স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার জানা বেটি(গ্রাম্য অর্থে পিসি) শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি এসে উঠলো ছেলেপুলে নিয়ে। আব্বার স্নেহ থেকে বঞ্চিত দুই ভাই আলমগির-বাসুন ক্রমে আমাদের খেলার সাথী হয়ে গেলো। সদ্য গজিয়ে ওঠা জানা বেটির জরির কারবার, স্বল্পপুঁজির ব্যবসার মধ্যে স্বাবলম্বী হয়ে উঠার চেষ্টা। ঘরের বারান্দায় মেয়েদের নিয়ে জরির কাজ হয়। অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় রোজ বারো চোদ্দঘন্টার কাজ। সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় দারিদ্রের ঘানি টানা ছাড়া উপায় ছিলো না বাসুনদের। বাসুনের অন্য নাম থাকলেও ‘বাসন’ শব্দটি গ্রাম্য হাওড়াসুলভ উচ্চারণে বাসুন হয়ে গিয়েছিলো। কতটা অব্যবস্থা থাকলে একটা বাচ্চার নাম থালা-বাসন জাতীয় কিছু হতে পারে, সেটা পরিস্থিতি বুঝিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। একঘরে গাদাগাদি সংসার, জরির ব্যবসায় বড়সড় লাভ না হলে সাদামাটা ঈদ।
কাকদ্বীপ থেকে হাওড়ার গ্রামের বাড়িতে ঈদ কাটাতে এসে ঈদের দিন আব্বার কাছ থেকে আমি আর মেজো দশটাকা করে পেতাম। নামাজ শেষে ঈমাম সাহেবের সাথে হাত মেলানোর সময় তা দিয়ে দিতে হতো। কিছু টাকাপয়সা মানে দু চারটাকা জমিয়ে রাখতাম আলমগির-বাসুনদের জন্য। আলমগির-বাসুন সাড়ে আটটার জামাতে নামাজ পড়ে নিতো ভাঙা মসজিদতলায়। আমাদের মসজিদে জামাত শুরু হতো নটায়। নামাজ শেষ করে বড়দের সালাম করে, বন্ধুদের সাথে কোলাকুলির পর দেখতাম আলমগির-বাসুন ঘুগনির পশরা নিয়ে বসে থাকতো মসজিদের গেটের সামনে। ছোট কলাপাতায় একটাকার ঘুগনি। তালপাতার পাতা কেটে বানানো চামচে তুলে খেতে হতো। ক্ষীর, লাচ্ছা-সিমুইয়ের জয়জয়কারের মাঝে হাতে হাতে ঘুরতো আলমগির আর বাসুনের ঘুগনি। যেন আলুকুচির মধ্যে গলে যাওয়া মটরের চিত্রনাট্যে সেলিম-জাভেদের জুটি। অজ পাড়াগাঁয়ে ঘুগনিটুকুই যেন ঈদের উপরি পাওনা। ঘিরে ধরা বাচ্চাকাচ্চার ভিড়, হইচই। আধঘণ্টায় ফুরিয়ে যেতো সব।
বাসুন ছোট হলেও হিসেবে পাকা, আলমগির আগাগোড়া আনাড়ি। তাই বাসুন হিসেব রাখে আর আলমগির ঘুগনি দেয়। মাঝারি মাপের অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি ফুরিয়ে এলে একশো দেড়শো টাকার সুপারহিট ব্যবসায় আলমগির-বাসুনদের ঈদের রোজগার। তারপর মাঠে গিয়ে বাসুনদের ভেতোপাড়ার সাথে আমাদের পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ...।
একবার ঈদে ওরা দুজনে ঘুগনি নিয়ে বসেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে জানলাম আলমগির জরির ওস্তাগরের কাজ করে, বাসুন আজানগাছি হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে। আলমগির-বাসুনের ঘুগনির ব্যবসায় ইতি পড়তে আমাদের ঈদ কেমন ফাঁকাফাঁকা লাগতে শুরু করলো। রাস্তাঘাটে ঘুগনীর ঝোল লেগে থাকা কলাপাতার টুকরো পড়ে থাকে না, তালপাতার চামচের ছড়াছড়ি নেই।
কয়েকবছর পর গ্রামের বাড়িতে এসে শুনলাম আজানগাছি হাইমাদ্রাসা থেকে বাসুন স্টার পেয়ে পাশ করেছে।
বহুকাল আলমগির-বাসুনের সাথে দেখা হয়নি। ওঁরা আর মামাবাড়িতে থাকে না। চেঙ্গাইলে ফিরে গেছে, অথবা অন্য কোথাও। কেউ যেন বলেছিলো বাসুন আল আমীন মিশনে চান্স পেয়েছে।
একটাকা-দুটাকার ঘুগনিতে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার ঈদ। হারিয়ে ফেলা পাড়ার খেলাধুলোর সঙ্গী আলমগির-বাসুন।
বাগদী পাড়ার ভক্তির মা, অশোক কাকুদের কাছে ঈদ অন্যরকম খুশি বয়ে আনতো। ঈদের নামাজের পর ভক্তির মা নাতি-নাতনীদের সাথে করে বাড়িবাড়ি ঘুরে খুচরো পয়সা, লাচ্ছা-সিমুই প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে নিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতেন। কখনো খুচরো পয়সা, কমদামী শাড়িও জুটে যেতো। বাবা কাকাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে যেতেন – “পরের পাব্বোনে একটু দামী শাড়ি দিস বাপ। তুরাই আমার ব্যাটা। মোর ছেলেরা গোরিব, ঠাকুর তোদ্যার পয়সা দিয়েছে...”। অশোক কাকু, শশাঙ্ক কাকুরা আমাদের চাষবাস দেখাশোনা করতেন। ঈদ তাঁদের কাছে ‘বাবুদের উৎসব’। প্রতিবারই তাঁদের আবদার খুব সামান্য। একটা লুঙ্গি পেলেই বেজায় খুশি। পাঞ্জাবী পেলে তো কথাই নেই। বেশ আয়েস করে লাচ্ছা সিমুই খাওয়ার মধ্যেও তাঁদের মধ্যে গো মাংসের ছোঁয়াছুয়ির আশঙ্কা লক্ষ্য করতাম। অভয় দিয়ে বাবা-কাকারা বলতেন – “তোরা নির্ভয়ে খা। তোরা আসবি বলে আজ মুরগীর মাংস হয়েছে...”।
নেমতন্ন ছাড়াও ‘পাব্বোন দিবে নাকি গো...’ সুর তুলে ঈদের নানান খাবারদাবার চেয়ে নিয়ে যেতো বাগদী পাড়ার বাচ্চা থেকে বুড়োরা।
শোলবাগা, কাশমলির বাগদী পাড়ার অভাবী মানুষেরা চিরকালই আমাদের আত্মীয় ছিলেন। ঈদের অপেক্ষা তাঁরাও করতেন, আজও করেন। অশোক কাকুদের বয়স হয়েছে, রাধা মাসিরা আর আসতে পারেন না। ভক্তির মা প্রায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে যান। শাড়ি আদায় করেন তাঁর পাতানো ছেলেদের কাছে। শাড়ি না পেলে পঞ্চাশ-একশো টাকাতেও খুশি হয়ে আশীর্বাদ করে যান – “তোদ্যের ব্যাটা-মিয়েরা ভালো থাক বাপ। বৌমা তুমিও ভালো থাকো মা...”।
ঈদের খুশিতে এখন নানান সংযোজন হয়েছে। ভাইজানের সিনেমা, সোশাল মিডিয়ায় হইচই, চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান, খাদ্যতালিকায় সংযোজন, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় বা ঈদের সাজগোছে ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষের অংশগ্রহণ, মুসলিম বন্ধুর বাড়িতে জমিয়ে খাওয়াদাওয়ার চিত্র এখন নজরে পড়ার মতো। কিন্তু আজ থেকে পনেরো কুড়ি বছর আগেও গ্রাম্য উৎসবে অশোক কাকুদের উপস্থিতি প্রশান্তি এনে দিতো। তখনো সাদামাটা ঈদযাপনে সহাবস্থান ছিলো। ‘প্রতিবেশীকে জানুন’ জাতীয় প্রচারের দরকার গ্রামেগঞ্জে তেমন কোনওদিনই সেভাবে পড়েনি। গ্রাম্য ক্যালেন্ডার সৌহার্দ্যের নিজেস্ব পরিভাষা দিয়ে উৎসবে মিলিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম এবং শ্রেণীর মানুষদের। জানা বেটি, বাসুনদের ঈদকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক সংগ্রাম, ভক্তির মা বা শশাঙ্ককাকুদের ঈদে পরোক্ষভাবে সামিল হওয়া ঈদকে তখনো এক অন্যরকম নির্দেশতন্ত্রে দেখার সুযোগ করে দিতো।