অবশেষে তিনশ সাতাত্তর বিদায় নিল। এত আনন্দের দিন অথচ কোথাও যেন একটা অস্বস্তি, একটা বিষণ্ণতা রিনরিন করে বেজে চলেছে। সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এই দিনটার জন্যই তো এত অপেক্ষা, এত সংগ্রাম, এত লড়াই। কত মানুষের দিন-রাত এক করা পরিশ্রম। নিজের আইডেন্টিটির জন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে আইনি মান্যতা ছিনিয়ে নিয়ে আসার জেদ। এই যুদ্ধটার সবথেকে ইন্টারেস্টিং দিক হল যারা এই লড়াইটা কোর্টে গিয়ে বা কোর্টের বাইরে লড়েছেন, ৩৭৭ থাকা বা না থাকায় তাদের অধিকাংশেরই কিচ্ছু ইতরবিশেষ হচ্ছিল না। আইনের ভয়ে কেউ সেক্স করে নি, এমনটা আমি তো অন্তত শুনি নি। আসলে ৩৭৭-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল নগণ্য। তুলনায় যেটা অনেক বেশি হত, সেটা হল ব্ল্যাকমেলিং। তবে সব থেকে বেশি যন্ত্রণা দিত ব্যক্তিগতস্তরের অপমানবোধ। দেশের আইনে আমি অপরাধী, এই ভাবনাটা কোথাও, কোনও এক অতল গভীরে খুব খুব কষ্ট দিত। সেই গ্লানি, সেই দাহ থেকেই বহু মানুষের এই লড়াইতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া। আর ক্রমশঃ একটু একটু করে সাথে পাওয়া সেই সব মানুষদের যাঁরা ক্যুইয়ার কমিউনিটির অংশ না হয়েও আমাদের এই লড়াইয়ের ভাগীদার হয়েছেন।
তিন দশক ব্যাপী এই লড়াইয়ে আমি চুনোপুঁটির থেকেও ছোট কিছু থাকলে তাই। নিরাপদ দূরত্বে বসে নির্ভয়ে আন্দোলনের আঁচ পুইয়েছি। কাজ বলতে ছিল লেখা, আর ইন্টারনেটে জনমত গঠনের চেষ্টা করা। সেই অর্কুট জমানায় শুরু। তখন ২০০৮। দিল্লী হাইকোর্টে কেস চলছে। আর অর্কুটে জমে উঠেছে হোমোফোবিক আক্রমণ। অনেকদিন স্বনামে তর্ক চালিয়ে বুঝলাম, একটা জায়গায় গিয়ে হেরে যাচ্ছি। সেটা হল, আমরা-ওরা। "আপনি ওদের কথা কি জানেন?" এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারছিলাম না, আমিও "ওরা"। আমিও "ওদেরই" একজন। শেয়ার করতে পারছিলাম না অনেক না বলা কথা। মনে হচ্ছিল মানুষকে সহজ ভাষায় আমাদের কথাটা বলা দরকার। কোনও তত্ত্বে নয়, নিতান্তই ব্যক্তিগত অনুভবে। সেই না বলা জমে থাকা কথার শব্দপিণ্ড থেকে বর্ন ফ্রী-র জন্ম। অর্কুটে। তারপর অনেক কিছু হয়ে গেছে। ইপ্সিতা ও অন্যান্যদের উৎসাহে গুরুচন্ডালীতে "অন্য যৌনতা" বিভাগ হয়েছে, প্রান্তিক যৌনতার ওপর আলাদা সংখ্যা হয়েছে, গুরুচন্ডালী থেকে একাধিক চটি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় প্রান্তযৌনতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে একাধিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখির কাজ হলেও, সেগুলোর প্রায় সবটাই হয়েছে কমিউনিটির ভেতর থেকে। কমিউনিটির পত্রিকা না হয়েও এইরকম ধারাবাহিকতার বজায় রেখে যৌনতা নিয়ে আর কোনও বাংলাভাষী সাহিত্য সংগঠন কাজ করেছে বলে আমার জানা নেই।
গুরুচন্ডালীকে পাশে রেখে এই পথ চলার সঙ্গে সঙ্গে কখন যে বর্ন ফ্রী আমার অল্টার ইগো হয়ে গেছে, সেটা নিজেই বুঝতে পারি নি। আজকে পেছন ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে বর্ন ফ্রী-র তো জন্মই হয়েছিল তিনশ সাতাত্তরের বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্য। আজ যখন তিনশ সাতাত্তরই বিদায় নিল, তখন আর বর্ন ফ্রী-র প্রয়োজন কি? এবার তবে তার বিদায় নিলেই হয়। তবে কি এই আনন্দের দিনে উঁকি মারা বিষাদ ক্লান্তি সেই অবধারিত আসন্ন গুরুত্বহীনতার ভয়ে?
সম্ভবত নয়। আসলে গত দশ বছরের পথ চলায় বর্ন ফ্রী নিজেই অনেকখানি পাল্টে গেছে। তার বয়স বেড়েছে, বেড়েছে অভিজ্ঞতার ঝুলিও। গত দশ বছরে খুব কাছ থেকে দেখেছি প্রান্ত যৌনতার মানুষদের যন্ত্রণা। দেখেছি কি ভাবে বাবা-মায়েরা ছেলে মেয়েকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে, কিভাবে স্কুলে-কলেজে-কর্মক্ষেত্রে বুলিড হয়েছে লোকজন। দেখেছি মৃত্যু, দেখেছি আত্মহত্যা। দেখেছি জবরদস্তির বিষমকামী বিয়ে, দেখেছি বিবাহবিচ্ছেদ, দেখেছি সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কষ্ট। আজকে বারবার মনে হচ্ছে, আহা, সুপ্রীম কোর্টের আজকের কথাগুলো যদি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারতাম। যদি গিয়ে সেই কুড়ি বছরের ছেলেটার বাবা-মায়ের হাত ধরে বলতে পারতাম, "প্লীজ, এমন ভুল করবেন না। একবার তো রায়টা পুরো পড়ে দেখুন, কিভাবে দেশের শীর্ষ আদালত আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।" যদি আজকে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সিরাস বেঁচে থাকতেন। আজ বারবার করে মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সব কষ্ট, সেই সব অপূরণীয় ক্ষতিগুলোর কথা, যেগুলো মন আর চোখ একটু খোলা রাখলেই এড়ানো যেত।
আর তার সাথে মনের ভেতর খচখচ করছে আরেকটা প্রশ্ন। গত তিন দশকের লাগাতার লড়াইয়ের শেষে ৩৭৭-এর প্রশ্নে দেশ এগোলো ঠিকই কিন্তু একই সময়কালে কি পিছিয়ে পড়ল না আরও অন্যান্য মানবাধিকারের ক্ষেত্রে? আমরা কি তিন দশক আগে ভাবতে পেরেছিলাম একের পর এক রাজ্য খাদ্যাভ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা বসাবে? আন্তঃধর্মীয় প্রেমকে আদালতে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করতে হবে যে সেটা জিহাদ নয়? খাস কলকাতার বুকে আলিঙ্গনের অপরাধে গনপিটুনির শিকার হবেন যুবক-যুবতী? ট্রেনের কামরায় প্রধানমন্ত্রীর নাম বলতে না পারায় প্রহৃত হবেন দরিদ্র যুবক? গোরক্ষার নামে দেশ জুড়ে মানুষ খুন হবে? আর সেই খুনিদের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানাবেন দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? সরকার বিরোধী ইন্টেলেকচুয়ালস ও অ্যাক্টিভিস্টদের নামের লিস্ট তৈরী হবে যেমন হয়েছিল নাজি জার্মানিতে বা পাকিস্তান অধিকৃত বাংলাদেশে? একটা গোটা রাজ্যের নাগরিকদের প্রমাণ দাখিল করতে হবে যে তাঁরা "ঘুসপেটিয়া" নন?
তাই মনে হচ্ছে একটা লড়াই শেষ হওয়ার আগেই আরও দশটা লড়াইয়ের ফ্রন্ট খুলে গেছে। আজকে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে একটা জয় পাওয়া গেলেও আরও বহু যুদ্ধ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। কেননা আমার চোখে ৩৭৭-এর যুদ্ধ কখনওই শুধু যৌনতার দাবিতে ছিল না, ছিল একটা প্রিন্সিপ্যালকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে যেই প্রিন্সিপ্যাল বলে, আমি-আপনি, আমরা সবাই বর্ণ ফ্রী, মুক্তজাতক। আমাদের সেই মুক্তসত্তায়, মুক্তচিন্তায়, মুক্তমনে বেড়ি পড়ানোর অধিকার কারওর নেই, সর্বশক্তিমান রাষ্ট্রেরও নেই।
৩৭৭-এর লড়াই শেষ হল।
মুক্তচিন্তার লড়াই জারী থাক।