(২)
ভাঙ্গুর থেকে ফিডটা যখন এসেছে তখন রেকর্ডিং-ই এসেছিল। শৈবাল প্রথম দেখেছিল। হুগলী জেলার সাংবাদিক পতিতপাবন ধাড়া তাকে ফোন করেছিল। তাকে ঠিক নয়। ফোনটা করছিল ডেস্ক-এ। সকালে ডেস্ক-এর যারা একটু আধটু সিনিয়ার সাব-এডিটার তারা থাকে না। খবরের দুনিয়াটা শুরুই হয় আসলে দুপুর একটা থেকে। বারোটা নাগাদ রাইটার্স-এ কোনো না কোনো সাংবাদিক বৈঠক থাকে। সেখান থেকে খবর আসতে আসতে শুরু হয় রাজ্যের কাজ কারবার। ততক্ষণে সাব-এডিটার, এডিটার সব এসে গিয়েছেন। এবারে বৈঠক হবে। কোন খবর বিশেষ করে যাবে না যাবে তার খসড়া হবে। মধ্যে তেমন কিছু ঘটতে থাকলে দিনটা একটু পাল্টে যায়। তখন দিনটা শুরু হয় তাড়াতাড়ি।
শৈবাল জুনিয়ার। সবে দু বছর হল। পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়েই চাকরিটা পেয়ে গিয়েছে। তপনদার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলেই সহজ হয়েছে। শৈবালের গৃহশিক্ষক ছিল তপনদা। এখন সুখবাজারের সাংবাদিক। এখানে পলাশদার সঙ্গে যোগাযোগ করায় তপনদাই। কাজটা সে মোটামুটি বুঝে নিয়েছে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস কম্যুনিকেশন বা জার্নালিজম কোর্সের কোনো ধ্যানধারণাই তার কাজে লাগেনি। এবং যত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে পেরেছে তত সে কাজটা তুলে নিতে পেরেছে। সকাল আটটার শিফট-এ আসে বর্ধমান থেকে। ভোরের গাড়ি ধরে চলে আসে, মাঝ সন্ধের ট্রেনে ফেরত যায়। চার হাজার টাকা মাইনেতে এর বেশি কিছু করা যায় না। কলকাতায় একটা ভদ্র ঘর ভাড়া নিয়ে থাকা খাওয়া চালিয়ে সম্ভব হয় না।
ডেস্কে ফোনটা বাজতেই সে ধরেছিল। জেলা সাংবাদিকরা এমনিতেই কলকাতার সাংবাদিকদের একটু এড়িয়েই চলে। নিতান্ত দরকার না হলে তাদের সঙ্গে ব্যাক্তিগত সম্পর্ক গড়ে না। কলকাতায় যারা কাজ করে তাদের নাক উঁচু বিষয় তো আছেই, সঙ্গে আছে একটা অবিশ্বাস। এই সব অফিসগুলোয় চোখের পলক ফেলার আগেই শত্রু-মিত্র পাল্টে যায়। একটা দু শো জনের অফিস হলে সেখানে অন্তত ছটা বড় গ্রুপ আর ছত্রিশটা সাব গ্রুপ থাকবেই। কে আজকে কোথায় আর কাল কোথায় যাবে এ কেউই জানে না! সুতরাং যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। তাছাড়া ফোন করলেই বা ধরছে কে? বাবুদের মেজাজই আলাদা। কলকাতার সাংবাদিক সব, চাট্টিখানি ব্যাপার? তাই ফোনটা ডেস্কেই করে তারা।
ঘুম ভেঙে উঠতে বাবুদের দেরি হয়। বহু রাত অব্দি প্রেস ক্লাব বা অলি পাবে মদ, তারপরে বাড়ি ফিরে অর্কুট, ফেসবুক- এ সব সেরে ঘুমোতে যেতে যেতে চারটে। সকাল দশটা মানে তো মাঝরাত্রি বাবুদের। বিশেষ করে তরুণ যারা তাদের। যাদের বয়স হয়ে গিয়েছে তারা হয় ঘুমের অভাবে ভোগে নয় তাড়াতাড়ি, মানে অন্তত বারোটায় শুয়ে পড়ে। তারাই থাকে গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে। সুতরাং দেরিতে আসা ও তাড়াতাড়ি বেরোনো তাদের অধিকারও বটে। যদিও শৈবাল পায় চার আর তারা পায় অন্তত চল্লিশ হাজার। এর মধ্যিখানে আছে জেলা সাংবাদিক। সে যদি প্রধান হয় তাহলে দশ-বারো আর যদি প্রধানের অধীনে কাজ করে তাহলে যে মাসে যেমন। সোজা কথায় তিন থেকে বড় জোর চার। অতএব দশ হাজার ফোন করে চার হাজার ধরে।
ফুটেজটা চালিয়ে দেখলো শৈবাল। ফিডটা মেশিনে দিয়ে দিয়েছে। পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে। গুলি! এই ফিড চালানো? শৈবালের দু বছর হয়ে গিয়েছে। সে জানে যা আসে তাই খবর না। খবর হল যা তার মধ্যে থেকে নির্বাচিত হবে তা। সেই নির্বাচন হবে চ্যানেলের পলিসি অনুযায়ী। চ্যানেলের পলিসি মানে মালিকের পলিসি। সুতরাং এই ফিড দেখালে তার চাকরি যাবে। শুধু চাকরি না, সঙ্গে আরো কিছু-ও যেতে পারে। বাপ্ রে! সে ফিডটা দেখেই ফোন করলো সমরদাকে। সমরদা তাদের ডেস্ক ইন চার্জ।
সমরদা তখন বাজারে। বাজারে দাঁড়িয়েই শুনলো। বললো ফোন করছে। অতএব শৈবালের দায়িত্ব খালাস। ফোন নামিয়ে সে মন দিল সানিয়া মির্জার দিকে। সানিয়া একটা হেলথ ড্রিঙ্ক-এর বিজ্ঞাপন করেছে। তার শ্যুটের ফুটেজ তার সামনের মেশিনে। কলকাতায় কাল রাতে ক্যাম্পেন-এ এসেছিল। তার ইন্টারভিউ। সানিয়া পেলে শৈবালের চোখ আর অন্য কোথাও যায় না। একটা ড্রপ শট নিতে ওই সানিয়া উড়ছে আকাশে। সানিয়ার মুখের থেকে চোখটা তার স্লিপ করে যায়। বুকের দিকে। বুকটা লাফাচ্ছে। টেনিস বলটার মতনই, কিন্তু সাইজে অনেকটা বড়। শৈবাল বাড়ি থাকলে এই সময়ে একবার ইচ্ছে হত বাথরুমে যাবার। এটা অফিস- কঠিন, কঠোর। বাড়িতে বাথরুমে, একান্তে...!
সমরদা ফোন করেছিল স্বপনদাকে। স্বপনদা তাদের কন্টেন্ট এডিটার। স্বপনদা আর আশীষদার মধ্যে আদায়-কাঁচকলায়। আশীষদা তাদের ইনপুট এডিটার। এই সময়ে ফোনটা করার কথা আশীষদাকে। কিন্তু সমরদা আশীষদাকে ফোন করবে না। সমরদা স্বপনদার লবির। স্বপন অল্প কথার মানুষ এমনিতে। সমর যখন ফোন করেছিল তখন সে ছিল বাথরুমে। বৌ ফোনটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওয়েস্টার্ণ স্টাইল প্যানে বসে একটা কোঁত পারতে পারতে আর শব্দটাকে গলায় আটকে রাখতে রাখতে শুনেছিল স্বপন। কাল রাতে মাংসটা বেশি ঝাল ছিল রণির বাড়িতে। মদটা রাম হলে নেমে যেত, কিন্তু এই হচ্ছে হুইস্কির সমস্যা। আটকে দিয়েছে। লাঠি চলেছে, গুলিও। ভাঙ্গরের এই খবরটা করার কথা না তাদের সেও জানে। কিন্তু এটা একটা সুযোগ। আশীষ লবি করছে। অমানিশের সঙ্গে লবি করে আশীষ চেষ্টা করছে‘বার্তা’য় চলে যেতে। বার্তাতে মাইনে খুব ভাল না হলেও চ্যানেলটা চলবে। মাইনে হবে নিয়মিত। অন্তত যদ্দিন বাংলা সমাজতন্ত্রীদের দাপট আর টাকা ফুরোচ্ছে। সে হতে এখন অনেক দেরি। অথচ তাদের মাইনে নিয়ে চব্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। গত মাসেই মাইনের তারিখ গড়াতে গড়াতে ঠেকেছিল আঠাশ-এ।
সেটাই স্বাভাবিক। অমিতাভর নিজের ব্যবসা যে কী সে বোধহয় সে নিজেও জানে না। এতদিন এক সঙ্গে ব্যবসা করেছে। ব্যবসা নিয়ে সে খুব মাথা ঘামায়নি। এককালে সেই সবচেয়ে বেশি টাকা ঢেলেছিল ব্যবসায়। তার বৌ-এর বাড়ি ছোটখাট শিল্পপতির বাড়ি। একদিকে এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট অন্যদিকে বিস্কুট ফ্যাক্টারি। অতএব শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেকটাই মূলধন জুটেছিল। চীনের অর্ডারটা ধরার আগে তারা যখন জমি কিনছিল কারখানার জন্য, যেখানে অ্যাসেম্বলি লাইন করবে সেই সময় সে অনেকটাই ঢেলেছিল। ব্যাঙ্ক লোন পেতে সুবিধেও হয়েছিল তাই। সেই দিয়েই চলছিল। এবারে হাঁড়ি আলাদা হয়েছে। চ্যানেল ছাড়া তার আর কোনো ব্যবসা নেই। চ্যানেলের আয় অত্যন্ত কম। প্রথমত কলকাতার বাজারে ব্যবসা করার জন্য যতগুলো চ্যানেল এখন আছে তত স্থানীয় ব্যবসা নেই। বাংলাদেশের বাজার খুলবে বলে একদিন হাওয়া গরম হয়ে উঠেছিল। তখনই এই চ্যানেল ব্যবসার রমরমা। সেটা খুললে এই বাজারটা একটা বিপুল বাজার হয়ে দাঁড়াবে। বাঙালির সংখ্যা দুই বাংলা মেলালে খুব কম না। কিন্তু সে গুড়ে বালি পরেই আছে।
এখন যাদের জাতীয় স্তরে কোনো অস্তিত্ব আছে তারাই টিকবে শুধু। যেমন সুখবাজার যে চ্যানেলটা করেছে প্ল্যানেট নিউজ-এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে সেটার সুবিধে। নাম দিয়েছে প্ল্যানেট সুখ। সুখবাজারের নিজের জাতীয় অস্তিত্ব আছে ইংরেজী দৈনিকের জন্য। প্ল্যানেট নিউজ আন্তর্জাতিক খবরের প্রায় চল্লিশ শতাংশ মিডিয়ার মালিক। এদের পক্ষে সহজ বিজ্ঞাপন পাওয়া।একজন বিজ্ঞাপনদাতাকে এরা একসঙ্গে প্যাকেজে দুটো চ্যানেল তিনটে প্রিন্ট অফার করে দিচ্ছে। অন্যান্য চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ বেশি রেট হলেও সামর্থ্যবান বিজ্ঞাপনদাতার কাছে এটা লাভ। স্বপন জানে যে তাদের চ্যানেলে এই সব বিজ্ঞাপনদাতারা দেবে না বিজ্ঞাপন। তাহলে কোন বাজারটা দিয়ে কাজ চলবে? মাইনে হবে কি করে? এর সঙ্গে সঙ্গেই আছে অপদার্থ ওই সৌমিত্র ব্যানার্জীটা। রাত আটটার থেকে মদে চুর, সারাদিন কাজ শুধু মেয়েদের শোয়ার জন্য পটিয়ে বেরানো, আর না পেলে নিজের মার্কেটিং টিমের কারো না কারো সঙ্গে শোওয়া। সে হল তাদের বিজ্ঞাপন অধিকর্তা। বেশ ক’টা খবরের কাগজ ও চ্যানেলে লাথ খেয়ে এখানে এসেছে। কাজ হল অমিতাভকে মেয়ে মডেল সাপ্লাই দেওয়া। তাই তাদের মাইনে হয় না। কোনো রকম চলছে।
এর মধ্যে আছে চ্যানেলের পলিসি। গোটা দেশ জুড়ে এত এত চ্যানেলের মধ্যে একটা চ্যানেল আমি কেন দেখবো এই প্রশ্নটাই তো সবার আগে করা দরকার! এর নিজস্বতা কী আছে? স্বপন এক সময়ে কাজ করতো কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে। সোজা সহজ নীতি ছিল তাঁর। তিনি কম পুঁজির পত্রিকা চালান। তাঁকে তাঁর পত্রিকার অবস্থানের জন্য বড় বড় টাকাওলারা টাকা দেবে না। মানে বিজ্ঞাপন দেবে না। দিলে তিনি তাদের বিরুদ্ধে খবর করতে পারবেন না। একমাত্র ছোট বিজ্ঞাপন, মাঝারি বিজ্ঞাপন তাঁকে টিকিয়ে রাখতে পারে। তারা সত্যি সত্যি কাগজের সার্কুলেশন বুঝে বিজ্ঞাপন দেবে। বেশিরভাগ আসবে সরাসরি, এজেন্সি খুব কম দেবে। সার্কুলেশন বাড়ানোর জন্য ডিস্ট্রিবিউটার চাই। আটকে দিচ্ছে সুখবাজার। তাহলেও রাস্তা আছে। খবরকে যতটা সম্ভব সাধারণ মানুষের জন্য করতে হবে। সাধারণ মানুষ কি জানতে চান, কি বুঝতে চান তা মাথায় রেখে স্বচ্ছভাবে সেই খবরটা দিতে হবে। ধরা যাক বাজারে খাবারের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে অমিতাভ বচ্চন আসছে শহরে স্টার নাইট করতে। সেদিনের পাতাটা সাজাতে হবে। সাধারণ মানুষ হলে গিয়ে থুবড়ে দেখে অমিতাভ কেমন করে দুশমনের নাকটা মেরে ফাটিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং এই নাইটের দিকে তার টান থাকবে। পকেটের পয়সায় টিকিট কেটে সে দেখতে পারবে না। সে খবরের কাগজ খুলে সেই নাইটের কথা জানতে চাইবে। কিন্তু তাতে কি তার পেটের জ্বালা মিটবে?
যে সময় কৃষ্ণকিশোর কাগজ করতেন তখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় চাকরি ছিল সরকারি চাকরি। বাজার খুলে যাওয়ার গল্পটা তখনো শুরু হয়নি। খবরের কাগজ পড়ে সেই সরকারি চাকুরে, মাস্টার, অধ্যাপক এই সব লোকেরা। ব্যাস্ত যারা তারা এমনিতেও পড়ে না। পড়ে যারা তারা একটু কম ব্যাস্ত। ব্যাতিক্রম নিয়ে ভেবে লাভ নেই। এখন যারা পড়ছে তারা কি জানতে চাইছে সেটা বুঝতে হবে। এরা অমিতাভর নাইট নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাচ্ছে না। যারা ঘামাবে, সেই নিম্নবিত্ত অংশ কাগজ কিনে পড়ে না, বেশিরভাগ পড়তেই জানে না। আবার মধ্যবিত্ত এবং একটু নিরাপত্তাপ্রাপ্তরা এই পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনীতি সচেতন বলেই ভাবতে ভালবাসেন। কিন্তু তাঁদের রাজনীতি সচেতনতা বহু ক্ষেত্রেই ইষ্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থকদের মত। অর্থাৎ অন্ধ! এবারে যে সব রাজনৈতিক দলের নিজেদের কাগজ আছে তাদের সমর্থকরা সেটা পড়েই তৃপ্ত। ক্বচিৎ-কদাচিত অন্য কাগজে চোখ বোলাবে।
তাহলে তাদের কাগজ পড়বে কারা সেটা এবারে জানতে হবে। কৃষ্ণকিশোর বলতেন, এই দলাদলির বাইরেও একটা অংশের মানুষ এই মধ্যবিত্তদের মধ্যে আছে। যারা হয় কখনো দল করেননি, ব্যাপারটার রকমসকম দেখে বীতশ্রদ্ধ অথবা দলের মধ্যে ছিলেন, কাণ্ডকারখানা দেখে বেরিয়ে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার বিচারে এই সংখ্যাটা নেহাত কম না। আরেকদল যারা সব কটা সংসদীয় দলকেই সমান অপদার্থ বলে মনে করে তারাও আছে এই জনসংখ্যায়। তাহলে পাতা যখন সাজানো হবে তখন মাথায় রাখতে হবে এদের কথা। এদের কথা বলার এবং শোনার কেউ নেই। সেই শূন্যস্থানটাই পূরণ করার কাজ করতে হবে। প্রথমে শহরে এদের ধরতে হবে। শহরের বাজারে সুখবাজার শুধু টাকা ছড়িয়ে লাভ করতে পারবে না। তাদের ছাপা কপিই হল পঞ্চাশ হাজার। কাজেই ঠিক বেরিয়ে যাবে। তারপরে শহরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে আস্তে আস্তে ঢুকতে হবে গ্রামে। শিয়ালদা আর হাওড়া লাইন ধরে গ্রামের দিকে যাওয়া হবে।
স্বপন তখন তরুণ ছিল। এ সব শুনেছে, খুব যে বুঝেছে এমন না। কিন্তু সত্যি সত্যি দেখা গেল এই সব লোকগুলো পড়ছে তাদের কাগজ। তারা অমিতাভ নাইটের বদলে খাবারের দাম কেন বাড়ছে তা নিয়ে যতটা গভীরে যাওয়া সম্ভব খবরের কাগজে ততটা গিয়েই খবর করতো। খবরের পাঠকের দুনিয়া কলকাতা শহরে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করলো। সুখবাজার অমিতাভ নাইটে জোর বেশি দিত। আরেকটা কাগজ ছিল ‘দিনকাল’ বলে। তারা বাংলা সমাজতন্ত্রীদের, বিশেষ করে আলো বসুর কুকীর্তি নিয়েই মত্ত থাকতো। পরের পর তদন্তমূলক সাংবাদিকতা তাদের ব্যানার হেডলাইন হত। সেটা আর সুখবাজার পড়তো ফেডারেশনের সমর্থকরা। বাংলা সমাজতন্ত্রীদের নিজেদের দলীয় মুখপত্র ‘লোকশক্তি’ পড়তো পার্টি মেম্বার আর সমর্থকরা। উত্তেজিত তর্ক-বিতর্ক এক সময় থামলে তখন শোনা যেত ‘সমকালীন’-এর পাঠকদের গলা। কী হয়েছে, কেন হয়েছে, কী হবের ব্যাখ্যা নিয়ে তারা হাজির! কাগজ বাড়ছিল। বাড়ছিল বলে ছোট আর মাঝারি বিজ্ঞাপন আসছিল নিয়মিত। দেরী হত মাইনেতে বিজ্ঞাপনদাতা আর পাঠকের টাকা আদায় করতে লোক কম ছিল বলে। বেশি ছিল না মাইনে। কিন্তু স্বপনের মনে হত একটা কাগজ করছে যার একটা জায়গা আছে। পাড়ার সাধারণ লোকেরা, সে যে দলের সমর্থকই হোক, স্বপনকে বলতো কাগজটা কিন্তু খবরটা করে। সরাসরি যারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে জড়িয়ে তারা অবশ্য চুপ থাকতো, কিন্তু তারাও চেষ্টা করতো ‘সমকালীন’ কী লিখেছে জেনে তবে কথা বলতে চায়ের দোকানে। সে সব ভেঙে দিয়েছিল বীতশোক। তার আগে অব্দি স্বপন বুঝেছিল একে বলে সম্পাদকীয় নীতি। আর অমিতাভ, শালা শ্বশুরবাড়ির পয়সায় মদ-মেয়েবাজি করে, গদার-ত্রুফো আওড়ে চ্যানেল পলিসি বানাবে? কিম্বা অনুরাগ বা জয়ন্ত ওই সব চিটিংবাজী করে বানাবে পলিসি?
মাইনে হচ্ছে না ঠিকমত এটা তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বুঝতেও পারছে যে মাইনে কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে একেবারে এইভাবে চললে। সে ‘সমকালীন’ ছেড়ে একদিন গিয়েছে ‘অপূর্ব বাংলা’তে। চার মাস চলেছিল কাগজটা। তারপরে চিট ফাণ্ডের কাগজ ড্রিম-ল্যান্ড। সেটা উঠিয়ে দিয়েছিল বাংলা সমাজতন্ত্রীরা। একে তো চিট ফাণ্ড, তার উপরে বাংলা সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল মালিক। কোনো এক মন্ত্রীর সঙ্গে হোটেলে কথা কাটাকাটি দিয়ে শুরু, শেষে মালিকের জেলে রহস্যময় আত্মহত্যা। ‘সুখবাজার’ তাকে নেবে না কোনোদিন, সে কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে ছিল বলে। ‘বার্তা’ নিতে পারতো। কিন্তু আশীষ কাঠি করে রেখেছে। অমানিশকে বলেছে স্বপন হল বঙ্গ ফেডারেশনের লোক। শুধু অমানিশকে বললেও স্বপন একবার চেষ্টা করে দেখতে পারতো। কিন্ত নির্মল থেকে সিদ্ধার্থ সবার কাছেই খবর দিয়েছে। তরু দত্তকেও জানিয়েছে।
ন্যাড়টা যখন শেষমেশ কমোডে পরলো তখন স্বপন তার খেলা সাজিয়ে নিয়েছে। সমরের ফোন রেখে সে ফোন করেছিল অমিতাভকে। অমিতাভর ফোন যথারীতি এই সকালের দিকে বন্ধ। তার অজুহাত তৈরি। আশীষকে নিশ্চই অমানিশ বলে রেখেছে এই লাঠি, গুলির খবর শুধু সন্ধ্যেতে করতে! তাও ছোট করে এবং পুলিশ বাধ্য হয়েই লাঠি ও গুলি চালিয়েছে জাতীয় খবর করতে। যদি খবর সেটা না হয়ে অন্য কিছু হয় তাহলে আশীষ যেতে পারবে বার্তাতে? ঠোঁটের কোণটা তার বেঁকে যায় আলগা হাসিতে। ব্যাঙ্গাত্মক হাসিটা অনেকটা মোনালিসার মতন মনে হচ্ছে তার নিজের মনেই। সমরকে ফোন করে সে। চ্যানেলের নিজের স্ট্যাণ্ড চাই। নিজের পায়ে দাঁড়ানো চাই। তাহলে ছোট ও মাঝারি বিজ্ঞাপন আসবে। আসবেই। অনেকদিন পরে কৃষ্ণকিশোরদার মুখটা মনে পড়লো তার। ওই সম্পাদকের ঘরে একটা সাধারণ কাঠের চেয়ার-টেবিলে বসে লিখছেন ছোট ছোট তীব্র বাংলা বাক্যে ভূয়োদর্শীর ডায়ারি। কাগজের প্রথম পাতায় বাঁ দিকে যাবে। সম্পাদকীয় হলেই তাকে মাঝের পাতায় যেতে হবে কেন?
স্বপন অনেকদিন পরে উত্তেজিত। এখান থেকে চাকরি গেলে তো শীলা আছে। শীলার টেলিফোন বিভাগের চাকরিটা রয়েছে। আর মাইনে না হলে চাকরি থাকলেই কি না থাকলেই বা কি! একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না! ডেস্কে শৈবাল ফোনটা ধরতেই বলে,
- চালিয়ে দে! ফুটেজ দিবি, সঙ্গে অ্যাঙ্কার দিয়ে। কোনো ভয়েস ওভার দিবি না। আমি আসছি এক ঘন্টার মধ্যে।
- কেউ, মানে কিছু বললে-
ফোনের অন্য প্রান্তে শৈবালের অস্বস্তিটা বোঝা যাচ্ছে। স্বাভাবিক। সকলেই জানে এর পরিণাম বেশ গুরুতর হতে পারে। শীলাকে এই জন্যই ফোন করতে গিয়েও করেনি স্বপন। ওকে বলা যাবে না। আজ কেন, বোধহয় কোনোদিনই বলা যাবে না। শীলা এত সব বোঝে না। স্বপনের চাকরি থাকলে তাদের স্ফুর্তির হার একটু বেশি হয়, সেটাই তার কাছে মুখ্য। শৈবালও নিশ্চই এমন কোনো শীলার সঙ্গে জড়িয়ে। অথবা সংসারে বাপ-মা বোন ইত্যাদি...। অস্বস্তি হবেই। হতেই হবে। গলাটা খুব শান্ত রেখে স্বপন বললো,
- বললে বলবি আমি চালাতে বলেছি। যা বলার আমাকে বলতে।
অতএব ভাঙ্গুরে পুলিশি সন্ত্রাস চলে এল খবরে। অমানিশ আশীষকে ফোন করে সব শুনলেন। ক্ষতি যা হওয়ার হহয়ে গিয়েছে। এখন আগে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে তারপরে ফোন করবে নির্মলদাকে। অমিতাভকে খুঁজে বের করা দরকার। সকালে ফোনটা অমিতাভর বন্ধ থাকে। কলকাতাতেই যখন আছে অমিতাভ তখন খুঁজে পাওয়া যাবে ঠিক-ই। আশীষের ফোনটা রেখে অমানিশ চোখ বুজলেন আরেকবার। এত সহজে সমস্ত ছক ঘেঁটে যেতে দেওয়া যায় না। অনেক কষ্টে তিনি এমন একটা জায়গায় উঠে এসেছেন যেখানে কিছু করতে পারেন রাজনীতিতে। এই অন্যের অবিমৃষ্যকারীতায় সে সব শেষ হয়ে যাবে? না, তিনি এত সহজে হারবেন না।
(চলবে)
এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে কারোর সঙ্গে মিল থাকলে সে নেহাতই কাকতালীয়।