বাংলাদেশের পলান সরকারঃ আলোর ফেরিওয়ালা
হাসনাত কালাম সুহান
বাংলাদেশের বইয়ের ফেরিওয়ালা ‘পলান সরকার’ গত পরশু পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।
শহুরে মধ্যবিত্তের অনুরোধে ঢাকা বই মেলার মেয়াদ যখন বাড়লো দুইদিন। ওইদিকে, জীবনের মেয়াদ শেষে চলে গেলেন গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের বইয়ের ফেরিওয়ালা ‘পলান সরকার’।
প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি।
মাইলের পর মাইল হেঁটে একেক দিন একেক গ্রামে। এইভাবে ২০টি গ্রাম।
বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দেন। কাঁধে একটি ঝোলাভর্তি বই।
চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা আর গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষ।
গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন মাইলের পর মাইল; এমন দৃশ্য আর দেখা যাবে না।
উত্তরবঙ্গের রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ২০ টি গ্রামে পায়ে হেঁটে যিনি নিজের গরজে বই দিয়ে আসতেন। ‘উদ্দেশ্য ছিল ‘মানুষকে বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করা। পলান সরকার নেই। কিন্তু থেকে যাবে কীর্তি।
কে ছিলেন পলান সরকার?
জন্ম নাম অনুযায়ী, অন্য নামটি হারেজ উদ্দিন। তবে দেশব্যাপী তিনি পলান সরকার নামেই পরিচিতি পেয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ব্রিটিশ ভারতবর্ষের এক ক্ষুধাপীড়িত পরিবারে জন্ম। জন্মের পাঁচ মাস বয়সেই পিতৃহীন অনাথ হয়ে যান।
তারপর জীবন সংগ্রাম চালাতে গিয়ে, ষষ্ঠ শ্রেণিতেই পড়াশুনার ইস্তফা।
ঝুঁকে পড়েন ছোট ছোট ব্যবসায়। কখনও ফেরিওয়ালা। কখনও পঞ্চায়েত বোর্ডের ট্যাক্স কালেক্টর।
কিন্তু বই পড়ার অদম্য নেশাটা পুষতেন নিজের ভেতরে।
যে স্বল্প টাকা রোজগার করতেন। তার থেকে কিছু অংশ বাঁচিয়ে কিনতেন বই। পড়তে দিতেন অন্যদেরও।
যুক্ত ছিলেন সৃজনশীল কাজেও।
দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান হলো।
গ্রামে গ্রামে চলছে ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ। আর গ্রামের যুবক হারেজ উদ্দিন যাত্রা দল তৈরি করে ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো উত্তরবঙ্গ। প্রণম্য এই মানুষটি নিজের ভেতর লালন করতেন সব ধর্মের প্রতি মমতা আর মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি। হারেজ উদ্দিনের ‘পলান সরকার’ নামটিও সেই ভাবনার বাতাবরণ।
পাকিস্তান আমলের নব্য ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চর্চা যখন পূর্ববাংলাকে গ্রাস করছে।
তখন প্রত্যন্ত গ্রামের পলান সরকার, অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি লালন করতেন নিজের মধ্যে। যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। কখনওনিজেই অভিনয় করতেন ভাঁড়ের চরিত্রে। লোক হাসাতেন।আবার কখনও যাত্রাদলের বিবেক।
পলান সরকার বাড়ি ফিরতেন বই হাতে নিয়ে। যিনি বিয়ের দাওয়াতে বই উপহার দিতেন। কেউ তার রাইস মিলের টাকা পরিশোধ করলে উপহার তুলে দিতেন বই। এমনকি নিজের জমি বিক্রি করে যিনি কিনতেন বই। শুরুতে তার বাড়ি থেকে গ্রামের লোকজ ধার নিয়ে যেত বই।
১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হন পলান সরকার। ওই সময় তিনি হাঁটার অভ্যাস করেন। এবার আর নিজের বাড়ি থেকে বই নয়! প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেওয়া শুরু করেন তিনি। পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালার কাজ।
পড়তে দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি লেখকদের বইগুলো ছিল পলান সরকারের সবচেয়ে পছন্দের তালিকায়। তাছাড়া লোকসাহিত্যসহ অন্যান্য জনপ্রিয় লেখকের বইও তিনি বিতরণ করেন।
এভাবে চা দোকানি থেকে শুরু করে গৃহবধূ সবাই তার পাঠকের তালিকায় চলে আসেন। বদলে যায় দৃশ্যপট। নিজের গ্রামে তার বাড়ি হয়ে ওঠে পাঠাগার।
তবে ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। দান-অনুদানে মিলে যায় বইসহ অন্যান্য আসবাব।
৫২ শতাংশ জমি দান করে বাউসা হারুন অর রশিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন পলান সরকার।
প্রথমে আশপাশের ১০ গ্রামের মানুষ কেবল জানতেন পলান সরকারের কীর্তি। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’ তাকে তুলে আনে আলোকিত মানুষ হিসেবে।
২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয় নাটক, বিজ্ঞাপন চিত্র। শিক্ষা বিস্তারের অনন্য আন্দোলন গড়ে তোলায় ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে সাদা মনের মানুষ খেতাবে ভূষিত করে।
এরপর ২০১১ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন পলান সরকার।
তার মৃত্যুতে শোকে বিহবল গোটা বাংলাদেশের পড়ুয়া মানুষেরা।গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান। পাকিস্তান থেকে আজকের বাংলাদেশ।
সমাজ-রাষ্ট্রীয় বিচ্যুতি আর বিকৃতির বুনো ঝাপটা থেকে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছিলেন পলান সরকার। অদম্য এই মানুষটির মহাপ্রয়াণে, তাঁর স্মৃতির প্রতি নতজানু শ্রদ্ধা।