ফারুকি সংক্রান্ত রায়ের পর ধর্ষণ আইন এবং আদালতের রায় নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এই লেখাটা ঠিক ফারুকি বিষয়ক নয়। কিন্তু আলোচনা যখন হয়েছে, এবং ধর্ষণের নতুন আইনটির বেশ ক বছর হয়ে গেল, তার এবার একটা পুনর্মূল্যায়নও দরকার, এই জায়গা থেকে কয়েকটা লেখা ফেসবুক গ্রুপে লিখেছিলাম। সেগুলোই একটু নেড়েচেড়ে তুলে রাখলাম। পাবলিক ফোরামের লেখা। একটু তাড়াহুড়োতে। বাক্যগঠন ইত্যাদি বদলালামনা। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তুইআসল, এই অজুহাতটুকু রইল।
---------------
১।
ধর্ষণ এবং যৌননিগ্রহ সংক্রান্ত যে নতুন সংশোধনটি ( http://indiacode.nic.in/acts-in-pdf/132013.pdf ) ২০১৩ সালে ভারতীয় সংসদে পাশ হয়, তার তিনটি অংশ ছিল।
১। ভারতীয় দন্ডবিধির সংশোধনী। এতে অনেকগুলি বদল হয়। (কেবলমাত্র) ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনগুলি বদলে যা দাঁড়ায়, সংক্ষেপে তা এরকমঃ
ক। যৌন আচরণ ধর্ষণ কখন হবে? তার কিছু নির্দিষ্ট শর্ত গুলো বলা আছে আইনে। এক। মহিলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। দুই। অসম্মতিতে (কনসেন্ট ছাড়া)। তিন। মহিলা যদি মনে করেন লোকটি তার বর। চার। ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করলে। পাঁচ। মহিলা নেশাগ্রস্ত বা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় থাকলে। ছয়। মহিলার আঠারোর চেয়ে বয়স কম হলে। সাত। মহিলা সম্মতি জানাতে অক্ষম হলে।
খ। কী করলে ধর্ষণ হবে? শুধু যৌনাঙ্গ ব্যবহার ছাড়াও, একজন পুরুষ যদি একজন মহিলার শরীরের যে কোনো অংশে (তাঁর অসম্মতিতে) যেকোনো জিনিস প্রবেশ করান, তবে তা ধর্ষণ।
গ। শুধু প্রবেশ নয়, মহিলার যৌনাঙ্গ বা পায়ুতে মুখ দিয়ে স্পর্শ করলে, সেটিও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে।
এগুলি ভারতীয় দন্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় লিপিবদ্ধ, যেটা এই আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধারা ৩৭৬ এ আছে, এই কাজ কারা কারা করলে অন্তত ৭ বছরের কারাদন্ড। তালিকা অনেক বড়। পুলিশ অফিসার, সরকারি চাকুরে, ইত্যাদি প্রভৃতি হয়ে, এমন কোনো মানুষ, যার সঙ্গে 'অথরিটি' (বাংলা করতে পারলামনা) বা 'বিশ্বাস'এর সম্পর্ক, বা, মহিলা ওই মুহূর্তে যার অধিকারে (কন্ট্রোল বা ডমিন্যান্স) আছেন, সকলেই এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
এছাড়াও শারীরিক ক্ষতি ঘটালে, বা গ্যাং রেপ হলে অন্য কঠিনতর আইন আছে। সেটার বিশদে গেলামনা।
২। ফৌজদারি কার্যপ্রণালীর সংশোধনী (ক্রিমিনাল প্রসিডিওর অ্যাক্ট)। এইটায় ফৌজদারী কার্যপ্রণালী কীভাবে চলবে, কখন ভিডিও টেপ করতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দী দিতে হবে, এইসব এবং আরও নানা খুঁটিনাটি আছে। সেটা এই আলোচনায় অপ্রয়োজনীয়।
৩। সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন (এভিডেন্স অ্যাক্ট)। তাতে বদল হয়ে আইন যা দাঁড়িয়েছে, তা সংক্ষেপে এইরকমঃ (যদিও সবকটা এখানে লেখা হলনা)
ক। আদালতে 'কনসেন্ট' নিয়ে জেরার সময় মহিলার চরিত্র বা অন্যের সঙ্গে পূর্ববর্তী যৌন মিলনের প্রসঙ্গ আনা যাবেনা।
খ। 'কনসেন্ট' বা সম্মতি নিয়ে যদি ডিসপিউট হয়। অর্থাৎ, মহিলা যদি বলেন, সম্মতি ছিলনা, এবং পুরুষটি বলে ছিল, সেক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মহিলার কথাই চূড়ান্ত । যৌনক্রিয়া হয়েছে কিনা, এইটা তার আগে অবশ্য নিশ্চিত হতে হবে। এই 'চূড়ান্ত' শব্দটা নিয়ে গ্রুপে কিঞ্চিৎ বিতন্ডা হয়েছে। তাই ইংরিজি ভাষাটা তুলে দেওয়া যাকঃ "where sexual intercourse by the accuse is proved, and the question is whether it was without the consent of the woman ..... and such woman says in her evidence before the court that she did not consent, the court shall presume she did not consent". আইনগত ভাবে এখানে 'প্রিজিউম' ব্যবহার করা হয়েছে, অর্থাৎ 'প্রাথমিকভাবে ধরে নেওয়া হবে'। 'চূড়ান্ত' শব্দটার ব্যাখ্যা এ বিষয়ে আলোচনার সময় দেওয়া হচ্ছে।
গ। যদিও এখানে ইংরিজিতে 'সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স' বলা হয়েছে, কিন্তু আইনেই শব্দটার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যে, এখানে ইন্টারকোর্স মানে, শুধু প্রচলিত অর্থে ইন্টারকোর্স না, আইনানুযায়ী যাতে ধর্ষণ হয় সবই অন্তর্ভুক্ত।
২।
এই বদলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা কোনগুলি। যে মামলার উল্লেখ করে এই লেখার শুরু, সেই ফারুকি মামলায় নিম্ন আদালত ফারুকিকে দোষী সাব্যস্ত করার পর কাফিলায় নিবেদিতা মেনন এবং জে দেবিকা একটি লেখা লেখেন ( https://kafila.online/2016/08/14/the-mahmood-farooqui-rape-conviction-a-landmark-verdict-j-devika-nivedita-menon/ ) । ডিসেম্বর ২০১২র পরে (অর্থাৎ নতুন আইন হবার পরে) ধর্ষণের বিচারেরক্ষেত্রে কী বদলেছে?, এই প্রশ্নের উত্তরে নিবেদিতা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন, ধর্ষণকে বিচারালয়ে কীভাবে দেখা হবে, সেই দৃষ্টিভঙ্গীকে অব্যর্থভাবে বদলে দিয়েছে এই আইন। ফারুকি মামলায় নিম্ন আদালতের রায়েই সেটা স্পষ্ট। কীরকম সেই বদল? ঠিক এই প্রশ্নের উত্তরে নয়, কিন্তু লেখার শুরুতেই নিবেদিতা লিখছেন, শিল্পায়ন, জমি অধিগ্রহণ, ইত্যাদির প্রশ্নে যেমন নন্দীগ্রাম, ফারুকি মামলার রায় (এবং নতুন আইনটি) যৌন অপরাধের ক্ষেত্রে তেমনই। যা পুরোনো ধ্যান ধারণাইত্যাদিকে ভেঙে ফেলে নতুন ঐকমত্যের পথ প্রশস্ত করে। সেই নতুন ধারণা ধর্ষণকে 'সম্মান'এর প্রশ্নের সঙ্গে চিহ্নিত করেনা, বরং 'যৌনতার অধিকার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা'র সঙ্গে দেখে। অর্থাৎ, ধর্ষণের 'পাপ', সম্মান হারানোয় না, বরং নিজের যৌনতার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর (বলা বাহুল্য, এখানে 'পাপ' শব্দটি উনি সাহিত্যিক অর্থে ব্যবহার করেছেন, প্রচলিত অর্থে নয়)।
শুধু আদালতের রায়কে দেখলে, এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে, এই ২০১৭ সালে দ্বিমত হবার জায়গা নেই। প্রথমত, আইনগত ভাবেই ধর্ষণ আর পেনিট্রেশন বা প্রবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ধর্ষণের গন্ডী বেড়েছে। এবং সেটা 'সম্মান'কে ঘিরে নয়। তা হলে শুধু 'প্রবেশ'এই আইনটা সীমাবদ্ধ থাকত। দ্বিতীয়ত, ফারুকির বিচার প্রক্রিয়া দ্বর্থ্যহীনভাবেই দেখিয়ে দেয়, আইনী প্রক্রিয়াও ধর্ষণকে ২০১৩ উত্তর চোখে দেখতে শুরু করেছে। নিম্ন আদালত ফারুকিকে দোষী সাব্যস্ত করে। উচ্চআদালত নির্দোষ। কিন্তু যেটা কৌতুহলোদ্দীপক, কোনো আদালতই 'সম্মান' এর পুরোনো ধারণাটি ব্যক্ত করেনি। বরং শরীর বা যৌনতার অধিকারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে আদালতের বয়ান। এটি নিঃসন্দেহে ধর্ষণ এবং নারীর অধিকার সংক্রান্ত মূলধারার চিন্তায় একটা পরিবর্তনের চিহ্ন।
৩।
কিন্তু চিহ্নই তো সবসময় শেষ কথা বলেনা। চিহ্নের আড়ালে থাকে নানা ফাঁকফোকর। ধর্ষণের আইন বা সেই সংক্রান্ত চিন্তনের মূলধারাটিকে কাটাছেঁড়া করা এবং ফাঁকফোকরগুলিকে চিহ্নিত করা, অর্থাৎ, এক কথায়, পুনর্মূল্যায়নই, এই লেখার লক্ষ্য। ২০১৩ সালে নতুন আইনটি হবার পরে প্রথম ফাঁকটি দেখা যায়, ২০১৪ সালে। নতুন আইনের এক বছর পূর্তিতে শ্রীমতি রুক্মিনী এস হিন্দু পত্রিকায় ভারতের 'ধর্ষণ রাজধানী' দিল্লিতে এক বছরে নতুন আইনে বিচার হওয়া সমস্ত মামলাগুলিকে নিয়ে এক ব্যাপক অনুসন্ধান ( http://www.thehindu.com/data/the-many-shades-of-rape-cases-in-delhi/article6261042.ece ) করেন। এই ধরণের অনুসন্ধান ভারতে ইতিপূর্বে সম্ভবত হয়নি (কারণ এনসিআরবি অনুসন্ধান শুধু অভিযোগ সংখ্যা চিহ্নিত করে, মামলাগুলির চরিত্র নয়)। এক বছরে দিল্লির আদালতে ওঠা সমস্ত মামলাগুলিকে খতিয়ে দেখে যা পাওয়া যায়, তা এরকমঃ
দিল্লির আদালতে সম্পূর্ণ বিচার হওয়া ৪৬০টি মামলার মধ্যেঃ
ক। ৪০% ক্ষেত্রে "ধর্ষণ"এর অভিযোগ এসেছে, সম্মতিক্রমে ঘটির যৌন আচরণের জন্য। এগুলোকে আমরা সিধে ভাষায় বলি "পালানো"র ঘটনা। ছেলেটি ও মেয়েটি পালিয়েছে, পরে মেয়েটির বাপ-মা-আত্মীয়স্বজন-পুলিশ অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে। এটা হল ধর্ষণের অভিযোগের সিংহভাগ।
খ। ২৫% শতাংশ ক্ষেত্রে (এটাও সম্মতিক্রমে যৌন সংসর্গের ঘটনা), যৌন সংসর্গের পর বিয়ে না হওয়ায়, মেয়েটি ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে। -- এটা হল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কেস।
গ। ১৭% ক্ষেত্রে, যে অভিযোগগুলি এসেছে, সেখানে আক্রান্তরা বস্তি বা রাস্তার বাচ্চা যারা রাস্তায় ঘুমোয় বা সময় কাটায় এবং ফুটপাথবাসিনীদের ধর্ষণ। এগুলো অবশ্যই বলপূর্বক। এবং শাস্তি হয় ৭৫% ক্ষেত্রে।
ঘ। বাকি রইল ১৮%। এটা কোনো আলাদা ক্যাটেগরি না। এই ১৮% এর মধ্যে দিল্লী গণধর্ষণের মতো ঘটনা গোটা দিল্লীতে ২০১৩ তে হয়েছে ১২ টা। যেখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক বা একাধিক লোক একটি অপরিচিত মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে।
দিল্লির এক বছরের এই পরিসংখ্যান, যে ফাঁকটিকে চিহ্নিত করে, তা হল, নতুন আইনের পরেও ৬৫% নথিভুক্ত ধর্ষণের অভিযোগ আসলে স্বেচ্ছায় যৌন সংসর্গের ঘটনা। অন্তত দিল্লিতে। এর বাইরেও বহুসংখ্যক অ-নথিভুক্ত ধর্ষণ থাকাই সম্ভব। কিন্তু নতুন আইন অনথিভুক্তিকরণের সমস্যার সমাধান করেনি। বরং, অন্তত ৪০% ক্ষেত্রে তা ব্যবহৃত হয়েছে, মেয়েদের যৌনতার স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে (সম্ভবত সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের পক্ষে) । তারা তাদের যৌনতার উপরঅধিকার হারিয়েছে। সেটা সম্পূর্ণতই আইনের নতুন অংশের জন্যই কিনা বলা শক্ত। তবে পরিবর্তিত আইনটি তার পরিবর্তিত চেহারা নিয়েই এই অধিকার হারানোয় ভূমিকা নিয়েছে, এটুকু বলা যায়। কারণ, আইননানুযায়ী, 'সম্মতি' না থাকলে যৌন সংসর্গ, শুধু প্রবেশ নয়, যেকোনো সংসর্গই ধর্ষণ। আর ১৮র নিচের একটি মেয়ের 'সম্মতি' দেবার কোনো অধিকার নেই। তার সঙ্গে যৌন সংসর্গ সবসময়ই ধর্ষণ। তার প্রেমিকের বয়সও যদি ১৮র নিচে হয়, তবুও। অপ্রাপ্তবয়স্কতার অজুহাতেকোনো অপরাধী যেন ছাড়া না পায়, সম্ভবত এটা নিশ্চিত করার জন্য আইনে 'ধর্ষক'এর বয়সের নিম্নসীমা রাখা হয়নি। সেটা কার্যক্ষেত্রে উল্টো কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। 'সম্মতি' পরিণত হয়েছে 'ধর্ষণ' এ। দিল্লির এই পরিসংখ্যানটি ঘিরে, এক অদ্ভুত নীরবতা দেখা গেছে। সম্ভবত চালু কিছু ধারণা ( যেমন অধিকাংশ ধর্ষণ হয় পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা) ভেঙে পড়তে পারে এই আশঙ্কায়। ফলে এই 'অসম্মতি'কে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি।
৪।
ফাঁকফোকরের দ্বিতীয় চিহ্নটিও এই 'সম্মতি'কে ঘিরেই। সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন সংশোধনীর পর যা দাঁড়িয়েছে, আগেই বলা হয়েছে, যে, 'কনসেন্ট' বা সম্মতি নিয়ে যদি ডিসপিউট হয়, অর্থাৎ, মহিলা যদি বলেন, সম্মতি ছিলনা, এবং পুরুষটি বলেন ছিল, সেক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মহিলার কথাই সত্যি ধরে নেওয়া হবে। অতঃপর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব বর্তাবে পুরুষটির উপর।
কিন্তু এটা শুধু 'নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব' নয়। তার চেয়ে অধিক কিছু। তার জন্য একটু ইতিহাস লেখা দরকার।
সাক্ষ্যপ্রমাণ আইনে এই (১১৪এ) ধারাটি সর্বপ্রথম আসে ১৯৮৩ সালে। সেটা আসে কুখ্যাত মথুরা কেসের পর। সেখানে কেবলমাত্র কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে (যেমন কাস্টডিয়াল রেপ) নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব অভিযুক্তের উপর বর্তায়। এইসব ক্ষেত্রে সহবাস প্রমাণিত হলে, অভিযোগকারিণীর সম্মতি ছিল, এটা প্রমাণ করার দায় অভিযুক্তের। এই আইনে কোনো সমস্যাই নেই। কারণ, কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, যেমন পুলিশ কাস্টডিতে কোনো মহিলার সঙ্গে সরকারী আধিকারিকের যৌনসম্পর্কে যাবার কথাই নয়।
এর পর ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র কুমার বনাম দিল্লির মামলায় একটা রায় দেয়, যেখানে বিষয়টা 'নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা' থেকে অভিযোগকারিণীর বক্তব্য 'চূড়ান্ত' -- এই জায়গায় পৌঁছয়। আদালতের রায়ে বলা হচ্ছেঃ "It is a settled legal proposition that once the statement of prosecutrix inspires confidence and is accepted by the court as such, conviction can be based only on the solitary evidence of the prosecutrix and no corroboration would be required unless there are compelling reasons which necessitate the court for corroboration of her statement. Corroboration of testimony of the prosecutrix as a condition for judicial reliance is not a requirement of law but a guidance of prudence under the given facts and circumstances. Minor contradictions or insignificant discrepancies should not be a ground for throwing out an otherwise reliable prosecution case."
এটা অ্যাবসলিউটলি "চূড়ান্ত" না। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য বা কনসিস্টেন্ট হলে "চূড়ান্ত"। তাতেও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি, কারণ, তখনও নতুন ধর্ষণ আইন হয়নি।
এরপর ২০১৩ সালে নতুন ধর্ষণ আইন হয়। তাতে নিজেকে "নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব" কেবলমাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকেনা। ধর্ষণের অভিযোগের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়। একই সঙ্গে পেনিট্রেশনের পরিবর্তে সঙ্গে ওরাল সেক্স এবং অন্যান্য সমস্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। এটা সামন্য তালিকা পরিবর্তন নয়। পুলিশি আধিকারিক কাস্টডিতে কারো সঙ্গে যৌন সংসর্গ করছেন, -- এখান থেকে বন্ধ-দরজায় প্রেমিক-প্রেমিকা ডিজিটাল/ওরাল সেক্স করছে, এই জায়গাপর্যন্ত চলে আসে। এবং এটা শুধু 'নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব' নয়। ২০১২ সালে আদালত যা রায় দিয়েছিল, এই সমস্ত ক্ষেত্রেই সেটা প্রযোজ্য হবার কথা (যদিনা, আদালত তার রায় আবার উল্টে দেয়)। অর্থাৎ, এক কথায়, অভিযোগকারিণীর বক্তব্য যদি 'কনফিডেন্স' জাগায়, তবে অভিযোগকারিণীর বক্তব্যই 'চূড়ান্ত'। শুধু তার বয়ানের উপর ভিত্তি করেই আদালত রায় দেবে।
২০১২ সালের রায় এবং ২০১৩ সালের আইন, এরা দুটি আলাদা পরিপ্রেক্ষিতে নির্মিত। কিন্তু দুটির যোগফল এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে, ধর্ষণে অভিযুক্তের পক্ষে 'সম্মতি' নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থ বস্তুত প্রায় অসম্ভব।
৫।
প্রথম ফাঁকটি নিয়ে নীরবতা থাকলেও, 'সম্মতি' এবং 'আত্মপক্ষ সমর্থনের জায়গার অভাব', এই দুটি বিষয় নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয়নি তা নয়। বস্তুত নিবেদিতা এবং দেবিকা, তাঁদের লেখাতেই এ ধরণের একটি বক্তব্যের পক্ষে পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন। তাঁদের লেখায় বিরুদ্ধ মত হিসেবে সিএনএন ঘোষক ভূপেন্দ্র চৌবের একটি লেখাকে কোট করা হয়। "Rape is the worst possible crime that can be committed by any human being. The laws have tightened up, and rightly so, in favour of women. But is there a possibility tthat while the laws have been made more stringent, has the space for providing a valid defence been reduced? If it has, I think our lawmakers need to do something about it. " এই অংশটি উদ্ধৃত করে নিবেদিতা প্রশ্ন তোলেন, এই উদ্বেগটা আসছেকোথা থেকে? সত্যি সত্যিই কি দলে দলে মেয়েরা বন্যার মতো পুরুষদের অভিযুক্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে? নাকি যে নির্দিষ্ট প্রোফাইলের একজন পুরুষ একটি নির্দিষ্ট ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছেন, যার সঙ্গে পুরুষ মতনির্ধারকরা একাত্ম বোধ করছেন? সেটাই এই উদ্বেগের কারণ?
এরপর এই নিয়ে নিবেদিতা লেখায় পাল্টা যুক্তি দেন। রায়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে। রায় ঠিক না ভুল, এ নিয়ে এখানে কথা হচ্ছেনা, তাই তাতে আমরা ঢুকবনা। বরং এখানে একটা কৌতুহলোদ্দীপক পর্যবেক্ষণ আছে, সেটা দেখে নেব। পর্যবেক্ষণটা এই, যে, নিবেদিতা এবং ভূপেন্দ্র, রায়ের বিষয়টিতে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করলেও, একটা ব্যাপারে একমত। যেন সেটা বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নিবেদিতা লিখছেন "'sin' of rape is that it robs a woman of what is most precious to her: control over her own sexuality." আর ভূপেন্দ্র লিখছেন, "The laws have tightened up, and rightly so, in favour of women." মিলটা কোথায়? এই বাক্যদুটিতে দুজনেই সম্পূর্ণ একমত, যে, ধর্ষণ হয় কেবলমাত্র নারীর উপরে। এবং যেটা অকথিত, যেমন থাকে পূর্বসত্যরা, যে, ব্যাপারটা সংঘটিত হয় কেবলমাত্র পুরুষ কর্তৃক নারীর উপর।
এমন নয়, যে, নিবেদিতা বা ভূপেন্দ্র জানেননা, ধর্ষণ নারীর একচেটিয়া ব্যাপার না। এটা ঠিক তথ্য জানা বা না জানার ব্যাপার না। বস্তুত নিবেদিতা অন্য একটি প্রসঙ্গে, উদ্ধৃত করেন, অন্য একটি লেখাকে। Mick Brown এর "Male Rape is Not Even Recognized as a Crime"। ফলে নারী ব্যতীত আর কারো ধর্ষণ হয়না, কথাটা ঠিক নয়, এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন। কিন্তু তবুও গোটা লেখায় ধর্ষণের শিকার প্রসঙ্গে বারবার অব্যর্থ ভাবে আসে নারীরএবং কেবলমাত্র নারীর কথা। হয় সরাসরি, কিংবা ইংরিজি সর্বনামে। এবং এহ বাহ্য। মিক ব্রাউনের লেখাটিকে কোট করা হয় কোন প্রসঙ্গে? মহিলারা যৌন আক্রমণের সামনে অনেকসময়ই কেন "ফ্রিজ" করে যান? বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, এমনকি "বিগ গাই"রাও তাইই হয়। পুরো বাক্যদুটি এরকমঃ " This paralysis has to do with the mythical power attributed to sexual violence in cultures globally, and is not restricted to women alone. A counsellor in Britain heading Survivors, the principal counselling service for male rape victims, says that even men, even 'big guys' 'freeze' when they are victims of a sexual attack." পুরো লেখাতে পুং ধর্ষণ নিয়ে আর একটিও কথা নেই। শুধু এই জায়গায় যেটা বলা হয়েছে, একটু কথ্য ভাষায় বললে তার মানে এই দাঁড়ায়, যে, আক্রান্তহলে শুধু দুবলা মেয়েদের হাত-পা কাঁপে এমন না, শক্তিমান ব্যাটাছেলেদেরও অমন হয়ে থাকে।
এই শক্তিমান-দুর্বল দ্বিত্ব, গোটা লেখায় প্রকট। বস্তুত, পুং-নারীর একাধিক দ্বিত্ব লেখাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি শক্রিমান-দুর্বল। দ্বিতীয়টি (চায়ের উদাহরণ প্রসঙ্গে একটি আস্ত ভিডিও আছে, দেখে নেবেন)। সেটি হল দাতা-গ্রহীতা দ্বিত্ব। অর্থাৎ, যৌনতায় পুরুষরা 'চায়' এবং নারীরা 'দেয়'। এবং তৃতীয়টা হল আক্রমণকারী-আক্রান্ত দ্বিত্ব্। পুংরা আক্রমণ করে, মহিলারা আক্রান্ত হয়। পুং-নারী বিষয়ক এই তিনটি দ্বিত্ব গোটা লেখায় ঘুরে বেড়ায়, ভারতীয় আইনী ডিসকোর্সকে কেন্দ্রকরে, যে আইন 'মরদের দরদ হয়না' এই নীতিশিক্ষায় বিশ্বাসী হয়ে, ধর্ষণের আইনকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করতে অস্বীকার করেছে। ভারতের পুং প্রধান সংসদ, দিল্লির ভার্মা কমিশন, র্যাডিকাল নিবেদিতা মেনন এবং মূলধারার ভূপেন্দ্র চৌবে, সবাই এই ব্যাপারে একমত। এঁরা অনেকেই সম্ভবত জানেন, ধর্ষণ ব্যাপারটা পুং-নারী / গ্রহীতা-দাতার ব্যাপার না। পুং কর্তৃক পুং ধর্ষণ অজানা কিছু না, সমকামীদের মধ্যে ধর্ষণ হয়না, তাও না। বিভিন্ন দেশে ধর্ষণ এবং যৌন হেনস্থাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ ধরেনিয়ে আইন বানানো হয়েছে, সেও গোপন কোনো তথ্য না। তবুও পুং-নারী গ্রহিতা-দাতা দ্বিত্বে সকলেরই অটুট বিশ্বাস। বিশ্বাস মানে অবশ্যই ব্যক্তিগত স্তরে না। লেখালিখিতে যা দেখা যায়।
বস্তুত উপরে যে দুটি ফাঁকের কথা বলা হয়েছে, তাদের পিছনের যে মূলগত ধারণা, অর্থাৎ, 'আমাদের মেয়েকে ফুসলে পালিয়েছে' এবং 'মেয়েরা ধর্ষণ নিয়ে মিথ্যে/ভুল বলতে পারেনা' এই দুইয়ের পিছনেও এই একই দ্বিত্বের স্টিরিওটাইপিং কাজ করছে। এমনকি যখন 'বৈবাহিক ধর্ষণ'এর কথা বলা হয়, সেখানেও কেবল নারীর কথাই বলা হয়। ব্যাপারটাকে লিঙ্গনিরপেক্ষ করার কোনো আওয়াজ কোনো তরফেই সেভাবে চোখে পড়েনা। সেই চিন্তনেও কাজ করে এই একই দ্বিত্ব। এব্যাপারে ভারতবর্ষের সব পক্ষই, লাইনের একটি দিকেই বিরাজ করে।
৬।
এইখানে একটা প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক। খুব চলিত ভাষায় বললে, প্রশ্নটা এরকমঃ "মোশাই আপনি খামোখা পুং ধর্ষণ নিয়ে পড়লেন কেন? পুংরা কি ধর্ষিত হয় নাকি? হলেও তো এক আধটা"। নিবেদিতাও, এর কাছাকাছিই একটা প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর লেখায়। যে, হঠাৎ, 'পুরুষ'এর সমস্যা নিয়ে এত মাথাব্যথার কারণ কী? সেটা কি নির্দিষ্ট কোনো প্রোফাইলের পুরুষ অভিযুক্ত হচ্ছেন, সেই কারণে?
উত্তরটা দেবার আগে, একবার চিত্রটা দেখে নিলে সুবিধে হত। কিন্তু সেটা অসম্ভব। 'মরদের দরদ হয়না' মতাদর্শ এত প্রবল, যে, ভারতবর্ষের ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভেতে এ নিয়ে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হয়না। ক্রাইম রেকর্ড থেকে কিছু পাওয়া যাবেনা। কারণ ভারতবর্ষে পুরুষের পায়ুপ্রহার হয়না। অর্থাৎ, অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘটনাটা ঘটলে তা ধর্ষণ না, কিন্তু স্ব-ইচ্ছায় ঘটালে তা অপরাধ। সৌদি আরবে মেয়েদের ধর্ষণ নিয়ে এরকম আইন ছিল শুনেছি। তো, সে যাই হোক, তথ্যনেই। যদিও ভিকটিম আছে (গুরুর বইতেই তাদের আত্মকথন আছে)।
ভারতে যেহেতু তথ্য নেই, অগত্যা আমেরিকা। ২০১০ সালের তথ্য থেকে দেখতে পাচ্ছি, সে দেশের ১৮.৩% মহিলা সারাজীবনে একবার ধর্ষিতা হয়েছেন। অর্থাৎ, অনিচ্ছাসত্ত্বেও কোনোরকম "প্রবেশ" ঘটেছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ১.৪%। অর্থাৎ, প্রায় ১৩ ভাগের এক ভাগ। তাতেও একেবারে উপেক্ষণীয় কিছু না।
কিন্তু এহ বাহ্য। এই ১.৪% সংখ্যাটা সম্ভবত পুং কর্তৃক পুং এর পায়ুপ্রহারের চিত্র। মহিলাদের পক্ষে সাধারণভাবে এই কাজ করা অসম্ভব। মহিলাদের পক্ষে যেটা সম্ভব, সেটা হল, "আমাকে প্রবেশ করাও" বলে জোর করা। সেটা এখানে নেই। পরিবর্তে পরিসংখ্যানে আরেকটা কলাম আছে, যেখানে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুরুষদের প্রবেশ করাতে বাধ্য করা হয়েছে (মেড টু পেনিট্রেট)। সেই সংখ্যাটা ৪.৮%। অর্থাৎ এই সংখ্যক পুরুষ অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই কর্মটি করতে বাধ্য হয়েছেন।দুটোকে যোগ করলে পাচ্ছি ৬.২%। অর্থাৎ মহিলাদের ধর্ষণের এক তৃতীয়াংশের বেশি। (অন্যান্য সমস্ত যৌন হিংসা যোগ করলে সংখ্যাটা মহিলাদের অর্ধেকে পৌঁছে যায়, কিন্তু সেটা এখানে আলোচ্য না)। যদিও, মনে রাখতে হবে, "মেড টু পেনিট্রেট" কিন্তু ধর্ষণ না। অর্থাৎ, একজন পুং যদি একজন মহিলার অনিচ্ছাসত্ত্বেও "প্রবেশ" করান, সেটা ধর্ষণ, কিন্তু একজন মহিলা যদি পুরুষের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে প্রবেশ করাতে বাধ্য করেন, সেটা ধর্ষণ না। আইন এবং পরিসংখ্যানেরচিহ্নিতকরণের হিসেবে। শুধু ভারতে নয়, আমেরিকাতেও।
বলাবাহুল্য, এখানে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে কূটকচালি হচ্ছেনা। তর্কও না। সংজ্ঞা নির্মাণের একটি মতাদর্শ থাকে। কোনটা 'ক্রাইম' আর কোনটা নয়, তার কোনো সার্বজনীন যুক্তি নেই, ওটা মানবসভ্যতায় যে চিন্তন যখন প্রকট, সে নির্ধারণ করে। এখানে সেই চিন্তনটিকে দেখা হচ্ছে, চিহ্নিত করা হচ্ছে মাত্র। তা, দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রকট চিন্তন অনুযায়ী, আপাতত, ধর্ষণ একেবারেই 'অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলপূর্বক যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করানো' নয়। বরং, 'অনিচ্ছাসত্ত্বেও নারীকে যৌনক্রিয়ায়অংশগ্রহণ করানো'। সেইজন্যই 'প্রবেশ' ইত্যাদির আগমন। ওই সংজ্ঞায় ১% পুরুষও কোনোক্রমে ধরে যাচ্ছেন, এই মাত্র। ফলে ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে শব্দবন্ধটি ধর্মোচ্চারণের মতো ব্যবহৃত হয়, সেই কনসেন্ট, অর্থাৎ 'সম্মতি', তারও হায়ারার্কি আছে। মহিলাদের সম্মতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ, পুরুষদের নয়, বা কম গুরুত্বপূর্ণ।
৭।
এত করে, পয়েন্টটা কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই, যে, পুংদের ধর্ষণ হয়না, হলেও সামান্য, একথা 'ঠিক', কারণ, ধর্ষণের সংজ্ঞাই ওইভাবে নির্মিত। পৃথিবীব্যাপী। অর্থাৎ 'যারা আকাশে ওড়ে এবং যাদের গায়ের রঙ কালো, তারাই শুধু পাখি', এইভাবে যদি পাখির সংজ্ঞায়ন করি, তো কেবলমাত্র কাকই পাখি। দু-একটা পায়রা-টায়রা ওই দলে ঢুকে পড়তে পারে এই মাত্র। এটা ব্যঙ্গ করে লেখা নয়, প্রতিতুলনা দিয়ে সংজ্ঞায়নের পিছনের চিন্তন প্রক্রিয়াটাকে স্পষ্ট করার জন্য লেখা। এই চিন্তনঅনুযায়ী, 'মরদের দরদ হয়না' (এর সঙ্গে যে দ্বিত্বগুলি আছে, সেগুলিও আগে বলা হয়েছেঃ শক্তিমান-দুর্বল। দাতা-গ্রহীতা । আক্রমণকারী-আক্রান্ত )। ধর্ষণের ভিকটিম কেবলমাত্র সর্বনামে 'শি'। দু-একটি 'হি' তালিকায় ঢুকে পড়তে পারে বড়জোর, তার বেশি না।
এই চিন্তন সর্বগ্রাসী। ভারতীয় সংসদ থেকে নিবেদিতা মেনন হয়ে পশ্চিমের গর্ভগৃহ অবধি। নারী ও পুরুষ উভয়ের চিন্তনেই। ধর্ষণের শিকার কেবলমাত্র নারী, কারণ, নারীকে 'লুটে নেওয়া যায়'। নারী একটি প্রাইজ। আর পুরুষ তার প্রাপক, পুরুষ লুটেরা। এই স্টিরিওটাইপের নির্মাণ সর্বত্র। নিবেদিতা মেননের 'চা পান' এর প্রতিতুলনা এই চিন্তনের বহিঃপ্রকাশ, ভূপেন্দ্র চৌবের বক্তব্যও তাই। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে এ দুটো আলাদা কিছু না।
এই নিয়ে কথা তোলা কেন? 'পুং'দের উপর অত্যাচার হচ্ছে, এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্য না। পুরুষরা যদি কোনো জিনিসকে অত্যাচার মনে না করেন, তো সেটা বাইরে থেকে চাপানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। 'পুরুষদের ধর্ষিত হবার অধিকার দেওয়া হোক', এটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যও এতটা লেখা নয়। যেজন্য এতটা লেখা, সেটা হল, ধর্ষণ মূলত একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। এই সামাজিক প্রক্রিয়া পূর্বনির্ধাসণ করে দেয় কে ধর্ষিত হতে পারে, কে নয়। এবং এরও একটাবৃহত্তর প্রক্রিয়া আছে। মেয়েদের ধর্ষণ শুনলে আমরা সবাই গম্ভীর হয়ে যাই, আর পুং ধর্ষণ শুনলে ঠোঁটে স্মিতহাস্য খেলে যায়, এমনকি, 'আমাকে কেন কেউ ধর্ষণ করেনা' বলে পুং ফ্যান্টাসাইজও করতে পারেন, এটা এমনি এমনি হয়না। সমাজে দুটো লিঙ্গচিহ্নের জন্য দুটো প্রক্রিয়া চলে। একটা মেয়েদের জন্য, শরীর সচেতনতার। আরেকটা পুরুষের, শরীরকে ডিসেন্সিটাইজ করার। খুব সোজা করে লিখলে, মোট কথা হল, ছেলেরা যেখানে সেখানে হিসি করতে পারে, তাদেরযৌনাঙ্গ নিয়ে ছোটো থেকেই অবাধে নাড়াচাড়া করা যায়, ইয়ার্কি তো মারা যায়ই, এগুলো হল ডি-সেন্সিটাইজেশনের প্রক্রিয়া। উল্টোদিকে মেয়েদের শরীর রাখা হয় ঢেকে, স্পর্শ করা তো বটেই এমনকি উচ্চারণ করাও বারণ, এটা হল শরীর সচেতনতা তৈরি। এই দুটো উল্টো প্রক্রিয়া যতদিন চলবে, ততদিন মেয়েরা 'প্রাইজ'ই থাকবে, ধর্ষণ চলবেই। পুরুষরা নিজেদের্ শরীরে ইন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টাচকে যতদিন 'পুরষ্কার' ভাববে, ততদিন, মেয়েরা লুটের মালই থাকবে। সোজা বাংলায়পুরুষদের যতদিন না ধর্ষণ সম্ভব, ততদিন স্রেফ মেয়েদেরই ধর্ষণ করা হবে।
এবার, এই অবস্থাটা বদলাবেন, পুরো চিত্রটায় নজর দেবেন, নাকি পুং-নারী / গ্রহীতা-দাতা মডেলে থেকে যাবেন, সেটা নিবেদিতা মেননদের ঠিক করতে হবে।