
১।
এক যে ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ ও স্বাধীন। গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে, কাকে বলে গণতন্ত্র।
রাজা বলিলেন, 'এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।'
গুজরাতি মহামন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, 'কখন পাকিস্তানিরা আসিয়া কী মন্ত্র দেবে ঠিক নাই। তার আগেই পাখিটাকে গণতন্ত্র শিক্ষা দাও'।
২।
রাজার ভাগিনাদের উপর ভার পড়িল পাখিটাকে শিক্ষা দিবার।
পণ্ডিতেরা বসিয়া অনেক বিচার করিলেন। প্রশ্নটা এই, উক্ত জীবের অবিদ্যার কারণ কী।
সিদ্ধান্ত হইল, সামান্য খড়কুটা দিয়া পাখি যে বাসা বাঁধে সে বাসায় বিদ্যা বেশি ধরে না। তাই সকলের আগে দরকার, ভালো করিয়া গণতান্ত্রিক খাঁচা বানাইয়া দেওয়া।
রাজপণ্ডিতেরা দক্ষিণা পাইয়া খুশি হইয়া বাসায় ফিরিলেন।
৩।
স্যাকরা বসিল গণতান্ত্রিক সোনার খাঁচা বানাইতে। খাঁচাটা হইল এমন আশ্চর্য যে, দেখিবার জন্য দেশবিদেশের লোক ঝুঁকিয়া পড়িল। কেহ বলে, 'শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ।' কেহ বলে, 'শিক্ষা যদি নাও হয়, খাঁচা তো হইল। পাখির কী কপাল।'
স্যাকরা থলি বোঝাই করিয়া বকশিশ পাইল। খুশি হইয়া সে তখনি পাড়ি দিল বাড়ির দিকে।
পণ্ডিত বসিলেন পাখিকে বিদ্যা শিখাইতে। নস্য লইয়া বলিলেন, 'বল গ-য়ে গণতন্ত্র'। পাখি বলিল 'গ-য়ে গণভোট'। পন্ডিত বলিলেন 'গণতন্ত্র'। পাখি বলিল 'গণভোট'। বারবার এইরূপ চলার পর পন্ডিত বিরক্ত হইয়া বলিনেন, 'এ শুধু পুঁথির কর্ম নয়।'
ভাগিনা বলিলেন, 'তবে?'
পন্ডিত বলিলেন 'একে ছাড়িয়া দিলে দুনিয়াভর গণভোট গণভোট করিয়া বেড়াইবে, কেউ যাতে শুনিতে না পায় তাহার উপযুক্ত ব্যবস্থা করুন'।
ভাগিনা তখন পুলিশদের তলব করিলেন। তাহারা চতুর্দিকে পাহারা বসাইল। দুর্গের মতো করিয়া তুলিল খাঁচার চারিদিক। কেউ যেন প্রবেশ করিতে না পারে। লোকে ধন্যধন্য করিল। এই না হইলে নিরাপত্তা। পাখি কপাল করিয়া জন্মাইয়াছিল বটে। তাহার যেমন খাঁচা, তেমনই পাহারা।
কূটনীতিকের দল জয়ধ্বনি দিগ্বিদিকে ছড়াইয়া দিল। রাষ্ট্রপুঞ্জ অবধি তটস্থ হইয়া পড়িল। তাহারা পারিতোষিক লইল বলদ বোঝাই করিয়া। তখনি ঘরের দিকে দৌড় দিল। তাদের সংসারে আর টানাটানি রহিল না।
অনেক দামের খাঁচাটার জন্য ভাগিনাদের খবরদারির সীমা নাই। মেরামত তো লাগিয়াই আছে। তার পরে ঝাড়া মোছা পালিশ-করা পাহারা-দেওয়া। খাঁচার জন্য বিশেষ মর্যাদার ধার্য হইল। তার নাম তিনশসত্তর। নিরাপত্তার ঠেলায় পন্ডিতেরও আর কাছে ঘেঁষবার জো নাই। তিনি মাইকে করিয়া দূর থেকে শিক্ষাদান করিতে লাগিলেন, 'একে কেন্দ্র, দুয়ে বিরোধীপক্ষ, তিনে তিনশসত্তর। ক-য়ে কৃপাণধারী, খ-য়ে খড়্গহস্ত, গ-য়ে গণতন্ত্র'। দুনিয়া শুদ্ধু লোকে শুনিতে পাইল। ঘটা দেখিয়া সকলেই বলিল, 'উন্নতি হইতেছে।'
লোক লাগিল বিস্তর এবং তাদের উপর নজর রাখিবার জন্য লোক লাগিল আরও বিস্তর। তারা মাস-মাস মুঠা-মুঠা তনখা পাইয়া সিন্ধুক বোঝাই করিল।
তারা এবং তাদের মামাতো খুড়তুতো মাসতুতো ভাইরা খুশি হইয়া কোঠাবালাখানায় গদি পাতিয়া বসিল।
৪।
এইভাবে দিন কাটিতে লাগিল। ইতিমধ্যে রাজা বদলাইল। নতুন রাজার আমলেও অবশ্য শিক্ষার কোনো তারতম্য হইলনা, জোরকদমে চলিতে লাগিলে। কিন্তু তাহা হইলে কী হয়, সংসারে অন্য অভাব অনেক আছে, কেবল নিন্দুক আছে যথেষ্ট। তারা বলিল, 'খাঁচাটার উন্নতি হইতেছে, কিন্তু পাখিটার খবর কেহ রাখে না।'
কথাটা রাজার কানে গেল। তিনি ভাগিনাকে ডাকিয়া বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।'
ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, সত্য কথা যদি শুনিবেন তবে ডাকুন স্যাকরাদের, পণ্ডিতদের, পুলিশদের, ডাকুন যারা মেরামত করে এবং মেরামত তদারক করিয়া বেড়ায়। নিন্দুকগুলো খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে।'
জবাব শুনিয়া রাজা অবস্থাটা পরিষ্কার বুঝিলেন, আর তখনি ভাগিনার গলায় সোনার হার চড়িল।
৫।
পাখিটা দিনে দিনে ভদ্র-দস্তুর-মতো আধমরা হইয়া আসিল। অভিভাবকেরা বুঝিল, বেশ আশাজনক। তবু স্বভাবদোষে সকালবেলার আলোর দিকে পাখি চায় আর অন্যায় রকমে পাখা ঝট্পট্ করে। এমন কি, এক-একদিন দেখা যায়, সে তার রোগা ঠোঁট দিয়া খাঁচার শলা কাটিবার চেষ্টায় আছে। অন্য একদিন পন্ডিতদের কাছে ধরিয়া আনা হইয়াছিল, কাছ থেকে শিক্ষা কীরূপ হয় পরীক্ষা করার জন্য। পাখি দুই পন্ডিতের হাতে সজোরে ঠুকরাইয়া দিল।
কোতোয়াল বলিল, 'এ কী বেয়াদবি।'
ধর্মগুরু কহিল 'ব্রাহ্মণের গায়ে হাত, এ কী সাম্প্রদায়িকতা?'
রাজনীতিক বলিল, 'পাখির জন্য নিরাপত্তার হদ্দমুদ্দ আর পন্ডিতদের জন্য বরাদ্দ কামড়? এ কী সিকুলারিজম?'
তখন শিক্ষামহালে হাপর হাতুড়ি আগুন লইয়া কামার আসিয়া হাজির। কী দমাদ্দম পিটানি। লোহার শিকল তৈরি হইল, পাখির ডানাও গেল কাটা।
রাজার সম্বন্ধীরা মুখ হাঁড়ি করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল, 'এ রাজ্যে পাখিদের কেবল যে আক্কেল নাই তা নয়, কৃতজ্ঞতাও নাই।'
তখন পুলিশেরা এক হাতে কলম, এক হাতে সড়কি লইয়া এমনি কাণ্ড করিল যাকে বলে শিক্ষা।
কামারের পসার বাড়িয়া কামারগিন্নির গায়ে সোনাদানা চড়িল এবং কোতোয়ালের হুঁশিয়ারি দেখিয়া রাজা তাকে শিরোপা দিলেন।
৬।
রাজা আবার বদলাইল। শিক্ষা যে কী ভয়ংকর তেজে চলিতেছে, নতুন রাজার ইচ্ছা হইল স্বয়ং দেখিবেন। একদিন তাই পাত্র মিত্র অমাত্য অক্ষয়কুমার ধোনি লইয়া শিক্ষাশালায় তিনি স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত।
দেউড়ির কাছে অমনি বাজিল শাঁখ ঘণ্টা ঢাক ঢোল কাড়া নাকাড়া তুরী ভেরি দামামা কাঁসি বাঁশি কাঁসর খোল করতাল মৃদঙ্গ জগঝম্প। পণ্ডিতেরা গলা ছাড়িয়া, টিকি নাড়িয়া, মন্ত্রপাঠে লাগিলেন। মিস্ত্রি মজুর স্যাকরা পুলিশ মিলিটারি তদারকনবিশ আর মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো এবং মাসতুতো ভাই জয়ধ্বনি তুলিল।
ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, কাণ্ডটা দেখিতেছেন!'
মহারাজ বলিলেন, 'আশ্চর্য। শব্দ কম নয়।'
ভাগিনা বলিল, 'শুধু শব্দ নয়, পিছনে অর্থও কম নাই।'
রাজা খুশি হইয়া দেউড়ি পার হইয়া যেই হাতিতে উঠিবেন এমন সময়, নিন্দুক ছিল ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিয়া, সে বলিয়া উঠিল, 'মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি।'
রাজার চমক লাগিল; বলিলেন, 'ঐ যা! মনে তো ছিল না। পাখিটাকে দেখা হয় নাই।'
ফিরিয়া আসিয়া পণ্ডিতকে বলিলেন, 'পাখিকে তোমরা কেমন শেখাও তার কায়দাটা দেখা চাই।'
দেখা হইল। দেখিয়া বড়ো খুশি। কায়দাটা পাখিটার চেয়ে এত বেশি বড়ো যে, পাখিটাকে দেখাই যায় না; মনে হয়, তাকে না দেখিলেও চলে। রাজা বুঝিলেন, আয়োজনের ত্রুটি নাই। খাঁচায় দানা নাই, পানি নাই; কিন্তু সোনার উপর লোহার শিকলের যত্নের শেষ নাই। সামনে দিয়া রাশি রাশি সেনাদল মার্চ করিতেছে, তাদের বুটে খটখট শব্দের জগৎ সংসার পরিব্যাপ্ত। আর পুঁথি হইতে রাশি রাশি পাতা ছিঁড়িয়া কলমের ডগা দিয়া পাখির মুখের মধ্যে ঠাসা হইতেছে। জোরে মাইকে গান চলিতেছে 'এক-ekke ekamaatra কেন্দ্র, দুয়ে duye গোমাতার দুগ্ধ, তিন-tirixe তিনশসত্তর'। গান তো বন্ধই, চীৎকার করিবার ফাঁকটুকু পর্যন্ত বোজা। দেখিলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়।
এবারে রাজা হাতিতে চড়িবার সময় কানমলা-সর্দারকে বলিয়া দিলেন, নিন্দুকের যেন আচ্ছা করিয়া কান মলিয়া দেওয়া হয়। তারপর কী খেয়াল হইতে গুজরাতি মহামন্ত্রীকে বলিলেন, তোমাদের মন্ত্রটা এবার পাল্টাইয়া দাও। শিক্ষা তো প্রায় সম্পন্ন, বিশেষ মর্যাদার আর কোনো প্রয়োজন নাই। ওটাকে ebaar তিন-tirixe ত্র্যহস্পর্শ করে দাও।
যেমন কথা তেমন কাজ। নিন্দুকদের কানমলার জন্য ইউএপিএর ব্যবস্থা হইয়া গেল। তিনশসত্তরের স্থানে চলিয়া আসিল ত্র্যহস্পর্শ। লোকে ধন্য ধন্য করিল। এ একটা কাজ হইয়াছে বটে। বজ্জাত পাখিটার এবার উচিত শিক্ষা হইবে। নিন্দুকদেরও।
৭।
পাখিটা মরিল। কোন্কালে যে কেউ তা ঠাহর করিতে পারে নাই। ইউএপিএর ভয় না করিয়া নিন্দুক লক্ষ্ণীছাড়া রটাইল, 'পাখি মরিয়াছে।'
ভাগিনাকে ডাকিয়া রাজা বলিলেন, 'ভাগিনা, এ কী কথা শুনি।'
ভাগিনা বলিল, 'মহারাজ, পাখিটার শিক্ষা পুরা হইয়াছে।'
রাজা শুধাইলেন, 'ও কি আর লাফায়।'
ভাগিনা বলিল, 'আরে রাম!'
'আর কি ওড়ে।'
'না।'
'আর কি গান গায়।'
'না।'
'দানা না পাইলে আর কি চেঁচিয়ে লোক জোটায়।'
'কিছুই করেনা মহারাজ। খাঁচার চারদিকে তো চিরস্থায়ী কার্ফু জারি করা আছে। '
রাজা বলিলেন, 'একবার পাখিটাকে আনো তো, দেখি।'
পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, পাইক আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হুঁ করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খস্খস্ গজ্গজ্ করিতে লাগিল।
বাহিরে মাইকে-মাইকে নিন্দুকের থোঁতা মুখ ভোঁতা করিয়া বাজিয়া উঠিল 'উরি, দা সার্জিকাল স্ট্রাইক'এর গান। যুবকেরা বলিউডি ধেইনৃত্য জুড়িল, হোয়াটস্যাপে মোবাইলে মোবাইলে ছড়াইয়া পড়িল সুসমাচার। কেবল এই নববসন্তের দক্ষিণহাওয়ায় পাখির মৃতদেহের বোঁটকা গন্ধও কিঞ্চিতধিক মিশিয়া রহিল, উৎসবের আকুলতায় কেহই খেয়াল করিলনা।
-----------------------
লেখকের মন্তব্যঃ লেখাটি প্যারডি ফর্ম্যাটে লিখব ভেবেই শুরু করা। কিন্তু কী আশ্চর্য, বেশিরভাগ লাইনই শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকল। আজকের কথা ভেবেই যেন মূল লেখাটি লেখা হয়েছিল।
b | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ০৩:৩৯78984
dc | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ০৪:০৮78985
Swati Ray | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ০৯:০৭78980
dc | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ১১:৫৮78981
খ | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ১২:০০78982
দ | unkwn.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০১৯ ১২:৩৫78983
ফরিদা | unkwn.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০১৯ ০৪:০৫78986
A | unkwn.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০১৯ ০৬:১৮78988
S | unkwn.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০১৯ ০৮:০৮78987
“ | unkwn.***.*** | ০৮ আগস্ট ২০১৯ ০৯:২০78989
aranya | unkwn.***.*** | ১০ আগস্ট ২০১৯ ০৬:১৯78990
কুশান গুপ্ত | unkwn.***.*** | ১৩ আগস্ট ২০১৯ ১১:২৩78991
Rouhin Banerjee | unkwn.***.*** | ১৪ আগস্ট ২০১৯ ০৭:২২78992
# | unkwn.***.*** | ১৪ আগস্ট ২০১৯ ০৮:৪৯78993
b | unkwn.***.*** | ১৪ আগস্ট ২০১৯ ০৯:৪০78994