[গত সপ্তাহে ট্রেনে করে দিল্লী থেকে হরিয়ানায় নিজের বাড়ি ফেরার পথে, চলন্ত ট্রেনের মধ্যে একদল দুষ্কৃতির মারধোর ও ছুরির আঘাতে ১৬ বছরের ছেলে জুনেদ খান মারা যায়। দুষ্কৃতিদের সন্দেহ ছিল যে জুনেদদের কাছে গো-মাংস রয়েছে। এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ২০১৭-র ২৮শে জুন, দিল্লীর জন্তর মন্তরে “#NotInMyName” শীর্ষ নামে এক বিশাল সমাবেশ হয়। সেই সমাবেশে জুনেদের বন্ধু মহম্মদ আজহারউদ্দীন একটি চিঠি পাঠ করেন। সেই পাঠ শুনে সমাবেশে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। স্বর্গ থেকে জুনেইদ তার মা-কে চিঠি লিখলে কী লিখতে সেটাই এই চিঠির মূল বিষয়। উর্দুতে লেখা এই চিঠির ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আলিয়া খান, যা ২৯শে জুন, ২০১৭র অনলাইন “দি মিলি গেজেট” প্রকাশিত হয়েছে।
ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন শেখর সেনগুপ্ত]
আমার প্রিয় মা,
আসলাম আলায়কুম ওহা রহমাতুল্লাহ বরাকাতুহু (শান্তি, ক্ষমা ও আল্লাহ-র আশীর্বাদ তোমার উপর বর্ষিত হোক)।
আশাকরি তুমি ভাল আছো এবং আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তুমি যেন সবসময়ই ভাল থাকো।
মা, আমি আমার আসল বাড়ি-“স্বর্গে” (জন্নতে)পৌঁছে গেছি।তুমি আমায় ঈদের দিন নতুন পোশাকে দেখতে চেয়েছিলে। দেখো আমি একদম নতুন পোশাকে সেজে আছি। তুমি আমায় দিল্লী পাঠিয়েছিলে বাড়ির সবার জন্য ইদের নতুন পোশাক কিনে আনতে। কিন্তু ভাগ্য আজ আমায় স্বর্গে নিয়ে এসেছে। এখানে আমি আমার জন্য ভারি সুন্দর একজোড়া নতুন পোশাক কিনেছি।
মা, এখানে খুব সুখে আছি। এখানে কোনো উন্মত্ত জনতা নেই যাদেরকে দেখে আমি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ব, এখানে কোনো বিভেদের বাতাবরণ নেই। স্বর্গের বাগানে আমি হেঁটে বেড়াচ্ছি, এখানকার ফল খাচ্ছি।
আমি তোমাকে বলতে ভুলে গেছি যে, এখানে আমি অন্য শহীদ ভাইদের সাথে ঈদ উদযাপন করছি। আমার সাথে আছে মহসিন শেখ, মিনাজ আনসারি ও আরো অনেকে, যারা সবাই এখানে চিরন্তন শান্তির জীবন উপভোগ করছে।
কিন্তু মা, এখানে আমি তোমার অভাব ভীষণভাবে অনুভব করছি। অভাব বোধ করছি আমার সেইসব ভাইদের সাহচর্যের, যারাও সেদিন আমার মতো হিংস্রতার শিকার হয়েছিল। ঐ উন্মত্ত জনতা সেদিন ছুরি দিয়ে আমাদের সবাইকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু দেখো মা, সবকিছুই কেমন পাল্টে গেছে। এখন থেকে এখানেই আমি চিরদিন থাকব। মা, আমাকে যেটা কষ্ট দিচ্ছে তা হল, তুমি ঈদের দিন নতুন কাপড়-জামা পরবে না, সেমাইর পায়েস তৈরি করবে না, বিগত ঈদের দিনগুলির মতো এবার তুমি খুশি খুশি থাকবে না। আশপাশে অন্য যেসব ছেলেমেয়েরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করবে, তাদের মাঝে আমায় খুঁজে না পেয়ে তুমি কষ্ট পাবে।
ঈদের দিন তোমার হাতে তৈরি সেমাইর পায়েস এবার কে খেতে আসবে? অঙ্গে নতুন জামাকাপড় পরে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে এবার তোমাকে কে খুশি করবে? কে সারা বাড়িতে দুষ্টুমি করে বেড়াবে?
তুমি আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনতে পাঠিয়েছিলে যাতে সেগুলো পরে আমাকে সুন্দর দেখায়, একেবারে নতুন বরের মতো। কিন্তু আমি কী করতে পারি মা, কিছু ইচ্ছা থাকে যা কোনোদিন পূরণ হয় না। তুমি আর কোনোদিনই আমাকে নতুন পোশাকে দেখতে পাবে না।
মা, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি একা নেই। তুমি জানলে খুশি হবে যে স্বর্গে (জান্নাতে) আমি এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। ফেলু খান ও আখলাখ ঐ বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিল। যাকগে, এসব নিয়ে ভেবো না। পৃথিবীতে তো মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী। একদিন তুমিও আমার কাছে আসবে, আর তখন তো আমরা সবাই একসাথেই থাকতে পারব।
মা, তোমার কাছে আমার একটা অভিযোগ আছে। তুমি কি তা শুনবে?
মা, তুমি আমার কাছে মিথ্যে কথা বলেছিলে। তুমি আমাকে বলতে যে হিন্দু-মুসলমান ভাই-ভাই। কিন্তু সেদিন যখন সেই উন্মত্ত জনতা আমাকে খুন করতে উদ্যত হল, কেউই আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি। সবাই নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। তারা দেখেছিল কী ভাবে আমাকে ছুরির আঘাতে খুন করা হচ্ছে। তারা আমার খুনের ভিডিও তুলে রেখেছিল। আমি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেছিলাম, যদিও কেউই আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে নি। কোনো ভাই কি তার ভাইকে খুন হতে দেখলে এরকম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? কোনো ভাই কি তার ভাইকে খুন হতে দেখলে খুনের ভিডিও তুলতে পারে?
মা, দোহাই তোমার। তুমি এরকম মিথ্যে কথা আর কখনো বোলো না। কখনো বোলো না যে সরকার আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। তুমি দেখতে পাচ্ছ যে এই ঘটনায় মোদিজি শোক বা নিন্দা প্রকাশের জন্য এখন পর্যন্ত টুঁ শব্দটি উচ্চারণ করেন নি। “সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক নেতারাই আমাদের রক্ষা কর্তা” – এ এধরণের গুজব তুমি আর ছড়াবে না। এখন তুমি নিশ্চয় সবকিছু বুঝতে পারছো। আইনপ্রণেতাদের মধ্যে কিছু অংশ বিরোধী দলে, কিছু অংশ ইফতার পার্টি নিয়ে ব্যস্ত আর বাকিরা রাজনীতির দরবারে সেলফি তোলায় মত্ত। তারা মনে করেন যে এসব করলেই বুঝি আল্লাহ এর কাছ থেকে পুরস্কার মিলবে, সেইজন্যই খবরের শিরোনামে থাকার লক্ষ্য নিয়ে তারা সময় অতিবাহিত করেন। কেউই আমাদের কথা ভাবে না। আমি কি মানুষ ছিলাম না? তুমি কি মানুষ নও? আমার অন্তরের অন্তস্থলে কি পবিত্র কোরাণের বাণী বিরাজমান নয়? তাহলে কেন তারা আমাদের কাছে কিছু জানতে চাইলো না?
ঠিক আছে মা, এ প্রসঙ্গ বাদ দিচ্ছি। তবে তুমি একটা কথা সঠিক বলেছিলে। তুমি আমায় বলতে যে আল্লাহ ছাড়া আর কেউই নেই যাঁর কাছে আমরা আশ্রয় পেতে পারি। তুমি কি মা দেখতে পাচ্ছ না? নির্যাতিভরা সব তাঁর ছায়ার নিচে বসে আছে। এখানে কেউ আমাদের পাকিস্তানী বলে দাগাতে পারছে না, কেউ আমাদের ওপর গুলি চালাতে পারছে না, কেউ আমাদের সন্দেহর চোখে দেখছে না। পেহলু খান তাঁর বৃদ্ধা মা এর অভাব আন্তরিকভাবে বোধ করছে, আখলাখ চাচার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছি যে চাচা ঐকান্তিক ভাবে তাঁর বিধবা বউ ও সন্তান-সন্ততিদের অভাব বোধ করছেন। আর সইফুল্লা হয় তো ওর বাবার ওপর রেগে আছে।
মা, তুমি কি জানো সইফুল্লা কে? সইফুল্লা হল সেই লোক যাকে নাকি রাজনীতির কারবারিদের জ্বালাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। যদিও রাজনীতির কারবারিরা তাঁর মৃত্যুকে মুখোমুখি লড়াই এ মৃত্যু বলে প্রচার করে থাকে। একমাত্র সইফুল্লাই ওর বাবার ওপর রেগে আছে। মা, তুমি কি এর কারণটা জানতে চাও? ঘুষের বিনিময়ে সইফুল্লার বাবা তার নিরীহ সন্তানকে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করেছিলেন, যদিও জনসাধারণের কাছে সইফুল্লা একজন নির্যাতিতের মর্যাদাই পেয়েছেন।
মা, মানুষ খুব আশ্চর্য সৃষ্টি। আমার হত্যাকে কেন্দ্র করেও এরা দ্বিধাবিভক্ত। একদল তোমাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তোমার দুঃখে সমব্যথী হয়েছে, কালো ফিতে পরে তারা ঈদের নামাজ পড়েছে। অপরপক্ষে আর একদল মানুষ এদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছেন। এরা মনে করেন যে কালো ফিতে পরে যারা ঈদের নামাজ পড়ে তোমাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন তারা প্রকৃত ধর্মাচরণের বিরোধিতা করেছেন।
আমি আজ শুনলাম যে শেহলা রশিদ এবং কবি ইমরাণ প্রতাপগারহি তোমার প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করার জন্য ফতোয়ার তোয়াক্কা না করে কালো ফিতে পরবেন। আল্লাহ তাঁদের মঙ্গল করুন। আরো মঙ্গল করুন।
কিন্তু এসবের ফলে কি আমি ন্যায় বিচার পাবো? তুমি কি সুখশান্তি ফিরে পাবে? আমি জানি যে কোনো ন্যায় বিচার আমি পাবো না, তোমার মুখের হাসিও আর ফিরে আসবে না, কেননা যে জুনেদকে তুমি বাজারে পাঠিয়েছিলে সে আর ফেরত আসবে না তোমাকে নতুন পোশাক দেখাতে। কারণ আমাদের আইনপ্রণেতারা (সত্যি কথা বলতে আমাদের নয় ওদের...) আমাদের ব্যাপারে আদৌ চিন্তিত নয়।
সবশেষে বলছি, আমার বিদায় যেন তোমায় শোকসন্তপ্ত না করে এবং তুমি কেঁদো না..., কেননা এসবকিছু কেউ মারা গেলে করলে ঠিক আছে। কিন্তু এখন আমি অনন্তের পথে যাত্রা করেছি, আমি এখনো বেঁচে আছি।
তোমার প্রার্থনার সময় আমাকে সতত মনে রেখো, কোরাণ পাঠ চালিয়ে যেও।
তোমার প্রিয় সন্তান,
হাফিজ জুনেদ শহীদ
সামান্য সংযোজন
অচল সিকি
২৮শে জুন, স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা সাবা দেওয়ানের ডাকে "নট ইন মাই নেম" শীর্ষক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল কলকাতা, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু ইত্যাদি বিভিন্ন শহরে। দেশ জুড়ে বেড়ে চলা এই মব লিঞ্চিং-এর বেড়ে চলা সংস্কৃতির প্রতিবাদে ছিল সমাবেশ। যে সংস্কৃতির তখনও পর্যন্ত শেষ শিকার ছিল ষোল বছরের কিশোর জুনেদ। আজ আর সে শেষ নয় অবশ্য - অত দু দিনে একই ধরণের আরও গণপ্রহারে মৃত্যুর খবর আমরা পেয়েছি ঝাড়খণ্ড, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকেও।
সেদিনের সেই সমাবেশ দিল্লিতে হয়েছিল জন্তর মন্তরে। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম, এবং নিতান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায়, মঞ্চের একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলেছিলাম এই কবিতাটা। যিনি পাঠ করছেন, তিনিও কান্না ধরে রাখতে পারছেন না, আমি নিজেও চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার আশেপাশে তখন হাজার হাজার প্রতিবাদীর ভিড়, আমি বাজি রেখে বলতে পারি, খুব কম লোকের চোখ তখন শুকনো ছিল।
দুদিন ধরে টানা খোঁজবার পরে, অবশেষে আজ পেলাম সেই কবিতার সম্পূর্ণ ক্লিপ, কেউ আপলোড করেছেন ইউটিউবে। আপনাদের জন্য এখানে তুলে দিলাম সেই মূল উর্দু কবিতাটি - যখন তা পাঠ করা হচ্ছে।