ঈদের সময় ঈদকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান টিভিতে প্রায় থাকেই না। নিদেনপক্ষে ধর্মীয় প্রেক্ষাপট তুলে ধরা বা ঈদের আড্ডা টিভি চ্যানেলগুলোতে বসে না। ঠিক যেমনভাবে দুর্গাপুজোয় হয়। বিভিন্ন নামী পুজোর ইতিহাস ইত্যাদি নিউজ চ্যানেলগুলো তুলে ধরে, কিন্তু নামী মসজিদের ঈদের নামাজের ইতিহাস বা হেভিওয়েট নেতা কিংবা সেলিব্রিটিরা কোথায় নামাজ পড়লেন সেভাবে প্রকাশ্যে আসে না। কোনও প্রথমশ্রেণীর দৈনিক ঈদ সংখ্যা বের করে না! দু একটি ফিচারেই দায়সারা সান্ত্বনা পুরস্কার।
চণ্ডীপাঠের সুর বাজে চারিদিকে, কিন্তু “রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” গানটাও রেডিওতে বাজে না।
ঈদের নানান রেসিপি নিয়ে রান্নার শো গুলোর খুব মাতামাতি নেই। পুজোয় ছুটি বেশি, ঈদে দুদিন ছুটি দিলেই তোষণ থিওরি চলে আসে। সরকার প্রতিমা বিসর্জন সংক্রান্ত দূষণ নিয়ে যতটা চিন্তিত, কুরবানিতে তেমন ব্যবস্থা নিলে অনেক অভিযোগের অবকাশ থাকে না। এইসব বহুকালের ব্যক্তিগত অভিযোগ স্বজাতি বাঙালীর কাছে, বাঙালী হিসেবে খানিক আত্মসমালোচনার।
ঈদ নিয়ে মিডিয়ার হইচই নেই, বিজ্ঞাপনদাতাদের দাপাদাপি নেই, এমনকি জরুরী খবর ছেড়ে উৎসব কভার হয় না। যদিও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে ভাইচারার জায়গাটা থাকে।
মুসলমানরা পুজোয় অঞ্জলি দেন না ঠিকই, মুসলিমদের সহযোগিতাপূর্ণ অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। অথচ দুঃখের বিষয় সেটিকে উপপাদ্য আকারে প্রমাণ করতে হয়। কখনো মন্ডপে টুপিওয়ালা কিশোরের ছবি, কিংবা মন্ডপের সামনে কর্মরত দাড়িওয়ালা মুসলমান বৃদ্ধের ছবি সহকারে বর্ণনা দিয়ে। নতুন করে প্রমান করার কিছু নেই! পশ্চিমবঙ্গের অনেক পুজোর কমিটিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ বহুকাল থেকেই। সারা পশ্চিমবাংলার পাশাপাশি মুসলিম প্রধান এলাকা গাডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এলাকায় মুসলমানরাই পুজোর দায়িত্ব নেন।
মণ্ডপসজ্জায় জন্য শিল্পীর ইন্টার্ভিউ নেওয়ার পাশাপাশি কুটিরশিল্পীদের বাড়ি গিয়ে উঁকি মারলে দেখা যাবে গরীব মুসলমান বাড়িতে তৈরী হচ্ছে দেবীর অলংকার, কেশদাম, নকল অস্ত্রসস্ত্র ইত্যাদি। জামাকাপড়ের পাইকারি ব্যবসার অনেকটাই মুসলিমদের হাতে থাকে। মেটিয়াবুরুজের হাটে গেলে অনুধাবন করা সম্ভব। সেই জামাকাপড় ব্যবসায়ী মারফত ছড়িয়ে পড়ে হাওড়ার হাটে, কাকদ্বীপ থেকে কাঁথিতে। পুজোটাকে ধর্ম হিসেবে না দেখে উৎসব হিসেবে শামিল হওয়া মুসলমানরা বলেন - “চাঁদা দিই, উৎসবের জন্য। হইহুল্লোড় হবে, মানুষ খুশি হবে। এতে সমস্যা কোথায়। আমার নিয়েত ফিস্ট হিসেবে দেখা, মূর্তিপূজা নয়…”।
কলেজ পড়ুয়া হোন বা চাকুরিজীবি, ধর্মটাকে ধর্মের জায়গায় রেখে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ান। এই উৎসবমুখর মেলামেশার সুযোগ দুর্গাপুজো করে দেয়। পুজোর সাজসজ্জা, আলোর রোশনাই সবার। রোলে কামড়, চাউয়ে ডিমের কুচি, বন্ধুর বাড়িতে রাতে থাকার মধ্যে দারুণভাবে মিশে যাওয়া যায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ বা মন্ডপে আশা ভোঁসলের ‘কথা হয়েছিলো’ গানের আবেগ হিন্দু মুসলমানে পৃথক হয় বলে জানা নেই। পুজোর মন্ডপে গানের জন্য সারাবছর অপেক্ষা। কৈশোরে রেডিওয় সনৎ সিংহের গান, স্কুলে ‘আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে…’ গানে বাচ্চাদের নাচ, তাতে ধর্ম খুঁজতে বসা সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর।
প্রীতমের পুজোর প্ল্যান অসম্পূর্ণ থাকে সইফকে ছাড়া। পূজাবার্ষিকীতে তৈমুর খান কবিতা লেখেন, তৌসিফ হকের আঁকার জাদুতে প্রচ্ছদে জীবন্ত হন দশভুজা, নুসরাত জাহানের সিনেমা আসে, পুজো উদ্বোধন করেন উস্তাদ রশিদ খান। স্কুলে আগমনী সংখ্যা সম্পাদনা করতে গিয়ে পেয়েছি একরাশ শিউলির ছুঁয়ে যাওয়া, কাশেদের দলবদ্ধ নাচ, ঢাকের বাদ্যি...। অন্তমিলের ছড়ায় বাঙালী সংস্কৃতি।
পুজো আসলে বিপুল কর্মসংস্থান, কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার ছুতো, আড্ডা-তর্ক-গান, নতুন উপন্যাসে বুঁদ হয়ে যাওয়া। যা উটকো নাক সিঁটকানির বাইরে সব সংস্কৃতিকেই কাছে টেনেছে। দেবীর টানা চোখ বা সাজসজ্জায় মুগ্ধ হওয়া মধ্যে ধর্ম নেই, যদি থাকে এক অমোঘ সৃষ্টি। সেই সৃষ্টিতে হানাহানি নেই, বিজেপি-আর.এস.এস নেই, তোষণ-সিদ্দিকুল্লাহ নেই। মন্ডপের ভিড়ে দাঁড়িয়ে বুকের রেডিওয় বেজে ওঠে - “মাতলো রে ভুবন…”। এই শ্রদ্ধা শিল্পকর্মের প্রতি শ্রদ্ধা। এখানেই দুর্গাপুজোর ব্যাপকতা আর বিস্তার।
তুলনামূলকভাবে দুর্গাপুজো এবং ঈদে গ্রহণযোগ্যতায় বৈষম্য অস্বীকার করার জায়গা নেই। ঈদুজ্জোহায় (কুরবানি ঈদ) গোমাংসের উপস্থিতি অমুসলিমদের সমস্যার কারণ। কিন্তু ঈদুল ফিতর নিয়েও হিন্দুসমাজ সহযোগিতা বা অংশগ্রহণের দিক থেকে ততোটাও স্বতঃস্ফূর্ত নয়। লাচ্ছা-সিমুইয়ের দাওয়াত ছাড়া ঈদকে শিল্পের পর্যায়ে তুলে ধরতে ব্যর্থ বাঙালী সমাজ। অনেক হিন্দুভাই রাস্তায় আধঘণ্টা ঈদের নামাজে প্রকাশ্যে বিরক্তি প্রকাশ করেন, কিন্তু মুসলিমভাইরা রাস্তার ধারে প্যান্ডেল বা টানা মাইক বাজানো নিয়ে অভিযোগ করেন বলে জানা নেই। বিদ্বেষকারী বিচ্ছিন্নতা এড়াতে দুটো ধর্মের উৎসবে আরো বোঝাপড়ার রাস্তাই আসল সমাধান। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানদের একটা অংশের মধ্যে ‘পুজোয় যাব না’ এমন মানসিকতা বিরল। কিছু না হলে মেলা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মিলনসূত্র মুক্তচিন্তার মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গ্রামের ফতেমা বিবির মণ্ডপে আসা হয়ে ওঠে না, আব্বাসউদ্দিন পুজোয় খেলনা বিক্রি করলেও তার কাছে পুজোটা ব্যবসার সময়, উৎসব নয়।
বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া বাঙালীয়ানা, বাঙালী জাতির নিজেস্বতার বাতি জ্বেলে রেখেছে। সিরিয়াল, বাংলা সিনেমার গানের লিরিক্সে, বিজ্ঞাপনে যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিন্দি আগ্রাসন। দুর্গাপুজো বাঙালী উৎসব সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। সাম্প্রতিককালে পুজো নিয়েও নানান অবাঙালী ফতোয়া শুধু অবাঙালী কালচারের অনুপ্রবেশ নয়, বাঙালী কালচারে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা।
দুর্গা, গনেশ, কার্তিক, লক্ষ্মীরা এই বাংলায় কোনওদিনই মাটির অবয়ব হয়ে রয়ে যাননি। উৎসব ফুরিয়ে গেলে দুর্গা আমার বন্ধুর মা, কখনও লক্ষ্মী আমার পরিচিতা বোন, গণেশ আমার মেসের বন্ধু। নিজেই কতবার প্রেমিকার কাছে ক্যাবলা কার্তিক হয়েছি। বারেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছেন এইসব নাম। মর্তে এসে সংসার করে ধন্য হয়েছেন দেবতারা। মানবজন্ম নিয়ে আমাদেরও ধন্য করেছেন। দুর্গা আসেন আনন্দের চারটে দিন নিয়ে, ফিরে যান চারপাশ খালি করে। ঠিক যেন বাঙালী মেয়ের ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি ঘুরতে আসা। ব্যস্ত উড়নচণ্ডী স্বামীটি অফিসের কাজে আসতে পারেননি। এই সাংসারিক যোগসূত্র দুর্গাপুজোকে জীবনের সাথে জুড়েছে। ‘আসছে বছর আবার হবে’ কথাটিতেই অপেক্ষার প্রহর গোনা।
পুজোকেন্দ্রীক মানুষের উন্মাদনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ নেই। তবুও এই কর্মকাণ্ড কিছু অংশে পয়সাওয়ালাদের। মুর্শিদাবাদ থেকে ছুটে আসা ঢাকিরা দুটো পয়সার জন্য খুশি হতে পারেন, কিন্তু তাঁদের পুজো অন্যরকম। হতদরিদ্র পরিবার, পথশিশুদের কাছে উৎসবের সংজ্ঞা আলাদা। সমাজের দলিত এবং নিম্নবর্ণের গরিবের পুজো আজও ক্ষুধার উপাসনাতেই কাটে। সাঁওতাল শ্রেণীর মানুষের পরব নিয়ে হাতেগোনা বাঙালী আগ্রহ দেখান। দুর্গাপুজোকে পুরোপুরিভাবে সার্বজনীন হতে গেলে সর্বস্তরের মানুষকে কাছে টানা প্রয়োজন। তবেই দেবীর ত্রিশুলে বাড়তে থাকা অনাচার, দুর্নীতি, বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির ধ্বংস সম্ভব।
পুজোর সাথে মহরমকে জুড়ে যতোই সাম্প্রদায়িকতার উন্মাদনা ছড়ানো হোক বা রাজনৈতিক ফায়দার চেষ্টা হোক, উৎসবের উপচে পড়া আজও ভিড়ে মানুষের স্রোত দেখা যায়। একডালিয়া, ম্যাডক্স, মহম্মদ আলির ভিড়ে আলাদা করে যেদিন হিন্দু মুসলমান চেনা যাবে সেদিন বাঙালীর উৎসব বলে কিছু থাকবে না।
#হককথা