অনুবাদঃ প্রতিভা সরকার
চমৎকারই লাগছিলো বিজ্ঞাপনটা (), বাকিদের মতন আমারও। প্রাথমিক ভাবে। বাহ, মাতৃত্ব আর কর্তৃত্ব নিয়ে বেশ চটকদার, সপাট, "কেমন দিলাম"! দেখতে ভালো, শুনতে ভালো। ভাবতে ভালো। কিন্তু...
কিন্তু, ভেবে দেখুন তো? এত সহজেই কি সাহস দিয়ে সমস্যাগুলোকে উপড়ে তুলে ফেলা যায়, অপ্রমাণ করা যায় যে মেয়ে, তোমার শরীর, মন, চাহিদাগুলো এইসময় বাকিদের থেকে আলাদা। অনেকগুলো অজানা, অবশ্যম্ভাবী, পরিবর্তনের চক্করে পড়েছে সে, তোমার শরীর। এখন তার বিশেষ বিশ্রাম চাই, বিশেষত ঐ সকালের গা গুলিয়ে ওঠা আর হরমনের উথালপাতালের সময়গুলোতে। নিরন্তর বমি, হিসেবের বালাই না করে। সর্বশক্তি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রমাণ করতেই হবে, নাকি, যে অন্তঃসত্ত্বা নারীর সশক্তিকরণের একমাত্র সসম্মানের রাস্তা হল নিজেকে প্রচন্ড সাহসী বলে প্রমাণ করা আর যাবতীয় বিশেষ লক্ষণ উপেক্ষা করে, অতিক্রম করে এমন ভাব দেখানো যে চারপাশে সব ঠিকঠাক চলছে, যেন এক্কেবারে আগের মতোই।
আরে বাবা, এটা একেবারে অন্য একটা অভিজ্ঞতা। আমরা একটা গোটা মানুষকে বহন করে নিয়ে চলেছি শরীরের ভেতরে, যে মানুষটা আবার তৈরি হচ্ছে আমারই রক্তমাংসে,আর আমার যুগিয়ে যাওয়া পুষ্টিতে। এটাই স্বাভাবিক যে এখন আমার বেজায় ঘুম পাবে, খিদে তেষ্টা বহুগুণ বেড়ে যাবে, কিছুক্ষণ অন্তর অন্তরই প্রাকৃতিক প্রয়োজন ঘনিয়ে উঠবে, আর মনকে রাখতে হবে হাল্কা, চাপমুক্ত। পেটের ভেতরের ডেলাটা কিন্তু সব অশান্তির আঁচ পায় আর সেটা ওর চিরস্থায়ী ক্ষতিরও কারণ হয়ে উঠতে পারে।
আমাকেও নানা ঝড়ঝাপটা সইতে হয়েছে এই সময়ে। আমার অফিস বেছে বেছে এই সময়েই ডবল কাজ চাপিয়েছে যাতে করে ভোর চারটের আগে তা কিছুতেই শেষ না হয়। আসলে আমি বাচ্চা হবার পর ফিরে আসবো কিনা ওরা নিশ্চিত ছিলো না, আবার যে সময়টা আসতে পারব না সেসময়ের মাইনে যাতে "অন্যায্য " ভাবে পেয়ে না যাই তা নিয়েও ওরা চিন্তিত, তাই আর কি, সব সময়টুকুর কাজটাই আমি যেন উঠিয়ে দিয়ে যাই।!
আর সে যা ব্যবহার !
- দিনে কতবার খাবার ব্রেক নিতে হয়? এক এক বারে কতক্ষণ? এইটুকু স্ন্যাক্স খেতে পনের মিনিট? তিনবার পনের মিনিট না লাগিয়ে,দুবার খাও আর দশ মিনিটে সারো। তাহলেই তো কতটা সময় বাঁচে !
- সেকি, জানেননা আমার সুগার আছে। প্রসব সম্পর্কিত ডায়াবেটিস। আমি না খেলে ভ্রূণও খেতে পাবে না যে !
এইরকম টানাপোড়ন চলতে থাকতো দিনের পর দিন। প্রায় চার পাঁচজন পুরুষ আর এদিকে আমি একা, ওরা অনেক চেষ্টা করতেন আমায় "শোধরাবার"।
ডাক্তার আমায় অনেকবার সতর্ক করেছিলেন। আর আমিও যত্নশীল ছিলাম বাচ্চাটাকে এইসব ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে বাঁচাতে। চেনাশোনা বান্ধবীদের ক্ষেত্রে, যতই ডাকসাইটে প্রফেশনাল হোক, এই সময়টা দেখেছি এক এক করে কিরকম উইকেট পড়ে যায়। কিন্তু আমি লড়ে গেছি। পরজীবীর মতো মেটারনিটি লিভের ওপর ভরসা করে মা হতে চাও! --- ঘরেলু স্ত্রী আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভরা সংসার এইরকম এক পুরুষ বসের ভাষা ছিল এই। অফিসের কাজ, বাড়ি ফিরে কাজ, রাত জেগে কাজ। দিনের পর দিন। আমার খুউব গর্ব হয় যখন ভাবি এই লড়াইটা ভালো লড়েছি, পাওনা মেটারনিটি লিভ একটুও ছাড়িনি।
ডেলিভারির পর,ফিরে গিয়ে কাগজ পত্র গুছিয়ে ওদের তিন মাসের নোটিস দিই। কারণ ঐ সময়টা নতুন চাকরি খুঁজে ওদেরকে মুখের মতো জবাব দেবার পক্ষে বড়ই সাহায্য করেছে।
আমার মনে হয় এটা আমার একটা খুব বড় অর্জন, ওদেরকে ওদের মতো করেই জবাব দেওয়া।
তবে এই একই সাথে আরেকটা প্রশ্নও তাড়াতে পারিনা কিছুতেই... এই যে প্রতি পদে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই, শহীদ হওয়া, প্রতিটা মুহূর্তে আদায় করে নেওয়া, অধিকার অর্জন... এটাই কি একমাত্র পথ? মাতৃত্বের স্বাভাবিক ধর্মকে স্বীকার করে নিয়ে, জায়গা করে দিয়ে, পাশাপাশি মেয়েদের নিজেদের যোগ্যতা আর সম্মান নিয়ে বাঁচা... খুব বেশি চাওয়া হয়ে যায় কি?
মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে মাথা সোজা রেখে স্বাভাবিক ভাবে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার অন্য রাস্তা কি সত্যিই খোলা থাকতে নেই ?