
মাসকাওয়াথ আহসান : প্রবাসী সাংবাদিক ও লেখক। বিশেষ করে গুরুর জন্য পাঠিয়েছেন লেখাটি। বাইরের পৃথিবী থেকে কেমন লাগছে মোদী সরকারকে, সেটা জানাও জরুরি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর তিনি দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক সংস্কারের যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তা আশা জাগানিয়া ছিলো। জার্মানির রক্ষণশীল খ্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট নেতা আঙ্গেলা ম্যারকেল যেমন জার্মানিকে ইউরোপীয় অর্থনীতির দুরন্ত সহিস হিসেবে গড়ে তুললেন, ভারতের রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী গণতন্ত্রী নেতা নরেন্দ্র মোদি ঠিক সে রকম একটা কিছু করে দেখাবেন এমন প্রত্যাশা জেগেছিলো।
জার্মানিতে উদারপন্থী সামাজিক গণতন্ত্রীরা বার বার ম্যান্ডেট পেয়েও জনপ্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতের উদারপন্থী কংগ্রেস বার বার ম্যান্ডেট পেয়েও জনপ্রত্যাশার প্রতি কাংক্ষিত সুবিচার হয়তো করতে পারেনি। সে কারণে রাজনৈতিক আদর্শ যাই হোক, জনউন্নয়নে একটি রক্ষণশীল আদর্শের দল ক্ষমতায় এসে যদি জনগণকে কল্যাণরাষ্ট্রের স্বাদ দিতে পারে, তা প্রশংসনীয় হতে পারে। জার্মানির খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাটরা যেটা করে দেখিয়েছে।
কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী গণতন্ত্রীরা ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসেও ইতিবাচক কোনো ফলাফল উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি বা অন্যান্য সামাজিক সূচকে অবনমন ঘটেছে। নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম চার বছরের শাসনে তবু অর্থনৈতিক সংস্কার ও দারিদ্র্য বিমোচনে মনোযোগ থিতু করেছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়ে মোদি যেন ফোকাস বা লক্ষ্যবিন্দু হারিয়েছেন; ওনার অগ্রাধিকার তালিকায় উন্নয়ন ও জনকল্যাণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না যেন।
নাগরিক নিবন্ধন তালিকার বা এনআরসি‘র মতো নেহাত উপরিকাঠামোর কাজ বা নাগরিক আইন সংশোধন বা সিএবি‘র মত রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদ-মনোরঞ্জক উদ্যোগের সঙ্গে জনউন্নয়নের কোনো সংযোগ চোখে পড়ে না। বরং গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে মোদি সেখানে ডেমোগ্রাফি বা জনমিতির পরিবর্তনের মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে তার হিন্দুত্ববাদী দলের নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করার যে কাজ করেছেন, সেটিকে পুরো ভারতের মানচিত্রে পুনরাবৃত্তি ঘটানোর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যেন তিনি।
মোদির এজেন্ডায় যেন রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীদের রাষ্ট্র ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে সাম্যবাদী ঝোঁক থাকায় এসব রাজ্যে ধর্মভিত্তিক একটি রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলের চিরস্থায়ী ভোটব্যাংক নিশ্চিত করা কঠিন। সেই অসম্ভব চিন্তার অভিলাষে এসব রাজ্যে জনমিতি পরিবর্তনের কাজে সক্রিয় মোদির প্রশাসন। বাঙালি ও মুসলমান জনসংখ্যা নির্মূল করে একপেশে রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদী ভোট ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় উদ্যত নরেন্দ্র মোদি ও তার দলীয় সহযোগীরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের জার্মানির চ্যান্সেলর আডলফ হিটলার 'বিশুদ্ধ জার্মান রক্তের জনমিতি' সুনিশ্চিত করার অবাস্তব অভিপ্রায়ে ইহুদি ও বামপন্থী নির্মূলের ডাক দিয়েছিলেন। ঠিক সেই উগ্রজাতীয়তাবাদ ও মানবতাবিরোধী কন্ঠের অসহিষ্ণু আর্তনাদ যেন এবার শোনা গেলো ভারতের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক নানা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-মতের সহিষ্ণু সমাজে। গোটা বিশ্ব ভারতকে এতোকাল দেখেছে অসাম্প্রদায়িক বোধের ও চর্চার রোল মডেল হিসেবে। সেখানে আচম্বিতে লাখ লাখ মানুষকে রাতারাতি অনাগরিক ঘোষণা করে, এমনকি ডিটেনশন ক্যাম্প গড়ে মানবতা বিরোধী ক্রিয়াকলাপ রীতিমত বিস্মিত করেছে বিশ্বসমাজকে।
সিরিয়ার মুসলমানেরা ইউরোপে শরণার্থী হলে জার্মানির রক্ষণশীল খ্রিস্টিয় গণতন্ত্রী নেতা আঙ্গেলা ম্যারকেল তাদের স্বাগত জানিয়েছেন-- জনপ্রিয় শরণার্থী বিরোধী আত্মকেন্দ্রিক ও রক্ষণশীল অভিমতের বিপক্ষে গিয়ে। কারণ তিনি জানেন, একজন শরণার্থী শুধু একটি মুখ নিয়ে আসে না, সে আসে দুটি কর্মীর হাত নিয়েও।
জার্মানির তুলনায় আয়তনে অনেক গুণ বড় ভারতবর্ষ। সেখানে দীর্ঘকাল ধরে যারা বসবাস করছে তাদের মাঝে বাঙালি বলে বা মুসলমান বলে তাকে রাতারাতি অনাগরিক ঘোষণার মাঝে 'ভোটব্যাংক'-এর চিন্তা হয়তো আছে, কিন্তু যে চিন্তাটা নেই-- তা হচ্ছে এদের প্রত্যেকের দুটি হাত আছে; আর ভারতের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এদের অংশগ্রহণ রয়েছে। এই যে এআরসি-সিএবি‘র এতো তোড়জোর, ডিটেনশান ক্যাম্প তৈরি-- এই হৈ হট্টগোলে লাখ লাখ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে মাত্র ছয় মাসে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগী অংশের মাঝে অত্যন্ত হিটলার মানসের সাম্প্রদায়িক লোকেদের বসবাস। এরা হালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসে উগ্র জাতীয়তাবাদের আর উগ্র-ধর্মপন্থার বিষ ছড়ায়। শরীরে অগাধ চর্বি, গলায় অনেক জোর, পচনশীল মনে সাম্প্রদায়িক কুঁচকুঁচানি--সারাদিন এদের এই এক কাজ। এ দেখে মনে হতে পারে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেহনতি; তারা অন্ন-সংস্থানের জন্য জীবন সংগ্রাম করে। তাদের সময় নেই কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বাঙালি, কে অসমি-- এসব ঠিকুজি খুঁজে বিলাসি আত্মপরিচয়ের ঢেঁকুর তোলার। তাদের ঈশ্বর বাস করে কর্মমুখর দিনের শেষে খাবারের থালায়; তাদের আত্মপরিচয় বাস করে কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকার মাঝে। ভাবা যায়, একবিংশের পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র মানুষেরা বাস করে ভারতবর্ষে, অনেক গ্রামে ক্ষুধায় শিশুরা মাটি খায়, সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে না পেরে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষেরা আত্মহনন করে!
এইসব জীবন্মৃত মানুষের কাছে, এআরসি বা সিএবি অর্থহীন শব্দগুচ্ছ।
নরেন্দ্র মোদি শৈশব থেকে দারিদ্র্য-অনাহার এগুলো বুঝে বড় হওয়া জননেতা। তিনি কী করে দরিদ্রঘাতী রাজনীতির অংশ হলেন, এ এক বিপুল বিস্ময়। এ এক আত্মঘাতি ভোট-ব্যাংকের অবাস্তব অভিসন্ধি। অথচ ইতিহাসের হিটলার নয়, আগামির আঙ্গেলা ম্যারকেলের পাশে গর্বভরে উচ্চারিত হতে পারতো নরেন্দ্র দামোদর মোদির নাম।
রাজনীতি তো জনকল্যাণের স্বার্থে নিবেদিত স্বেচ্ছাশ্রম। একজন রাজনীতিক নিজেই তার ভাগ্যের স্থপতি। এখানে কেউ কল্যাণরাষ্ট্র গড়ে নিজের অমরতার আয়োজন করে। কেউবা হালকা পপুলিস্ট উগ্র জাতীয়তাবাদ ও উগ্র ধর্মবাদের মাতম তুলে অশনি লুসিফেরা হয়ে ওঠে। ইতিহাসে গণধিকৃত হয় প্রতিদিন।
b | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:২৩79754
দ | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০৪79755
সে | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৪:৪৭79756
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:০১79751
কি | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৭:৪৬79752
একক | unkwn.***.*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:১২79753
অশোক | unkwn.***.*** | ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ ১২:৩৯79757
খ | unkwn.***.*** | ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৩৮79758