ভারতের বিচারব্যবস্থা রমরমিয়েই চলছে। ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট অব্দি সর্বত্র রয়েছে সাধারণের এবং অসাধারণের শর্তসাপেক্ষ এবং নিঃশর্ত যাতায়াত। অধিকার বুঝে নেওয়ার প্রখর দাবিতে, সারারাত জেগে থেকে মামলা শুনছে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। সেই মামলার শুনানি আদালতে শেষ হওয়ার আগেই, রায় শুনিয়ে দিচ্ছেন মহামান্য অর্ণব গোস্বামীরা। রিপাবলিক টিভি, টাইমস নাউ বা জী নিউসেই বিচার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক বা ভুলের। এমনি এক বিচার সভায়, মহামান্য অর্ণব গোস্বামী একদিন ঘোষণা করে দেন, "ডু নট আস্ক এবাউট জাজ লোয়া”। না, এই আলোচনা শুধু জাজ লোয়া, বা ভারতবর্ষের সংবাদ মাধ্যমে চলা সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা নিয়ে নয়, এই আলোচনা, ভারতের বিচার ব্যবস্থার বর্তমান সংকট নিয়ে। তবে, এগুলো ঘুরে ফিরে আসবেই, যেমন ফিরে ফিরে আসে ইতিহাস। সংকট কেন, তা জানতে একটু ইতিহাস জানতে হবে।
সালটা ছিল ১৯৭৩। দেশ জুড়ে তখন ছড়িয়ে পড়েছে বিক্ষোভ। একদিকে নকশাল আন্দোলনের আগুন, অন্যদিকে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে অসহযোগ ধাঁচের আন্দোলন। চাপ বাড়ছে কংগ্রেস সরকার ও তার প্রধান নেত্রী তথা দেশের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ওপর। এসবের মাঝেই তিনজন অভিজ্ঞ বিচারপতিকে সুপারসিড করে বা টপকে, আচমকাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হলেন, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এ. এন. রায়। বর্তমানে, এই ঘটনা কেই বলা হয় "দ্য ব্ল্যাকেস্ট ডে ইন ইন্ডিয়ান জুডিশিয়ারি"। শোনা যায়, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এ. এন. রায় নাকি, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো মামলা শুনানির পর, তা নিয়ে ডিসিশন জানানোর আগে তৎকালীন প্রধান মন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে নিতেন ! এগুলো গুজব হতে পারে, সত্যিও হতে পারে, কিন্তু দেশ জুড়ে আইন-পেশার সাথে যুক্ত প্রায় প্রতিটি লোক যে এর প্রতিবাদ করেছিল, সেটা সত্যি।
(১) ওনার অবসর হয় ১৯৭৭-এ, এক্ষেত্রে সময়টা ভুলে গেলে চলবেনা। এই সময়ের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলেছে সেই বিখ্যাত "কেশাবনান্দ ভারতী" মামলার, যেখানে ভারতবর্ষের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে, প্রথমবার ১৩ জন বিচারপতির বেঞ্চ গঠিত হয়। এই বেঞ্চ রায় দান করে যে, "ইফ নো প্রভিশন ইস মেড ফর এমেন্ডমেন্ট অফ দি কনস্টিটিউশন, দি পিপল উড রিকোর্স টু এক্সট্রা-কনস্টিটিউশনাল মেথডস, লাইক রিভোলিউশন " ! ডামাডোলের মধ্যেই, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এ. এন. রায় রিটায়ার করবার পর, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী মির্জা হামিদুল্লাহ বেগ। বলাই বাহুল্য ইনিও সুপারসিড করেন, বা টপকে আসেন, সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন সব থেকে অভিজ্ঞ বিচারপতি, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এইচ. আর. খান্না কে, ঠিক ওই মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এ. এন. রায়ের মতনই। এক্ষেত্রে বলে রাখা উচিত যে উপরক্ত ১৩ জন বিচারপতির বেঞ্চ-এর একজন বিচারপতি ছিলেন, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এইচ. আর. খান্না। উক্ত মামলায় বিচার্য ছিল যে, আইনসভা বা পার্লামেন্ট অর্থাৎ, বকলমে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল চাইলে, ভারতবর্ষের সংবিধান কে সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে ফেলতে পারে কিনা। এই সংশোধনের নামে, সংবিধান পাল্টানোর বা এমেন্ড করবার প্রক্রিয়া এবং অধিকারের কথা অবশ্য সংবিধানের আর্টিকেল ৩৬৮-এই বলা রয়েছে। "কেশাবনান্দ ভারতী" মামলায়, উপরোক্ত ওই ১৩ জন মহামান্য বিচারপতিদের মধ্যে, প্রথম ছয় জন রায় দেন যে, সম্পূর্ণ কনস্টিটিউশন বা সংবিধানকে চাইলেই একেবারে পাল্টে ফেলতে পারে আইনসভা, বা পার্লামেন্ট (অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল), এবং পরের ছয় জন রায় দেন যে না, কোনো পরিস্থিতিতেই, আইনসভা বা পার্লামেন্ট, কনস্টিটিউশন বা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার, বা মূল-কাঠামোকে পাল্টাতে পারেনা। এই ছয় বনাম ছয়ের পরিস্থিতিতে, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এইচ. আর. খান্না, কারণ তাঁর রায় যেই পক্ষেই যাবে, সেই পক্ষের রায়ই মেজরিটির, বা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় হিসেবে গণ্য হবে, এবং, আইন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। তিনি তাঁর রায়ে বলেন যে, "পার্লামেন্ট'স পাওয়ার টু এমেন্ড দ্য কনস্টিটিউশন ইস লিমিটেড এন্ড ফান্ডামেন্টাল রাইটস গুয়ারেন্টীড দেয়ারইন ক্যান নট বি এমেন্ডেড। অর্থাৎ, কোনো পরিস্থিতিতেই, আইনসভা, বা সংসদে , ভারতবর্ষের কনস্টিটিউশন বা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার, বা মূল-কাঠামো, যা ওই ফান্ডামেন্টাল রাইটস এর মধ্যে দিয়েই প্রতিষ্ঠিত, তাকে পাল্টাতে পারেনা। এর পক্ষে যুক্তি ছিল যে, ভারতবর্ষের সংবিধানের মূল-কাঠামোই হলো, ভারতরাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিচিতি। অর্থাৎ, ভারতরাষ্ট্রের পরিচিতি যে একটি সভারেইন, সেক্যুলার, সোসালিষ্ট আর ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র হিসেবেই, তা আইনসভা বা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বদলে ফেলা যাবেনা।
(২) এক্ষেত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার কথা বলা প্রয়োজন, যাতেও যুক্ত ছিলেন উপরোক্ত মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এইচ. আর. খান্না। এই মামলাটি পরিচিত "দি হেবিয়াস কোর্পাস কেস" নামে। ইন্দিরা গান্ধী কতৃক ইমার্জেন্সি ডিক্লারেড হয়, ১৯৭৫ সালের জুন মাসে। ওই সময়ে, কারণে, অকারণে, "মাইন্টেন্যান্সি অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি এক্টের" অছিলায় গ্রেপ্তার করা হতো রাজনৈতিক কর্মীদের। এই অন্যায় কে চ্যালেঞ্জ করে, নানান রাজ্যের হাই কোর্টে ফাইল হয়েছিল অজস্র পিটিশন। ওই সমস্ত পিটিশনকে একত্রিত করে, ফাইনাল হিয়ারিং-এ সুপ্রিম কোর্টে পুনরায় গঠিত হয়, পাঁচ সদস্যের আরেকটি বেঞ্চ। ওই বেঞ্চ রায় দেয় যে, যা হচ্ছে একদম ঠিক হচ্ছে, ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হলে, এমনটাই নিয়ম, এরমটাই দস্তুর। উক্ত আইনের মাধ্যমে নেওয়া সমস্ত পদক্ষেপ সঠিক, এবং তার বিরুদ্ধে কোনো কোর্টে মামলা করা যাবেনা। সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলায় আরো বলেছিলো যে, "নো পারসন হ্যাস এনি লোকাস স্টান্ডাই তো মুভ অন্য্ রিট পিটিশন আন্ডার আর্টিকেল ২২৬ বিফোর এ হাই কোর্ট টু চ্যালেঞ্জ দি লিগালিটি অফ এন অর্ডার অফ ডিটেনশন" ! অবাক হবেন না, এটাই বাস্তব। কিন্তু, বলতে একটু ভুল হলো, উক্ত পাঁচ জন বিচারপতির বেঞ্চ-এর চার জন এই রায় দিয়েছিলেন, পঞ্চম জন অর্থাৎ, মহামান্য প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী এইচ. আর. খান্না ভিন্নমত জানিয়েছিলেন। তিনি আলাদা করে ওই রায়েই বলেছিলেন যে, "দি কনস্টিটিউশন এন্ড দি ল'স অফ ইন্ডিয়া ডু নট পারমিট লাইফ এন্ড লিবার্টি টু বি এট দি মার্সি অফ দি অ্যাবসলিউট পাওয়ার অফ দি এক্সেকিউটিভ"। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় হিসেবে বাকি চারজনের রায়েই গণ্য হলো।
(৩) এসবের ফলশ্রুতি স্বরূপ তাঁর আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়া হয়নি, উক্ত মামলায় রায়দান করবার আগে, তিনি তাঁর বোনকে চিঠি লিখে, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন, এবং বাস্তবেও তেমনটাই ঘটে। ক্রমাগত অপমানিত হতে হতে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন জাস্টিস খান্না। পরবর্তীতে, জনতা দলের সরকার গঠিত হলে, আইনমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবেও রাজি হননি, প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ইমার্জেন্সি বিষয়ক কমিশনের দায়িত্বভার নিতেও। তাঁর ভয় ছিল যে তিনি বায়াসড বা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়তে পারেন ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে। ১৯৮০ সালে আবার ক্ষমতায় আসবার পরে, বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং কুর্নিশ জানাতে বাধ্য হন, তাঁর সততা, বিশ্বাসযোগ্যতাকে। নাহয় হলেন না সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, কিন্তু তাতে কী ? অনেকবছর পরে হলেও, আজ তো তাঁর বলে যাওয়া কথা গুলোই দেশের আইনে রূপান্তরিত হয়েছে, কারণ আইন সদা পরিবর্তনশীল। সময়ের এবং প্রয়োজনের সাথে সাথে আইন পাল্টাবেই। মোটামুটি এই একই যুক্তিতে, পাল্টেছে হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের নিয়োগের প্রক্রিয়াও।
ওপরের এতগুলো কথা বলবার কারণ একটাই। আমরা লক্ষ্য করছি, বিভিন্ন আলোচনায় বারবার উঠে আসছে জুডিশিয়ারি বা বিচারব্যবস্থার ভূমিকা বা কাজ কী , সেই প্রসঙ্গ। কিন্তু, এই আলোচনা করতে গেলে, এই ভূমিকা এবং কর্মপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে কার হাতে, তাও তো বুঝতে হবে। আর তার জন্য, বুঝতে হবে, বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া। বুঝতে হবে, আমাদের বিচারব্যবস্থায়, হাই কোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির গুরুত্ব ঠিক কতটা। তবে, তার আগে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক, ভারতবর্ষে আইন তৈরির প্রক্রিয়া দুটির ব্যাপারে। আমাদের দেশে আইন দুইভাবে তৈরি হয়। সংসদে নেতা মন্ত্রীরা যে আইন পাশ করেন, সেই আইন এর রূপকর মূলত আমলারা। আইনসভায় পাস্ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির সম্মতি পেলে ও সরকারি গেজেটে পাবলিশ হলে, তবেই তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলে। আমার বা আপনার যদি সেই আইন বা তার কোনো বিশেষ অংশ নিয়ে কিছুমাত্র আপত্তি থাকে, তাহলে আমরা সুপ্রিম কোর্ট বা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হতেই পারি, এই যুক্তিতে যে, নতুন তৈরি আইনটি সংবিধানের কোনো বিশেষ ধারার পরিপন্থী। আমাদের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হলে, আদালত সেই আইনটিকে অসংবিধানিক বা আলট্রা-ভাইরিস ঘোষণা করতে পারে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল, সিঙ্গুর ল্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট একট, ২০১১'র ক্ষেত্রে। অর্থাৎ, আইন সব কিছুর ঊর্ধ্বে না, বরং, আইন মাত্রই প্রশ্নসাপেক্ষ, আইনের ঠিক, ভুল, কম, বেশি ইত্যাদি সবই তর্কসাপেক্ষ। এটা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।
এটা গেলো একটা পন্থা। কিন্তু, অন্যটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট যদি কোনো মামলার বিচার করবার সময়ে কোনো বিশেষ আইনের পরিধিকে আরো বিস্তৃত বা সংকুচিত করে দেয় বা, সেই বিষয়ে নিজের ব্যাখ্যা দেয় তাহলে, সেই ব্যাখ্যা ও সেই বিস্তৃত বা সংকুচিত পরিধিও সেই মুহূর্ত থেকেই দেশের আইন হিসেবে গণ্য হয়। পরবর্তী সময়ে, সেই বেঁধে দেওয়া ব্যাখ্যা ও পরিধির ভিত্তিতেই বিচার্য হয়, অনুরূপ আর সমস্ত মামলা।
এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, বা সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিচারের দায়ভার যেই জুডিশিয়ারি বা বিচারব্যবস্থার হাতে রয়েছে, স্বাভাবিক জাগতিক নিয়মেই, তাতে নিযুক্ত হওয়ার জন্য প্রয়াসও সর্বাত্মক হবেই।