সুপ্রীম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের ফলে আমরা আবার অপরাধী। দিল্লি হাইকোর্ট চার বছরের জন্য একটা জানলা খুলে দিয়েছিল। সুপ্রীমকোর্টের রায় আবার সেই জানালা পেরেক ঠুকে বন্ধ করে দিল।
যারা মনে করেন, সমপ্রেম অপ্রাকৃতিক, অসুস্থতা বা ভারতীয় সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকারক, এ লেখা তাদের জন্য নয়। তাদের জন্য এর আগে অনেকে অনেক লেখা লিখেছেন। এই পত্রিকার-ই অন্য যৌনতা বিভাগে সেই বিষয়ে লেখা পাওয়া যাবে। সেই লেখাগুলো পড়ে নিতে অনুরোধ করছি।
এই লেখা তাদের জন্য যারা মনে করেন সুপ্রীম কোর্টের রায় আইনের নিক্তিতে সঠিক, অথবা ধারা ৩৭৭ তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এই লেখা তাদের জন্যও যারা আমাদের মত প্রান্তিক যৌনতার মানুষজনের জীবনে এই রায়ের অভিঘাত সম্পর্কে সরাসরি জানতে চান। আর সবশেষে এই লেখা তাঁদের জন্য যাঁরা বোঝেন, আমাদের সমর্থন করেন কিন্তু জানেন না কীভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবেন।
অনেকেই বলছেন যে আইন তৈরি করা আদালতের কাজ নয়, সেটা সংসদের অধিকার। কথাটা সত্যি কিন্তু এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
প্রথমত, ধারা ৩৭৭-এর ক্ষেত্রে আদালতকে আইন তৈরি করতে বলা হয় নি, আইনের সাংবিধানিকতা জানতে চাওয়া হয়েছে। কোনো আইন সংবিধানের সীমা অতিক্রম করছে কি না, সেটা দেখার অধিকার আদালতকে সংবিধান দিয়েছে। ধরা যাক, আজ সংসদ আইন করল যে স্বামী-স্ত্রী পুর্ণিমার রাত ছাড়া সঙ্গম করতে পারবে না। করলে তা অপরাধ হিসেবে দেখা হবে। আদালতের পুরো অধিকার রয়েছে এরকম অসাংবিধানিক আইনকে রদ করে দেওয়ার।
দ্বিতীয়তঃ, যেখানে আইনের পরিধি সুস্পষ্ট নয়, সেখানে আইনের ব্যাখ্যা করা আদালতের শুধু অধিকার-ই নয়, দায়িত্বও বটে। এই রায়ে আদালত সেই দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। ধারা ৩৭৭ খুবই অস্পষ্ট একটি আইন। “অর্ডার অফ নেচার” কাকে বলা হবে আর কাকে নয়, তার কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, ধারা ৩৭৭-এর নির্দেশের সঙ্গে সরাসরি সমকামিতার কিন্তু কোনও সম্পর্ক নেই। এই ধারা অনুযায়ী যদি কোনো বিপরীতকামি যুগলও পুরুষাঙ্গ-যোনি সঙ্গম ব্যতীত অন্য কোনো যৌনক্রিয়া করে, তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তাই ৩৭৭-এর পরিসর নির্দিষ্ট করে দেওয়া আদালতের শুধু এক্তিয়ারই নয়, কর্তব্য ছিল, যা তারা কোনো অজ্ঞাত কারণে করতে অস্বীকার করেছেন।
এই প্রসঙ্গে দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের কথা উল্লেখ করা দরকার। হাইকোর্ট যেটা করেছিলেন, সেটা আইন তৈরি করা বা রদ করা নয়, সেটাকে পরিভাষায় বলা হয় “রিডিং ডাউন” অর্থাৎ আইনের পরিধিকে বিশেষভাবে বেঁধে দেওয়া, যা একান্তভাবে আদালতের অধিকারভূক্ত।
যে আদালত, একদিন আগে গাড়িতে লালবাতি থাকবে কি না সেই বিষয়ে রায় দিতে পারল, সেই আদালত কেন এই বলকে সংসদের কোর্টে পাঠিয়ে দিল, তা বোঝা গেল না।
এ তো গেল, আদালত কী করতে পারত। এর পরে আসব, আদালত কী করল, সেই প্রসঙ্গে।
আদালত জানাল যে ধারা ৩৭৭ সংবিধানকে লঙ্ঘন করছে না। আমরা দেখব, আদালত কীভাবে এই সিদ্ধান্তে এলেন এবং তাতে কী সঙ্কটের সৃষ্টি হল।
প্রথমত আদালত জানাল যে লিঙ্গভিত্তিক যে সাম্যের অধিকার সংবিধান দিয়েছে, যৌনতা বা সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন তার আওতায় আসবে না (দিল্লি হাইকোর্টের ভাবনা ভিন্ন ছিল)। এখানে ভাবা দরকার যে, সংবিধানে কেন লিঙ্গভিত্তিক সাম্যের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। একথা অনুমান করা কষ্টকর নয় যে সংবিধান প্রণেতারা বুঝেছিলেন, সমাজে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য আছে, তাই তার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের দরকার রয়েছে। একই রকম ভাবে আমাদের সমাজে যৌনতাভিত্তিক অসাম্যও রয়েছে, কিন্তু আদালত দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার বিরুদ্ধে কোনো রক্ষাকবচ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তারা বলে দিলেন যে যৌনতা সমানাধিকারের মাপকাঠি হতে পারে না। অর্থাৎ, এক কথায়, কোনোরকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের সংগ্রামের অধিকার তারা কেড়ে নিলেন।
তাঁরা আরও জানালেন যে, যারা “প্রকৃতিসম্মত যৌনক্রিয়া” করেন আর যারা “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনক্রিয়া” করেন তারা দুটি ভিন্ন গোত্রভুক্ত (ক্লাস)। তাই এক গোত্রের সাম্যের অধিকার, অন্য গোত্র দাবি করতে পারে না। কিন্তু আইনের চোখে কেন হেটেরোসেক্সুয়াল আর হোমোসেক্সুয়ালদের ভিন্ন গোত্র হিসেবে দেখা হবে, তা তাঁরা ব্যাখ্যা করলেন না। আরো মজার ব্যাপার হল, তাঁরা এটা বুঝলেন না যে, এই গোত্রবিভাজন খুবই আপেক্ষিক। আজ যদি স্বামি-স্ত্রী দুরকমের যৌনক্রিয়া করেন তবে তাদের কীভাবে গোত্রভুক্ত করা হবে, এই রায় থেকে সেটা বোঝা গেল না।
৩৭৭ ধারার অন্যতম সমস্যা হল, এটি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রাইট টু প্রাইভেসিকে খর্ব করে। এই গোপনীয়তার অধিকার, সংবিধান প্রদত্ত অধিকার। তাই আদালতের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যেহেতু ৩৭৭ এই অধিকারকে খর্ব করে, সেহেতু একে অসাংবিধানিক বলা যাবে কি না। এই প্রসঙ্গে আদালত জানালেন, কোনো বে-আইনি কাজের ক্ষেত্রে, এই অধিকার প্রযোজ্য নয়। যেহেতু, “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার” ধারা ৩৭৭ মতে বে-আইনি, তাই এক্ষেত্রে ৩৭৭ প্রয়োগ করা হলে তা অসাংবিধানিক নয়। এরকম বৃত্তাকার যুক্তিজাল আদালতের কাছ থেকে খুব বেশি শোনা যায় নি।
তবে এই রায়ের সবথেকে ভয়ঙ্কর দিক হল, সংখ্যার বিচারে সাম্যের অধিকার নির্ণয়। আদালত তাদের রায়ে জানালেন, যেহেতু এলজিবিটি সম্প্রদায় খুবই ছোট (আদালতের হিসেবে ২৫ লাখ) এবং গত ১৫০ বছরে মাত্র ২০০ বার এর আদালতে প্রয়োগ হয়েছে, তাই এই ধারা অসাংবিধানিক নয়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে কবে থেকে, কীভাবে সাম্যের অধিকারের সঙ্গে সংখ্যার হিসাব সম্পর্কযুক্ত হয়ে গেল। এই আশ্চর্য রায় আমাদের জানাল যে, যদি কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনো অন্যায় হয়, তবে তা সংখ্যার বিচারে অন্যায় বলে ধরা হবে না! এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ৩৭৭-এর প্রয়োগ যত না আদালতে হয়, তার থেকে অনেক বেশি হয় পুলিশি হয়রানি আর ব্ল্যাকমেলিং-এর ক্ষেত্রে। অনেক বিষয়ের মত, এই বিষয়টিকেও আদালত “নজর আন্দাজ” করে গেলেন।
সব শেষে এই রায়ের বয়ানে একটি এবং মামলা চলাকালীন একটি শব্দচয়নের উল্লেখ করে প্রসঙ্গান্তরে যাব। এই রায়ে বলা হল “এলজিবিটিদের তথাকথিত অধিকার”। “তথাকথিত”? “সো কল্ড”? মামলা চলাকালীন বিচারপতি বললেন যে “সৌভাগ্যক্রমে ভারতে সমকামীদের সংখ্যা অনেক কম”। “সৌভাগ্যক্রমে”? “ফরচুনেটলি”? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
এর পরে আসি এই রায় আমাদের জীবনে কী অভিঘাত নিয়ে এল।
প্রথমতঃ, এক মুহুর্তে আমি এবং আমরা ক্রিমিনাল হয়ে গেলাম। অর্থাৎ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমস্ত রক্ষাকবচ হারালাম। কাল যদি সমকামী হওয়ার জন্য আমাকে আমার নিয়োগকর্তা চাকরি থেকে বরখাস্ত করে, আমার কিছু করার রইল না।
দ্বিতীয়তঃ, যে পুলিশি হয়রানি ও ব্ল্যাকমেলিং অনেকাংশে কমেছিল, তা আবার দ্বিগুণবেগে ফিরে আসার রাস্তা প্রশস্ত হল।
তৃতীয়তঃ, অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের এলজিবিটি গ্রুপ বন্ধ বা ব্যান করে দিল। অর্থাৎ, যদিও সমপ্রেম (হোমোসেক্সুয়ালিটি) অপরাধ নয়, তবুও এই রায়ের অভিঘাতে ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেসন আটকে গেল।
চতুর্থতঃ, সমাজে সংখ্যাগুরুর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। আমরা জানলাম, যেকোনো ‘আনকমন’ কাজকে রাষ্ট্র অপরাধ বলে সাব্যাস্ত করতে পারে।
পঞ্চমতঃ, এই রায় বহু সমপ্রেমী ছেলেমেয়েকে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে ঠেলে দিল। তাদের ভীতি, মানসিক অশান্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিল।
তবে এই রায় আমাদের অনেক উপকারও করল।
এই প্রথমবার, সমপ্রেম এত খোলাখুলি আলোচনার বিষয় হয়ে উঠল। আমরা দেখলাম বেশ কিছু রাজনৈতিক দল আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। সমাজের নানা স্তর থেকে প্রতিবাদের ঢেঊ উঠল। এলজিবিটি সম্প্রদায় আর পেছন ফিরে তাকাল না। দিল্লি হাইকোর্টের খুলে দেওয়া জানালা দিয়ে যারা খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে এসেছে, তারা আর ফিরে যেতে অস্বীকার করল। তারা রাস্তায় নেমে জানাল, এ লড়াই আত্মসম্মানের লড়াই, এর শেষ না দেখে ছাড়া হবে না।
যারা আমাদের এই লড়াইকে সমর্থন করেন, যারা মনে করেন যে এ লড়াই শুধু এলজিবিটি-দের লড়াই নয়, তাদের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা। প্রথমতঃ, আপনারা সর্বত্র জোর গলায় জানান যে আপনারা এ লড়াইকে সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়, অন্যদের এটাও জানান যে কেন আপনি সমপ্রেমীদের সমানাধিকারে বিশ্বাস করেন। আপনার কাজের জায়গায় সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করুন। আলোচনা করুন, কাগজে লিখুন, গান, কবিতা, নাটক, কার্টুনে আমাদের সমর্থন করুন। অশালীন গে জোক্সের প্রতিবাদ করুন। সব থেকে বড় কথা, হিরন্ময় নীরবতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসুন, অন্যকে শিক্ষিত করুন।
[গত কয়েকদিনে পড়া বহু লেখার টুকরো-টাকরা নিয়ে এই লেখা। কিন্তু সে সব এতই ছড়ানো-ছিটোনো যে নির্দিষ্ট করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারলাম না। লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।]