আতরের সুবাস, পাঞ্জাবীর নতুন ভাঁজ, মাথায় টুপি... দলবদ্ধভাবে মসজিদে যাওয়া, নামাজ আদায়, কোলাকুলি, সালাম বিনিময়।
ফিরে এসে নাস্তা করে কুরবানিতে শরিক হওয়া।
খাবারের সমাবেশে লাচ্ছা, সিমুইয়ের পাশাপাশি মাংসের নানান পদ। বিরিয়ানি, চাঁপ, ভুনা, মগজভাজা, খিরি, নিহারি, কলিজা, পরোটা সহযোগে কাবাবময় দিন।
সমাজের একটা অংশের প্রশ্ন তোলেন কুরবানি নিয়ে। এক্ষেত্রে তাঁদের দাবি পশুহত্যা উচিত নয়। কিন্তু কুরবানি বোধহয় আর ধর্মে আটকে নেই।
১)মাংস খাওয়া। নিজে খাওয়ার পাশাপাশি পাড়া পড়শির মধ্যে বিধান মেনে বিলিয়ে দেওয়া।
অমুসলিমদের মধ্যে যাঁরা বিফ খান তাঁরাও সামিল হন। গরুর পাশাপাশি অন্যান্য পশুও কুরবানি হয়।
২)কুরবানিকে কেন্দ্র করে একটা বিশাল বাজার দাঁড়িয়ে। যেখানে মুসলিমদের আধিপত্য থাকলেও। তা দেশের বানিজ্যে বড় ভূমিকা নেয়।
৩)বয়স্ক গরু তো বটেই, গরুর কেনাবেচার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়। যেটা না হলে সমস্যা হতে পারে। বয়স্ক গরুর মরার অপেক্ষা করলে গো পালককে খাবার যোগাতে ফতুর হতে হয়।
৪)চামড়া শিল্পের কাঁচামালের বিপুল যোগানের মাধ্যম কুরবানি।
৫)কুরবানির চামড়ার পয়সা দান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা পয়সার রোটেশনে ভূমিকা নেয়।
বিজ্ঞানের নিরিখে খাদ্য-খাদক সম্পর্কে যদি বিবেচনা নাও হয়। তবুও বুকে হাত রেখে দেখলে অনুধাবন করা যাবে পশু-পাখি তো বটেই, মাছ বা ডিমের মাধ্যমেই প্রাণহত্যা করে চলেছি।
যে মানুষটি রবিবারে পাঁঠার ঠ্যাং চেবান। তাঁর প্রাণ অবশ্যই কাঁদতে পারে সদ্য ভোগে যাওয়া প্রাণীটির জন্য। কিন্তু আমিষের যোগান পেতে আমাদের প্রাণ হত্যা করতেই হবে। নিজের প্রয়োজনে, সভ্যতার প্রয়োজনে।
খাসির দোকানে লম্বা লাইন দেওয়া মানুষ, জ্যান্ত কইগুলোকে পটাপট বঁটিতে ঠান্ডা করে পাত সাজানো বাঙালী যদি প্রাণহত্যার বিরুদ্ধে নেমে বসেন। অচিরেই বাঙালী পাতে মাছের আগ্রাসনও হারাবে।
কুরবানিকে নিয়ে ধর্মকে অস্বীকার করলেও আমিষ বড় সত্য। যে ব্যক্তির কাবায় বিশ্বাস নেই, তাঁর বিশ্বাস কাবাবে থাকুক।
কুরবানি একটা নিছক মাংসের উৎসব হলেও সমস্যার কারণ থাকা উচিত নয়। ইলিশ উৎসব, বিফ উৎসব দিব্যি হচ্ছে আজকাল।
প্রাণহত্যার অজুহাতে কুরবানি বন্ধের কথা উঠলে, খুব একপেশে শোনায়। নচেৎ স্পষ্ট দ্বিচারিতা। কেউ কেউ আবার গোহত্যার সেন্টিমেন্ট নিয়ে চলে আসেন।
অথচ বিয়েবাড়ি থেকে রেস্টুরেন্ট, মাংসের দুনিয়ায় হাহাকার। লেগপিস নিয়ে কাড়াকাড়ি। বিরিয়ানি, কাবাবের ছবিতে ভরে ওঠা টাইমলাইন কিন্তু পশুদের উপর সদয় নয়!
যে বাঙালী দিনে দুপুরে বিফ খেয়ে বুক বাজিয়ে বলতে শিখেছে, সন্ধ্যেয় চিলিপর্ক সাজিয়ে খুল্লামখুল্লা সেলফি সাজায় তার মরশুমি পশুপ্রেম বিজয় মালিয়ার দেশপ্রেমের মতো শোনায়।
পশুহত্যা বন্ধের দাবি ওঠে তাহলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ঘাস খেয়ে বাঁচার উপায়ও নেই। সভ্যতা ক্রেসক্রোগ্রাফ ছুঁড়ে মারবে!
সর্বোপরি দেশটা ধর্মসর্বস্ব। এখানে ধর্ম ও ব্যবসা সমার্থক। মহাকাব্য এবং ধর্মগ্রন্থ ঘাঁটলেও পশুশিকার করে আগুনে ঝলসে খাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে পশুহত্যা বন্ধ মানে ঐতিহ্যকে অস্বীকার। টিঁকে থাকতে গেলে পশুহত্যা করতেই হবে।
দেশের বানিজ্যের একটা বড় অংশ পশুপালন এবং পশুর মাংস রপ্তানির উপর নির্ভরশীল। ভারত সারা বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকার পাশাপাশি গোমাংস রপ্তানিতে দেশের অমুসলিম ব্যবসায়ীরাও বেশ জমিয়ে ব্যবসা করছেন। চামড়া, জৈব সার ইত্যাদি শিল্পের ক্ষেত্রে পশুহত্যা ছাড়া উপায় নেই।
কেএফসির মতো কোম্পানিগুলো যেদিন উঠে যাওয়ার সম্মুখীন হবে, রেস্টুরেন্টগুলোয় শুধু ভেজ খাবারের অর্ডার পড়বে। সেদিন কুরবানির সার্বিক প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সঠিক সময় হবে।
প্রাণহত্যার বিরোধিতায় দেশের মানুষ গাছদেরও কষ্ট দিচ্ছেন না। বাছুরকে অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে দুধ আহরণ বন্ধ, গোবর খেলেও ক্রিমিদের প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা। তাই কার্যত হাওয়া খেয়ে থাকছেন মানুষ। কেউ কেউ ইঁট কাঠ খেয়ে থাকার কথা ভাবছেন... কেমন হবে!
কথায় কথায় আমরা সাদা চামড়ার মানুষদের অনুকরণ করি, কদর করি। সেক্ষেত্রে শিকাগো, লন্ডন, নিউইয়র্কের উন্নত মানুষজন পশুহত্যায় সেন্টিমেন্ট দেখান না।
‘ঘোড়া ঘাসের সাথে বন্ধুত্ব করবে তো খাবে কী।” এই সত্যটা সহজে বুঝে নিলেই এতো তর্কের অবকাশ আসে না। ধর্মের প্রসঙ্গ না টেনেও দিব্যি মাংসের উৎসব হওয়া প্রয়োজন।
যে মুসলিম ভাইটি কুরবানিতে গরু বা মোষ খাচ্ছেন বলে আপনার এতো অভিযোগ, ঠিক সেই দিনেই আপনি প্রাণভরে মাটন বা চিকেন সাঁটাচ্ছেন। স্থান পৃথক হলেও, কার্যকারিতায় উনিশবিশ। আপনার খাবারের প্লেটও একটি প্রাণের বিনিময়ে সেজেছে। সারা ভারতে হোটেল বা রেস্টুরেন্টে চাহিদা অনুযায়ী বা গৃহস্থালির জন্য রোজ ধর্মনিরপেক্ষ কুরবানি হচ্ছে। কোটি কোটি গরু, শুয়োর, খাসি, পাঁঠা হত্যা হচ্ছে... মুরগীর হিসেবে না যাওয়াই ভালো। আসলে এগুলো ধর্মের নামে হচ্ছে না বলেই আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। ধর্মের নামে পশুহত্যাও হত্যা, রসনার তৃপ্তির নামে করলেও হত্যা। এদেশে খাদ্যের প্রয়োজনে বিশাল সংখ্যায় প্রাণহত্যা হয় রোজ।
ভারতীয় মুসলিমরা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সচেতন। প্রকাশ্যে কুরবানি দেওয়ার ঘটনা কমে এসেছে। ফেসবুক জুড়ে জবাই করা পশুর ছবি না দেওয়ার আর্জি, পশুর রক্ত ও অন্যান্য পরিত্যক্ত অংশ মাটিতে চাপা দেওয়ার দাবিও উঠেছে মুসলিমদের মধ্যে থেকে।
দু একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই যায়। তার কারণ অশিক্ষা বা কিছুক্ষেত্রে কুরবানির পর্যাপ্ত জায়গা না পাওয়ায় এমন ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। শুনতে অবাক লাগলেও দেশের সরকারকে তৎপর হওয়া প্রয়োজন। অমুসলিম প্রধান এলাকায় সম্ভব হলে পৃথক কুরবানির ক্ষেত্রের ব্যবস্থা করা। জল নিকাশি ব্যবস্থাও ভালো হওয়া দরকার। তাতে অন্ততপক্ষে অমুসলিমদের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ভালোভাবে এড়ানো যাবে।
ভারত বা বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোয় কুরবানি দেওয়ার আলাদা জায়গা নির্দিষ্ট না থাকায় সমস্যা হয়ে যায়। বৃষ্টির জলে রক্ত মিশে বিতর্কের সৃষ্টি করে। কিন্তু আরবিয়ান দেশগুলো কিংবা পাশ্চাত্ত্য দেশগুলোতে কুরবানি নির্দিষ্ট জায়গায়, নিয়ম মেনেই হয়।
যে দেশে মুসলিমদের নিয়ে রাজনীতি হয়, সেখানে উভয় সম্প্রদায়ের কথা ভেবে কুরবানির কিছু জায়গা নির্দিষ্ট করা কি খুব অসম্ভব? তা কি তোষণের আওতায় আসবে?
কুরবানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা রাজনৈতিক নেতারা নিজেরাই মাংস ফেলে দাঙ্গা ছড়াতে চান, তখন বুঝতে হবে পশুর রক্তে তাঁদের কিছুই আসে না। তাঁরা ক্ষমতার জন্য মানুষের রক্তের পরোয়া করেন না।
মায়ানমারে নিরীহ মানুষের রক্তস্রোতের চেয়ে বাংলাদেশে খারাপ বৃষ্টিরজলে পশু রক্ত মিশে যাওয়ার ঘটনায় অধিক চিন্তিত। খারাপ নিকাশির কারণে বৃষ্টির জলে রক্ত মিশে যাওয়াটা মোটেই শোভনীয় নয়, কিন্তু গণহত্যা অধিক গুরুতর বিষয়।
অনেকেই অবগত নন, কুরবানি ঈদের দিন ছাড়াও তার পরের দুই দিন ধরে দেওয়া যায়। কুরবানির পর কসাইখানাগুলো বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। এমনকি বিফসর্বস্ব মুসলিম হোটেলগুলোও চার পাঁচদিন বন্ধ রাখা হয়। কয়েকদিন পশুহত্যায় বিরাম থাকে।
ফেসবুকে রক্তাক্ত ছবি দেওয়া এবারে অন্ততপক্ষে চোখে পড়েনি। কেউ কেউ বাংলাদেশ বা অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের ছবি দিয়ে বাজার গরম করতে চাইছেন। যার মধ্যে আছে প্রচ্ছন্ন ধর্মীয় ‘আমরা-ওরা’। ‘ওরা কত খারাপ দেখুন, নিজে হাতে গরু কেটে যায়। আমরা ভালোমানুষ, কসাইখানা থেকে আনি’। বাংলাদেশের ছবি দিয়ে এই দেশের পরিস্থিতির বিচার করতে চাওয়া বোকামি এবং ভিন্ন উদ্দেশ্যযুক্ত। ফেসবুকে বাবা মেয়ের রক্তমাখা ছবির কমেন্টে গালাগালি লিখছেন যাঁরা, ফেসবুকে শেয়ারের পর শেয়ার করছেন। মিশরের ছবিকে বাংলাদেশের ছবি বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। অতীতে জবাই করা পশুর সাথে সেলফি তুলে নোংরামি ঘটনা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু বর্তমানে এই দৃশ্যদূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
খুব ছোটবেলায় কুরবানি ঈদ এলে আমরা খেলতাম গরু-গরু খেলা। গরু জবাই খেলা বললেও অত্যুক্তি হয় না। পাড়ার ছোট ছোট বাচ্চারা জড় হয়ে কোনও একজনকে গরু বানিয়ে হাতের তালুকে ছুরি ধরে নিয়ে, নকল জবাই-জবাই খেলা। দু চারজন গরু সাজা ছেলেটির হাত পা চেপে ধরতো।
আবছা মনে আছে। বড়দের নজর পড়লেই বকা খেতাম। মা বলতেন - “আর খেলা নেই? এসব আর খেলতে না দেখি”। আমরা বকাঝকা খেয়ে এসব আর করতাম না। ক্রিকেট বা ফুটবল বোঝার আগেই জবাই-জবাই খেলা শিখেছিলাম। অনুকরণপ্রিয় ছোটবেলা জবাইয়ের খেলা শিখেছিলো ঠিকই। কিন্তু মরতে বসা পশুর রক্ত বা পা ছোঁড়া আমায় ভাবাতো, দেখে ভয় লাগতো, মনখারাপ করতো। এমনকি মাংস খাওয়ার আগ্রহ হারিয়েছিলাম অনেক বড় হওয়া পর্যন্ত।
ঠিক এইকারণে সচেতন থেকে বাচ্চাদের কুরবানির সময় দূরে রাখা প্রয়োজন। একগাদা রক্ত বা উৎসর্গীকৃত পশু জবাইয়ের ঘটনা শিশুর মনে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
কুরবানি ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হোক বা খাদ্য খাদক সম্পর্কের জন্য। শিশুদের দূরে রাখার চেষ্টা থাকুক।
বাচ্চারা গ্রামেগঞ্জে আজও কুরবানিকে নকল করার চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে সাবধানতা বজায় রাখতে হবে। বিপদ ঘটে যেতে পারে।
কুরবানি ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে পশুত্বকে বলি দেওয়া। যদি ধর্মকে অস্বীকার করাও হয়, সেক্ষেত্রে কুরবানির পজিটিভ দিক অবশ্যই থেকে যায়।
প্রকাশ্যে কুরবানি না হলে কুরবানি নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কুরবানি বন্ধ নয়, প্রকাশ্যে কুরবানি বন্ধ হোক। ঠিক তেমনি শহরে খাসি কেটে ঝুলিয়ে রাখার বিরুদ্ধে সরব হওয়া প্রয়োজন। সমস্যা হলে ফেসবুক গরম না করে প্রশাসনকে জানানো দরকার। কুরবানির ফলে দূষণের সম্ভাবনা তৈরি হলে মুসলিমদের সাথে প্রশাসনকেও ব্যবস্থা নিতে হবে। সাগর মেলায় সরকার যে পদক্ষেপ নেন, কুরবানিতে তার ৫০% নিলেও দিব্যি দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব।
কুরবানিকে সবরকমভাবে দূষণমুক্ত করাই আমাদের উদ্দেশ্য হোক।
কুরবানি মাংসের ভাগ করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার ভালো দিকটাও তুলে ধরা প্রয়োজন।
কুরবানির চামড়ার পয়সা গরিবদের দেওয়া হয়।
কেউ কেউ বলেন মাংস তো এমনিও বিলিয়ে দেওয়া যায় ধর্মের মোড়ক ছাড়াই। কিন্তু ধর্মই এই পরিসর দিয়েছে।
কুরবানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা কতজন মানুষ মহার্ঘ্য খাসির মাংস গোটা গ্রামে বিলি করেন? কতজন সামান্য মুরগির মাংস কিনে বছরে একবার গ্রামে বিলি করেন? চামড়ার টাকা তুলে দেন কোনও অসহায় বৃদ্ধার হাতে। হ্যাঁ, এই দিকটাও তুলে ধরতে হবে।
কুরবানির উপর প্রশ্ন তোলার আগে আপনাকে মিশতে হবে সেইসব হতদরিদ্র সংখ্যালঘু পরিবারের সাথে, যাদের কাছে একবেলা মাংসও স্বপ্নের মতো। ঈদের কটা দিন জমিয়ে আমিষ খেতে পাওয়ার হাসি দেখতে হলে গ্রামে যেতে হবে। রবিবারের ছুটিতে রেওয়াজি খাসির ঝোল ভাতে মেখে সেই ‘গরিবের খুশি’ অনুভব করা যাবে না।
গ্রামের দিকে দলিত বা নিম্নবর্ণের অমুসলিমরাও মাংস চাইতে আসেন। বকরী ঈদটা এখানে একটা বিশেষ ধর্মে সীমাবদ্ধ নেই।
কুরবানি ভিন্নধর্মের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়ার উৎসব নয়, প্রকাশ্যে পশু জবাই করে আস্ফালন করার পরব নয়। দিনের শেষে ধর্মীয় বিধান ভুলে যান, মাংসে প্লেট সাজান।
#হককথা