এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • অঘোষিত অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা

    নীলাঞ্জন দত্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ | ৯০৯ বার পঠিত
  • অঘোষিত অর্থনৈতিক জরুরী অবস্থা

    বেশ কিছুদিন ধরেই আমরা বলছিলাম, দেশে অঘোষিত জরুরী অবস্থা চলছে। সরকারের কোনও নীতির থেকে একটু আলাদা কথা বললেই তাকে বলা হচ্ছে দেশদ্রোহী, ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র পক্ষে বিপজ্জনক। বিভিন্ন ভাবে তার কথা বলা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে – কাউকে জেলে পুরে, কাউকে একেবারে নিকেশ করে দিয়ে, কোনও সংবাদ মাধ্যমকে প্রকাশিত বা প্রচারিত হতে না দিয়ে, কোনও বইয়ের প্রকাশক বা সিনেমার প্রযোজককে হুমকি দিয়ে। কাশ্মীর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল আর মধ্য ভারতের ছত্তিসগড়কে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর বুটের তলায় চেপে রাখা হয়েছে। সীমান্তে রোজ চলছে যুদ্ধের মহড়া, সেখানে গ্রামের পর গ্রাম জোর করে ফাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে।

    এইসব চলতে চলতেই হঠাৎ ৮ নভেম্বর মাঝরাতে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে দেওয়া হল। তারপর থেকে দেশের মানুষকে যে দুর্ভোগ ভুগতে হচ্ছে, তা আর নতুন করে আলোচনা করার দরকার নেই। আর এই নিয়েও যারা সমালোচনা করছে, তাদের শুনতে হচ্ছে, তারা নাকি ‘দেশদ্রোহী’, কারণ দেশের স্বার্থেই তো এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাই দেশের জন্য যারা এইটুকু ত্যাগস্বীকার করতে রাজি নয়, তাদের আর কী বলা পারে?

    এটাই মুশকিল। সরকার বলছে বলেই এটা দেশের স্বার্থে, আর যারা জানতে চাইছে এত কষ্ট করে সত্যিই কেষ্ট মিলবে কিনা তারা কি সবাই দেশের বাইরের লোক, না শত্রুদের গুপ্তচর? এর আগে যখন শোনা গেল, ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কতগুলো জঙ্গী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তার ভিডিও তোলা আছে, কেউ কেউ বলেছিল, “বাঃ, বেশ, তবে ভিডিও দেখিয়ে দাও।” সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বললেন, “সেনাদের কাজকর্ম নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলা যাবে না।” কিছুদিন আগে ভূপালে আটজন “জেলপালানো” সিমি কর্মির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে বলে তাদের গুলি করে মারল পুলিশ। অনেকেই বলল, “সংঘর্ষের প্রমাণ কই?” এক অধস্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, “পুলিশকে তাদের কাজ করতে দাও, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলো না।” এখন একটা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েও একই সুর গাওয়া হচ্ছে।

    এইসব অর্বাচীনদের লাল চোখকে ভয় পেয়ে তো আর প্রশ্ন না করে থাকা যায় না। প্রশ্ন করাই  ভারতবাসীর স্বভাব। নচিকেতা যমকে পর্যন্ত প্রশ্ন করতে ছাড়েনি, আর জিভ কেটে দেওয়ার হুমকি দিয়েও ক্ষণার প্রশ্নবান থামানো যায়নি। তাই আসুন, কয়েকটা সোজা প্রশ্ন করি, তার সোজা উত্তর চাই।

    রাতারাতি কেন এত টাকা বাতিল করা হল? উত্তর দিতে গিয়ে মন্ত্রীমশাইরা নানা রকম কথা বলছেন। সবচেয়ে প্রথমে শোনা গেল, ৫০০ আর ১০০০ টাকার জাল নোটে ছেয়ে গিয়েছে দেশ। পাকিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে জঙ্গীরা জাল নোট বানাচ্ছে আর এখানকার বাজারে ছাড়ছে, ভারতের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য। যত নোট বাজারে চলছিল, তার কতটা জাল? বিভিন্ন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে। তার কোনটি ঠিক কারও জানা নেই, তবে বেশিরভাগ নোটই কি জাল ছিল? তাই যদি হত, তবে নোট বাতিল হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে, ২৬ অক্টোবর ২০১৬ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোটিস দিয়ে বলেছিল কেন, যে কিছু অসাধু ব্যক্তি জাল নোট ছড়াচ্ছে বটে, কিন্তুভারতের বেশি দামের টাকার নোটগুলিতে যথেষ্ট শক্তপোক্ত জাল নিরোধক সুরক্ষা ব্যবস্থা আছে, যা ভাল করে দেখলেই চেনা যায় (Circulation of Counterfeit (fake) Currency Notes, Public Notice dated Oct 26, 2016, Press Release : 2016-2017/1037)? এর কদিনের মধ্যেই এমন কী ঘটল, যে ৮ নভেম্বরেই একেবারে সব নোট ফেলে দিতে হল?

    আবার বলা হচ্ছে, কালো টাকার কারবারিদের বিপদে ফেলার জন্যই এই ব্যবস্থা। কালো টাকা যে নগদ নোটে জমা হয় না, তা আজকাল বাচ্চারাও জানে। তবুও বোধহয় মন্ত্রী-শান্ত্রী আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা একথা বলে চলেছে এই ভেবে যে, বারবার আওড়ালে মিথ্যাও সত্যি হয়ে যায়। কালো টাকা মানে অসদুপায়ে জমানো টাকা। সবচেয়ে বেশি অসৎ কারা? বড় শিল্পপতি আর বড় ব্যবসায়ীরা। যে যত বড় সে তত অসৎ। অসদুপায়েই সে বড় হয়েছে। এদের পুঁজি বাড়ছে কী করে? একটা উপায় তো আমরা দেখতেই পাই – মানুষকে কম টাকা দিয়ে খাটিয়ে নিয়ে তাদের পরিশ্রমে বেশি টাকা রোজগার করে, আর সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ যেখানে থাকে, যেমন ছত্তিসগড়ের বস্তার বা ওড়িশার মালকানগিরি, সেখান সরকারের পুলিশ ও আধা-মিলিটারি বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গায়ের জোরে তাদের হঠিয়ে দিয়ে মাটির তলার দামি দামি খনিজ পদার্থ, এমনকি ঝর্ণার জল পর্যন্ত দখল করে।

    আর একটা উপায়ে তারা কালো টাকা করেছে। অনেক ব্যাঙ্ক থেকে, যেখানে আপনার-আমার মত কোটি কোটি লোকের কষ্টে জমানো সামান্য সঞ্চয় রাখা থাকে, সেখান থেকে শিল্প বা ব্যবসা করার নামে লোন নিয়ে তারা আর ফেরৎ দেয় না। এমনি করে তাদের ব্যাঙ্ককে ফেরৎ না দেওয়া টাকার পাহাড় জমে জমে বছরখানেক আগেই ৩ লক্ষ কোটি টাকার ওপর দাঁড়িয়েছিল। ব্যাঙ্কের মাধ্যমে নেওয়া আপনার-আমার কাছে ধার শোধ না দেওয়া কোম্পানিগুলোর তালিকায় সবচেয়ে ওপরে আছে রিলায়েন্স, বেদান্ত, এসার আর আদানী গোষ্ঠী, যাদের সঙ্গে দেশের শাসক দলের মধুর সম্পর্কের কথা সবাই জানে।

    এত টাকা আছে কোথায়? বস্তায় আর বালিশের তলায় নগদের বান্ডিলে? না, বড়লোকদের টাকা আজকাল আর টাকা থাকে না। অনেকেই জানেন, তা হয়ে যায় সম্পত্তি, যখন তা দিয়ে জমি, সোনা, হিরে, এইসব কিনে ফেলা হয়। কিন্তু তার থেকেও বড় অংশকে বিভিন্ন ভাবে খাটানো হয়। সবচেয়ে সরল উপায় হল স্টক মার্কেটে খাটানো, নানান কোম্পানির শেয়ার কেনা। এর থেকে আরও অনেক জটিল পদ্ধতি আছে। অনেকের পুঁজি মিলেজুলে বিশাল অঙ্কে পরিণত হয়ে অনেক সময় বিশ্ববাজারে মুনাফার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, আদতে সে কোথা থেকে এসেছে, সাদা না কালো কী ছিল, তা আর চেনা যায় না। নানান নামে নানান ‘ফান্ড’ সেজে এসে সে হয়ত তখন সেই দেশের সরকারকেই ‘জনকল্যাণের কাজ’ করবার জন্য ঋণ দেয়, যেখান থেকে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা শুষে সে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এইভাবে লগ্নিপুঁজি হয়ে সে দুনিয়াময় ঘুরতে থাকে। একে ধরার সাধ্য কোনও সরকারের তো নেইই, থাকলেও ধরতো না। কারণ আজকের পুঁজিবাদী দুনিয়াটা তাহলে অচল হয়ে পড়বে।

    নোট বাতিল অভিযানে কি এই লগ্নিপুঁজির সাম্রাজ্যে হাত পড়বে? একেবারেই না। বরং তার উল্টোটাই হবে। লগ্নিপুঁজির হাতকে আরও শক্ত করা হবে। একথায় আবার পরে আসছি। তার আগে দেখে নিই, নোট বাতিল করে দেওয়ার আপাতত ফল কী হল।

    যে ফলটা আমরা হাতেনাতে দেখতে পাচ্ছি তা হল, ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটে আমাদের কাছে যা টাকা ছিল, তার আর কোনও দামই রইল না, যতক্ষণ না আমরা সেগুলো ব্যাঙ্কে গিয়ে জমা দিচ্ছি। বলা হল, জমা দিলে তার সমান দামের নতুন (বা পুরনো, কিন্তু অন্য মূল্যের) নোট আমাদের দেওয়া হবে। প্রথমে এক দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকল, যার ফলে আমরা জমা দেওয়ার সুযোগও পেলাম না। তার পরের দিন ব্যাঙ্ক খুললো তো এ টি এম বন্ধ রইল, ফলে অনেকে কোনও টাকাই তুলতে পারলো না। তার পর থেকে শুরু হল লম্বা লাইন দিয়ে টাকা জমা দেওয়া, আর তার থেকেও লম্বা লাইন দিয়ে টাকা তোলা। তাও আবার যত টাকা চাই বা যতটা দরকার ততটা নয়, সরকার যতটুকু সীমা বেঁধে দিল ততটুকুই।

    সীমা বেঁধে দেওয়া মানে কী? আমার টাকা আমার অবাধ মালিকানা থাকল না। যদি কালো টাকা না হয় তাহলেও। আমি কষ্ট করে সেটা উপার্জন করেছি আর সরকারকে ট্যাক্স দিয়েছি, তা সত্ত্বেও। এখানে সাদা-কালোর কোনও তফাতই রইল না। বাংলা কথায়, অনেক লোকের অনেক টাকা আটকে গেল। আটকে কোথায় রইল? রাষ্ট্রের ঘরে। আর বলার যো রইল না, “রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে।” আমার ঘরে যে ধন ছিল, তা এখন রাষ্ট্রের ভাঁড়ারে। তা থেকে একটু একটু করে আমাকে দেওয়া হবে, আগে যেমন লাইন দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে রেশনের চাল বা কেরোসিন দেওয়া হত।

    কিন্তু তখন তো বলা হত, দেশে চাল বা কেরোসিনের অভাব রয়েছে বলেই এমন ভাবে রেশনিং করে দেওয়া হচ্ছে। এখন তবে রাষ্ট্রের ভাঁড়ারে টাকা কি কম পড়িয়াছে? প্রশ্নটা শুনেই অনেকে হাঁউমাউ করে উঠবেন, “সে কি মশাই, দেশ এত এগিয়ে চলেছে, সাত শতাংশ হারে বৃদ্ধি ঘটছে, এখন এসব কথা কেউ বলে নাকি?” কিন্তু না বলে উপায় নেই। দেশ এগিয়ে চলেছে, কিন্তু কোন দিকে?

    এখন বিশ্বায়নের যুগ। বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছে লগ্নিপুঁজি (আগে যার কথা বললাম)। ‘উন্নয়ন’ আর বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করবার নেশায় সেই ফাঁদে সেধে ধরা দিয়েছে ভারত। কিন্তু এ পথ পিছল বড়। একটু এদিক ওদিক হলেই ধপাস। যেমন পড়েছিল আমেরিকা আর ইউরোপের বহু দেশ মাত্র কয়েকবছর আগেই, ২০০৮ সালে। তাদের অমন যে পেটমোটা ব্যাঙ্কগুলো, তাদেরও তখন নাভিশ্বাস উঠছে। তার একটা বড় কারণ, বাজারে প্রচুর লোন দিয়ে তারা তা আর আদায় করতে পারছে না। তখন ওদের দেশের সরকারকে নিজের রাজকোষ থেকে কোটি কোটি টাকা ঢেলে তাদের কোনও রকমে উদ্ধার করতে হয়েছিল। সেবারের সঙ্কট ভারতের কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু সারা পৃথিবীতে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, আবারও সঙ্কট আসতে পারে। এবার যদি আসে, ভারত অত সহজে ছাড় পাবে না, কারণ সে এর মধ্যে আরও বেশি বেশি করে বিশ্বপুঁজির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, জড়াতে চাইছে। এখানেও যদি তার জেরে ব্যাঙ্ক ফেল পড়তে থাকে, কী করবে আমাদের সরকার? তার হাতে অত টাকাই নেই যে ব্যাঙ্ক আর অন্যান্য ব্যবসাকে টেনে তুলবে।

    বলবেন, এসব ‘যদি’র কথা, সত্যিকারের সম্ভাবনা কতটা আছে? আমরা আগেই দেখেছি, এখানকার বড়লোকেরা ব্যাঙ্কগুলোকে চুষে ছিবড়ে করে দিয়েছে। তার ওপর এখন লগ্নিপুঁজির জালে জড়ানো পৃথিবীর অর্থনীতিগুলো সব এক অন্যের সঙ্গে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা।  বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের বাজারে যত টাকা ঢেলেছিল, গত বছর থেকে তারা তার বেশ খানিকটা বেচে দিয়ে চলে গেছে। এবছর ১ নভেম্বর থেকে ভারত ছেড়ে পুঁজির পালানোর হার অনেকটাই বেড়ে গেছে। এর পেছনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন থেকে শুরু করে নানান কারণ রয়েছে।

    যে সাড়ে তের লক্ষ কোটি টাকার নগদ ৫০০ আর ১০০০-এর নোটে দেশের বাজারে ঘুরছিল, তার একটা বড় অংশ এবার ব্যাঙ্কের হাতে আসছে। লোকে যত টাকা জমা দেবে, তত তুলতে পারবে না, ব্যবস্থাটা এমনই করা হয়েছে। তাতে আপনার-আমার অসুবিধা হলে কী হবে, ব্যাঙ্কের হাতে পুঁজি তো বাড়ছে। আর যে টাকাটা জমা পড়বে না, সেটা যেহেতু বাতিল টাকা, তাই ব্যাঙ্ককেও আর তার দায় নিতে হবে না। দায় কমে গেলে ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্যও ভাল হল। ভারত রাষ্ট্রের ঝুঁকি কমে গেল। এখন ড্যাং ড্যাং করে বিশ্ববাজারের কাছে নিজেকে হাট করে খুলে দেওয়া যাবে।  তাতে দেশি-বিদেশি সকল পুঁজিপতিই সুখী হবে, আর তাদের প্রসাদে রাজনৈতিক-প্রশাসনিক বিভিন্ন দালালদেরও পেট ভরবে। 

    প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী স্পষ্টই বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য ভারতকে একেবারে ‘ক্যাশলেস’ বা নগদবর্জিত অর্থনীতিতে পরিণত করা। কোনও কোনও হাসপাতালে গেলে যেমন আপনার স্বাস্থ্যবিমা করা থাকলে ক্যাশলেস চিকিৎসা পান, এটা তেমন নয়। এর মানে হল নগদের কারবারকেই খতম করে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড – যাকে বলে ‘প্লাস্টিক মানি’ – আর কম্পিউটার ও ফোনের সাহায্যে টাকাপয়সার লেনদেন করা। বেশ কিছুদিন ধরেই তো পেটিএম আর এরকম নানান কোম্পানি তাদের মাধ্যমে এটা করার জন্য আমাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছিল। নোট বাতিলের পর যতদিন আমাদের টাকা “আটকে” থাকল অথবা আমরা কতগুলো ২০০০ টাকার নোট হাতে নিয়ে “কে নেবে, কে নেবে” করে ঘুরে বেড়ালাম, তার মধ্যে অনেকেই কিন্তু তাদের ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছি। ক্যাশলেস কারবার যত ছড়ায়, লগ্নীপুঁজির ততই লাভ। প্রত্যেকবার আপনি কার্ড ব্যবহার করা বা নগদহীন লেনদেন করায় যারা ‘ইন্টারচার্জ’ নামে একটা কমিশন খাচ্ছে মাস্টার, ভিসা, পেটিএম-এর মত কয়েকটা কোম্পানি, যাদের মধ্যে বিশ্বজোড়া লগ্নিপুঁজির টাকা খাটছে।

    আর সেইসব ছোট চাষি, মৎসজীবী, হকার, ছোট দোকানদার আর নানান কিসিমের খুচরো ব্যবসায়ীদের কী হবে, যারা এই লগ্নীপুঁজির জালে নিজেদের জড়াতে পেরে উঠবে না, তাদের কী হবে? নোট নাটকের প্রথম অঙ্কেই অর্থমন্ত্রী কিন্তু স্পষ্টই বলেছিলেন, “এ তো সবে শুরু। আমাদের অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে। তাদের কাছে আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। [মার্কিন] পেনশন ফান্ডগুলিকে এখানে বিনিয়োগ করতে দিতে হবে। খুচরো ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টাও দেখতে হবে।” সেদিন আর বেশি দূরে নয়, ওই ছোট চাষি আর মাছ-শিকারীরা হয় শপিং মলের ‘ফ্রেশ কর্নার’-এ নাম লিখিয়ে সাপ্লাই দেবে, নয় ফলিডল খাবে।

    আপনার-আমার মত ক্রেতাদেরই বা কী হবে, যারা এদের কাছ থেকেই কেনাকাটা করতে অভ্যস্ত? আমাদের টাকা যতদিন আটকে রাখা হয়েছে, তার মধ্যেই অভ্যাসটা পাল্টাতে শুরু করেছে অনেকের। সাক্ষী আছে পেটিএম, অ্যামাজন, ওলা, বিগ বাজার, মোবিকুইক...। ৯ নভেম্বরই তো অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সরকারের এই পদক্ষেপ অর্থনীতিকে ক্যাশলেস হওয়ার দিকে শুধু একটু খোঁচাই মারেনি, বেশ জোর একটা ধাক্কা দিয়েছে।” জবরদস্তি হঠাৎ আপনার টাকা আটকে না দিলে এই রকম ধাক্কা দেওয়া যেত? লগ্নীপুঁজিকে এক বারে এত সুবিধে করে দেওয়া যেত?

    টাকা বাতিলের ঘোষণা করেই প্রধানমন্ত্রী জাপানে গিয়ে জানিয়ে দিলেন, “ভারত হবে পৃথিবীর সবচেয়ে খোলা অর্থনীতি”। সেদিন আমরা আমরা ফুটো থলে হাতে টাকার রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে এত দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম যে এসব কথাকে এর সঙ্গে জুড়ে জুড়ে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারিনি হয়ত। এটা “তুঘলকি ঘোষণা”, এর “উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু পদ্ধতিটা ভুল”, এসব বিড়বিড় করেছি। কিন্তু আজ বুঝে নিতে হবে, ভারতের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদীরা যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, এটা তারই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। পুঁজির মালিকদের কাছে অবস্থাটা জরুরী, তাই এই ব্যবস্থা। আর জরুরী অবস্থা রাতারাতিই জারী করতে হয়, সে ঘোষিতই হোক বা অঘোষিতই হোক। পুঁজির স্বার্থেই আম জনতার অধিকার হরণ। অধিকার রাখতে হলে পুঁজিকে রুখতে হবে। আর কোনও পথ খোলা নেই।

    (অধিকার পত্রিকার সেপ্টেম্বর নভেম্বর ইস্যু থেকে অনুমতিক্রমে গৃহীত )


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ | ৯০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • hotovaga | ***:*** | ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০১:৩৩81788
  • সবই তো বুঝলাম - সল্যুশনটা কি ?
  • Bhaskar Talukder | ***:*** | ০৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০৯:৫৯81789
  • আর কোতো দিন ভুগ্তে হোবে কে জানে
  • PT | ***:*** | ০৫ জানুয়ারি ২০১৭ ১০:২০81790
  • "কিন্তু আজ বুঝে নিতে হবে, ভারতের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদীরা যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, এটা তারই যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ।"
    এইসব "পুঁজিবাদীরা" কি শুধুই দিল্লীতে থাকে? তারা বা তাদের অক্সিজেন জোগানোর লোকজন পশ্চিমবঙ্গে নেই? ঘরের "পুঁজিবাদী"-দের নিয়ে নিবন্ধ কোথাও লেখা হয়ে থাকলে দু-একটা লিং পাওয়া যাবে?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন