ও চোখ দুটো বন্ধ করল। খুব আবছা হাসির টুকরো ঠোঁটের কোণে। মেনে নেওয়ার হাসি। একেবারে নিজস্ব। আর ঠিক তখনই আমার মনে ঝিলিক দিয়ে গেল, ও যা কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে... এই মুহূর্তে তা আমাদের দু'জনের। দু'জনকেই ভাগ করে নিতে হবে। তা না হলে এই যে আলো ..দোদুল্যমান আলো .. আমাদের যাপনে এখন...তা নিভে যাবে। ফুসমন্তরে । আলো -আঁধারিতে দেখি ওর চোখের পাতা কেমন তিরতির করে কাঁপছে। নিজেকেই বুঝি স্তোক দিয়ে যাই, হয়ত অনেক করে চাওয়া এক দু'কণা সুখের কুচি এখনও পড়ে আছে কোথাও। ওর মনের কোণের বাইরে।
মাথাটা একটু নামিয়ে একটা চুমু খেলাম । ওর বন্ধ চোখের পাতায়।
একটু উষ্ণ, একটু বা বুঝি ভিজে। ইদানীং যেমন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, আজ তেমনটি করল না । আমাকে মেনে নিল ওর নিশ্চুপ অভিব্যক্তিতে। এ এক এমন নীরবতা, যা নির্মমভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিনতায়, সটান প্রবেশ করছে আমার শরীর ভেদ করে। অনেক অনেক অচেনা দূরত্ব পেরিয়ে কানে আসে ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ। বেলাভূমিতে। এই ধ্বনি আমাদের অতীত আর ভবিষ্যৎ জুড়ে বিছিয়ে; এই ধ্বনি অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে রেশমি সুতোর ফাঁস। এই ধ্বনি আমার মনের মধ্যে প্রায় নিভু নিভু স্মৃতির প্রদীপের সলতেটাকে কেমন উসকে দেয়। আমি ওর কাঁধে হাত রেখে ওকে খুব শান্ত অথচ অচঞ্চল ভাবে শুইয়ে দিলাম খাটে।
জিজ্ঞেস করলাম, ব্যথা করছে কি ? ঠিক প্রশ্ন নয়, অনেকটা বক্তব্যের ধাঁচে। খুব সন্তর্পণ অনুভব। আসলে কী যে বলব, বুঝে উঠতে পারি না । সকালে শ্যাম্পু করেছিল। সানসিল্ক। সেই খুব হালকা মিষ্টি গন্ধটা আমার নাকে আসছে । কেমন একটা অস্বস্তি ... মাথার মধ্যে টুংটাং টুংটাং ।
জবাবে শুধু মাথা নেড়ে "না"। এর মধ্যেই চোখ খুলেছে . দৃষ্টি থমকে আছে মেঝেতে ; আমার পায়ের কাছে। আমি জানালা পেরিয়ে বাইরে তাকিয়ে; দূরে বিশাল নদীগর্ভ ঢাকতে চেষ্টা করছে আসন্ন রাত্রির অন্ধকার । আর আমার দেখার ফাঁকে ফাঁকে কেমন টিপটিপ করে জ্বলে উঠছে রক্তবিন্দু। লাল আলো। সেতুর ওপরে। ইস্পাতের শীতল স্তম্ভগুলি সাজিয়ে।
ইতিমধ্যেই রাত ঘনিয়ে এসেছে । অন্ধকারের মুখে অনেকটা যেন প্রীতম সিংয়ের ক্যানভাসে আঁকা মেয়েদের মুখের আদল ... নিষ্কম্প, চিন্তিত। ঘন কালচে নীল রাতের আকাশ। একটু কি বঙ্কিম বিদ্রূপ লেগে আছে? ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা। অপেক্ষা। সূর্যোদয়ের। কিন্তু সব ছাপিয়ে আমি যেন অনুভব করছি এক অদ্ভুত অহিতেচ্ছা । হয়ত এই অন্ধকার আমার ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইছে বাইরে; আমাদের বাড়ির ঠিক বাইরে ওই শূন্য চবুতরায় ...আমরা হাঁটছি ...সামনে পেছনে... শুধু হাঁটছি....
নদীর বাতাস ভাসিয়ে নিয়ে এলো স্টিমারের ভোঁ। গম্ভীর, থমথমে রাগী । আচমকা কেমন জোয়ারের মতো আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে পরাজয়ের ঢল।
আমি তাকালাম ওর দিকে। ও নিশ্চুপ। একটু ঝুঁকে পড়া পিঠ। খাটের ওপর।
একটুও নড়েনি । ওর সীসের মতো ভারী নিস্তব্ধতা আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছিল।
আমার কেন মনে আসছে একটা মরা গাছ ..নুয়ে আছে পাহাড়ী ঝোরার ওপর?
তুমি কি ভাবো আমি সত্যি সইতে পারব? যদি তুমি চলেই যাও ...? আমি কিছুতেই এই কথাটা মনে মনেও উচ্চারণ করে উঠতে পারি না। এ এক এমন বাক্যবন্ধ, যার নিঃশব্দ অভিঘাত অনুভব করা মোটেই সহজ নয়। মাত্র ছাব্বিশ বছরের সুন্দরী তরুণী স্ত্রী আমার ... অন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।
ফিরে এসেছি সরকারী হাসপাতালের চোখের ডাক্তার দেখিয়ে। আপাতত ওই নাকে চশমা -আঁটা কঠিন চোখ মুখের লোকটা আমাদের মন জুড়ে বসে। যা বলেছে, কথাগুলো শুনলেই বোঝা যায় স্রেফ মিথ্যে কথা ...কারণ ওর মুখ ছিল অভিব্যাক্তিবিহীন। আমরা ওকে বিশ্বাস করছি, আবার যেন পুরোপুরি আস্থা রাখতেও পারছি না।
ঠিক মনে হচ্ছে আমাদের জীবনটা যেমন হবার, তেমনটা হয়েই গেছে ..এবার ওই রাস্তাতে যতটা সম্ভব সাবধানে পা ফেলতে হবে।
ওর না জানি কী ভীষণ খারাপ লাগছে । আমার ভেতরে বসে থাকা কেউ ফিসফিস করে বলছিল। সাহসই নেই আমার ..ওর দিকে অনুকম্পার চোখে তাকানোর। যে অর্ধস্বচ্ছ তরল ও গত দু'বছর ধরে ব্যবহার করছে, যে তীব্র আলোর রশ্মি ওর কোমল চোখের তারা ভেদ করেছে বারবার ..নিষ্ঠুরতায় ... একের পর এক হাসপাতালে .. আমি নিশ্চিত, ও এতদিনে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে। ওর চূড়ান্ত অস্বস্তি, কষ্ট কী ভীষণভাবে প্রকট ওর মুখে ! আমার খুব ইচ্ছে করে, যেভাবে পারি ওকে খানিক স্বস্তি দিতে।
ও শোবার ঘরে। আমি ভেতরে ঢোকার আগে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঠিক পাশের ঘরটায় পায়চারী করলাম খানিকক্ষণ। কেমন একটা ক্লান্তিকর দোটানা ভাব আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সটান গিয়ে দাঁড়ালাম ওর আয়নাটার সামনে। দাঁড়িয়েই রইলাম। কিছুই না করে । নির্দিষ্ট কোনো কিছুই করছিলাম না আমি। দেখছিলামও না। শার্টের কলারটা অনাবশ্যকভাবেই ঠিকঠাক করার চেষ্টা। সত্যি, আমি একেবারে চাইছি না ওর মুখোমুখি হতে ..আমার এই বোকা বোকা ঢুলুঢুলু আধফোটা হাসি ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে রেখে ! এ নিছক অপ্রস্তুত হাবভাব লুকোনোর চেষ্টা ছাড়া তো আর কিছুই নয় ! আর এই মুহূর্তে বুঝতেও পারছিলাম, আমার নিয়ন্ত্রিত অভিব্যক্তির আপাত দুর্ভেদ্য বর্ম কেমন ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়ছে।
আচ্ছা, আমাদের মতো দুর্বল মানসিকতার মানুষরা কি এভাবে শুধু চুপকথার খেলা খেলে যায় আজীবন?
মনে হল, একটা কিছু পানীয় নিয়ে আসি . হয়ত ও একটু সহজ হতে পারবে ।
বরফ-ঠাণ্ডা দুধের গ্লাসের দিকে এক ঝলক তাকাল ও। আমি গ্লাস এগিয়ে ধরেছি ওর সামনে। হাসতে পারলে হাসতাম; কিন্তু হাসতে আর পারছি কই ! মেকি হাসিও নয়।
খানিক বেখাপ্পাভাবেই বললাম, নাও, দুধটুকু খেয়ে নাও। ভালো লাগবে । ও কেমন শক্ত হয়ে গেল ।
আমার দিকে তাকাল। দ্রুত, রাগী ভঙ্গিতে। এই দু'টি চোখ ছায়াছায়া গভীর মায়াময় হতে পারে। বেশিরভাগ সময়ে। আমি অন্তত সেভাবেই চিনেছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে দৃষ্টিতে এমনই তীব্রতা যা আমারই নিজেকে এক ভিনগ্রহের বাসিন্দা বলে মনে হচ্ছিল। কিংবা চিড়িয়াখানার। এক ঝটকায় ও দুধভর্তি গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে।
একটুক্ষণের জন্য আমি হতচকিত। নির্বাক।
কষ্ট প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করছে নীরবতাকে, বিদ্বেষকে ... যে কোনো কিছুকেই।
আমি ঘরের অন্য কোণে গিয়ে রেডিও চালিয়ে দিলাম । যত জোরে পারা যায়।
একটু পরেই ওর হুঁশ ফিরে এল। শান্ত, ভীতু বেড়ালছানা । একেই আমি এতকাল ধরে চিনে এসেছি । এত বছর ধরে। নিরাপদ, অনুমেয়।
আমি ঘুরে তাকালাম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ওর মুখের রেখাগুলো কেমন কোমল হয়ে আসছে । সেই কোনকালে ঠিক বিয়ের কয়েক মাস আমার 35 মি.মি. ক্যামেরায় তোলা ছবির মতো। ও দাঁড়িয়েছিল স্টেশনে, প্ল্যাটফর্মে । সিঁড়িতে। আর ওর চুলে সূর্যের রুপোলি রোদ্দুর এসে পড়েছিল। ঠিক । সেদিন ওর মুখে ঠিক এমন অভিব্যক্তিই ছিল। যেটি আমি ধরে রেখেছিলাম f / 5.6 আর এক সেকেন্ডের 1 / 250 তম ভগ্নাংশে। 1974 -এ।
ওকে লক্ষ্য করতে করতে, ওই শুদ্ধ প্রতিমার মতো মুখ, দূরে, প্রায় স্বর্গীয় সুষমায় ... আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা এখন ঠিক কী অবস্থায় আর অবস্থানে আছি। ঠিক কোন যন্ত্রণার মুখোমুখি। টানটান অপেক্ষায়। আবার এ এক এমন যন্ত্রণা, যে আমি বুঝে উঠতেই পারি না এর অভিঘাত কতটা। এ এক এমন অবোধ্য যন্ত্রণা, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শেষ পর্যন্ত এমন এক জায়গায় পৌঁছে যাবে; যেখানে চোখে বা দৃশ্যমানতার বৃত্তের মধ্যের শূন্যতাকে আর আত্মসম্ভ্রমবোধ দিয়ে পূর্ণ করা যাবে না।
ওর ঠোঁটের কোণে এই যে এখন লেগে আছে ..সব কিছু মেনে নেওয়ার হাসি; এইটুকুই কিন্তু। এর বেশি আমি একতিলও জানি না, ও এই মুহূর্তে ঠিক কেমন আছে । ওর মনের গহীন গোপন অন্ধকারে খিল তোলা । মাঝেমাঝে ভাবি, আমার একান্ত অনুভব কখনও ওর মনে সেভাবে আলোড়ন তুলতে পেরেছে কিনা বা আদৌ ওর চাহিদার কাছে পৌঁছতে পেরেছে কিনা। হয়ত ওর একেবারেই কোনো প্রয়োজন নেই..আমার প্রতিক্রিয়ার , আমার এই টুকরোটাকরা সহনশীলতার নমুনার; ও এখন এক ভারশূন্য নতুন জগতের বাসিন্দা। আমার আবেদন নিবেদন সেখানে গুরুত্বহীন, অচল, একেবারেই গতিহীন ।
ব্যথার আত্মাটির যে দেশে বসবাস, সেখানে কোনো আইন খাটে না ।
আমার কী বলা উচিত? শোনো, আমি তোমার জন্য খুব কষ্ট পাচ্ছি । কিন্তু কী আর করা যাবে বল; আমি ভাগ্যের হাতের পুতুল . এর বেশী আর কীই বা তোমার জন্য করতে পারতাম ! এই সান্ত্বনাটুকু দেওয়া ছাড়া। এর বদলে বলে উঠলাম, মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে।
এই কথাগুলো ওর সামনে একটা প্রাচীর তুলে দেয় । সেই এক কথা। বস্তাপচা, একঘেয়ে, অর্থহীন। বুঝতে পারি, কারণ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে . আমার দিকে তাকায়ও না। দরজাটা খুলে ঘর থেকে বেরিয়েও যায়।
আচমকাই বুঝতে পারলাম, আমি একা। শ্রোতা নেই। বকবক করে যাচ্ছি ।
দিন যায়। ও আরোই বিষণ্নতায় ডুবে যেতে থাকে। আমি বুঝতে পারি ওর মরা মাছের মতো চোখ দুটোর নড়াচড়া দেখে। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওর নিজের তৈরী আবেগবিহীন খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে । তবুও খুব মাঝেমধ্যে ওর কথার ভেতরে বিদ্যুচ্চমকের মতো কিছু ঝিলিক দিয়ে যায় । কিছু প্রতিশ্রুতি। ওর চোখে নেমে আসা বাস্তবের অন্ধকার পর্দার ওপরে ভেসে ওঠা ছায়াছবির মতো।
সে যাই হোক, এ এক বিচিত্র মানসিক বিক্রিয়া। ওর চাউনিতে দেখি কোনার্কের পরিত্যক্ত মন্দিরের নিঃসঙ্গতা। আর আলো -অন্ধকার কেমন ওর চারিপাশে নিজেদের বৃত্ত এঁকে দিয়েছে।
এক সন্ধেতে দেখি সিঁড়ির ওপর বসে আছে। স্থির, ভাবলেশহীন । চোখ ওই আকাশে . একফালি চতুর্থীর রুপোলি চাঁদ। ওর চিরকাল এই যা কিছু শুদ্ধ আর নিষ্কলুষ সৌন্দর্য, তার দিকে ঝোঁক । ওকে যেন আচ্ছন্ন করে দেয়। আর আমার তো এমনটাও মনে হয়, ও যেন তখন নিজেই নিজের বিষণ্ন প্রতিমার রূপটিতে নিমজ্জমানা . রাত্রির প্রেক্ষাপটে ওর মুখ রক্তশূন্য, নির্বিকার। ঠিক যেন পাথরপ্রতিমা।
নিস্তব্ধতা আরো দীর্ঘায়িত হয়। তার যন্ত্রণা আমাদের দু'জনকেই ধীরে ধীরে গ্রাস করে ।
আমি শুনি নিজের কন্ঠস্বর . তুমি ঠিক আছ তো? কিছু চাও?
ওর উত্তরের অপেক্ষায় থাকি। নীরবতা কেমন দুমড়ে মুচড়ে ছোট হয়ে যায়। কানে ভেসে আসে ওর গভীর শ্বাসের শব্দ।
প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, তুমি কি জানো, আমি ওই আকাশে চারটে চাঁদ দেখতে পাই?
কী যেন ছুটে বেরিয়ে যায় আমার পাশ দিয়ে . তুফান তুলে। বাতাস? নাকি আমারই হৃদয়ের শব্দ? জানি না।
বুঝে যাই, প্রতিটি আলো, প্রতিটি সূর্য, ছোট এবং বড় ..ওর চোখে ক্রমাগতই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলেছে ।
এই যে এতদিন আমরা একসঙ্গে , আমাদের মধ্যে ব্যবধান তো ছিল। এখন তাতে আলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
এরপর ও হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর কাজ করে বসল। খুব ধীর পায়ে উঠে এসে সন্তর্পণী মায়ায় আমার ভুরুতে একটা চুমু খেল। দু'চোখের ঠিক মাঝখানে।
সহজাত আবেগের বশেই ওকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরলাম। ওর মুখ ঠিক যেন ঘড়ির মুখচ্ছবি . শুধু সময়ের কাঁটা দুটো গরহাজির। শুধু চোখের তারা দু'টি ঝিকমিক। খুব অস্ফুটে, যেন নিজেকেই শোনানোর মতো করে ও বলে উঠল, "ভালোবাসি তোমাকে।" আমার অস্বস্তি দানা বাঁধছিল। কিছু কিছু ভাবনা, কিছু ঘনিষ্ঠ ঘোষণা নিরুচ্চার থাকাই তো শ্রেয় ...এমনকি খুব ব্যাকুল প্রণয় - মুহূর্তেও । আর এখন ওর এইসব কথা.......
শব্দমালা কি পারে অতীত বা ভবিষ্যৎকে জয় করতে ? এই সব শব্দমালা? হয়ত । বর্তমানকে। মুহূর্ত এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
আমি নিশ্চুপ।
উত্তর দেবার আগে আমি ওর দিকে তাকিয়ে। আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বিষয়ে আমি পূর্ণমাত্রায় সচেতন। আমার মুখের রেখায় রেখায় বদান্যতা। ভাবি, সত্যি ..তোমার সঙ্গে কেন এমন হল ! চাই না তুমি কষ্ট পাও।
ও খুব মৃদু লয়ে মাথা নাড়ল । অনেকটা যেন আমাকে সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে। আর আমি..ক্রুদ্ধ হতাশায় আবিষ্কার করলাম , বুড়িয়ে যাচ্ছি, একা ..আর কী ভীষণ শূন্যতা ! ঠিক মনে হল, যে বিরাট মহান আত্মত্যাগ আমি করে দেখাতে যাচ্ছি, তা সম্পূর্ণ নিরর্থক । এই মুহূর্তে।
দু'মাস পর। আমি নজরে রাখছিলাম। ও হেঁটে যায় এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। ভারী পায়ে , থেমে থেমে। অনেকটা যেন পা ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া রোগীর মতো। কেমন লাজুক লাজুক, দ্বিধাগ্রস্ত ..অনেকটা সেই প্রথম দেখার সময়ের মতো। কত বছর হয়ে গেল ! ওকে দেখেছি আয়নার সামনে দাঁড়াতে। চুল সাজাচ্ছে পরিপাটি করে। ওর দীঘল প্রাণবন্ত মুখশ্রীতে ছায়া ছায়া হয়ে মিশে আছে কিছু ফেলে আসা স্বপ্ন। ও যেভাবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিল। যা ঢেকে গিয়েছে নিশ্ছিদ্র তমিস্রায়। কে জানি বলেছিল, চোখ কিছুই দেখে না; দেখে হৃদয়। শুধু রাতে যখন শুতে যাই, ক্লান্ত হয়ে ভাবি...আরও একটা দিন ফুরোলো।
এখন আর নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যাই না আমরা । কিন্তু ওষুধপত্র তো খেতেই হয়। আর আমার নিজের কাছে অন্তত এটুকু দাঁড়াবার জায়গা চাই যে যা যা করণীয় ছিল, কিচ্ছু বাদ দিইনি। অর চোখ দু'টো বাঁচাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুতে কেমন একঘেয়ে দৈনন্দিনতার সীলমোহর পড়ে যায়। নির্বিচারে মেনে নেওয়ারও।
কিন্তু ভীষণভাবে বুঝতে পারছি, ওর দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমি ওকে টুকিটাকি কাজকর্মে সাহায্য করি। যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই অসমঞ্জস, তুচ্ছ; কিন্তু এক সময়ে আমাদের কাছে খুব জরুরী ছিল। এও আমার নিজস্ব পন্থা, নিজের মতো করে বলা, বিদায় জানানো। আমি হয়ত ওকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছি ওর একটু একটু করে মরে যাওয়া চোখে চোখ রেখে। হয়ত আমি ওর আলো ফুরিয়ে আসা চোখে ওকেই খুঁজে ফিরছি। ওই আলোর আত্মাটিকে ও পুজো করত । ওই আলোর শিখাটি এখন কম্পমান, অন্য সহস্র সহস্র চোখে নিজের ক্ষমতার প্রতিফলনে, আর এই দু'টি চোখে ব্যথার অনুরণন অনুভব ক’রে। একটু বেশি সময়ের জন্য ওর হাত ধরে থাকি, কাঁধে বিছাই হালকা চাদর ...নদীর জল বেয়ে উঠে আসে হিমভাব ..ছড়িয়ে যায় বাতাস জুড়ে। আর প্রয়োজনের তুলনায় যেন একটু বেশি জোরে হেসে উঠি। এ কথায়। ও কথায়।
আর এরপর শুরু হল আমার ভাগ করে নেবার পালা। ওর সঙ্গে। যা যা শব্দ ও সারাক্ষণ ধরে শুনতে পায়। ভোরের কুয়াশামাখা অনামা সকালে আশেপাশের গাছগাছালি থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক। ওর শ্রুতির ফিনফিনে শিরায় উপশিরায় ধরা পড়ে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস। ও শুনতে পায় সূর্যের আলো, যখন তা রাঙিয়ে দেয় ওর মুখটি।
ওর চোখ এখন দেখতে পায় এক বৃহত্তর জগত। একান্ত আপনার ভুবন। এমনটি আগে কখনও ছিল না।
আর আমি যখন ওর হাত ধরি, ও বলে..ও নাকি নতুন কিছু ছুঁয়ে আছে। উষ্ণ, নরম ..কবুতরের ডানা।
আর আমার নিজের কাঁধের ওপরে আমার পুরনো সুস্থ দু'টি চোখ আমাকে একদৃষ্টিতে নজর করে যায়। অনন্ত অপরাধবোধের উত্স হিসেবে ।
কাটল আরও তিনটি মাস।
নভেম্বর। আলোর রকমফের। আমার চোখের আড়ালেই। দিনগুলো এখন ছোট। ইতস্তত অলক মেঘ কখনও কখনও আঁকড়ে ধরে পড়ন্ত গোধূলির রক্তিমা। ফিরে তাকাই ওর দিকে। জানি তো..কী ভালো যে বাসে ও... রঙের খেলার এই রোমাঞ্চ ! কিন্তু এখন...এ যেন শুধু আমাদের মধ্যে বাড়িয়েই চলেছে ...দূরত্ব আর দূরত্ব।
সন্ধেবেলা। আমরা বসেছিলাম বারান্দায়। চেয়ারে। আমি ফস করে বলে ফেললাম, ইস, তুমি যদি সিনেমা যেতে পারতে ! তোমার এত ভালো লাগে নতুন ধারার সিনেমা .. বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়। মনে আছে, কী কান্নাই না কেঁদেছিলে তুমি? ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে? সিনেমা হলের অন্ধকারে? তারপর আমরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার ছলে গম্ভীর হয়েছিলাম, ও কিছু না..বিচ্ছিরি সর্দি লেগেছে !
ও মুখ আড়াল করল। দেখাতে চায় না আবেগের ঝিলিক।
আমার চোখ চাঁদের চোখে। কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে ঝুপসি কালো মেঘের আড়াল নিয়ে। খুব শিগগির ...খুব খুব শিগগির..ও আর কিছুই দেখতে পাবে না। সন্তর্পণে ওর হাত ছুঁয়ে আছি।
ওর ঠোঁটের কোলমোছা আবছা হাসি। ওর দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, কিছুই বদলে যায়নি। আমি ভাবছিলাম, এটাই কি সত্যি যে ও আর দেখতে পায় না...নাকি এটাই যে , এই না-দেখতে পাওয়া পৃথিবীর নকশা ও নিজেই বুনে নিয়েছে ... এক নতুন ভুবন, প্রতিবিম্বের ভুবন... যেখানে ও নিজের ছায়াগুলি বিছিয়ে রাখবে আলতো মায়ায়।
আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম ওর কোমলতা আর স্থৈর্য দেখে .. ওর প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে কী অনায়াসে ওর আরও কাছে নিয়ে আসছে ! আর এক অমলিন শুদ্ধতা ..যা ওর অতটা জুড়ে মিছিয়ে আছে মসলিন ওড়নার মতো। এ শুদ্ধতা আমি সারাটি জীবন কামনা করেছি, আমার আয়ত্তে আসেনি কখনও। ওর এই নতুন শিশুবেলা। অবোধ , এলোমেলো, সদ্য হাঁটতে শেখা ...টলমল পায়ে।
আর অনুভব করলাম, আমিই ওর নিঃসঙ্গতা। আমিই ওর একাকীত্ব। এই অনুভব অনুপ্রবেশ করেছে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে। রোজ ও উঠে যায় মাঝরাতের ট্রেনে। ফাঁকা কামরায়। অথবা আমি সেই গন্ধবিধুর বাতাসভেজা অস্তিত্ব, যা ভেসে বেড়ায় ওর যাপনদুঃখে। যখন ..যখন ও হেঁটে যায় ঝুলবারান্দা বরাবর .. পাঁচিলের গায়ে সারিসারি চিনেমাটির ফুলপাত্র ... সোনালি হলুদ চন্দ্রমল্লিকাদের সূর্যের দিকে চোখ, শরীর জুড়ে হাসির হিল্লোল। কিন্তু আমি জানতেই পারি না। এই অনন্ত অন্ধকারের কথা। আশা ও অবসাদ।
আর ওর দিকে তাকিয়ে যেন শুনতে পাই রাতচরা পাখির কান্না । এই ভুবনে সময় নিষ্কম্প। মুহূর্ত বিলীন হয় অনুকম্পার দিগন্তরেখায়। আমি অনুভব করি মন্দলয়ে... কামনার সুর, আবেগমদির....
আমি ওকে দখল করি . চাঁদের আলোয় ভেসে। বাধা দেয় না। হয়ত খানিক অকরুণ আমি...বলি, কেন তুমি নিজের জীবনে পূর্ণযতি চাও ... আমার মনে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর... যখন আমরা প্রথম জানতে পারি, ও দৃষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছে... আর আমি..আমি দেখি.. ওই হাসিটি এখন ওর ঠোঁটে ... কিন্তু যে কান্না আমি কোনওদিন স্পর্শ করতে পারব না ...কেমন অক্লেশে গড়িয়ে যায় ওর জ্বরতপ্ত গাল দু'টি বেয়ে ... চাঁদের আলো মেখে ... স্বর্ণিম মুক্তোবিন্দু যত... নাটমঞ্চে ঝিলমিল ঝিলমিল সারিসারি বাতির মতোই ।
( ভাষান্তরিত / মূল গল্পঃ Eyes / জয়ন্ত মহাপাত্র )