(১)
টু...ওয়ান...জিরো! রোলিং।
বেজে উঠলো থিম মিউজিক। খবরের গ্রাফিক্স ঘুরতে ঘুরতে চলে এল বিশেষ খবরের কার্ড। হেডলাইনস।
ভাঙ্গুরে পুলিশের অপ্রত্যাশিত হানা গ্রামে। লাঠি, গুলি, আহত ৩৬। সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত। ...
ফোন বেজে উঠলো বার্তা চ্যানেলের দপ্তরে। চোখে ওষুধ দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন নিজের চেয়ারে অমানিশ চক্রবর্তী। গত বেশ কিছুকাল তিনি এই দুপুরের দিকে এটাই করেন। যদিও এই চ্যানেলের তিনি বার্তা সম্পাদক তবুও এই সময় তাঁর কাজ তেমন কিছুই নেই। অন্যান্য সমস্ত চ্যানেলে, খবরের কাগজের বার্তা সম্পাদকরা এখন অজস্র মিটিং-এ ব্যাস্ত। তিনি চোখে ওষুধ দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছেন। নাক ডাকে না তাঁর। চোখ বন্ধ করে নিঃসাড়ে ঘুমোন তিনি। সারারাত ফোনে ব্যাস্ত থাকতে হয় তাঁকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা তখন ফোন করেন। তিনিও করেন। তাঁর কাজ হল শোনা। তারপরে প্রয়োজন মাফিক এর কথা ওর কাছে পৌঁছে দেওয়া। সকলেই জানেন যে তিনি এই কাজটাই করেন। ঠিক সেই জন্যেই তাঁর দাম। যার যে কথা অন্যকে জানাতে হয় এবং অন্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সুসম্পর্ক রক্ষা করতে হয় সেই তাঁকে ব্যবহার করে। এবং তিনিও ব্যবহৃত হন বলেই এখনো টিকে আছেন। নইলে সাংবাদিক হিসেবে অনেকদিন আগেই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা।
এই চ্যানেলেও তাঁর টেকার এটাই রহস্য। এই যে তিনি চোখ বন্ধ করে ঘুমে তাতে তাঁর মাথা বন্ধ নেই। ঘুমের মধ্যেও তিনি দেখে চলেছেন যে ওপরের কোনো একটা ঘরে মিটিং হচ্ছে। সেখানে বসে নিত্যপ্রিয় তাঁকে খুব খিস্তি করছে। বলা বাহুল্য নিত্যপ্রিয়ই তাঁকে ‘সমকাল’ পত্রিকা থেকে এখানে এনেছিল। সেখানে থাকাকালীন নিত্যপ্রিয় ও তিনি একই লবিতেও ছিলেন। সম্পাদক-মালিক ছিল বীতশোক ঘোষ। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তাঁর, বীতশোক আর নিত্যপ্রিয়র। বীতশোক যত যত মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তত তত তাঁদের দূরত্ব বেড়েছে। বীতশোক অবশ্য যখন আজকের মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়েছেন তখন তিনি মন্ত্রীসভায় এক সদস্য মাত্র এবং কোণঠাসা। তার কিছুদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেবেন মন্ত্রীত্ব। তারপরে একদিন ফিরেও আসবেন। আবার মন্ত্রী হবেন। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী যত অসুস্থ হতে থাকবেন, এনার গুরুত্ব বাড়তে থাকবে। বীতশোকও রাজ্য-রাজনীতিতে মাতব্বর হবেন। ভুলে যাবেন এককালে তিনি, নিত্যপ্রিয় ও অমানিশ একসঙ্গে রাত্রে ফিরতেন এক গাড়িতে।
তখন অবশ্য নিত্যপ্রিয় আর বীতশোক দুজনই বেকার। নিত্যপ্রিয় বৌ-এর স্কুল মাস্টারির টাকায় মদ খেয়ে বেড়ায়। কিন্তু স্কুল মাস্টারির টাকা কম বলে নিত্যর সঙ্গী তখন বাংলা। বীতশোকের স্ত্রী অধ্যাপিকা। ফলে বীতশোক বিদেশী মদ তখনো খেতেন। এবং নানা সময়েই নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির হতেন সন্ধেটা কোনো রকমে কাটাতে। প্রতিদিন পাবে গেলে অনেকটা টাকা যায়। এমনই এক অনুষ্ঠানে নিত্যপ্রিয়র সঙ্গে নতুন করে সখ্যতা। বীতশোককে মদ খাওয়ার পরে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা নিতে নিত্যপ্রিয়র কোনো সমস্যা ছিল না। বিদেশী মদ এবং সঙ্গের চাট জুটলে সে জুতোও পরিয়ে দিতে পারে। প্রেস ক্লাবে মদ সস্তা এবং সেই খেতে ও আরো নানা জটিল ইক্যুয়েশন কশতে দুজনেই যেতেন সেখানে। প্রেস ক্লাব থেকে অমানিশের পত্রিকার রাত্রের গাড়িতে তিনজনে ফিরতেন বেশিরভাগ দিন।
তার কিছুদিন পরে বীতশোক যোগ দেবেন সম্মানিত সাংবাদিক কৃষ্ণকিশোর ঘোষের ‘সমকাল’ পত্রিকায়। তিনি ‘অপূর্ব বাংলা’ ছেড়ে চলে আসবেন সেখানে। নিত্যপ্রিয় চাকরি পাবে। তিনজনে আবার এক জায়গায়। কৃষ্ণকিশোরকে তাঁরা কোণঠাসা করে দেবেন একদিন। বীতশাক এক এন আর আই কে ধরে সংবাদপত্রের জন্য বিনিয়োগ আনবে। তখন ‘সমকাল’ পত্রিকার বেশ দুরবস্থা। সরকারি বিজ্ঞাপন আসে নাম কা ওয়াস্তে। সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করলে যা হয়। তার সঙ্গেই রয়েছে অন্যান্য শিল্পপতিদের রাগ। এই পত্রিকা নাকি খুব বাম ঘেঁষা। সম্পাদক কৃষ্ণকিশোর একসময়ে বামেদের সঙ্গেই ছিলেন। পরে সরে গিয়েছেন ও বামেদের সমালোচনা করে উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু নিজের অবস্থান ছাড়েননি। অতএব কাগজ ধুঁকছে। ডিস্ট্রিবিউশন থেকে টাকা আসেনা। সেখানে গাঁট হচ্ছে ‘সুখবাজার’ পত্রিকা। তারা সব ডিস্ট্রিবিউটার কিনে রেখে দিয়েছে। তাদের বাড়তি টাকা দেয় ‘সমকাল’ পত্রিকা না নেওয়ার জন্য। অতএব সব দিক থেকেই চাপ খেতে খেতে পত্রিকার নাভিশ্বাস। কৃষ্ণকিশোর শুরুর জীবনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তেল-ও বেচেছেন, তিনি এতে দমে যাওয়ার পাত্র না। তা বলে সকলেই রাজি না স্বল্প মাইনেতে সংবাদজগতে বিপ্লব আনতে। তাঁদের সম্মান আছে সামাজিক। মাইনে কম বা অনিয়মিত হলে বাড়ির জন্য ধার থেকে আত্মীয়র অনুষ্ঠানে উপহার সব আটকে যায়। মদ-টদ তো বলাই বাহুল্য। অতএব কৃষ্ণকিশোর একদিন ছবি হয়ে ঝুলতে থাকলে পত্রিকা দপ্তরে। প্রাক্তন সম্পাদক, সম্মানীয়, কিন্তু অনুকরণীয় নহে।
তারপরের থেকে শুরু হল তাঁর বনাম বীতশোকের যুগ। বীতশোক প্রথমে নিত্যপ্রিয়কে তাড়ালো। তারপরে তাঁর পালা ছিল। কিন্তু তিনি নিত্যপ্রিয় নন। মদ, সিগারেট কিচ্ছু খান না। বাড়তি খরচ করেন না। এককালে জেল খাটা বিপ্লবী। যদিও মোট তিন বছর জেলে ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গীরা এখন জানেন যে তিনি তখন জেলে প্রগতিশীল বাংলা সমাজতন্ত্রীদের চোখকান। তাই খুব বেশি মারধোর খাননি। অন্য অনেকেই যখন হাত বা পা বা চোখ হারিয়েছে, না হলে নিদেনপক্ষে হার্টের অসুখ ইত্যাদি বাঁধিয়েছেন তিনি তখন বৃহত্তর বাম আন্দোলনের পরিকল্পনা করতেন। এইভাবেই তিনি সারভাইভ করতে জানেন। অবশ্য এ তাঁকে শিখিয়েছিল তাঁর বাবার জীবন। বাবা রেলের কেরানি। রাজনীতির ধার কাছ দিয়ে যাননি কখনো। ঘুষ নিতেন উদারহস্তে। একদিন ধরাও পড়লেন। চাকরিটা গেল। অবশ্য তার আগে যৌবনের গরমে অমানিশ বাড়ি ছেড়েছিলেন, বিপ্লব হবে এই স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু বাবার জীবন হিসেব করে দেখেছেন অতি লোভই পতনের কারণ। এমনকি জুলিয়াস সিজার না হলেও এটাই সত্যি। তাই তিনি মেপে চলেন। অতএব যখন দেখলেন নিত্যপ্রিয় লাথি খেয়ে গিয়েছে, তিনি সরাসরি চলে গেলেন বীতশোকের চেম্বারে।
অমানিশের গলাটা একটু ভাঙা, খ্যাসখ্যাসে।
- আমি জানি এবারে আমার পালা।
বীতশোক কাগজের মধ্যে থেকে চোখ তুলে তাকালেন। বড় বড় উজ্জ্বল চোখ। চোখের তলায় অত্যধিক বিয়ারের কারণে একটা মাংসল ঢেউ খেলে যায় আজকাল।
- ক্কি করতে চাও?
ক-এর উপরে একটু জোর দিয়েছিলেন বীতশোক।
- আপনার হয়ে কাজ করতে চাই। অশোক, দেবাশিস, অনুপম, তন্ময়রা এখনো ওদের পরের চালগুলো আমাকে বলে। তাছাড়া অবীনদারা পরের প্ল্যানগুলো আলোচনা করে। নিয়তিদি তো এবারেও এম পি। ভালবাসেন। মিটিংগুলোর ব্রিফ পেয়ে যাই। চাইলে আগের থেকেই জানা যায় কি হবে! ওনার তো এখন আবার রাম্বানিদের সঙ্গে বেশ ভাল দহরম মহরম। রাম্বানির বৌ আর উনি একই সমিতি করেন দিল্লিতে। নারী উন্নয়ন সমিতি। সেদিন বলছিলেন মিউচ্যুয়াল ফাণ্ড নিয়ে কি সব বলছিল রাম্বানির বৌ!
তির নিশানায়। বীতশোকের মিউচ্যুয়াল ফাণ্ড আর শেয়ার নিয়ে কারবার আছে। কলকাতার বিয়ার কার্টেলকে তাঁর পছন্দ নয়। মুম্বাই-এর বুলদের সঙ্গে পেলে তাঁর সুবিধে। অমানিশের দিকে সামান্য সময় চেয়ে রইলেন। তারপরে আবার কাগজে মন দিলেন। এর মানে হল কাজটা অমানিশকে করে দেখাতে হবে। করে দেখালেই আর বীতশোকের কিছু বলার নেই। শত্রু বা বন্ধু কোনো অনড় ধারণা না বীতশোকের জীবনে।
তো, এইভাবে সারভাইভ করে গেলেন অমানিশ। এখনো যখন নিত্যপ্রিয় স্বপ্নে তাকে গালাগালি দিচ্ছে তখনো তিনি টিকে আছেন। নিত্যপ্রিয়র তাঁবেদার হতে ইচ্ছে করেনি। কেন না সেক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান হত তাঁবেদারের তাঁবেদারের তাঁবেদার হিসেবে। নিত্যপ্রিয় বাংলা সমাজতন্ত্রী দলের রাজ্য কমিটির তরু দত্তের তাঁবেদার। তরু দত্ত, দলের সম্পাদক অমিয় বিশ্বাসের তাঁবেদার। তাহলে তিনি একটা কাগজ যার মাথায় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর হাত সেটা ছেড়ে এখানে কেন? ওখানে তিনি বীতশোকের পরেই। মানে একই অবস্থান ছিল। এখানে যদি উন্নতি না হয় তাহলে কবে হবে? তাঁর বৃহত্তর বাম প্রকল্পের কী হবে? অতএব তিনি একই পন্থায় সরাসরি ধরেছেন অমিয় বিশ্বাসকে। বীতশোকের মতনই।
- তরু তো আছেনই, আমিও রইলাম আপনার হয়ে। নির্মলদা মেদিনীপুরে কি বলছেন সেটা আমাকে জানায় সুধীর। একটু মারদাঙ্গা করলেও সুধীর ছেলে ভাল। আপনি জেনে যাবেন সরাসরি। জেলা কমিটির কাটছাঁট করা রিপোর্ট ছাড়াও আমি থাকলাম।
নির্মল চ্যালেঞ্জার হিসবে উঠে আসছে দ্রুত। তাঁরা একসঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করতেন। কিন্তু নির্মল মদটা খুব ভাল খেতে পারতো বলে অনেক বেশি কাছের ছিল ছাত্রদের। তিনি খুব মদ খান না। নেশা বলতে একটু নস্যি নেওয়া। তাছাড়া পড়াশোনার বাতিক ছিল তাঁর। তাই বুড়োদের কাছেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ। তাঁদের মেন্টর রণজিৎ দাশগুপ্ত তাঁকে পছন্দও করতেন এই কারণে। রণজিৎ আবার পড়াশোনা খুব কম করেছেন। তাই তাঁর ডাক পড়তো রেফারেন্স-এর জন্য। যদিও রণজিৎ বলতেন রিসার্চ। এই করে করে তিনি নিয়মিত সংগঠন থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। নির্মল সেখানে অনেকটা এগিয়ে ছিল। যে সিদ্ধার্থ মুখ্যমন্ত্রী হয়, সেও ছাত্রনেতা। তবে কাব্যিটাব্যি বেশি করতো। মেয়েমহলে বেশি পপুলার। আর তার এক জ্যাঠা ছিলেন বিপ্লবী কবি সিদ্ধিনাথ মুখার্জী। এই সুবাদেও সে অনেকটাই ফুটেজ বেশি খেত। তিনি যে দলের রাজ্যসম্পাদক হবেন তা খুব একটা স্থির ছিল না। সিদ্ধার্থর আগের মুখ্যমন্ত্রী আলো বসু যাওয়ার আগে এটা করে দিয়েছেন। অনেকটা সাম্রাজ্য ভাগ করার ঢঙে। নির্মল গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। দক্ষিণবঙ্গ আর দিল্লি সে দেখবে। সিদ্ধার্থ শ্যাডো মুখ্যমন্ত্রী। তিনি রাজ্যসম্পাদক। কেউ বেশি ক্ষমতায় নেই। কেউ একা সব চালাতে পারবে না। এই ব্যাক্তির উপরে নির্ভরশীল হলেই মুশকিল হয়। এটা আলো বসু জানতেন।
- তাছাড়া জানেনই আমার সঙ্গে অর্জুনের খুব ভাল সম্পর্ক। ও আমার এলাকাতেই চাকরি করতো। আমি ওখানে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করতাম।
- হ্যাঁ, তুমি তো আবার ভোটেও দাঁড়িয়েছিলে।
- ও আমাকে খুব সাহায্যও করেছে। এখন শান্তির সম্পর্কে খবর ওই দেয়। অথেনটিক।
শান্তি মুখার্জী। সেই আলো বসুর সময় থেকে তাঁদের অশান্তি। এককালে ফেডারেশন করত। তারপরে ফেডারেশন ইন্ডিয়া ছেড়ে এখন নিজের দল করেছে। নাম দিয়েছে বঙ্গ ফেডারেশন। ইদানীং বেশিই জ্বালাচ্ছে। হিন্দু সঙ্ঘের সঙ্গে মিলেজুলে ভোট পায়নি। দিল্লিতে একজন সাংসদ। মানে নিজেই হয়েছে। এই নিয়েই এখানে পড়ে থাকছ আর অশান্তি। আজ এই মিছিল কাল ওই মিছিল। অ্যাম্বিশন হচ্ছে পুলিশের হাতে মার খাওয়া। ওইটাই ইউ এস পি। তারপরে নানা যাত্রাপালা।
- নাল্লাকুল্লা প্রকাশমকে আমি চিনতাম জেলের সময়েই। ওদের এখনকার সেন্ট্রাল কমিটিতে আমার দুজন আছে চেনা- মানে, ও ছাড়াও-
- এইটা গোয়েন্দারা বলেছে আমাদের।
- জানি। কিন্তু আমি সাংবাদিক দাদা। খবর রাখাই তো কাজ।
- হ্যাঁ, সেই জন্যে এখনো...
- আমার খবর কিন্তু একদম অথেনটিক। ওরা সুন্দরবন কমিটি করেছে।
এইগুলো নতুন উপসর্গ। মাও-এর নামে আবার শুরু করেছে উপদ্রব।
- ঠিক আছে। তুমি আমাকে ডাইরেক্ট রিপোর্ট করবে।
অমানিশ কিন্তু নিষ্ঠ মানুষ। যতকাল অমিয় বেঁচে ছিল ততকাল অমানিশ কাজ দিয়ে গিয়েছেন। অমিয়র অকাল মৃত্যুর পরে অমানিশ নির্মলের দলে। তিনি যে সারভাইভার। নিত্যপ্রিয় খিস্তি করছিল স্বপ্নে যদিও।
- ওই শুয়োরের বাচ্চা প্রতিদিন অফিস আসবে, ঘুমোবে, আর ঘোঁট পাকাবে। তরু তোকে বলে রাখছি, এইটার আমি কোনদিন বিচি টিপে ধরবো।
- আহ্!
- না না...
- থাম।
থেমে যায় নিত্যপ্রিয়। তরু তার কলেজের বন্ধু। কিন্তু অবস্থানের ফারাক আছে। তরু অমিয়র হাতে তৈরি ছেলে। অমিয় আর সিদ্ধার্থের মধ্যেকার যোগসূত্র। যখন সিদ্ধার্থ পার্টি ছাড়ে তখন সেই গিয়েছিল দিনের পর দিন সিদ্ধার্থের বাড়িতে। সিদ্ধার্থের আদ্ধেক ঘ্যাঁট তত্ত্বগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা মন দিয়ে শুনতো। মতামত দিত। সত্যিই দলে নতুন দিশা চাই। সিদ্ধার্থই পারে একমাত্র দলকে সততার সঙ্গে চালাতে। অমিয়দা কালকেও এটাই বলেছে। সিদ্ধার্থর সাদা পাঞ্জাবী বাতাসে ওড়ে। সাদা চুলও। ফ্যানের হাওয়ায় সিদ্ধার্থর মুখে খেলা করে আলো ছায়া। চেয়ারটা একটু হেলিয়ে শোয় সিদ্ধার্থ। কমরেড মাও ইয়েনান ফোরামে যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিপ্লব এনেছিল দলিলের মাধ্যমে সেটা সেও আনতে পারে। কিন্তু আলো বসু শুনবে না। দিল্লির উল্লুরি প্রকাশম শুনবে না। কি করে যে নীরা ওকে বিয়ে করলো। কাল রাতেও নীরা ফোন করেছিল। আধো মৃদু উচ্চারণে কত কথা বললো। গলাটা সেই বাষট্টির কনফারেন্সের মতই রয়ে গিয়েছে। সেবারে দুজনেই কেরালার ব্যাকওয়াটারে এক চাঁদনী রাতে, আহা...
সিদ্ধার্থকে আবার মন্ত্রীত্বে ফিরিয়ে এনেছিল তরুই। পেছনে ছিল অমিয় বিশ্বাস। এক ঢিলে দুই পাখি। অমিয়র হিসেব এটা। সিদ্ধার্থ মুখ্যমন্ত্রী হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না। হলে অমিয়র উপকার ভুলতে পারবে না। এমনিতে সংগঠন এখন অমিয়র ইশারায় চলে। সব নানান মাপের নেতাদের জন্য ফাইল তৈরী করা আছে। ট্যাঁ-ফো করলে ‘সুখবাজার’ কি ‘ইদানীং’ পত্রিকায় বেরিয়ে যাবে। ‘ইদানীং’ এর সম্পাদক আবার এক সময় বিপ্লবী বাংলা দল করতো। সেই সময় থেকে তাঁদের সখ্য। এক সময় যখন পার্টির প্রেস ছিল না, অন্যান্য প্রেস বন্ধ করে দিচ্ছিল ছাপা তখন ‘ইদানীং’-এর ছাপাখানা থেকে তাঁর উদ্যোগেই ছাপা হয়েছে পত্রিকা। যদিও আলো বসুর সঙ্গে আবার ‘ইদানীং’ সম্পাদক অরুণ সেনগুপ্ত-র আদায়-কাঁচকলায় ছিল। অমিয় এই সব খেলা যা যা জানতেন সব হাতে ধরে শিখিয়েছেন তরুকে।
তরু শিখেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সে। সেখান থেকে ছাত্ররাজনীতিতে আসা। এবং অমিয়র তাকে তুলে নেওয়া পার্টির প্রচারের সেল-এ। অমিয় দেখেই তুলেছিল। অমিয় নিজে পাঁচ ফুট টায়েটায়ে। নস্যি নেওয়ার অভ্যাস, বাঙাল বচন তাঁকে জনপ্রিয় নেতা হতে দেয়নি। পার্টি মিটিং করে বলেছিল অমিয়র বক্তৃতার ঢঙ ভাল না। তার সঙ্গে উচ্চারণ নিয়ে সমস্যা আছে। কাজেই জনসভায় তুর্কী বক্তা সে হবে না। এবং মাঠেঘাটে তাকে কৃষক বা শ্রমিক ফ্রন্টে কাজ করতে দেওয়ার মানে হল তার ক্ষমতার অপচয়। তার পড়াশোনাকে কাজে লাগাতে হবে। অমিয় জানতেন এর সরাসরি একটাই মানে। তিনি কোনোদিন দলের প্রথম সারির নেতা হলেও মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। এই রাজ্যের ধারা মেনে মুখ্যমন্ত্রী সেই হবে যে বাঙালি ভদ্রলোকের ধারণার সঙ্গে খাপ খায়। তাঁর গ্রাম্যতা এখানে তাঁর সবচেয়ে নেগেটিভ গুণ।
তিনি মেপে মেপে চলেছেন। দলের মাথায় আসতে তাঁকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি। সেই পথে আসতে আসতেই নিজের জন্য একটা কমিটেড স্কোয়াড বানিয়েছেন। তরুও তাঁর মত। শিক্ষাগত যোগ্যতা যাই থাক, তরু অস্বাভাবিক মোটা। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মনে হয় তাকে। অত মোটা লোক একটা সমাজতন্ত্রী দলের নেতা হতে পারে না। তরুর ছাত্রবেলার বন্ধুরা বলতো তুই ভাই বক্তৃতা দিস না। ছেলেমেয়েরা বলবে সমাজতন্ত্রের সব খাবার এ শালা একাই খেয়ে নিচ্ছে, কিসের সমাজতন্ত্র হবে মামা? তরুর জননেতা হওয়ার স্বপ্নের ওখানেই ইতি। অমিয় এটা দেখেই নিয়েছেন তরুকে স্কোয়াডে। তরুর উচ্চাকাঙ্খা থাকবে, কিন্তু নিজের সামর্থ্য সম্পর্কেও ধারণা থাকায় তাতে কাটাকুটি হয়ে যাবে। তাঁর সঙ্গে তরু বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
এই একই পাঠশালার পাঠ কাজে লাগিয়েছে তরুও। সে নিত্যকে নিয়েছে। নিত্য তার কলেজ জীবনের বন্ধু। একসঙ্গে কিছুদিন পড়েছে। তখন নিত্য নাটক করে। আর নকশালবাড়ির শেষ বেলাতে যে বিপ্লব বিপ্লব খেলা তখনো চলছিল তাতে আঁচ নিয়েছে ক’দিন। তবে বেশিদিন না। একদিন রাত্রে ফেরার পথে ফেডারেশনের গুন্ডারা একটা মাল ঠেকিয়েছিল রগের কাছে।
- শুয়োরের বাচ্চা, আমরা হলাম ফেডারেশন জানিস?
তখন দেশে সামরিক শাসন। ফেডারেশনের নেত্রী নলিনী দেবী তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে সামরিক বাহিনীর প্রধানসমস্ত কিছু। রাষ্ট্রপতির নামে তিনিই দেশ চালাচ্ছেন। একদল বলে ট্রেন ঠিক টাইমে চলছে। দ্যাখ শালা কেমন কাজ করতে হয়! এবার বাবা হুঁ হুঁ উন্নতি আটকায় কে! অন্যদল বলে ফিসফিস করে- প্রতিদিন পাড়ার ছেলেগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে-বৌ কালো গাড়ি তুলে নিয়ে গেলে তারা ফিরে এলে ঘরের মধ্যে সেপ্টিপন পড়লেও আতঙ্কে নীল হয়ে যায়। অনেকেই আর ফিরে আসার পর থেকে চলতে পারে না। নিম্নাঙ্গ অসাড় তাদের। কেউ কেউ ফেরেও না। এমন একটা সময় তখন।
- ভাল করে বোঝ্! আমাদের নেত্রী এশিয়ার ধাত্রী। ফেডারেশন চাইলে তুই ফেড আউট হয়ে যাবি এক্ষুণি। আর কোনো ফেড ইন নেই।
শিশিরদার গলা এটা নির্ঘাত। শিশিরদা টালিগঞ্জের সিনেমা পাড়ায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেকটরের কাজ করতো। এখন নিজেই সিনেমা বানায়। সে নিজেও অ্যাকশনে এই গুণ্ডাগুলোর সঙ্গে? ঘাড় ঘোরাতে সাহস হয়নি নিত্যর। বরং আস্তে আস্তে প্যান্টের সামনেটা ভিজে গেছিল। তারপরে একজন প্যান্টটা খুলিয়ে দিয়েছিল তার। বলেছিল পাঁচশো গুণবি, তারপর বাড়ি যাবি। পাড়ার মোড়ে তখনো টিমটিমে ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলছিল। আশেপাশের বাড়ির জানলাগুলো অল্প অল্প খোলা। ফাঁক দিয়ে সবাই দেখছে। মিনতি বৌদি, রুবী, শিপ্রা, প্রলয়দার বৌ সকলেই। নিত্য গরমের দিন বলে প্যান্টের নীচে কোনো জাঙ্গিয়া পড়েনি। চোখ বন্ধ করে গুণেছিল পাঁচশো। তারপর প্যান্ট টেনে নিয়ে দৌড়েছিল। না, বাড়ির দিকে না। সোজা ট্রাম ধরে মামাবাড়ি ভবানীপুরে। সেখান থেকে হাওড়া পরেরদিন। হাওড়া থেকে আন্দুল পিসির বাড়িতে। বাড়ির লোককে সেজ মামা জানিয়ে দিয়েছিল। আন্দুল থেকে হাওড়া নরসিংহ কলেজে পড়া। সেখানে তরুর সঙ্গে আলাপ।
এর অনেক পরে যখন বীতশোক কাগজের কাটতি বাড়াতে নকশালদের মুক্তি নিয়ে প্রতিদিন লিখবে তখন সে ভরসা করে তরুকে জানিয়েছিল সেও নকশাল ছিল একদিন। তরু তার দিকে চোখ সরু করে চেয়েছিল। কিছু বলেনি। সে তখন পার্টির নির্বাচন সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সঙ্গে হাওড়াটাও দেখে।পার্টি যখন কাগজ ছাড়াও বন্ধু চ্যানেল করার সিদ্ধান্ত নিল তখন তরু নিত্যকে ডেকেছিল। নিত্য ততদিনে প্রাক্তন নকশাল খেতাব প্রাপ্ত ও সিনেমা পাড়ায় বিপ্লবী বাণী দেয়। লোকে মুখ টিপে হাসে। মাঝেমধ্যে তরুর কল্যাণেই গ্রামের স্বাস্থ্য ও পায়খানা নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় সাংবাদিকতার পাশাপাশিই।সেই নিত্য অমানিশের স্বপ্নে খিস্তি করে।
-তুই ওকে সামলা নইলে ও শুয়োরের বাচ্চার পোঁদে আমি বাংলা ঢেলে দেব।
- নিত্য, নিজেকে সামলা। প্রত্যেকবার তোর জন্য আমি পার্টির কথা শুনবো না বাল।
ব্যাস। নিত্য এবারে চুপ। তরু ‘বাল’ বলেছে মানে খুব খচেছে। আরো কিছু বলতো, কিন্তু তরুর ফোন বেজে ওঠে। তারস্বরে ফোন বাজে। তরু ধরতে যায়। ফোনটা পকেট থেকে বেরিয়ে হাওয়ায় নাচতে থাকে। তরু উঠেছে, নিত্যপ্রিয় উঠেছে। কেউ ধরতে পারছে না। দুজনেই লাফাচ্ছে প্রাণপণ। তরুর ওজন এখন একাশি কিলো, নিত্য নব্বই। আর দু বার লাফালেই নিত্য পায়ের উপরে ভেঙে পড়বে। অমানিশ অপেক্ষা করছে। ফোন ধরতে ওকে লাফাতেই হবে। নে লাফা, লাফা...
- ও অমানিশদা...
একটু জোর ধাক্কা। হড়বড় করে চোখ খোলে অমানিশ। সামনে প্রদীপ। তার একনিষ্ঠ স্তাবক এখানে। ওর দাদাও আছে এখন স্টেট কমিটিতে।
- প্রদীপ, প্রদীপ বলুন বলুন...
- নির্মলদা আপনাকে না পেয়ে আমাকে ফোন করেছে বস! হেব্বি সিরিয়াস।
তার মানে ঘুমের মধ্যে ফোনটা তার ছিল। সে ধরেনি।
- সিরিয়াস কেন?
- আরে ‘খবর কলকাতা’ দেখুন।
অমানিশ ঘুরে তাকায়। তার মাথার পেছনে সারি সারি টেলিভিশন সেট। একেকটাতে একেক চ্যানেল। ‘খবর কলকাতা’ দেখাচ্ছে ভাঙ্গুরে পুলিশ, র্যাফ। লাঠি চালাচ্ছে। ওই, ওই গুলি চললো আকাশে। এই রে, একী? অপারেশন হবে জানা ছিল। কিন্তু এখন দেখাচ্ছে কেন? সকলকেই তো বলা আছে। কারোর তো দেখানোর কথা না। তার ওপরে ‘খবর কলকাতা’ কেন? এতো সিদ্ধার্থের পোষ্যদের চ্যানেল।
গত কয়েকবছর ধরে অমিতাভ, অনুরাগ আর জয়ন্তকে সিদ্ধার্থ পুষছে। সেই ১৯৯২ থেকে। একটা ছোট্ট কম্পিউটার কোম্পানি। তিনজনের। তারপরে সেখান থেকে চায়নায় মাল আনার অনুমতি মেলা। কোম্পানি বাড়া। জমি, ব্যাঙ্ক লোন সব সিদ্ধার্থের দয়ায়। তারা চালাচ্ছিল মাত্র। এই কদিন হল সব আলাদা আলাদা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই এত দূর? চোখে ওষুধ এখন আর নেই, অমানিশ ঝাপসা দেখছে না। এ কি সত্যি?
- নির্মলদা লাইনে।
ঘুরে ফোনটা ধরে। একটু হাত কাঁপে কি তার?
- এটা কী করে হয় অমানিশ? কী করে হয়?
- আমি জানি না নির্মলদা। কালকেও আমার আশিষের সঙ্গে কথা হয়েছে। চালাবে না বলেছিল। ক্লিয়ার ইন্সট্রাকশান ছিল।
- তাহলে ভায়োলেট হয় কী করে?
- আমি তো...
- এক্ষুণি বন্ধ করতে বল।
টাঁয় টাঁয়... ফোন কেটে যায়। অমানিশ চোখে চশমা দিয়ে মোবাইলে নাম্বার খোঁজে আশিষের। এই মোবাইল ব্যাপারটা এখনো রপ্ত হয়নি অমানিশের। এখনই বন্ধ না হলে...
আবার টিভির দিকে তাকায়। পুলিশ ছাদের ওপরে উঠেছে গ্রামের বাড়িতে। ওই তো লাঠি চালাচ্ছে। তিনজন পুলিশ, মারছে একজনকে। ভাঙ্গুরের পঞ্চায়েত অফিসে ধর্ণা হবে, ভাঙচুড় হবে। তাই পুলিশ সেখানে লাঠি চালাবে। এই ছিল কথা। তার বদলে তো দেখিয়েই দিচ্ছে ভাঙ্গুরের গ্রামে ঢুকে পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে, গুলি করছে আকাশে। কোনো ধর্ণা হয়নি। অথচ...
(চলবে)
এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে কারোর সঙ্গে মিল থাকলে সে নেহাতই কাকতালীয়।