সম্প্রতি ৩১শে অগস্ট, ২০১৬ তারিখের সিঙ্গুর মামলার রায় সামনে এসেছে, আপামর বাঙালী নড়ে-চড়ে বসেছে, মনে পড়ে গেছে পুরনো দিনের কথা, স্মৃতি-রোমন্থন ইত্যাদি। এই রায়কে পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে, শুধু রাজনৈতিক কারণে না, সামাজিক দায়ভার থেকেও। এ বিষয়ে মূল রায় নিয়ে আলোচনার আগে, তাই দু-চার কথা বলে নেওয়া দরকার।
২০০৬ সাল, সবে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ২৩১-৩০ হিসেবে। মৌ সই হলো, টাটার সাথে। কারখানা হবে, কর্ম-সংস্থান হবে, উন্নয়ন হবে, ক্রমান্বয়ে হবে বেকার সমস্যার সমাধান, আসবে আরো অনেক শিল্প। মোটামুটি এটাই ছিল বামফ্রন্ট সরকারের দাবি। বলাই বাহুল্য, সাম্প্রতিক অতীতে বাংলায় ওই পর্যায়ের বিনিয়োগ সেভাবে দেখা যায়নি। তার দায় কার, সে আলোচনা আজ বৃথা। এখন, মৌ তো কতই সই হয়, ফলপ্রসূ হয় কটা? যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। ছোট গাড়ির কারখানা হবে, তাই ১০০০ একর জমি চাই। সেই জমির একটা ছোট অংশে কারখানা হবে, বাকিটায় রাস্তা, শপিং মল, স্কুল, টাউনশিপ, পার্ক ইত্যাদি অনেক কিছু, সব মিলিয়ে হৈহৈ কান্ড। টাটাদের পছন্দ মতন জমিও পাওয়া গেল। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের একদম পাশেই সিঙ্গুরের কিছু চাষ-জমিই পছন্দ হল, বাকি রইলো অধিগ্রহণের প্রসেস। এইখানে এসে সব হয়ে গিয়েও, সমস্তটাই আটকে গেল। কেন? কারণ, ওই জমির মালিক যারা সেই চাষিদের কিছু অংশ বেঁকে বসল। জমির প্রশ্ন যেহেতু সরাসরি রুটি-রুজির প্রশ্ন, সেহেতু প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্রজেক্ট প্রথমে পিছোল এবং শেষ পর্যন্ত কারখানা হল না! তাতে কার লাভ, কার ক্ষতি, কী হলে কী হত, এসব প্রশ্ন-আলোচনা-তর্ক অনেক বার হয়েছে, নানান মাধ্যমে হয়েছে, সেই নিয়ে কথা বাড়াব না। ভূমিকার পরে, এবার বরং কাজের কথায় আসি, সিঙ্গুর মামলার রায়।
৩১ শে অগাস্ট, ২০১৬। ঘটনার দশ বছর পরে, সুপ্রিম কোর্টের মহামান্য বিচারপতি, ভি.গোপালা গৌড়া ও অরুণ মিশ্রের বেঞ্চ চূড়ান্ত রায় দিল, এবং টাটাদের নির্দেশ দিল, অধিগৃহীত জমি ফেরত দেওয়ার। বিস্তারিত রায়ে পরে যাচ্ছি, তার আগে জানা দরকার এই মামলা কারা করেছিল, কাদের বিরুদ্ধে করেছিল এবং কেন করেছিল।
অধিগ্রহণে সন্তুষ্ট না হওয়া কিছু চাষি, ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট, ১৮৯৪ (পরবর্তীতে “জমি অধিগ্রহণ আইন” বলে উল্লেখ করব) এর ৫-এ ধারায় আপত্তি জানিয়েছিল ল্যান্ড-কালেক্টরের কাছে, ল্যান্ড কালেক্টর রিপোর্ট দেন যে, রাজ্যের এবং সমাজের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে সেই আপত্তিগুলোকে উপেক্ষা করাই ভালো। সেই মতো, ২০০৬এরই সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর এর মধ্যে অধিগ্রহণের কাজ সম্পূর্ণ হয়। সেই চাষীরাই, যাঁদের আপত্তি উপেক্ষা করা হয়েছিল, তাঁরা ফাইল করেছিলেন এই রিট পিটিশন কলকাতা হাইকোর্টে, যা আদতে ছিল “পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন” অর্থাৎ, জনস্বার্থে দাখিল হওয়া মামলা। প্রসঙ্গত বলে রাখা উচিত, গোদা ভাষায়, সরকারের কোনো কাজে কোনো নাগরিক অসন্তুষ্ট হলে, কনস্টিটিউশনের আর্টিকেল ২২৬এর মাধ্যমে হাইকোর্টের সামনে সেই অসন্তোষের অভিযোগ জানানো যায়, একেই বলা হয় রিট পিটিশন। এই মামলার শুরু তাই বলা যায় ওই ল্যান্ড কালেক্টর এর কাছে অবজেকশন জানানো থেকেই। এই মামলা করেছিল চাষিরা এবং তা করা হয়েছিল প্রধানত রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, অধিগ্রহণের বিষয়ে, আপত্তি বা অসন্তোষ জানাতে।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, অধিগ্রহণ হচ্ছিল, ওই জমি অধিগ্রহণ আইনেই, যা এই আলোচনায় বার বার উঠে আসবে। পাবলিক ডিবেট, লেখালেখি বা, নানান আলোচনার ফলাফল যাই হোক না কেন, এখানে ধরে নেব যে, আইনটি ত্রুটি-বিহীন, কেননা, এই রায়ে ওই বিষয় বিচার্য ছিলনা।
যে কোনো মামলার রায় নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় খুব জরুরি, যেমন ধরা যাক, মামলা যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে হচ্ছে তার ডিটেল দরকার, বা, মামলায় কারা যুক্ত, তা জানার প্রয়োজন হয়। এই দুটি প্রশ্নের মূলগত উত্তর ওপরে রয়েছে। ঘটনার এর থেকে বেশি ডিটেল এখনই প্রয়োজনীয় নয়, সে বিষয়ে পরে আবার লিখব। কিন্তু, কিছু তথ্যগত ডিটেল প্রয়োজন। ইচ্ছুক চাষিরা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন ২০০৬ সাল এর সেপ্টেম্বর মাসে। জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় লিজ ডিড এক্সিকিউট হয়েছিল ২০০৭ সালের মার্চে। এপ্রিল-মে, ২০০৭ নাগাদই হাইকোর্টে রিট পিটিশনগুলো ফাইল হয়। এবং, এই সব কটি মামলার শুনানিই একসাথে হয় ও আঠারোই জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে, ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় যে, জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল জনগণের স্বার্থে, এবং বলাই বাহুল্য, ওই সবকটি রিট পিটিশনই ডিসমিস অর্থাৎ খারিজ হয়ে যায়। এই আঠারোই জানুয়ারী, ২০০৮এর অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সিঙ্গুর মামলা পৌঁছয় সুপ্রিম কোর্টের সামনে।
সুপ্রিম কোর্ট তার রায়দানের শুরুর দিকেই জমি অধিগ্রহণ ঘিরে অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেছে। ধরে নেওয়া যায়, ইচ্ছুক আর অনিচ্ছুক চাষিদের দাবি-দাওয়া, অনিচ্ছুকদের ওপর পুলিশের অত্যাচার, অনশন, অবরোধ এবং, সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রায় সমস্ত দিকই সুপ্রিম কোর্টের সামনে ছিল। সুপ্রিম কোর্ট প্রায় মেনেই নিয়েছে যে, এই অসন্তোষের কারণেই নভেম্বর ২০০৮এ, টাটা কোম্পানি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেয় যে, শান্তিপূর্ণ ভাবে কাজ করবার পরিস্থিতি না থাকবার কারণে, তারা সিঙ্গুরে কাজ বন্ধ করছে। এবং, তারপর সেই এই কারখানা তৈরি হয় গুজরাটের সানন্দে। এরপর প্রায় আড়াই বছরের অখণ্ড শান্তির পর, ২০১১ সাল এর জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গে নতুন সরকার গঠন হয়, ও সেই সরকার একটি নতুন আইন তৈরি করে, যার নাম সিঙ্গুর ল্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাক্ট, ২০১১ (পরবর্তীতে “সিঙ্গুর আইন” বলে উল্লেখ করব)। এই সিঙ্গুর আইন তৈরি হয়েছিল, টাটা কোম্পানিকে দেওয়া জমি, সরকারের হাতে ফেরত আনবার জন্য। বলা বাহুল্য, টাটা সেই আইন চ্যালেঞ্জ করে দ্বারস্থ হয় হাইকোর্টের। টাটার করা মামলাতে প্রথমে সিঙ্গল বেঞ্চে টাটা কোম্পানি হেরে যায় ও সিঙ্গুর আইন সিদ্ধতা পায়। পরে, আপীলে গেলে, ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় যে, সিঙ্গুর আইনের নানান অংশ ল্যান্ড আইনের বিরোধী ও সিঙ্গুর আইন তৈরির পর ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মতি নেওয়া হয়নি; এবং সেই কারণে সিঙ্গুর আইন অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়।
সিঙ্গুর আইন এখানে আলোচ্য নয়, কারণ, প্রথমে টাটাদের মামলা ও চাষিদের মামলা সুপ্রিম কোর্টে একসাথে শুনানি হলেও, গত মে মাসেই সুপ্রিম কোর্ট এই দুই মামলার পৃথক শুনানির অর্ডার দিয়ে দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট তার জাজমেন্টে স্পষ্ট ভাবেই বলেছে, বর্তমান রায় শুধু জমি অধিগ্রহণ ও কমপেনসেশন এই দুটি বিষয়ে নিয়েই। অতএব,এখানে আলোচ্য জাজমেন্টটি চাষিদের করা মামলার রায়, টাটাদের করা মামলার শুনানি এখনো শেষ হয় নি।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে, সরকারের কাছে কারখানা করবার জন্য প্রয়োজনীয় জমির আবেদন করে টাটা কোম্পানি। সরকার তারপর টাটা কোম্পানির জন্য জমি খোঁজা শুরু করে, টাটা কোম্পানির কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। কোন জমি নেওয়া হবে তার সিদ্ধান্ত একসাথে নেয় টাটা কোম্পানি ও সরকার। এবং তারপর, টাটার হয়ে, ল্যান্ড আইনের মাধ্যমে সেই জমি অধিগ্রহণের নোটিশ দেয় সরকার।
এবার প্রয়োজন জেনে নেওয়ার, মামলায় যুক্ত থাকা প্রত্যেক পক্ষের বক্তব্য, যা কোর্টের সামনে রাখা এসেছিল আর্গুমেন্টের সময়। এই মামলায় বিবদমান পক্ষ মূলত ৪টি। বিক্ষুব্ধ চাষি, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কমিটি (আরো কিছু বিক্ষুব্ধ চাষিদের তরফে), পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও টাটা কোম্পানি। এদের মধ্যে প্রথম দুজনের বক্তব্য একসাথে গ্রহণ করেছে কোর্ট। এখানে বলে রাখা ভাল, সাধারণের বোঝার সুবিধার জন্য, জমি অধিগ্রহণ আইনের বিভিন্ন ধারার ডিটেল, মামলায় ব্যবহৃত হওয়া নানা পুরোনো রুলিং, বিভিন্ন টেকনিকাল অ্যাসপেক্টসকে এই আলোচনায় আনছি না।
চাষিদের তরফে মূল বক্তব্য ছিল, জমি অধিগ্রহণ আইনের নানান টেকনিকাল ধারার উল্লঙ্ঘন করা হয়েছিল অ্যাকুইজিশন বা অধিগ্রহণের সময়। সরকার নিজের আইন নিজেই ভেঙেছে। জনস্বার্থেই যদি অধিগ্রহণ হয় তাহলে আগে টাটা কোম্পানি জমি দেখল কেন। টাটা কোম্পানি যদি জমি নেয়, তাহলে কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণ সরকার দেবে কেন। আর, যদি সত্যিই ক্ষতিপূরণ বাবদ পুরো টাকা সরকারই দেয়, তাহলে জমি টাটা কোম্পানি আগে দেখলো কেন, আর প্রজেক্ট তারা করবেই বা কেন। এই প্রজেক্টকে জনস্বার্থ বলতে গেলে, প্রজেক্ট থেকে সম্পূর্ণ লাভ পাওয়ার কথা শুধুই জনতার, কোনোভাবেই টাটা কোম্পানির নয়। শুধু জমি অধিগ্রহণ আইন নয়, তার সাথে সম্মিলিত নিয়মকানুনেরও চরম উল্লঙ্ঘন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে মূল বক্তব্য ছিল মজার। তাদের আইনজীবীরা প্রথমেই বলে দেন, জমি অধিগ্রহণের পুরো পদ্ধতিটাই ছিল বেআইনি। এ এক অলৌকিক পরিস্থিতি। বেআইনি অধিগ্রহণের অভিযোগ তুলে, যার বিরুদ্ধে মূল মামলা দাখিল করেছিল চাষিরা, সেই সরকার বাহাদুরই বলছে যে চাষিরাই ঠিক! এমতাবস্থায় মামলা চলবার প্রয়োজন থাকেনা। কিন্তু বাদ সেধেছিল টাটা কোম্পানি। সে কথায় পরে আসছি। সুপ্রিম কোর্টে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বক্তব্য ছিল, টাটা কোম্পানির লোকেরা, অধিগ্রহণের আগেই জমি দেখে পছন্দ করেছিল। এর সমর্থনে প্রামাণ্য নথি তৎকালীন সরকারি দলিলেই আছে, যা সুপ্রিম কোর্টের সামনেই ছিল। সেই নথি থেকে এও জানা যায় যে, প্রথমে ৬০০ একরের প্রয়োজন জানানো হলেও, পরে আচমকাই তা ১০০০ একরে বদলে যায়, ও সরকার, কোন অজানা কারণে, বিনা প্রশ্নে তাতে সম্মতিও দেয়। এছাড়া সরকারও জমি অধিগ্রহণ আইনের নানান ধারার ক্রমান্বয়ে ভায়োলেশনের কথা স্বীকার করে নেয়। এও মেনে নেয় যে, বিক্ষুব্ধ চাষিদের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে যে প্রাথমিক অবজেকশন বা বিরোধিতা ছিল, তা কোন কারণ না দেখিয়েই অস্বীকার করে সরকারের ল্যান্ড-কালেক্টর, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
এরপর থেকে যায় টাটা কোম্পানির বক্তব্য। পাঠক চমকে উঠবেন না, সুপ্রিম কোর্টে এই মামলায় পূর্বতন সরকার বা সরকারি দল যুক্ত ছিল না, আগামী বক্তব্য সত্যি টাটা কোম্পানির! টাটা কোম্পানির আইনজীবীরা কোর্টে বলেছেন, সরকারের জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে, এবং, অধিগ্রহণের সময় যদি সরকার কোনো কোম্পানির প্রজেক্টের কথা মাথায় রেখে চলে, শুধু তাহলেই অধিগ্রহণ বেআইনি হয়ে যায় না। পশ্চিমবঙ্গে গাড়ির কারখানা গড়লে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, অর্থনৈতিক উন্নতি হত, আর আরো অনেক ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প গড়ে উঠতো। ভারতবর্ষে এর আগে নানান জায়গায় এভাবেই কাজ হয়ে এসেছে, তাই টাটা কোম্পানির লোকেরা আগে জমি দেখে থাকলেও, অধিগ্রহণ জন-কল্যাণেই হয়েছিল, কেননা, ক্ষতিপূরণ বাবদ পুরো ১৩৮ কোটি টাকাই দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার, টাটা কোম্পানি এক টাকাও দেয়নি। যেহেতু ক্ষতিপূরণ পুরোটাই দিয়েছিল সরকার, আর যেহেতু তা একমাত্র সূচক হওয়া উচিত একটা প্রজেক্টকে জনকল্যাণকর ঘোষণা করবার, সেহেতু, এই প্রজেক্টও হয়েছিল জনস্বার্থেই। এবং, টাটা কোম্পানি কোনোভাবেই সরকারকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করেনি, সরকার স্বেচ্ছায় অধিগ্রহণ করেছিল।
এখান থেকেই স্পষ্ট যে জমি আইন ও তার সম্মিলিত নিয়মসমূহের নানান ধারার সম্পূর্ণ ও চরম উল্লঙ্ঘনের যে অভিযোগ, শুরু থেকে চাষিরা,এবং ২০১১র পর থেকে নতুন সরকার নিজেই করে এসেছে, তার কোনো আইনি উত্তর টাটা কোম্পানির আইনজীবীরা দেওয়ার চেষ্টা করেননি। এখান থেকে ধরে নেওয়া যায়, আইনি উত্তর নেই। আইন সত্যিই মানা হয়নি। অধিগ্রহণের যে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া, তার প্রথম থেকে শেষ অবধি, এবং তারপর চাষিদের আপত্তি না শুনে, কোনো কারণ না দেখিয়ে, উপেক্ষা করা পর্যন্ত, পুরোটাই ভুলে ভরা। টাটাদের বক্তব্য ছিল সোজা। এরকমটাই হয়, অন্তত এতদিন হয়ে এসেছে। উন্নয়নের জন্য জমি অধিগ্রহণের এটাই রাস্তা, তাতে আইনি জটিলতা না থাকা ভালো। সরকারি টাকায় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হচ্ছে, অতএব, জনতার টাকাই ব্যবহৃত হচ্ছে, অতএব, জনতার স্বার্থ। কিন্তু, তাতে তো বেআইনি কাজ আইনি হয়ে যায়না, অতএব, বেরোনোর রাস্তা ছিল আর একটিই। ‘চেঞ্জ অফ স্ট্যান্ড অফ দি ওয়েস্ট বেঙ্গল গভর্নমেন্ট’।
হ্যাঁ, আইনি জটিলতার উত্তর নেই বুঝেই, টাটা কোম্পানির আইনজীবীদের প্রথম আর্গুমেন্টই ছিল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার স্ট্যান্ড পাল্টাতে পারবে না। অর্থাৎ, মামলার শুরুতে, ২০০৭ সালে, কলকাতা হাইকোর্টে, সরকারের বক্তব্য ছিল যে অধিগ্রহণ ঠিকভাবেই হয়েছে, তাই এখন সুপ্রিম কোর্টে সরকার সেই বক্তব্য পাল্টাতে পারেনা। রাজনৈতিক দল বদলের সাথে সাথে সরকার এর মত বদল হতে থাকলে যেহেতু সব ধরণের সরকারি কাজেই বাধা সৃষ্টি হয়, সেহেতু এইভাবে, রাজনৈতিক কারণে মত বদল করে, একই মামলার নানান ধাপে, ভিন্ন মত বা স্ট্যান্ড নেওয়া অযৌক্তিক ও অনৈতিক। এই যুক্তিতেই, এরপর টাটা কোম্পানির আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আর্জি জানান যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই মত বদল ও এই একই মামলায় ভিন্ন ধাপে ভিন্ন বক্তব্য রাখবার কারণে তাদের বক্তব্য যেন বিবেচ্য না হয়। এর উত্তরে, সরকারের তরফের আইনজীবীরা জানান যে, যদি পূর্বতন সরকার কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, বা কোনো ভাবে কোনো আইনি ভুল করে ফেলে, বা যদি পূর্বতন সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তাহলে নতুন সরকার স্বাভাবিক নিয়মেই সেই ভুল সংশোধনের চেষ্টা করবে এবং জনগণের স্বার্থ রাখার চেষ্টা করবে।বর্তমান সরকার যে প্রাক্তনের করে যাওয়া ভুল সংশোধনের চেষ্টা করছে তার প্রমাণ, সিঙ্গুর আইন, যার মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই, বেআইনি ভাবে অধিগৃহীত জমি ফেরতের বন্দোবস্ত ছিল, যা আপাতত, সুপ্রিম কোর্টেই বিচারাধীন।
এই প্রথম আর্গুমেন্টের উত্তর, জাজমেন্টের শুরুর দিকেই, প্যারাগ্রাফ ৪৭, ৪৮ র ৪৯এ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কোর্টের রায় অনুসারে, যদি পূর্বতন সরকার এর জমি অধিগ্রহণ করবার প্রসেসে কোনো ভুল হয় বা কোনো আইনের উল্লঙ্ঘন হয়, তাহলে নতুন সরকার প্রাক্তনের ভুলের সংশোধন করতে পারে, এবং পুরনো বিচারাধীন মামলায়, স্ট্যান্ড বা মতও পাল্টাতেই পারে।
শুনানি পর্বের শেষে, অর্থাৎ, মৌখিক বক্তব্যের পর রায়দানের সুবিধার জন্যে, ৯টি পয়েন্ট বা মূল ইস্যু ঠিক করে সুপ্রিম কোর্ট। তার মধ্যে কয়েকটি এক জাতীয়ই, যাতে ল্যান্ড অ্যাক্ট ঠিক ভাবে মানা হয়েছিল কিনা সেই প্রশ্নই বিবেচ্য হয়েছে। মূল ইস্যুগুলি ছিলঃ
এর মধ্যে প্রথম দুটো ইস্যু একই সাথে বিচার্য। অর্থাৎ, যদি জনস্বার্থই অধিগ্রহণের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে কোম্পানি জমি পাবে না, আবার যদি কোম্পানির জন্যে অধিগ্রহণ হয়ে থাকে, তাহলে জনস্বার্থে হয়নি বুঝতে হবে। এই বিষয়ে রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উক্ত বেঞ্চের প্রথম জাস্টিস ভি.গোপাল গৌড়া বলেছেন, সরকারি নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, অধিগ্রহণ হয়েছিল টাটা কোম্পানির জন্যই। অধিগ্রহণের সময় যদি তা সরকারি কাজে হত, তাহলে যেসব আইনি পদক্ষেপ করা উচিত ছিল সেগুলো একটাও করা হয়নি, এবং শুরু থেকেই টাটা কোম্পানির জন্য অধিগ্রহণ করবার চেষ্টাই প্রমাণিত, অতএব, এই অধিগ্রহণকে কোনো ভাবেই জনস্বার্থের আওতায় আনা যায় না। এমনকি, অধিগ্রহণের জন্যে প্রয়োজনীয় পাবলিক মানি বা সরকারি অর্থের যে ব্যবস্থা প্রথমেই করতে হত, তাও করা হয়নি। জাস্টিস গৌড়া বলেছেন যে যদি এমন ধরণের বেআইনি অধিগ্রহণকে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে জনস্বার্থের নামে, বা সামাজিক উন্নয়নের নামে সমাজের সব থেকে পিছিয়ে থাকা অংশের জমি জোর করে ছিনিয়ে নেওয়াকে জাস্টিফাই করা হবে। অধিগ্রহণ কে করবে, অর্থাৎ কোন লোকাল অথরিটির মাধ্যমে অধিগ্রহণ হবে, সে বিষয়েও প্রশ্ন তুলেছেন জাস্টিস গৌড়া, এবং এও বলেছেন যে, যেহেতু সরকারের অধিগ্রহনের আগে কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণের কোনো স্কিম ছিল না, এবং, অর্থের ব্যবস্থাও আগে থেকে করা হয়নি, সেহেতু এই প্রজেক্টকে জনস্বার্থমূলক বলা যায়না। টাটা কোম্পানির আইনজীবীদের বক্তব্য ছিল যে, যেহেতু সরকার নিজে না অধিগ্রহণ করে, লোকাল অথরিটিকে দিয়ে করিয়েছিল, তাই সেইক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণ আইনের নানান ধারা মানা প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু জাস্টিস গৌড়া বলেছেন, যেহেতু উদ্দেশ্যই ছিল জমি অধিগ্রহণের পর টাটা কোম্পানির কাছেই তা হস্তান্তরিত হবে, গাড়ির কারখানা তৈরি করবার কারণে, তাই অধিগ্রহণ আইন মোতাবেকই হতে হত।
এই প্রসঙ্গে, সিঙ্গুর মামলায় বারবার আলোচিত হওয়া একটি পুরোনো জাজমেন্টের কথা না বললেই নয়, যাতে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সরকার যখন কারোর জমি নিজের প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করে, তখন জনস্বার্থ আর ক্ষতিপূরণই মুখ্য বিচার্য বিষয় হয়। কিন্তু যখন সরকার কারোর জমি কোনো কোম্পানির প্রয়োজনে অধিগ্রহণ করে, তখন ক্ষতিপূরণই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়। এবং, যেহেতু এখানে জনস্বার্থ থাকেনা, তাই, আইনের প্রতিটা ধারাই মেনে চলা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে কোর্ট আরো বলেছে, যদি কোনো আইনে, কোনো কাজ ঠিক কীভাবে করা উচিত, তা বলে দেওয়া থাকে, তাহলে, সেই কাজ শুধু সেভাবেই করা যায়, অন্য কোনো ভাবে না। এর সাথে সাথে এ কথাও এখন পরিষ্কার কোর্টের কাছে, অন্য কোনো কারণে না, বরং, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ ভুল শুধু এই কারণেই যে তা আইন ভেঙে করা হয়েছিল। আইনের নানান ধারা, মূলত যার সব কটিই চাষির বা জমির মালিকের তার নিজের জমির ওপর অধিকার সম্পর্কিত, পূর্বতন সরকার না মেনেই অধিগ্রহণের কাজ চালিয়েছিল। জাস্টিস গৌড়ার ভাষায়, “The acquisition of land for and at the instance of the company was sought to be disguised as acquisition of land for ‘public purpose’ in order to circumvent compliance with the mandatory provisions of the Land Acquisition Act”। বারবার ঘুরে এসে এই জায়গাটাতেই টাটা কোম্পানির সমস্ত আর্গুমেন্টও আটকে যাচ্ছিল। এ কথা জাস্টিস গৌড়ার কাছে পরিষ্কার হয়েছে যে, অধিগ্রহণ হয়েছিল টাটা কোম্পানির প্রয়োজনে, জমি চিহ্নিত ও ফাইনালও করে যায় টাটার লোকেরাই, তাই কোনো যুক্তিতেই এই অধিগ্রহণকে পাবলিক পারপাসে বা সমাজের কল্যাণে করা হয়েছিল বলা যায় না।
পাবলিক পারপাস, না কোম্পানির প্রয়োজন, এই তর্কের মীমাংসার পর, জাস্টিস গৌড়া নজর রাখেন ওই গাড়ি কারখানার বর্তমান অবস্থার ওপর। নথিপত্র ও চিঠি-চাপাটি থেকে স্পষ্ট হয় যে টাটা কোম্পানি ওই জমিতে কোনো ম্যানুফ্যাকচারিং কখনো করেনি, এমনকি পরবর্তীতে, কারখানা তুলে নিয়ে চলে গেছে গুজরাটে, অথচ, একটি নয়া পায়সাও জমি বাবদ খরচ না করেও, জমিতে নিজেদের পসেশন, বা অধিকার ধরে রাখবার চেষ্টা করছে।
আইন মেনে অধিগ্রহণের ইস্যুতেও জাস্টিস গৌড়ার রায় প্রায় সেরকমই। যেহেতু ওই অঞ্চলের ল্যান্ড-কালেক্টর অত্যাধিক তৎপরতার সাথে জমি অধিগ্রহণের চেষ্টায় ছিলেন, সেহেতু, ল্যান্ড এক্টের সেকশন ৫-এ, যেখানে জমির মালিকের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে থাকা বক্তব্যের বিচার হওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। বরং, মেকানিকাল এবং অনেকটাই দায়সারা ভাবে, চাষিদের বক্তব্যকে ইগনোর বা ঘুরিয়ে রিজেক্ট করেছিল সেই ল্যান্ড-কালেক্টর। এছাড়াও, প্রত্যেক জমির মালিক ও চাষিকে নোটিশ দেওয়ার সংস্থান রয়েছে আইনে, যা মানা হয়নি। কমপেনসেশনের প্রশ্নেও গলদ রয়ে গেছিল, ওই তাড়াহুড়োর কারণেই। যেহেতু হিয়ারিং বা শুনানির কোনো সুযোগই বেশিরভাগ লোক পান নি, তাই কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত ব্যাপারে তাদের দাবি-দাওয়াও মানবার প্রশ্নই ওঠে না। এবং, এভাবেই,মূলগত ভাবে সব ইস্যুতেই অন্তত, জাস্টিস গৌড়া চাষি বা জমির মালিকদের পক্ষে রায় দান করেন। উক্ত বেঞ্চের অন্য বিচারপতি, জাস্টিস অরুণ মিশ্র কিন্তু তা করেন নি!
পাঠকের এখানে বিভ্রান্তি হতে পারে এই ভেবে যে একই কোর্টের বিচারাধীন একই মামলায় দুজন বিচারপতি দুরকম রায় কীভাবে দিতে পারেন। এই বিভ্রান্তিটুকু নিয়েই পরবর্তী অংশটুকু পড়তে হবে, আশা রাখছি, শেষ অব্দি পড়লে বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে। এখন শুধু এটুকুই বলা থাক যে, এরকম প্রায়শই হয়। রায় যদি এক হয়, তাহলে, রায় দানের কারণ আলাদা হলেও, রায়ের ওপর কোনো প্রভাব তাতে পড়েনা।
এবার জেনে নেওয়ার পালা, জাস্টিস মিশ্র কী বলেছেন। উনি বলছেন, যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লোকাল অথরিটি, ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (WBIDC)র মাধ্যমেই কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়েছিল, আর যেহেতু প্রজেক্টটির মাধ্যমে চাকরির সুযোগ বাড়ত, অন্য ইন্ডাস্ট্রিও আসতে পারত, সেহেতু প্রজেক্টটি জনতার স্বার্থেই হচ্ছিল, ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ, শেষ অব্দি জমি যার হাতেই যাক না কেন, টাকা কে দিচ্ছে তার ওপরেই নির্ভর করবে, জমি কেন নেওয়া হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর। ইতিহাসের পাতা থেকে নানান মামলার উদাহরণ তুলে ধরে উনি দেখিয়েছেন যে, কোনো ব্যক্তি বিশেষের স্বার্থে না হয়ে যদি কোনো কাজ, জনসাধারণের স্বার্থে হয়, তাহলেও তা জনস্বার্থে হয়েছে বলা যেতে পারে, কারণ সময়ের সাথে সাথে চাহিদা বদলায়, চাহিদার সাথে সাথে আইনেরও বদল প্রয়োজন। ওনার মতে, প্রাথমিক নোটিশে WBIDC'র উল্লেখ না থাকা কোন বড়ো ভুল না, যেহেতু, ক্ষতিপূরণের টাকা সেই লোকাল অথরিটিই দিয়েছে, তাই, যতই সেই নোটিশ এ টাটা কোম্পানির নাম থাকুক, যেহেতু সরকার তার শিল্পায়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল, এবং যেহেতু সেই ইচ্ছাই টাটা কোম্পানিকে এই রাজ্যে টেনে এনেছিল, তাই সেই উদ্দেশ্যই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে অধিগ্রহণের কারণ বিচারের ক্ষেত্রে। এইভাবেই, পুরনো কিছু রুলিংএর ভিত্তিতে, এবং, কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণের টাকা সরকারি অর্গানাইজেশনই দিয়েছে এই যুক্তিতে, উনি অধিগ্রহণ যে পাবলিক পারপাসে হয়নি এ কথা মানতে নারাজ থেকেছেন, এবং, খুব পরিষ্কার ভাবে না হলেও, মূলত এটাই বলতে চেয়েছেন যে, সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া হয়েছিল জনস্বার্থে।
কিন্তু, অধিগ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটাই যে বেআইনি ছিল, এই ব্যাপারে উনি কোনো সন্দেহ রাখেননি। ওনার মতে, যেহেতু আগেই জমি চিহ্নিত হয়েছিল, ও ক্যাবিনেট মিটিঙে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছিল, সেহেতু চাষিদের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে থাকা অসন্তোষ, অভিযোগের বা আপত্তির, তৎকালীন ল্যান্ড-কালেক্টর কোনো বিচার করেননি, আর, মেকানিকালি উপেক্ষা করেছেন, বা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আগে থেকেই নিয়ে ফেলা সিদ্ধান্তের ওপর সিলমোহর ফেলতে একটা আই-ওয়াশ বা ছলনার মাধ্যমে চাষিদের ও জমির মালিকদের অভিযোগের বিবেচনা করা হয়েছিল, যার অন্তিম পরিণতি, সেই অভিযোগগুলির উচিত বিবেচনা না হওয়া। কমপেনসেশন বা ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যেভাবে ঠিক হয়েছে সে নিয়েও উনি প্রশ্ন তুলেছেন। অতএব, ওনার মতে, জমি অধিগ্রহণ জনস্বার্থে হয়ে থাকলেও, অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি।
এরপর, জাস্টিস মিশ্র তাঁর নিজের রায় জানিয়েছেন। তাঁর মতে, যেহেতু টাটা কোম্পানি ওই জমিতে কোনো কারখানা করেনি, বরং, কারখানা নিয়ে গেছে গুজরাটে, সেহেতু তাদের আর জমির প্রয়োজন নেই। বরং, যেই চাষিরা এত বছর জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, জমি ফেরত দেয়া উচিত তাদেরকেই, আর তার সাথে যারা অধিগ্রহণের সময় ক্ষতিপূরণ নেননি, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সরকারকে।
এবং, এইখানেই দুজন বিচারপতির রায় আবার এক জায়গায় মিলিত হচ্ছে! জাস্টিস গৌড়াও বলেছেন যে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া যেহেতু ভুল, তাই জমি ফেরত যাওয়া উচিত চাষিদের হাতে। এবং সেই কাজ ১২ সপ্তাহের মধ্যে শেষ করতে হবে সরকারকে। তার সাথে যেই চাষিরা ও জমি মালিকরা আগে ক্ষতিপূরণ বা কমপেনসেশন নেননি তারা পাবেন ক্ষতিপূরণ।
রায়দান পর্বের পরে, সাধারণত হাতে পড়ে থাকে পেন্সিল। এখানে পেন্সিল এর সাথে সাথে পড়ে রইল স্কেল, ফিতে, ১০০ দিনের প্রকল্প, সরকারি আমলা, কাজ শেষের ডেডলাইন, কয়েক হাজার উদগ্রীব চোখ, নীল ফাইলে লাল সুতো, কিছু শঙ্কা, বাজার-গরম বক্তৃতা, ভুল স্বীকার, ইত্যাদি, প্রভৃতি। কিন্তু, আলোচনা অল্প বাকি থেকে যায়, জানতে হবে, আমরা কী পেলাম।
সেটা আলোচনার আগে, একটা দরকারি কথা। আজকের দিন দ্রুত উন্নয়নের দিন। শিল্পায়নের প্রয়োজনে সরকার জমি অধিগ্রহণ করতেই পারে, কিন্তু শিল্পায়নের সব থেকে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে সমাজের সব থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর ওপর, চাষি-মজুরদের ওপর। এই কারণেই, প্রতিটা সরকারের উচিত এই শ্রেণীর বক্তব্য, অভিযোগ, বিরোধিতাকে শোনা ও বোঝার চেষ্টা করা। এ আমার কথা না, এই রায়েরই ৬৩ নম্বর প্যারাগ্রাফে এই কথা বলেছেন, জাস্টিস গৌড়া।
এখান থেকেই আমাদের আলোচনা শুরু ও শেষ। সিঙ্গুরের এই রায়ের পরে, জমি অধিগ্রহণ আইন আর বদলাবে কিনা জানা নেই। জানি না পশ্চিমবঙ্গ সরকার জমি ফেরত দিতে পারবে কিনা। জানিনা আরো সিঙ্গুর, বস্তার, নন্দীগ্রাম, দান্তেওয়াড়া, কালাহান্ডি, হরিপুর হবে কিনা। পাহাড় কেটে যদি চাষ করা সম্ভব হয়, তাহলে ফ্যাক্টরি ভেঙেও সম্ভব। টাটা কোম্পানি এরপর হয়তো ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে, সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশনও দাখিল করতে পারে, হয়তো করবেও, কিন্তু, এসবের পরেও যদি সত্যিই চাষযোগ্য জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়, যদি এরপর থেকে কখনো চাষির জমি তার মতের বিরুদ্ধে শিল্পায়নের জন্যে অধিগৃহীত না হয়, যদি সত্যিই কোনো সরকার প্রতিটা ইঞ্চি জমির জন্য সমাজের সব থেকে পিছিয়ে থাকা এই শ্রেণীর প্রতিটা চাষি-মজুর-জমি মালিকের সাথে আলোচনা করে, তাহলে তার থেকে সুন্দর আর কিছু হবে না। আর, তা নাহলে, চাষিরাই ঠিক করবেন তারা দশ বছরব্যাপী মামলা লড়বেন, নাকি জমির লড়াই প্রতিবারের মত জমিতেই বুঝে নেবেন।
প্রাপ্তি বলতে এই মামলার পর, চাষীদের আশা, সরকারের দায়িত্ব আর বৃহৎ পুঁজির চিন্তা, এই পড়ে থেকে যায়। লড়াইয়ের শেষ বা শুরু, এর কোনোটাই নয়।