটার আছে। বিদ্যুৎ, ফ্যান, গ্যাস, মোবাইল তো বটেই। টু হুইলার বা গাড়িও আছে। গুণে দেখুন, আপনার সম্পদের মাপ ৯ বা ততোধিক। আপনি অবশ্যই গ্র্যাজুয়েট বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট। ৬৩ টি খুপরির মধ্যে নিজেকে বসিয়ে দেখুন, একদম নিচের ডানদিকে আপনার অব্স্থান। অর্থাৎ, আপনি হলেন এ১। এবার, আপনার গৃহপরিচারিকাকে ধরা যাক। তিনি স্কুলে গেছেন, কিন্তু সম্ভবত মাধ্যমিক পাশ নন। বাড়িয়ে বিদ্যুৎ, ফ্যান, টিভি আছে, কিন্তু ফ্রিজ নেই। চোখুপিতে ফেলে দেখুন, তিনি সম্ভবত ডি১। বা সি২ ও হতে পারেন।
একটি পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থানকে এনসিসিএস অবিকল এই পদ্ধতিতে মাপে।
টিভি চ্যানেলের দৃষ্টিকোণ থেকে
একটি টিভি চ্যানেলের দিক থেকে বিষয়টা কীরকম? ধরা যাক, আপনি একটি নতুন সিরিয়াল চালু করেছেন। বার্কের থেকে আপনি ঠিক কী তথ্য পাবেন? ঠিক কী তথ্য পাবেন, সেটায় উপরে যা বলা হল, তার চেয়ে অনেক বেশি টেকনিকাল কথাবার্তা থাকবে। তার সবটুকু পাবলিক ডোমেনে পাওয়াও যায়না। কিন্তু দর্শকদের শ্রেণীবিভাগ সংক্রান্ত তথ্যটুকু মোটামুটি সম্পূর্ণভাবেই উপরে দেওয়া হয়েছে। খুব সহজভাবে বলতে গেলে, আপনি টিভি চ্যানেলের মালিক হলে, এরকম একটি সারণী পাবেনঃ
এই সপ্তাহে আপনার অমুক সিরিয়াল দেখেছেনঃ
গ্রামের ৭০ জন লোক।
ছোটো শহরের ২০ জন।
বড় শহরের ১০ জন।
এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪০, মহিলার সংখ্যা ৬০।
আর্থসামাজিক হিসেবে দর্শকদের মধ্যে এনসিসিএস এ ১০ জন, বি ২০ জন, সি .... ইত্যাদি।
এই তথ্যের উপরে দাঁড়িয়ে একজন টিভি চ্যানেলের মালিক বা সিরিয়াল নির্মাতা তাঁর সাফল্য নির্ধারণ করেন, এবং লক্ষ্যবস্তুও চিহ্নিত করেন। বলাবাহুল্য, এই সারণীর সংখ্যাগুলি কল্পিত। এবং ব্যাপারটি সহজবোধ্য। এখানে শহর-গ্রাম, লিঙ্গ বিভাজন, আর্থসামাজিক কাঠামো, সবকটিই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে লিঙ্গগতভাবে মহিলাদের উপর তো খুবই জোর দেওয়া হয়, কিন্তু এই আলোচনায় আমরা বিশেষ করে জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক বিভাজনটির উপরেই গুরুত্ব দেব। সেই নিরিখে এখানে একটি জিনিসই শুধু লক্ষ্য করার মতো। বার্ক যদিও জনগোষ্ঠীকে খুব ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে এ১, এ২ থেকে ই২, ই৩ পর্যন্ত, কিন্তু প্রকাশ করা হয় কেবলমাত্র মোটাদাগের বিভাজনের তালিকা। এ, বি, সি, ডি, ই। এর চেয়ে ছোটো বিভাগগুলির তথ্য বার্কের গ্রাহকরা হাতে পাননা।
এনসিসিএস ও ভদ্রলোক সংস্কৃতি
এবার আসল বিষয়ে ঢোকা যাক। এই রেটিং এর সঙ্গে টিভি সিরিয়ালের ‘মান’ এর সম্পর্কটি ঠিক কী? যে সিরিয়ালগুলি, ধরা যাক, এবি( এ এবং বি) জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্যবস্তু করে নির্মিত হয়, তার নির্মাতাদের কাছে এনসিসিএস এর এই সারণীর গুরুত্ব অপরিসীম। সিরিয়াল নির্মাতারা চান, নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর (এক্ষেত্রে এবি জনগোষ্ঠীর) সর্বোচ্চ সংখ্যক দর্শক তাঁর সিরিয়াল দেখুন। কারণ সংখ্যাটি কম হলেই চ্যানেল মালিক সিরিয়ালটি আর দেখাতে নাও চাইতে পারেন। চ্যানেল মালিক দর্শকের সংখ্যা কম হলে সিরিয়ালটি দেখাতে চাইবেননা, কারণ, কম দর্শকের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপন দিতে চাইবেননা। ফলে টিভি চ্যানেল এবং সিরিয়াল নির্মাতাদের বাণিজ্যিকভাবে একমাত্র লক্ষ্য হল আকাঙ্খিত দর্শকশ্রেণীর সর্বোচ্চ অংশের কাছে (পারলে ১০০% এর কাছে) তাঁর সিরিয়াল পৌঁছে দেওয়া। এবং সেই লক্ষ্যে তাঁরা কতটা সফল, এনসিসিএস সমীক্ষার ধারাবাহিক ফলাফল হল তার রিপোর্টকার্ড। এই রিপোর্ট লুকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। আমাদের ‘মান’ এর সংজ্ঞানুযায়ী তাই এই রেটিং পদ্ধতিটিই সিরিয়ালের মান এর মূল নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ, এবি বর্গটি যেভাবে নির্মিত হয়েছে, সেভাবেই সিরিয়ালের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারিত হচ্ছে। যদি রাম শ্যাম ও যদুকে নিয়ে তৈরি হয় এবি বর্গটি, তাহলে সিরিয়ালের মানের তারাই নিয়ন্ত্রক। এই বর্গ থেকে যদি শ্যামকে বাদ দিয়ে মধুকে যোগ করা হয়, তো সিরিয়ালের মান নির্ধারণ করবে রাম, যদু ও মধু। অর্থাৎ রেটিং এর বর্গীকরণই সিরিয়ালের মান নির্ধারণের ঈশ্বর।
ফলে আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় এখানে এ, বি, সি, ডি, ই, এই বর্গগুলি। সাধারণভাবে ধারাবাহিকনির্ভর টিভি চ্যানেলগুলি দুই ধরণের অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। একটি এনসিসিএস এবি (অর্থাৎ এ + বি) গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট করে। অন্যটি সিডিইকে লক্ষ্য করে। সিডিই নিয়ে এই লেখায় আমাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, এগুলি তথাকথিত নিম্নস্তরকে লক্ষ্য করে বানানো। এখানে আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হল এবি (উদাহরণস্বরূপ, গানের ওপারে বা মহানায়ক এর মতো সিরিয়ালগুলি এবি শ্রেণীকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল)। এই লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল, যে, আশির দশকের শুরুতে টিভি অনুষ্ঠানের লক্ষ্যবস্তু ছিল শিক্ষিত উচ্চ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় 'ভদ্রলোক' শ্রেণী। আমাদের এখন যেটা দেখা দরকার, এই ২০১৮ সালে টিভি রেটিং এর এবি নামক বর্গটি সেই ভদ্রলোক শ্রেণীকেই সূচিত করে কিনা। না করলে ভদ্রলোক শ্রেণী থেকে সেই লক্ষ্যবস্তু কতটা বিচুত হয়েছে। এ থেকিএ বোঝা যাবে, আজ, এই মুহূর্তে টিভি সিরিয়ালের সংস্কৃতি কতটা ভদ্রলোকের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বমূলক। এবং টিভি সিরিয়ালের মান ঠিক কতটা পরিবর্তিত হয়েছে।
এখানে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। 'ভদ্রলোক' এখানে কোনো অর্থনৈতিক শ্রেণী নয়। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে, বর্গটি অলীক। বাংলার ইতিহাস রচনায় সুমিত সরকার থেকে শুরু করে জয়া চ্যাটার্জি পর্যন্ত প্রতিটি ঐতিহাসিককেই নিজস্ব এই বর্গটি ব্যবহার করতে হয়েছে। দেশভাগ পূর্ব যুগের ক্ষেত্রে এই বর্গটি ব্যবহৃত হয়েছে, কৃষক নয়, কিন্তু কৃষি উৎপাদনের উদ্বৃত্তভোগী (প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে), শিক্ষিত সম্প্রদায়, এই অর্থে। কিন্তু সকল বর্গের মতই এটিরও 'অর্থ' ক্রমঃপরিবর্তনশীল। বিশেষ করে ভূমিসংস্কারের পর 'ভদ্রলোক' বর্গে এখন 'শিক্ষিত চাকুরিজীবি' অর্থই অধিকতর সুপ্রযুক্ত। কিন্তু এখানে সেই আলোচনা অর্থহীন, কারণ এই লেখা ‘ভদ্রলোক’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য নয়। এই একবিংশ শতকে ভদ্রলোকের কিছু লক্ষণ মোটামুটি সর্বজনগ্রাহ্য। সেটুকু ধরে নিয়েই এখানে এগোনো হবে।
এবং এখানে আরও একটি জিনিস উল্লেখ করা অবশ্য প্রয়োজন। যে, ‘ভদ্রলোক’ একটি নিছকই বাঙালি বা তথাকথিত ‘আঞ্চলিক’ বর্গ। এই পুরো বিশ্লেষণই করা হচ্ছে এই আঞ্চলিক বর্গটির উপর দাঁড়িয়ে। তাই এই বিশ্লেষণ একেবারেই ‘সর্বভারতীয়’ নয়। আঞ্চলিক টিভি সিরিয়ালের চরিত্র নিয়ে একটি আঞ্চলিক বিশ্লেষণ। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক তথ্যের অভাবে সরবভারতীয় তথ্য নিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে। কিন্তু তার পরেও এই লেখা সম্পূর্ণই আঞ্চলিক। বাঙলা ভাষায় লিখিত বাঙালিদের নিয়ে প্রতিবেদন।
ভদ্রলোকের সন্ধানে
অতএব মূল প্রশ্নটি এখানে দাঁড়াল এই, যে, সিরিয়ালের মান পরিবর্তন মাপতে গেলে এনসিসিএস বর্গগুলির মধ্যে, বিশেষ করে এনসিসিএস এবির মধ্যে ভদ্রলোককের কী অবস্থান, সেটা জানা দরকার। কিন্তু এনসিসিএস বর্গগুলির মধ্যে আমরা ভদ্রলোককে খুঁজে পাব কীকরে? তার জন্য এনসিসিএস বর্গীকরণ পদ্ধতিটি খুঁটিয়ে দেখা দরকার। এনসিসিএস এর স্থায়ী সম্পত্তির যে তালিকা, সেটি আমাদের হাতে আছে। হিসেবটা সহজ হয়ে যায়, যদি তার মধ্যে এই মুহূর্তে কোনো একটি বা একাধিক সামগ্রি এক কথায় ‘বাঙালি ভদ্রলোক’কে সূচিত করে। এরকম কোনো সামগ্রী কি ওই তালিকায় আছে? সেটা খুঁজে দেখাই আমাদের অনুসন্ধানের পরবর্তী ধাপ।
তালিকায় যা আছে, তাঅর মধ্যে এসি, জমি, গাড়ি, ল্যাপটপ বা ওয়াশিং মেশিন কোনোটাই ‘এক কথায়’ ভদ্রলোককে সূচিত করেনা। কারণ ‘ভদ্র’ বাড়িতে এগুলি থাকতেই পারে, কিন্তু থাকবেই এমন বলা যায়না। আবার বিদ্যুৎ সংযোগ, ফ্যান, মোটরবাইক, বা টিভিও নয়। কারণ ‘ভদ্রলোক’ এর বাড়ি ছাড়াও এগুলির অবাধ গতি। বিদ্যুৎ এবং ফ্যান পশ্চিমবঙ্গে ৯০% পার করে দিয়েছে। টিভি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ৬৫% (নিচের সারণী দ্রষ্টব্য)। ফলে এরা ‘ভদ্রলোক’এর একার সম্পত্তি নয়।
মূল সূত্রঃ আইসিই ৩৬০ সমীক্ষা। চিত্রঃ https://www.livemint.com/Specials/bhWpWqj3AFuETVdsC05fdM/In-India-washing-machines-top-computers-in-popularity.html
ফলে বাকি পড়ে রইল রান্নার গ্যাস এবং ফ্রিজ। এরা উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এরা একটি নির্দিষ্ট মানসিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। গ্যাস নিয়ে বিশেষ কাজ হয়নি, কারণ গ্যাস খোলা বাজারে সেভাবে সর্বত্র পাওয়া যায়না বা যেতনা। কিন্তু ফ্রিজ নিয়ে একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ফ্রিজ বাড়িতে আসে মূলত মেয়েদের (যাঁরা রান্না করেন) চাহিদার জন্য (সেইজন্য দাম একই রকম হলেও ফ্রিজের চাহিদা টিভির চেয়ে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে চিরকালই কম)। মেয়েদের শ্রম কমানো বা সেদিকে নজর দেওয়া, বা বাড়িতে গৃহিণীর তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক স্থান বাঙালি ‘ভদ্র’ বাড়ির একটি লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে এটি একটি নির্দিষ্ট জীবনঘরানার দিকে অঙ্গুলীনির্দেশও করে। এই তালিকাতেই, যিনি টিভি কিনেছেন, তাঁর বাড়িতে অবশ্যই বিদ্যুৎ আছে, ফ্যান আছে, টিভি আছে, যোগান থাকলে গ্যাসও অবশ্যই আছে। এবং এর পরের ধাপে তিনি সম্ভবত ওয়াশিং মেশিন বা এসি কিনতে পারেন, যদিনা ইতিমধ্যেই কিনে থাকেন। এবং বাড়িতে ফ্রিজ না থাকলে ওয়াশিং মেশিন যে ঢোকা মুশকিল, এ নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই।
ফলে, আমরা ধরে নেব, ‘ভদ্রলোক’এর বাড়িতে ফ্রিজ থাকবেই। ফ্রিজ থাকার অর্থ বিদ্যুৎ সংযোগ আবশ্যক। সঙ্গে আসবে ফ্যানও, কারণ বাড়িতে ফ্যান নেই কিন্তু ফ্রিজ আছে, এ কথা ভাবা অসম্ভব। একই কথা টিভি সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এ ছাড়া বাড়িতে অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু এই পাঁচটি জিনিস থাকবেই। এ হল দ্রব্যের মালিকানা সংক্রান্ত সূচক। একই সঙ্গে বাঙালি ‘ভদ্রলোক’এর আরও একটি পরিচিত সূচক ইতিমধ্যেই আছে। সেটি হল শিক্ষা। ৫০এর দশক থেকেই কলেজ পাশ না করে কেউ ‘ভদ্রলোক’ হননি। ভদ্রমহিলা হতে পারতেন। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে সে সুযোগও আর নেই। ফলে কলেজ শিক্ষা এবং ফ্রিজ এই দুটি যদি কোনো বাড়িতে পাওয়া যায়, তাকে মোটামুটিভাবে আমরা ভদ্রবাড়ি বলতে পারি। অবশ্যই এটি ভদ্রলোক মাপার খুব নিখুঁত কোনো পদ্ধতি নয়, কিন্তু যা উপাদান আছে, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে যথাযথ।
এবার এনসিসিএস এর দ্রব্যসামগ্রীতে ফেরা যাক। আমাদের প্রকল্প অনুযায়ী পাঁচটি দ্রব্য ‘ভদ্র’জনের বাড়িতে থাকবেই। সেই পাঁচটি নিচে দেওয়া হলঃ
এবং একই সঙ্গে ভদ্রবাড়ির মূল উপার্জনকারী ব্যক্তি কলেজ শিক্ষিতও হবেন।
এই পুরোটা এবার আমরা এনসিসিএস চৌখুপিতে বসিয়ে দেখব, বাঙালি ‘ভদ্রজন’ সেখানে কোন এলাকা দখল করেন। এলাকাটিকে নিচে লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হল।
এবার এই প্লটিং এর সমস্যা হল, ৫ সংখ্যাটা গ্রামের ক্ষেত্রে গোলমেলে। ফ্রিজ বা এলপিজি নেই, কিন্তু বাইক এবং চাষের জমি আছে, এরকম লোকজন এই এলাকায় ঢুকে পড়তে পারে। বস্তুত বাইক ব্যাপারটা শহর এবং গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই গোলমাল তৈরি করতে পারে। আমাদের অর্ডিনাল তালিকায় (বিদ্যুত -- ফ্যান -- টিভি -- ফ্রিজ -- ওভেন) এর মাঝে টিভির পরেই বাইক ঢুকে পড়তে পারে। আমাদের এই লাল রঙের বাক্সে সেই সমস্যাটি আছে। ‘প্রকৃত ভদ্রলোক’কে ধরতে গেলে বাক্সটার আকার আরও খানিকটা কমবে। কিন্তু কতটা কমবে, এই ১১ টি বস্তুর ক্রমিকসংখ্যাহীন তালিকায় সেটা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু মোদ্দা পয়েন্টটা হল, এনসিসিএস এবির চেয়ে 'ভদ্র' পরিবারের পরিধি অনেকটাই ছোটো। এবং সেটা ঠিকঠাক করে মাপার কোনো যন্ত্র এনসিসিএস মাপকাঠি আমাদের দেয়নি।
আরও কিছু মাপজোক
তবে এনসিসিএস কাঠামোয় ঠিকঠাক না ধরলেও ভদ্রলোক বর্গটির কিছু আনুমানিক পরিমাপ করাই যায়। বার্কের তথ্যানুযায়ী এনসিসিএস এবির বর্গের মোট যোগফল ভারতের ৪৪% জনসমষ্টি। এর মধ্যে অর্থনীতির বিচারে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অবশ্যই আছে। পরের ২০ শতাংশ হুবহু আছে কিনা বলা শক্ত। তবে মাপজোকের খাতিরে ধরে নেব তারাও আছে (সেটা খুব একটা ভুল আন্দাজ নয়)। এর থেকে একটা অংশকে আমরা বাদ দিয়ে 'ভদ্রলোক' এলাকাটি বানিয়েছি। বাদ দেবার মূল মাপকাঠিটা হল শিক্ষা এবং ফ্রিজ। সেটা বাদ দিতে গেলে দুটো ধাপ।
১। উপরের ৪০% এর মধ্যে প্রথমে মোট স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরদের অংশ কত সেটা বার করতে হবে। সেটা প্রথমে করে ফেলা যাক।
২০১১র সেন্সাস অনুযায়ী অন্তত একজন গ্র্যাজুয়েটসহ বাড়ির সংখ্যা ১৬.৭%।
চিত্রঃ https://factly.in/1-out-of-every-6-indian-households-has-at-least-one-graduate/
গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে ৭৮% ই উপরের চল্লিশ শতাংশে আছেন (৬০ + ১৮)। (বন্ধনীর মধ্যে সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশ এবং তার পরের কুড়ি শতাংশের মাপ আলাদা করে দেখানো আছে। পরবর্তী বন্ধনীগুলিতেও তাইই আছে, ফলে আলাদা করে উল্লিখিত নেই)
সূত্রঃ আইসিই ৩৬০ সমীক্ষা, চিত্রঃ https://www.livemint.com/Politics/AvHvyHVJIhR0Q629wkPS5M/Indias-richest-20-account-for-45-of-income.html
বাকি অঙ্কটি সোজা। ১৬.৮% গ্র্যাজুয়েট পরিবারের মধ্যে উপরের চল্লিশ শতাংশে আছেন ৭৮%। অতএব গ্র্যাজুয়েট এবং উপরের চল্লিশ শতাংশে আছেন এরকম পরিবার হল (৬০ + ১৮)১৬.৮% = ১৩% (১০ + ৩)।
২। এবার পরের ধাপ। এই ১৩% এর মধ্যে কতজনের ফ্রিজ আছে বার করতে হবে। আইস সমীক্ষা অনুযায়ী সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশে ফ্রিজ আছে ৬০% বাড়িতে। পরের ২০% তে ৩৫% মানুষের হাতে। এই হিসেবটা একটু জটিল। কারণ ফ্রিজের মালিকানা সমহারে বিস্তৃত নাই হতে পারে। শিক্ষার সঙ্গে নারীর অবস্থান এবং নারীর অবস্থানের সঙ্গে ফ্রিজ, এদের একটা জোরদার সম্পর্ক থাকা খুবই সম্ভব। কিন্তু তার তথ্য হাতে না থাকায় আমরা সবচেয়ে কম এবং সবচেয়ে বেশি, এই দুটো হিসেবই করব। সর্বোচ্চ কুড়ি শতাংশের ৬০% এবং পরের কুড়ির ৩৫%র কাছে ফ্রিজ আছে এবং এই হারটি সুষম ধরে নিলে সংখ্যাটি দাঁড়ায়ঃ .১ X .৬ + .০৩ X .৩৫ = ৭% (৬+১) । এটা উপরের ৪০% এর মধ্যে ভদ্রলোকের সর্বনিম্ন উপস্থিতির মাপ। সর্বোচ্চ মাপ (উপরের ৪০% এর যারাই গ্রাজুয়েট, তাদেরই ফ্রিজ আছে) হল ১৩%। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে উপরের ৪০% এর মধ্যে ভদ্রলোকের সংখ্যা ৭% থেকে ১৩% এর মধ্যে। প্রকৃত সংখ্যাটি অবশ্যই এর মাঝামাঝি কোথাও। ঠিক কোথায় এই প্রত্যাশিত মান, তা জানার কোনো অস্ত্র আমাদের হাতে নেই। অতএব, এর পর থেকে আমরা হিসেবের সুবিধের জন্য ঠিক মাঝামাঝি একটি মান ব্যবহার করব। অর্থাৎ ১০%(+ - ৩%)।
সংখ্যাটি ঠিক যাই হোক না কেন, এ থেকে একটি জিনিস পরিষ্কার, যে, এনসিসিএস এবি কোনোভাবেই ‘ভদ্রলোক’দের প্রতিনিধিত্ব করেনা। এনসিসিএস এবির জনসংখ্যা, মোট জনসংখ্যার ৪৪%। ভদ্রলোকদের আনুমানিক সংখ্যা যেখানে ১০%। একচতুর্থাংশেরও কম। অতএব ভদ্রলোকদের পছন্দের টিভি সিরিয়াল যে গণতান্ত্রিক টিআরপির বিচারে ফ্লপ হবে, ‘গানের ওপারে’র মতো সিরিয়ালগুলি যে বন্ধ হয়ে যাবে, তাতে একেবারে বিস্ময়ের কিছু নেই। এতে ম্যাজিক বা সৃষ্টিশীলতার অভাব, কিছুই নেই। পুরোটাই এই রেটিং ব্যবস্থার ফল, যেখানে এক ব্যক্তি এক ভোট।
বাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্র
কিন্তু বাজার অর্থনীতি ও গণতন্ত্র, এরা তো একই ভাষায় কথা বলেনা। গণতন্ত্রে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এক ব্যক্তি একটি ভোট। কিন্তু বাজার অর্থনীতিতে ভোক্তাদের ক্ষেত্রে একেবারেই তা নয়। বাজারে যে ভোক্তার পকেটে ১০ টাকা আছে, তাঁর ক্ষমতা যে ব্যক্তির কাছে ১ টাকা আছে, তাঁর চেয়ে ১০ গুণ বেশি। টিভি সিরিয়াল যেহেতু বিজ্ঞাপনদাতাদের পয়সায় চলে, বাজারের ভাষায় কথা বলে, তাই জনসংখ্যার চেয়েও অর্থনৈতিক জোর অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা। তাই আমরা এবার ভদ্রলোকদের অর্থনৈতিক পেশিশক্তির জোর একটু খুঁটিয়ে দেখব। অর্থাৎ, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কত।
এই হিসেবটিও নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়। অঙ্কটি কষার একমাত্র সহজ উপায় হতে পারে এনসিসিএস এর সম্পূর্ণ তথ্য থেকে অঙ্কটি শুরু করা। কিন্তু সেই তথ্য হাতে নেই। ফলে এক্ষেত্রেও আমাদের কিছু মোটামুটিকরণ বা অ্যাপ্রক্সিমেশনের সাহায্য নিতে হবে। সেই পদ্ধতিতে অঙ্কটি নানাভাবে করা যেতে পারে। আমরা সহজতম পদ্ধতিটি নেব। আমাদের ‘ভদ্রলোক’ সংজ্ঞানুযায়ী অতি অবশ্যই একজন গ্র্যাজুয়েট (বা তাঁর বাড়ির মূল উপার্জনকারী একজন গ্র্যাজুয়েট)। আমরা দেখব ভারতে একজন গ্র্যাজুয়েটের গড় উপার্জন কত।
সূত্রঃ https://www.tandfonline.com/doi/full/10.1080/23322039.2014.941510
এই সারণী থেকে দেখা যাচ্ছে, একজন মাধ্যমিকোত্তর ব্যক্তি ভারতের গড় উপার্জনের চেয়ে ৩.৩ গুণ বেশি আয় করেন। যদিও আমাদের ভদ্রলোকের নিম্নতম সীমা এর চেয়ে একটু উঁচুতেই, এবং সেক্ষেত্রে অনুপাতটি একটু বেশিই হবে। কিন্তু আপাতত কাজ চালানোর জন্য আমরা এই অনুপাতটিই ধরে নেব। দ্বিতীয় একটি আন্দাজও আমাদের করতে হবে। এই সারণীতে ব্যক্তির আয়ের কথা বলা আছে, আমরা ধরে নেব পারিবারিক ক্ষেত্রেও এই একই অনুপাত মোটামুটিভাবে প্রযোজ্য। অর্থাৎ, যে বাড়িতে অন্তত একজন কলেজ শিক্ষিত আছেন, সেই বাড়ির উপার্জন, গড় গৃহগত উপার্জনের ৩.৩ গুণ।
এই দুটি আন্দাজ করে নিলে মোটামুটি হিসেবটি খুব সহজেই করে ফেলা যায়। আমাদের ভদ্রলোকদের উপার্জন (অর্থাৎ ১০% গ্র্যাজুয়েট পরিবারের উপার্জন) সমস্ত জনগোষ্ঠীর উপার্জনের ৩৩% বা এক তৃতীয়াংশ।
এনসিসিএস এবির উপার্জন কত? এনসিসিএস এবির সামগ্রিক অংশ হল জনসংখ্যার ৪৪%। তার মধ্যে জনসংখ্যার উপরের ৪০% খপে খাপ মিলে যায় ধরে নিলে নিচের চিত্র থেকে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে। সংখ্যাটি ৪৫%। যদিও চিত্রটি ডিসপোজেবল ইনকামের, কিন্তু সামগ্রিক উপার্জন ধরলেও সংখ্যাটি মোটামুটি একই থাকে। বাহুল্য বোধে সেই হিসেবটি আর দেওয়া হলনা (সূত্রের লিংকে ক্লিক করে গেলে এবং সামান্য একটু অঙ্ক কষলেই হিসেবটি পাওয়া যাবে)।
সূত্রঃ আইসিই ৩৬০ সার্ভে, চিত্রঃ https://www.livemint.com/Politics/AvHvyHVJIhR0Q629wkPS5M/Indias-richest-20-account-for-45-of-income.html
ফলে আমাদের হিসেব অনুযায়ী অর্থনৈতিক জোরের ভিত্তিতে এনসিসিএস এবির তিন-চতুর্থাংশ জোরই ভদ্রলোক শ্রেণীর।
বিচিত্র বাজার
আমাদের সংখ্যাগুলি আনুমানিক, যদিও বাস্তব থেকে খুব দূরে থাকার এদের কোনো কারণ নেই। এবং এই সংখ্যাগুলি ধরে নিলে আমরা এক বিচিত্র পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। এনসিসিএস এবি বর্গের মধ্যে সংখ্যার জোরে ভদ্রলোক শ্রেণী হলেন ১/৪ ভাগ। কিন্তু অর্থনৈতিক জোরের ভিত্তিতে তাঁদের জোর ৩/৪ ভাগ। আগেই বলা হয়েছে, বাজার অর্থনীতিতে ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ কখনই প্রযোজ্য নয়। সেই হিসেবে টিভি সিরিয়ালগুলিতে (যে গুলির লক্ষ্য বস্তু এবি বর্গ) ভদ্রলোকদের প্রভাবই শেষ কথা হওয়া উচিত। কিন্তু এনসিসিএস রেটিং এর কারণে বাজারের এই নিয়ম খাটেনা। এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় গণতন্ত্রের ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নীতি।
ব্যাপারটি কেন অদ্ভুত একটি কল্পিত উদাহরণসহ বলা যাক। ধরা যাক, আন্দামানে একটি জুতো উৎপাদন/বিপণনেরর পরিকল্পনায় জনৈক বাঙালি যুবতী, জনৈক তামিল যুবক এবং দশজন জারোয়াকে হাজির করা হয়েছে, যারা কখনও জুতো পরেনি। কোম্পানির মাথা সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারা কোন জুতো ভালবাসেন?’ সবাই ভোট দিলেন। এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ঠিক হল ‘সবচেয়ে জনপ্রিয় জুতো’ কোনটি। এবং পরবর্তী জুতোর পরিকল্পনা সেই হিসেবেই করা হল। গণতন্ত্র হিসেবে ব্যাপারটি ঠিকই আছে। কিন্তু যেকোনো কোম্পানির মাথা এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাঁকে পাগল বলা হত। কারণ, যে দশজন জারোয়ার অদূর ভবিষ্যতে জুতো কেনার কোনো সম্ভাবনাই নেই, জুতো উৎপাদনের পরিকল্পনায় তাদের ভোটের ভূমিকা কী? সংক্ষেপে বললে, শূন্যের কাছাকাছি। যে জিনিয়াস মার্কেটিং ব্রেন জারোয়াদের মধ্যে জুতো বিক্রির প্রভূত পোটেনশিয়াল দেখেছিলেন (একজনও জুতো পরেনা, অতএব সকলকেই বেচা যাবে), এমনকি তিনিও কোন জুতো বেচবেন তার পরিকল্পনায় যে জারোয়াদের নেওয়া অর্থহীন, সে বিষয়ে একমত হতেন।
রেটিং এর হিসেবে সিরিয়ালের জগতেও প্রায় কাছাকাছি জিনিসই হয়ে চলেছে। বিজ্ঞাপনদাতারা সিরিয়ালে পয়সা ঢালেন সম্ভাব্য ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য। অথচ তিন-চতুর্থাংশ ক্রয়ক্ষমতার অধিকারীকে অবজ্ঞা করে সিরিয়ালের বিষয়বস্তু তৈরি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার গণতান্ত্রিক ভোটে। বাজার অর্থনীতিতে ব্যাপারটি অকল্পনীয়।
অকল্পনীয় হলেও ব্যাপারটি অলীক নয় একেবারেই। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা একেবারেই এই অকল্পনীয় ঘটনা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। ‘গানের ওপারে’ নামক একটি সিরিয়াল এই দশকের শুরুতে ভদ্রলোকদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু সিরিয়ালটি বন্ধ হয়ে যায় খারাপ রেটিং এর কারণে। সেটি অতি অবশ্যই এই ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’ নামক গণতান্ত্রিক রেটিং পদ্ধতির কারণে। তখনও এনসিসিএস রেটিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। চালু ছিল এর পূর্বসূরী সেক নামক একটি ব্যবস্থা। কিন্তু ২০১০ বা ১১ সালে সেক ব্যবস্থার অভিমুখ, আজকের এনসিসিএস ব্যবস্থারই অনুরূপ ছিল। কিন্তু সিরিয়ালটি বন্ধ হয়ে যাওয়া, বর্তমান আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বড় ঘটনা নয়। অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটে এর পরে। যদিও, সংখ্যার বিচারে সিরিয়ালটি সুপারফ্লপ, কিন্তু এর নবাগত অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা, কেবলমাত্র এই একটি সিরিয়ালের কারণেই হয়ে ওঠেন ‘জনপ্রিয়’। পরিণত হন সিনেমার হিরো এবং হিরোইনে। সাধারণ বুদ্ধিতে এই ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া অসম্ভব। যে সিরিয়াল সুপার ফ্লপ, তার অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা বাজারের হিসেবেই একযোগে সুপারহিট হয়ে উঠতে পারেননা। কিন্তু অদ্ভুত হলেও ঘটনাটি ঘটেছে। তার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ হতে পারে এই, যে, ভদ্রলোকদের পছন্দ, এখনও, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সিরিয়ালের বাজারে সেই সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তি পাত্তা পায়না, কারণ সেখানে অর্থনীতি বা সামাজিক শক্তি বিবেচ্য নয়, বিবেচ্য হল ‘এক ব্যক্তি এক ভোট’।
এর মোটামুটি বছর দশেক আগে, বাংলা সিরিয়ালের জগতে ভদ্রলোকদের লক্ষ্যবস্তু করে আরও একটি নন-ন্যারেটিভ ধাঁচের টিভি সিরিয়াল চালু হয়েছিল। তার নাম 'এক আকাশের নিচে'। সিরিয়ালটি শেষ হয় ২০০৫ সালে। গানের ওপারে এবং এক আকাশের নিচে এই দুটি সিরিয়ালের মধ্যে পরিণতিতে অদ্ভুত মিল এবং চূড়ান্ত অমিল দুইই দেখা যায়। মিলের জায়গাটি হল এই, যে, এই সিরিয়ালের অভিনেতা ও অভিনেত্রীরাও, অনেকেই, কেবল্মাত্র এই একটি সিরিয়ালের কারণেই পরবর্তীতে 'জনপ্রিয়' অভিনেতা ও অভিনেত্রীতে পরিণত হন। আর অমিলের জায়গাটি হল, সিরিয়ালটি রেটিং এর বিচারে গানের ওপারের মতো ফ্লপ তো নয়ই, বরং সুপারহিট।
এ থেকে দুটি জিনিস বোঝা যায়। এক, একজনকে 'জনপ্রিয় অভিনেতা' বানিয়ে তোলার জন্য ভদ্রলোকের যা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পেশিশক্তি, তা ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে অপরিবর্তিত ছিল। দুই, যা খুবই আগ্রহোদ্দীপক, রেটিং ব্যবস্থাটির অভিমুখ ২০০৫ থেকে ২০১০ মধ্যে, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ভারতীয় রেটিং ব্যবস্থা বিগত তিন দশকে বিপুল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। এমনিতেও ২০০০ সালে টিভির প্রবেশাধিকার শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে এবং সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এত ব্যাপক ছিলনা। এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য হাতে নেই (এই লেখক সংগ্রহ করতে পারেননি), ফলে এই নিয়ে পরিমাপসূচক কোনো জায়গায় পৌঁছনো, এই মুহূর্তে কোনো সম্ভব না, কিন্তু ২০০০ সালে টিভি এই পরিমান গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেনি, দর্শকদের মধ্যে 'ভদ্রলোক' এর পরিমান অনেক বেশি ছিল, এ নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই। তদুপরি রেটিং ব্যবস্থাটিও এই সময়কালের মধ্যে বিবর্তিত হয়েছে। শুরুতে রেটিং হত শুধু মেট্রো শহর এলাকায়। পরবর্তীতে বড় শহরগুলিকেও এর মধ্যে আনা হয়, কিন্তু ছোটো শহহরগুলি বাদ ছিল। ধাপে-ধাপে ছোটো শহর এবং গ্রাম অঞ্চলকেও ঢুকিয়ে আনা হয় রেটিং ব্যবস্থায়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই ৯০ দশক থেকে শুরু হয়ে ২০১২ পর্যন্ত চলে। ২০১২ সালে একটি তীব্র আইনী বিতর্ক সৃষ্টি হবার পর ব্যবস্থাটি বদলে আজকের এনসিসিএস রেটিং এ বিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনেরও সম্পূর্ণ এবং নিখুঁত সময়সীমা সাধারণের নাগালে উপস্থিত নেই। তবে আন্দাজ করা যায়, যে, টিভি দর্শকের সংখ্যা বাড়া এবং রেটিং এর পদ্ধতি বদল, এই দুই মিলিয়ে রেটিং এর 'গণতান্ত্রিকীকরণ' এর অভিমুখ তৈরি হয় ২০০৫ থেকে ২০১০ এর মধ্যবর্তী কোনো সময়। মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে 'এক আকাশের নিচে'র সুপারহিট হওয়া এবং 'গানের ওপারে'র সুপারফ্লপ হওয়া (রেটিং এর বিচারে), সেই দিকেই নির্দেশ করে।
বিষয়টি আরও কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে ওঠে, যদি এর মধ্যে হিন্দি সিরিয়ালকেও যোগ করা যায়। যে সময় কালের কথা এখানে হচ্ছে অর্থাৎ ২০০০-২০০৫, যখন এক আকাশের নিচে তুমুল জনপ্রিয়, ঠিক একই সময় 'সর্বভারতীয়' টেলিভিশনে হইহই করে চলছে 'কিঁউ কি সাস ভি কভি বহু থি', টিভি সিরিয়ালের মানাবনমনের ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের বিচারে যে সিরিয়ালটিকে সূচনাবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ একই সঙ্গে রেটিং ব্যবস্থা, একই সময়কালে বাংলা সিরিয়ালের ক্ষেত্রে 'ভদ্রলোক' এর সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিচ্ছে, অথচ হিন্দি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে, তা অনেক বেশি 'গণতান্ত্রিক'। এর থেকেও একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায়, যে, 'ভদ্রলোক' নামক যে বর্গটিকে আমরা এত সময় ধরে নির্মান করলাম, তা একান্তই বাংলার বৈশিষ্ট্য। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে, অন্তত হিন্দি বলয়ে সংস্কৃতির ভদ্র-অভদ্র জনবিভাজিকা নেই, বা থাকলেও সুস্পষ্ট নয়। ফলে 'ভদ্রলোক' মাপকাঠিটি হিন্দি বলয়ের ক্ষেত্রে একেবারেই অচল। এ অবশ্য নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, এই লেখাতেও আগেই বলা হয়েছে, তার আগেও দেশভাগ এবং অন্যান্য আলোচনায় বারবারই উল্লেখ করা হয়েছে, যে, 'ভদ্রলোক' বাঙালির একটি নির্দিষ্ট বর্গ, যা বাংলার বাইরে প্রযোজ্য নয়। ভদ্রলোক-ছোটোলোক দ্বিত্ব বাংলার নিজস্ব দ্বিত্ব, হিন্দি বলয়ের উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ বা ওই জাতীয় দ্বৈতের থেকে চরিত্রে যা সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের এই আলোচনা একান্তভাবেই বাংলা কেন্দ্রিক। হিন্দি বলয়ের ক্ষেত্রে বা দক্ষিণ ভারতের ক্ষেত্রে অনুরুপ কোনো বর্গ উদ্ভুত হতেই পারে, সে নিয়ে আলোচনাও করা যেতে পারে, কিন্তু সেটি এই নিবন্ধের আলোচ্য নয়। এখানে এইটুকুই বলার যে, রেটিং এর ক্ষেত্রে হিন্দি বলয়ের চলাচল একেবারেই আলাদা। এক্ষেতেরে 'সর্বভারতীয়' কোনো বিশ্লেষণ সম্ভবই নয়। ফলে এই নিবন্ধের আলোচনা সম্পূর্ণভাবেই 'আঞ্চলিক'। এই 'আঞ্চলিকতা'র বিচারেই দেখা যাচ্ছে, যে মান পরিবর্তনের অনুসন্ধানে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই মান পরিবর্তনটি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে সত্যিই ঘটেছে। বাংলায় ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক আধিপত্যের হাত থেকে বেরিয়ে রেটিং এর 'গণতান্ত্রিকীকরণ' হয়েছে মোটামুটি ২০০৫ থেকে ১০ এর মধ্যে। তারপরই টিভি সিরিয়ালের (যেগুলির লক্ষ্য এবি) তথাকথিত 'মান' পড়তে বা নড়তে থাকে। এর পিছনের দায়টি রেটিং ব্যবস্থার। সৃষ্টিশীলতার অভাব, রুচির অধঃপতন কোনোকিছুই না।
অনুসিদ্ধান্ত
তাহলে এই পুরো নিবন্ধে আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, তা সংক্ষেপে এইঃ
১। ৮০র দশক থেকে ২০১৮ এর মধ্যে টিভি সিরিয়ালের মান পরিবর্তিত হয়েছে।
২। মান পরিবর্তনের কারণ মূলত লক্ষ্যবস্তুর পরিবর্তন ( আমাদের মানের সংজ্ঞানুসারেই)।
৩। 'উচ্চমান'এর সিরিয়ালগুলির ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু, বাংলার ক্ষেত্রে ১৯৮০ র দশকে ছিলেন 'ভদ্রলোক'রা। ২০১৮ সালে লক্ষ্যবস্তু পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে এনসিসিএস এবি নামক একটি বর্গ।
৪। এই এবি নামক বর্গটিতে অর্থনৈতিকভাবে তিন-চতুর্থাংশ শক্তি ধরে 'ভদ্রলোক' শ্রেণী, কিন্তু সংখ্যাগতভাবে তাদের সংখ্যা মাত্র এক-চতুর্থাংশ।
৫। বাজারের সঙ্গে গণতন্ত্রের এক অদ্ভুত মিশেলে টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয়তা বিচারে অর্থনৈতিক জোরের বদলে সংখ্যাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। টিভি সিরিয়ালের মান পরিবর্তনের এটিই কারণ। একদিকে যেমন নির্মাতাদের সৃষ্টিশীলতার অভাব এই পরিবর্তনের কারণ নয়, তেমনই জনতার রুচি পরিবর্তনও এর কারণ নয়। অর্থাৎ 'ভালো পরিচালক আর নেই', এবং 'মানুষ যা ভালোবাসছে তাই দেখানো হচ্ছে' দুটি কথাই একেবারে অর্থহীন। এবি বর্গটির চরিত্র রেটিং পদ্ধতিতে যেভাবে নির্মিত হয়েছে, সিরিয়ালের মানকে, সেটিই নির্ধারণ করছে। রেটিং পদ্ধতি বদলালে সিরিয়ালের মানও বদলবে।
৬। এই লক্ষ্যবস্তু তথা মান পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয়েছে ২০০৫ থেক ২০১০ এর মধ্যে কোনো এক সময়ে।
এই সিদ্ধান্তগুলি এই নিবন্ধে নিঃসংশয়ে প্রমাণিত হয়েছে এমন না। কিন্তু তথ্যগতভাবে দেখা যাচ্ছে, এমনটাই হবার সম্ভাবনা যথেষ্ট প্রবল। এবং এগুলি যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তবে তার কিছু ফলাফলও আছে।
এই পুরো লেখায় জ্ঞানত কোনো পক্ষ নেওয়া হয়নি। নৈতিক বা অন্যরকম। শুধু প্রক্রিয়াটিকে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। বাজার অর্থনীতি এবং এক আধা-গণতান্ত্রিক সূচক এই দুয়ের অদ্ভুত মিশ্রণের ফলাফলগুলি কী, সেটিও এখানে পক্ষ না নিয়েই লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য এগুলি সম্পূর্ণই আঞ্চলিক অনুসিদ্ধান্ত। কোনোভাবেই সর্বভারতীয় নয়।
এক। সিরিয়ালের লক্ষ্যবস্তুর পরিবর্তন। এ কথা গোটা নিবন্ধ জুড়েই বলা হয়েছে। মূলত এই শতকের প্রথম দশকে সিরিয়ালের লক্ষ্যবস্তু 'ভদ্রলোকের সমাজ' থেকে সরে অন্যত্র সরে যায়। ফলে টিভিতে সিরিয়াল হিসেবে তার পর থেকে যা দেখা যায়, তা 'জনপ্রিয় সংস্কৃতি', অন্তত প্রযোজক বা পরিচালকরা যাকে জনপ্রিয় সংস্কৃতি হিসেবে ভাবেন। ভদ্রলোকীয় 'রুচি'র পরিচয় সিরিয়ালে আর পাওয়া যায়না। সেটা সম্ভবও নয়, কারণ 'ভদ্রলোক'কে লক্ষ্য করে সিরিয়াল আর বানানো হয়না। টিভি সিরিয়ালে ভদ্রলোকের যুগ শেষ হয়ে গেছে। এটা রাজনৈতিকভাবে কারো জয়ের সূচক হতে পারে, কারো বা পরাজয়ের। কিন্তু সেসব আলোচনায় এখানে ঢোকা হচ্ছেনা। শুধু এইটুকুই বলা যায়, যে, অবিলম্বে এটি পরিবর্তিত হবার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছেনা। এবং সংস্কৃতি যেহেতু কোনো স্থানু বস্তু নয়, তাই দীর্ঘদিন ধরে এই সিরিয়ালগুলি দেখাতে থাকলে ভদ্রশ্রেণীর একাংশও এই মান বা রুচিটি আয়ত্ত্ব করে ফেলবেন। সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে নানা শক্তিশালী গণমাধ্যম এই একই জিনিস প্রচার করে চললে, সেটিই গণসংস্কৃতিতে পরিণত হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।
দুই। আঞ্চলিকতার পরিসমাপ্তি। আমাদের বিশ্লেষণে আমরা দেখলাম, আঞ্চলিক ভদ্রলোক নামক বর্গটিকে এনসিসিএস রেটিং এ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। ঠিক তার উল্টোদিকেই আছে 'ছোটোলোক' শ্রেণী। বঙ্গসমাজের দ্বিত্ব দীর্ঘদিন ধরেই 'ভদ্রলোক ও ছোটোলোক' -- এই দ্বিত্ব ঘিরে আবর্তিত। হিন্দি বলয়ের বা দক্ষিণ ভারতের জাতপাত সম্পূর্ণ একটি অন্য চরিত্রের ব্যাপার, বাংলায় সেই চরিত্রটি পাওয়া যায়না। বাংলার নিজস্ব এই 'ছোটোলোক'দেরও কিন্তু টিভি সিরিয়ালে পাওয়া যায়না। যেহেতু রেটিং একটি সর্বভারতীয় সূচক, এখানে সমস্ত আঞ্চলিকাতাকে ভেঙে দিয়ে পুরো রেটিং প্রক্রিয়াটিই একটি 'উপরের চল্লিশ শতাংশের ভারতীয়ের গড় প্রতিনিধি' খুঁজে বার করায় লিপ্ত। ফলে এই গড় সংস্কৃতিই ক্রমশ টিভি সিরিয়ালে রাজত্ব করছে এবং করবে। অনেকেই আশ্চর্য হন বাংলা এবং হিন্দি সিরিয়ালগুলির ক্রমবর্ধমান মিল দেখে। মনে হয় ভাষা যাই হোক না কেন, এরা শীঘ্রই কোনো একটি জায়গায় এসে একেবারে মিশে যাবে। সেই আন্দাজ এক্বারেই অবাস্তব কিছু নয়। কারণ রেটিং ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে সেদিকে যেতেই বাধ্য করছে।
তিন। বিজ্ঞাপনের প্রবাহের পরিবর্তন। একজন বিজ্ঞাপনদাতা কেবলমাত্র লোকসংখ্যা দেখে বিজ্ঞাপন দেননা। আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে, সম্ভাব্য ক্রেতাদের মধ্যে পৌঁছনই তাঁর লক্ষ্য। অপ্রয়োজনীয় মানুষের কাছে বিজ্ঞাপন পৌঁছে দেবার জন্য অর্থব্যয় তাঁর কাছে নেহাৎই বাজে খরচ। এই কারণেই মার্কেটিং এ এত বেশি শ্রেণীবিভাগ বা সেগমেন্টেশনের প্রচলন। কিন্তু এই এনসিসিএস এবি রেটিং বিজ্ঞাপনদাতাকে সেগমেন্টেশনের কোনো সুযোগ দিচ্ছেনা। বরং বাজে খরচ করতে বাধ্য করছে। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে, একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন ওয়াশিং-মেশিন বিক্রেতা শুধু পৌঁছতে চান তাঁর সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে, যাদের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে তিনি প্রলুব্ধ করবেন। তাঁর আদর্শ লক্ষ্যবস্তু হতে পারে, আমাদের 'ভদ্রলোক' শ্রেণী, যারা কলেজ শিক্ষিত এবং যাদের ফ্রিজের মালিকানা আছে। কিন্তু সেই শ্রেণীকে নির্দিষ্ট করে বিজ্ঞাপন দেবার কোনো ব্যবস্থা এই রেটিং ব্যবস্থা দিচ্ছেনা। বিজ্ঞাপনদাতাকে অধিকতর খরচা করে পৌঁছে যেতে হচ্ছে আরও অজস্র মানুষের কাছে, যাদের কাছে তিনি পৌঁছতে চান না।
এই প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞাপনদাতারা বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্র বদলাতে পারেন। এমন কোনো ক্ষেত্র এবং বিষয়বস্তু খুঁজে নিতে পারেন, যেখানে ভদ্রলোক বর্গটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে। ইন্টারনেটের ওয়েব সিরিজে ঠিক এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। যাঁরা ইন্টারনেটে সিনেমা বা সিরিয়াল দেখবেন, বা দেখেন, তাঁরা সাধারণত কলেজ পাশ এবং বাড়িতে একটি কম্পিউটার থাকে। তাঁরা অতি অবশ্যই ভদ্রলোক শ্রেণীর একটি ভগ্নাংশ। যে বিজ্ঞাপনদাতারা এই অংশটির কাছেই পৌঁছতে চান, তাঁরা এই মাধ্যমটিতেই বিজ্ঞাপন দেবেন। এবং সংস্কৃতিগতভাবে 'ভদ্রলোকের সংস্কৃতি'কে প্রমোট করার চেষ্টা করবেন। এই প্রক্রিয়ায় 'ভদ্রলোকের সংস্কৃতি' একটু পরিপুষ্টও হবে, কিন্তু টিভি নামক মাধ্যমটি থেকে ভদ্রলোক ক্রমশ সরে যাবে।
এই তিনটি ফলাফলের মধ্যে এক ও তিনকে যদি খুঁটিয়ে দেখি, দেখব তারা পরস্পরের বিপরীত অভিমুখে চলেছে। এক (এবং কিছুটা দুইও) চায় একটি গড় 'ভারতীয় সংস্কৃতি' তৈরি করতে, যা চালু 'ভদ্রলোকের সংস্কৃতি' নয়। কিন্তু তারা এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়, যেখানে তাদের চালু করা সংস্কৃতিই মূলধারা হয়ে উঠবে, এবং তার বাইরে যা পড়ে থাকবে, তাকে নগণ্য বলে উপেক্ষা করা যাবে। উল্টোদিকে তিন, সুস্পষ্ট ভাবেই 'ভদ্রলোকের সংস্কৃতি' বলে একটি নির্দিষ্ট বর্গকে তুলে ধরতে চায় এবং ভদ্রলোকের সংস্কৃতি ও গড় সংস্কৃতির মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন তৈরি করতে চায় (ব্যাপারটা এরকমঃ আপনি ভদ্রলোক? বাড়িতে ফ্রিজ টিভি কম্পিউটার আছে? শিক্ষিত? এক আধটা বই টই পড়েন? তাহলে ওয়েব সিরিজ দেখে আপনার ক্লাসের প্রতি সুবিচার করুন, টিভি সিরিয়াল দেখবেন না)। এই দুটি প্রক্রিয়াই এই মুহূর্তে অন্তত বাংলায়, (সম্ভবত সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও, কিন্তু সেটা এখানে বিবেচ্য নয়), যুগপৎ চালু। তাদের মধ্যে দড়ি টানাটানিও চলছে। কোন পক্ষ নিজের লক্ষ্যে কতটা এগোতে পারে, তার উপরেই টিভি সিরিয়ালের আগামী দিন দাঁড়িয়ে আছে। তবে পরিস্থিতি যেদিকেই যাক, টিভি সিরিয়াল নামক জিনিসটির মান নিয়ে ভদ্রসমাজে যা হাহাকার দেখা যাচ্ছে, তার সুরাহা হবার কোনো অবস্থাই নেই, একমাত্র যদি না রেটিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে সেখানে আঞ্চলিক এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে সুস্পশ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।