এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বুয়েনোস আইরেস ডায়ারিজ

    Parichay Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৮ জুলাই ২০১৮ | ১৫১০ বার পঠিত
  • ১ম পর্ব
    এই জার্নি মাসে ১-২ বার করে কাউকে করতে হলেই পঞ্চত্ব সুনিশ্চিত। এমিরেটস লাতিন আমেরিকায় দুটি উড়ান চালান, একটি, যাতে আমি এলাম, দুবাই থেকে ভায়া রিও বুয়েনোস আইরেস, অন্যটি দুবাই থেকে ভায়া সাও পাওলো সান্তিয়াগো, যেটার সময় আরও বেশি লাগা উচিত। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা ফ্লাইটে বসে বসে (যার আগে মুম্বাই-দুবাই এবং দুবাইতে ঘণ্টা সাতেক বসে থাকা ছিল) মনে হচ্ছিল এইবারে নির্ঘাত মরুতীর্থ হিংলাজের কতদূর আর কতদূর গান ভেসে আসবে।

    প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে রিও এল। রিও দূরে মেঘের মতো ঘিরে থাকা পাহাড়ের উপত্যকায় ঘাপটি মেরে থাকা এক বিচিত্রদর্শন জনপদ। রিওতে এয়ারক্রাফট পরিষ্কার করতে ওঠা মূলত কৃষ্ণাঙ্গ ব্রাজিলীয় সাফাইকর্মীরা পর্তুগীজ বাদে কিছু বলেন না, আর আমার আশেপাশে ঘিরে থাকা আর্জেন্টিনীয়রা বলেন না স্প্যানিশ ছাড়া কিছু। এঁদের মধ্যে তাই আকারে-ইঙ্গিতে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা কথোপকথন হতে লাগল। ব্রাজিলীয় কর্মীরা আমাকে যা বললেন তার মধ্যে ওব্রিগাদো, অর্থাৎ পর্তুগীজ ধন্যবাদটাই কেবল ধরা দিল।

    বুয়েনোস আইরেসের চেহারা অন্যপ্রকার। যেমন শুনেছিলাম, এ শহর আদ্যন্ত ইউরোপীয় দর্শনধারী। ইমিগ্রেশনে কোন সমস্যা হল না (আজ পর্যন্ত কোথাও হয় নি, কেবল হিথরোয় সবসময় ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন প্রচুর প্রশ্ন করে জ্বালাতন করে), কাস্টমসেও নয়। সবেতেই খানিক ঢিলেঢালা ব্যাপার। এয়ারপোর্টের বাইরেই একটা মোবাইল সিমের দোকান, যে দোকানের মহিলা আধ ঘণ্টা চেষ্টা করেও (ঠিক প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর আরও 'সিঙ্কো মিনুতোস' লাগবে বলে বলে) আমাকে কোন সিম দিতে পারলেন না।

    কাস্টমস ডিক্লারেশন ফর্মে জানতে চাওয়া হয় ভেষজ বা প্রাণীজ কিছু সঙ্গে আছে কিনা। আমি অজি কাস্টমসের এই সংক্রান্ত খ্যাপামির সঙ্গে পরিচিত, তাই এতে আপত্তি করি নি। কিন্তু এখানের নিজস্বতা হল ফর্মে সিমেন সঙ্গে আছে কিনা এ প্রশ্ন করা। সিমেন কোথাও বাটি বা সিন্দুকে ভরে নিয়ে গিয়েছি বলে মনে পড়ে না। তাই ভেবেচিন্তে লিখলাম সঙ্গে সিমেন নেই।

    অইংরেজিভাষী দেশে আসার সমস্যা আর মজা দুইই সহজে টের পাওয়া যায়, যা ইউরোপের মেট্রো শহরে বোঝা যায় না। তাতে এক ধরনের বিরক্তিও তৈরি হয়। কিন্তু যে বাড়িতে থাকব সেখানে এসে বিরক্তি অনেকটাই গায়েব। আমার ঘরে বাড়িউলির (সম্ভবত তার পূর্বপুরুষের) এক বিপুল বইয়ের সংগ্রহ। বিবলিওতেকা আর্জেন্টিনা লা নাশিওনাল নামে এক সাহিত্য সিরিজ প্রকাশ করতেন। সেই সিরিজ গোটাটাই দেখি রয়েছে। তাতে বোর্খেস থেকে মানুয়েল পুইগ থেকে হুলিও কোরতাসার সকলেই আছেন। থরে থরে। এস্পানিওল আরও দ্রুত পড়তে পারলে ভাল হত। এইসব আক্ষেপ সঙ্গে সঙ্গে যায় সবসময়েই।

    কাজ শুরু হতে ১ দিন। তার আগে শহরের এক্সপ্লোরেশন শুরু হবে।

    ২য় পর্ব
    বুয়েনোস আইরেস আদতে অভিবাসীদের শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং তার পরে ইউরোপ থেকে অভিবাসন হয়েছে। এখানে ইতালীয়, স্প্যানিশ, ফরাসী, জার্মান এসেছে অজস্র। অন্যান্য লাতিন শহরের তুলনায় তাই বুয়েনোস আইরেস অনেক বেশি ইউরোপীয়। হুয়ান পেরনের পতনের পরে শহরের অভিজাতবর্গ কিভাবে অন্তেবাসীদের হটিয়ে শহরের চেহারা আরও বদলে দিয়েছিল তাই নিয়ে গবেষণা আছে।

    এখন দক্ষিণ গোলার্ধের শীত, কিন্তু শহরবাসীদের উষ্ণতা আশ্চর্য। প্রায় বিনা পরিচয়ে এক বন্ধুর যোগাযোগে সদ্য আলাপী এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা প্রায় সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন। ইভা পেরন মিউজিয়াম থেকে গোটা পালেরমো চক্কর দিয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর শহরের বাড়িটিতে গেলাম, পরে বিখ্যাত লা রেকোলেতা সেমেটারির দিকে। ওকাম্পোর শহর থেকে দূরের ভিলাটিতে পরে যাবার কথা। শহরের ভেতরের বাড়িটিও ছবির মতো, সেখানে গোটা দুই পিয়ানো। এখানের গ্যালারি, নানা মিউজিয়াম, অজস্র বইয়ের দোকানে হাতড়ে বেড়াবার সূচনা হচ্ছে। দক্ষিণের এই পারীতে রাস্তার সাধারণ বই/ম্যাগাজিনের দোকানে পাস্কাল বা শোপেনহাওয়ের চোখে পড়ে।

    বুয়েনোস আইরেস কাফের শহর। সেইসব কাফেতে রোদ মেখে দীর্ঘসময় বসে বই পড়ে মানুষ। আমার আস্তানার কাছে একটি চমৎকার কাফেতে প্রথমদিন অনন্যোপায় হয়ে যেতে হল। অন্য কোথাও কেউ ইউএসডি নিচ্ছে না, আর তখন পেসোতে ভাঙাবার উপায় আমার নেই। অথচ খেতে হবে। সে কাফেতে খুবই আশ্চর্যজনকভাবে একটি মেয়ে ওয়েটার রয়েছে যে ইংরেজি বলতে পারে, নয়ত সবজায়গাতেই আমাকে আমার ক্ষতবিক্ষত এস্পানিওলে কাজ চালাতে হয়। সে মেয়ে ইউএসডি ভাঙিয়ে দিল। খাওয়াদাওয়া করতে বসলাম। সঙ্গে অল্প কথাবার্তা। কত দূরের দেশ থেকে আসছি শুনে সে আশ্চর্য। কি কাজে এসেছি, কতদিন রয়েছি। মাঝে মাঝে আসতে বলল কাফেতে।

    ওঠার সময় মুচাস গ্রাসিয়াস, দানিয়েলা বলতেই হল ('কামারেরা' দের ব্যাজের গায়েই নাম থাকে, আলাদা করে বাসন্তীকে নাম জিগ্যেস করতে হয় না)। নিজের নামটা বলতে শুরু করলামঃ পে আ এরে ই সে আচে আ ই গ্রিয়েগা... নামের বানান এস্পানিওলে বলতে পেরে এতো উৎফুল্ল অনেকদিন হইনি।

    এখানে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। যে প্রফেসরের সঙ্গে কাজ করতে এসেছি তিনি বাড়িতে লাঞ্চে ডাকলেন, চমৎকার ফ্ল্যাট। বললেন ভাল সময়ে এসেছ, শিগগিরি এখান থেকে পারিবারিক বাড়িতে উঠে যাচ্ছি, ভাড়া দেওয়া মুশকিল। আর্জেন্টিনার পেসোর দাম মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাচ্ছে, খাবারের দাম প্রথম বিশ্বের চেয়েও বেশি, প্রেসিডেন্ট মাক্রি আইএমএফের বেলআউট নিচ্ছেন। এর বিরুদ্ধে শহরে প্রবল বিক্ষোভের সম্ভাবনা এ সপ্তাহে। বন্ধুদের কাছে জানলাম এর মধ্যেই ভেনেজুয়েলা থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু আসছেন শহরে, চাভেস যুগের শেষদিক এবং তৎপরবর্তী নিকোলাস মাদুরোর আমলে কারাকাসে মানুষ খাদ্যের অভাবে দাঙ্গা করছে, খাবার খুঁজে ফিরছে আস্তাকুঁড়ে এসব আগেই কাগজে পড়েছি। সেই বীভৎসতা থেকে আরেক সংকটের দিকে আসছেন রিফিউজিরা।

    মানুষের উষ্ণতা দেখলাম কাজের জায়গাতেও প্রসারিত। ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুলের আর্কাইভে লাইব্রেরিয়ানরা আতিথেয়তায় এতো তৎপর, বলা মাত্র বিনা পারিশ্রমিকে ফটোকপি পর্যন্ত করে দিতেও, যে মাঝে মাঝে দেশের আর্কাইভে/লাইব্রেরিতে কিভাবে কাজ করে এসেছি ভেবে আশ্চর্য হতে হয়। রোজ দুপুর থেকে রাত আর্কাইভে কাটে।

    রবিবার সন্ধ্যেয় শহর ঝলমল করে আলোয়। ওভারকোট চাপিয়ে মুখ ভার করা আকাশের তলা দিয়ে কাফেতে যেতে ভাল লাগে। আমি কাফেতে এলে দানিয়েলাকেই এগিয়ে দেয় অন্যরা, সেই একমাত্র ইংরেজিনবীশ। ওর চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, সে চশমার একটা ছাত্রীসুলভ লুক আছে, খুব ঠাওর না করলে ঝাপসা দেখে বলে মনে হয়। খাবার সাজাতে সাজাতে প্রশ্ন করেঃ

    ক্লাস কেমন চলছে?

    ক্লাস আমি নিই না তো। নিজের রিসার্চ করি। আর বক্তৃতা করতে তান্দিল যাব।

    তান্দিল কোথায়?

    এবারে আমার অবাক হবার পালা। কেন, তান্দিল এখান থেকে ঘণ্টা পাঁচেক। জান না?

    আমি এদেশের লোক নই। দু মাস হল বুয়েনোস আইরেসে এসেছি। ইংরেজি দেশে শিখেছিলাম।

    চিলে থেকে?

    না, আরও অনেক উত্তরে আমার দেশ।

    ইতস্তত করে, আস্তে আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে ও বলে, ভেনেজুয়েলা।

    বুয়েনোস আইরেসের ইউরোপীয় রাস্তা, মেঘলা আকাশ, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর আলো আমার সামনে ঝাপসা হয়ে আসে। অনেকটা পুরু কাঁচের পাওয়ারফুল চশমার ওপাশ থেকে তাকালে যেমন হয়। মনে হয় শীতের শহরের নিষ্পত্র গাছেরা হঠাৎ অনেক রং ছড়িয়ে রেখেছে। অশোকে কিংশুকে।

    ৩য় পর্ব
    অন্যদিন সাবওয়ে অর্থাৎ মেট্রো ধরে বাড়ি থেকে আর্কাইভ যাই আসি। পরশুদিন, অর্থাৎ ১৩ই, হেঁটে যাবার দরকার হল। এইভাবেই, বার তিথি না মেনেই, আশ্চর্য সব ঘটনার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। আভেনিদা করদোবা আর কাশাও ছাড়িয়ে পার্লামেন্ট বা কনগ্রেসো নাশিওনালের দিকে হাঁটব। কাশাওতে এসেই দেখলাম রাস্তায় থিকথিক করছে ভিড়। সকলের হাতে সবুজ রুমাল এবং সে রুমাল বিক্রিও হচ্ছে। একটু পরে ব্যাপার স্পষ্ট হল।

    ১৩ই জুন আর্জেন্টিনার পার্লামেন্টে ভোট চলবে অ্যাবরশনকে আইনস্বীকৃত করার একটি নতুন আইনের জন্য। এতকাল লাতিন আমেরিকার রোমান ক্যাথলিক দেশগুলিতে অ্যাবরশন, বিরলতম ক্ষেত্রে ছাড়া, বেআইনি ছিল। আয়ারল্যান্ড সে বাঁধ ভেঙে দিয়েছে (অদ্ভুত সমাপতনে ডাবলিনের সেই ভোটের ঠিক আগেই আমি ডাবলিনে ছিলাম এপ্রিল মাসের শেষে, রাস্তায় প্রো-লাইফ আর প্রো-চয়েস উভয়েরই পোস্টার দেখেছিলাম অনেক), পাশের দেশ চিলে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে চলেছে, কিন্তু আর্জেন্টিনা করতে পারলে তার গুরুত্ব ঐতিহাসিক, নানা কারণেই, যার অন্যতম হল বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস নিজে আর্জেন্টিনীয়। এবং ভ্যাটিকান ইহা চায় না।

    তাই ১৩ই জুন ভোটের দিন মানুষ পার্লামেন্ট অভিযান ডেকেছে (ইজকিয়েরদা সোশিয়ালিস্তার মতো কিছু রাজনৈতিক দল থাকলেও এই মিছিল আদতে দলহীন মিছিল)। এবং, প্রত্যাশিতভাবেই, সে মিছিলে সিংহভাগ মহিলা (জেন্ডার রেশিও অনুসারে এ দেশে মহিলারা সংখ্যায় বেশি)।

    কিছুক্ষণের মধ্যে যা দেখলাম তা না দেখা হলে লাতিন আমেরিকা দর্শনটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। শহরের প্রতিটি রাস্তা থেকে দলে দলে মিছিল আসছে পার্লামেন্টের দিকে। সিংহভাগ তরুণী, বয়স্কাও অনেকে আছেন। তাদের সবার চিহ্ন সেই সবুজ রুমাল। তারা গালে আঁকছে সবুজ রঙে নারীত্বের ভেনাস সিম্বল, মা মেয়ের গালে এঁকে দিচ্ছেন, প্রেমিকপ্রেমিকারা একে অন্যকে ভেনাস সিম্বলে সাজাচ্ছে। তরুণী মা ৩ বছরের শিশুকন্যাকে হাতে ধরে মিছিলে এনেছেন, সবার গলায় সবুজ রুমাল। রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান "আবরতো লেগাল" আর "সেপারাসিওন দে লা ইগ্লেসিয়া দেল এস্তাদো" (সেপারেশন অব দ্য চার্চ অ্যাণ্ড দ্য স্টেট)।

    আর্কাইভে গিয়ে দেখলাম ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুলের ছেলেমেয়েরা, লাইব্রেরীর কর্মীরা সবাই সবুজ রুমালে সেজেছেন। জানলাম যত রাত বাড়বে ততো মানুষ বাড়বে পার্লামেন্টের সামনে। সারারাত ডিবেট আর ভোট চলবে, সারারাত সবাই বসে থাকবে কনগ্রেসো ঘেরাও করে। আর্কাইভ থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। অধ্যাপককে মাঝেমাঝে পুঁথিপত্র ফেলে ছুটে আসতে হয়।

    সন্ধের পর থেকে আর রাস্তা চেনা যাচ্ছিল না। প্রতি গলির দখল নিয়েছে জনতা, সব পথ অবরুদ্ধ, পথে বিক্রি হচ্ছে ইভা পেরন আর চে র ছবি, মানুষ হাততালি দিয়ে 'বেল্লা চাও' এর মতো পার্টিজান সং গাইছে। রাস্তায় বসেছে অজস্র খাবারের অস্থায়ী দোকান, সেই দোকানীরা বাড়তি কয়লা আগুন ধরিয়ে পথের পাশে রাখছেন, এই প্রবল শীতে মিছিলের ছেলেমেয়েরা সেই আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে গান গাইছে, ড্রাম বাজাচ্ছে। ফুটপাথে বিক্রি হচ্ছে বোরগেস, হুলিও কোরতাসার, আলেহো কারপেন্তিয়েরের বই। স্প্রে পেন্ট করে দেওয়ালে দেওয়ালে স্লোগান লেখা হচ্ছে। পোস্টারে লেখা হয়েছে মারেয়া ভেরদে বা সবুজ ঢেউকে সুনামিতে পরিণত করুন। পথশিল্পীরা আঁকছেন রাস্তার উপরে ছবি, ফটোগ্রাফাররা মিছিলের নানা মুহূর্তের ছবি তুলে রাস্তার ধারে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন।

    ভিড়ের চাপে রাস্তার পাশে মনে হচ্ছে দমবন্ধ হয়ে আসবে। আন্তর্জাতিক সংবাধমাধ্যমে দেখলাম লিখেছে মিলিয়ন মানুষের জমায়েত। সবাই হাতের সবুজ রুমাল ওড়াচ্ছেন, মনে হচ্ছে যতদূর চোখ যায় সবুজ সমুদ্র। তাতে লেখা আবরতো লেগাল। একজন আরেকজনের কাঁধে উঠে রুমাল ওড়াচ্ছেন। মনে হচ্ছে চলমান এক বিশাল কার্নিভ্যাল। সারারাত তীব্র শীতে কার্নিভ্যাল চলেছে, ভোরের আলো ফুটতে জানা গেছে তীব্র বিতর্কের পরে অ্যাবরশন বিল পাস করেছে নিম্নকক্ষ, এবারে তা সেনেটে যাবে। আমি বেশি রাতে সারাপথ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, সারারাত থাকতে পারিনি। সকালের সেলিব্রেশনের সাক্ষী হতে পারিনি।

    সংবাদমাধ্যমে দেখেছিলাম এই সবুজ রুমাল স্মরণ করছে সেই মহিলাদের যাঁদের এদেশের ইতিহাসে বলে 'লাস মাদ্রেস দে লা প্লাসা দে মাশো'। এই রাস্তায়, প্রেসিডেন্টের প্যালেসের সামনে, বছরের পর বছর সাদা রুমাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই মহিলারা যাদের ছেলেমেয়েরা জেনারেল হোরহে রাফায়েল ভিদেলার ডিক্টেটরশিপের সময় চিরতরে হারিয়ে গেছে (চিলের মতো আর্জেন্টিনাতেও ডিজঅ্যাপিয়ার করে যাওয়া হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের আতলান্তিকে এয়ারড্রপ করেছিল মিলিটারি)। এদের নেত্রী কয়েকজনকেও (যাদের মধ্যে দুই ফরাসী নান ছিলেন) জেনারেল ভিদেলার আমলে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়, কিছুকাল পরে কয়েকজনের ভাসমান দেহকে বুয়েনোস আইরেসের দক্ষিণ তীরভূমিতেই ফেরত দিয়ে গিয়েছিল সমুদ্র।

    আমি যে ফিল্মমেকারদের নিয়ে কাজ করি আর্কাইভে বসে তাঁদের মধ্যে একাধিকজন এইভাবে সমুদ্রে বা লুকনো গণকবরে হারিয়ে গিয়েছেন ভিদেলা রেজিমে। কিছুই আসলে হারায় না, আতলান্তিকের মতোই বুয়েনোস আইরেস তার কার্নিভ্যাল সমেত স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। এই আমার লাতিন আমেরিকার অভিজ্ঞতা, সেখানে যা নিয়ে কাজ করি তা প্রসারিত হতে হতে জীবনের অংশ হয়ে যায়।

    ৪র্থ পর্ব
    মাঝে কিছুদিন ঠাণ্ডা লেগে শয্যাগত থাকার পরে দীর্ঘ বাসযাত্রা করে তান্দিল যাওয়া হল। তান্দিল যেতে ঘণ্টাছয়েক লাগে, আর্জেন্টিনার বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এই উপত্যকা শহরে। তান্দিলে শীত প্রবলতর, বুয়েনোস আইরেসের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এই যাত্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অবশ্যই এদেশের দূরপাল্লার বাস, এমন অসাধারণ বাস আমি ইংল্যান্ডেও দেখিনি, আর পশ্চিম ইয়োরোপের বাস তো রীতিমত সাধারণ। এই দোতলা বাসে সীট রিক্লাইন করে প্রায় বিজনেস ক্লাস-সুলভ গড়িয়ে নেওয়া চলে, সার্বক্ষণিক কফি মেলে, ব্যাগেজ ট্যাগের ব্যবহার রয়েছে।

    তান্দিলে যেদিন পৌঁছলাম সেদিনই সেই মারাত্মক ক্রোয়েশিয়া ম্যাচ। কাফেতে এনসালাদা আর চা নিয়ে বসে সেটা লাইভ করলাম। প্রতিটি গোলের সঙ্গে সঙ্গে কাফের 'কামারেরা' তরুণীদের ত্রস্ত দেখাচ্ছিল, আর বৃদ্ধদের হতাশ। দ্বিতীয় গোলটির সঙ্গে সঙ্গে একটি মেয়ের দুহাত উঠে এসে ঢেকে ফেলেছিল মুখ, অন্যজন ওয়াশরুমে ঢুকে গিয়েছিল। বৃদ্ধরা তখনো আলোচনারত। আমার আর লাইভ করতে ইচ্ছে করে নি।

    কনফারেন্সে ইংরেজিতে বলছি এবং পাশে বসে উদ্যোক্তা সেটার স্প্যানিশ অনুবাদ পাঠ করছেন এ অভিজ্ঞতা অনেককাল পরে আবার হল। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ ছিল তাইপেইতে এক কনফারেন্সে, সেখানে একইভাবে আমার পেপার অনুবাদ করে পাঠ করা হচ্ছিল ম্যান্ডারিনে। এখানে বই জমল একগাদা, কেননা কিনতে তা হয়ই না, এতদূর থেকে এসেছি জেনেই বইগুলি দান করেন এদেশের সহকর্মীরা, তাঁদের ধন্যবাদ দিয়েও কূল করা যায় না। আর একটা মস্ত উৎসাহের ব্যাপার, সকলেই আমার এস্পানিওল উচ্চারণের প্রশংসা করেন।

    আর আজ, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দেখি আমার ক্রীড়াপ্রেমী (এবং নিজে খেলোয়াড়ও বটে) বাড়িওয়ালি বেচারী মুখ চুন করে খেলার আগেই টিভি চালিয়ে বসে সাম্পাওলির বালছাল শুনছে। ওকে বলি তোদো লো মেখোর পারা আরহেন্তিনা। ও স্মিত হেসে ধন্যবাদ বিনিময় করে।

    মেট্রো থেকে নেমে আর্কাইভের গলিতে ঢুকতে ঢুকতে চারদিকের সাজ সাজ ভাবটা টের পাওয়া গেল, যা মাটির নীচে বোঝা যায় না। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ উচ্ছ্বাসের স্বরে বুঝতে পারলাম ভাল কিছু ঘটে থাকবে। ফিল্ম স্কুলে, যার উপরের শিরোনামে অন্য অনেক সরকারি জিনিসের মতোই এসকোয়েলার পাশে নাসিওনাল এর 'আ' টা পড়া যাচ্ছে না ঝাপসা হতে হতে, বাইরের মস্ত বারান্দার আধুনিক টিভিতে তখন দেখাচ্ছে মেসির প্রথম গোলটা, সেখানে ছেলেমেয়েদের ভিড়। আর্কাইভের ভেতরে সক্কলে, প্রধান লাইব্রেরিয়ান খ্যাতনামা আদ্রিয়ান মুশো পর্যন্ত, একটা সত্যযুগের অর্ধচন্দ্রাকৃতি (কাফেগুলোর প্রাত্যহিক ক্রোয়াজঁর কথা মনে পড়ল আমার, কেননা তার আকৃতি হেতু এদেশের স্প্যানিশে তার একটা সুন্দর নাম আছে, মেদিয়ালুনা, অর্থাৎ আধখানা চাঁদ) টিভির সামনে খেলা দেখছেন। একজন কর্মী উত্তেজিত হয়ে আমাকে বললেন উনো সেরো, অর্থাৎ এক শূন্য। ফোটোকপি করাতে যে দোকানে যাই তারা দেখলাম দোকানের ভেতর থেকে তালা মেরে বসে খেলা দেখছে, সন্ধের আগে কাজে নামবে না। সর্বত্র অঘোষিত বনধ-প্রায়।

    এরপর পারদ চড়তে লাগল। পেনাল্টির মুহূর্তে আদ্রিয়ান দুহাতে মুখ ঢেকে বসে আছেন। লাইব্রেরির একমাত্র স্বর্ণকেশীটি চতুর্দিকে ছড়ানো বইপত্রের উপরে টেবিলে চড়ে বসে নিজের সব নখ ততক্ষণে দেখলাম গলাধঃকরণ করেছেন।

    এরপর রোহো। সালতা আর মোরেনো দুই রাস্তা থেকেই যেটা ভেসে এল তাকে গর্জন ছাড়া কিছু বলা চলে না। আদ্রিয়ান ছেলেমানুষের মতো লাফাচ্ছেন। নাচ আর আলিঙ্গনের মাঝামাঝি এবং মিশ্রিত সবকটি স্তর ঝড়ের মতো বয়ে গেল এক পশলা। আর বুয়েনোস আইরেসের বিকেলের রাস্তা থেকে সমস্বরে অনেকগুলো গাড়ি হর্ন দিয়ে উঠল। দিতেই থাকল, দিতেই থাকল। সঙ্গে আরও কিছু ধাতব শব্দ।

    আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললেন, ফ্রান্সিয়া...

    ৫ম পর্ব
    সময় কমে আসতে থাকলে কাজের চাপ অস্বাভাবিকরকম বাড়ে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ক্লান্তি। প্রতি দিনের রুটিন বেয়াড়া অবস্থায় পৌঁছায়। ফিন দে সেমানা বা উইকএন্ডে জমিয়ে রাখা কাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়। ইতিমধ্যে শুক্রবার রাতে এদেশের এক সহ-গবেষক, সহকর্মীর বার্থডে পার্টি গেল। সেই পার্টি হোক বা আজকে বয়স্কা ফটোগ্রাফার বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, সবেতেই নানাজনের মুখে দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষত প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আরহেন্তিনা সমর্থনের কথা শুনতে পাই। এদেশে অনেকেই এইসব ভিডিও বুঝে না বুঝে দেখে ফেলেছেন, এমনকি দুটি সমর্থক কিশোরীর 'অপরাধী' নামক বিকট গানটির বিটকেল প্যারডি পর্যন্ত, যা বর্তমানে ভাইরাল, এবং যাতে অবশ্যই সাম্পাওলি কথিত অপরাধী।

    সান তেলমো বুয়েনোস আইরেসের প্রাচীনতম এলাকা, সেখানে হাট বসে, প্রাচীন ইতালীয় বারে খেলনা জাহাজ থেকে হরেকরকম্বা অদ্ভুত জিনিসের আপাত বেখেয়ালি জাদুবাস্তবিক স্থাপনায় চেহারা বদলে যায়, পাথরের ঈষৎ এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ঠকঠক শব্দ করে চলে মানুষ, বাড়ির একতলায় সাজিয়ে বসে কিউরিওর পুরনো দোকান, শহরের দুটো বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়াম এই অঞ্চলে। এ শহরের পথের তাঙ্গোর প্রদর্শনীর শ্রেষ্ঠ অঞ্চলও এই সান তেলমো। স্পেনীয় লেখক মানুয়েল বাসকেস মন্তালবান তাঁর 'বুয়েনোস আইরেস কুইন্টেট' এ বলেছিলেন এই শহরকে তিনটি চিহ্ন দিয়ে চেনে মানুষ, তাঙ্গো, ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স আর মারাদোনা। সেখানে বার ব্রিটানিকোয় সকাল এগারোটা থেকে বসার কথা খেলা শেষাবধি। ২০০০ র মারাত্মক ইকনমিক ক্রাইসিস, যা নিয়ে সোলানাসের শেষদিকের ট্রিলজি, তার বিরুদ্ধে গণজমায়েত এই বারেই শুরু হয়েছিল। এই শহরে সর্বত্র ইতিহাস, এবং তাতে বর্তমানের হতশ্রী চেহারা মিশে যেতে থাকে সবসময়েই।

    হন্তদন্ত হয়ে বারে ঢুকে তিলধারণের জায়গা হয়ত পেলাম, কিন্তু মনুষ্যধারণের সত্যিই স্থানাভাব। আমার আজ ছিল ধর্মসঙ্কট, আহা শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী, কারে রাখি কারে ফেলি। তবে প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক পরিবেশ (ছুতার নয়) ক্রমশ সঞ্চারিত হয় শরীর থেকে শরীরে, তাই আশ্চর্যজনকভাবে দি মারিয়ার আশার ছলনে ভুলিতে দেখলাম আশেপাশের শব্দব্রহ্মে আমারও হাত শূন্যে উঠে গেল। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ উৎসাহ দিয়ে চলে এদেশে, শেষের পরে সবাই হাততালি দিয়ে নিজের হেরে যাওয়া টিম আর বিমূঢ় অধিনায়ককে স্বাগত জানায় অনেকক্ষণ।তাতে করে সুবিধাও কিছু হল বইকি, এক বন্ধুর আবদারের লা আলবিসেলেস্তের ১০ নং 'কামিসেতা' খেলার পরে হাটে পেলাম সহজেই, এবং তা বিক্রি করতে পেরে হকারের আনন্দও কম নয়।

    নীরব জেশ্চার একবারই চোখে পড়ল আর জমা পড়ে গেল, যখন প্রাচীন ইতালীয় বারের একটি পাথরের মূর্তির গায়ে একজন নীরবে নিজের গায়ের ১০ নম্বর জার্সিটি জড়িয়ে দিলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য।

    সান তেলমোর এই বারে আসার এবং দেখা করার কথা ছিল লুইসার সঙ্গে। লুইসা প্রবীণা, তাঁর ভাই হোসে মারিয়া সালগাদো ওরফে পেপে এ শহরের অন্য অভিজ্ঞান ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের প্রতীকদের একজন, যাঁদের জন্য স্প্যানিশ অভিধানে 'দেসাপারেসিদো' শব্দের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এসেছে। জেনারেল ভিদেলার 'লা দিক্তাদুরা মিলিতার' এর সময়ে হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক বন্দীদের একজন এই পেপে। লুইসা আর পেপের মা হোসেফিনা ছিলেন লাস মাদ্রেস দে লা প্লাসা দে মাশোর অন্যতম, হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ের ছবি আর সাদা রুমাল হাতে যারা এল প্রেসিদেন্তের প্যালেসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন, এঁদের কথা এই লেখার আগের এক কিস্তিতে রয়েছে।

    পেপে বিখ্যাত আইরিশ অরিজিনের আর্জেন্টিনীয় সাংবাদিক-লেখক রোদোলফো ওয়ালশের ('ওপেরাসিওন মাসাক্রে' র লেখক, তা নিয়ে বিখ্যাত ফিল্ম আছে) রাজনৈতিক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে শোনা যায়, মিলিটারি দাবী করেছিল পেপের কাছ থেকেই তারা ওয়ালশের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য আদায় করেছিল। সাংবাদিক ওয়ালশ তাঁর সামরিক সরকারের উদ্দেশে শেষ সম্পাদকীয় চিঠিটি ডাকে ফেলে ১৯৭৭ এর ২৫শে মার্চ চলেছিলেন, রাস্তার মোড়ে সেনাবাহিনী তাঁকে আক্রমণ করে। নেভির বাহিনী মেশিনগান নিয়ে এসেছিল একজন সাংবাদিকের জন্য। ওয়ালশ তাঁর পিস্তলটি ব্যবহার করেন আত্মসমর্পণ না করে। আহত ওয়ালশকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁকে আর কেউ কোনদিন দেখেনি, কেবল বুয়েনোস আইরেসে একটা রাস্তার নাম হয়ে রোদোলফো ওয়ালশ থেকে গেছেন।

    জেনারেল ভিদেলা এবং অন্য সব মিলিটারি অফিসারদের ট্রাইব্যুনাল বসিয়ে বিচার করে সবাইকেই আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছিল আর্জেন্টিনা, যা চিলে বা অন্য কোন লাতিন দেশ পারেনি। প্রেসিডেন্ট ভিদেলা ২০১৩ সালে জেলেই মারা গেছেন। সেই ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী ছিলেন লুইসা আর তাঁর মা। মা প্রয়াত, লুইসা এসেছেন আমার এ বিষয়ে উৎসাহের কথা জেনে আমার সঙ্গে কথা বলতে।

    ধীরে বলতে চাইলেও বলা চলে না সবসময়। লুইসা ঝড়ের মতো স্প্যানিশে বলে চলেছেন, তার কিছু বুঝছি, কিছু বুঝছি না। কিন্তু সব রেকর্ড হয়ে থাকছে। পরিশ্রম হবে, বোঝাই যাচ্ছে। শুনে পরে ট্রান্সক্রাইব করতে হবে। লুইসাকে সেই কথাই দিলাম। এরপর ব্যাগ থেকে বেরলো বেশ কিছু ডকুমেন্ট। পেপের ছবিওয়ালা হ্যান্ডবিল। প্রয়াত মা হোসেফিনার অনেকগুলো চিঠি, হারিয়ে যাওয়া ছেলের খোঁজ চেয়ে সরকারি দপ্তরে মাথা খুঁড়ে মরা চিঠি। একটা সরকারি ফাইল, যা দেসাপারেসিদোদের জন্য বানানো হত। পুরনো খবরের কাগজে অস্পষ্ট হয়ে আসা ছবি, মৃত মায়ের রাস্তায় সাদা রুমাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা। এগুলি, সঙ্গী ফটোগ্রাফার বন্ধুর ভাষায়, পারতে দে সু ভিদা। লুইসার জীবনের অংশ, তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন আর বয়ে বেড়াচ্ছেন বহু যত্নে। বছরের পর বছর।

    আজ সকাল থেকেই আকাশ অংশত মেঘলা রয়েছে। ম্যাচের পরে কুয়াশায় শহর কার্যত ঢাকা পড়ে গেল। ঝাপসা দেখছি, তার মাঝে মৃদু বৃষ্টিতে পাথরে বাঁধানো সান তেলমো ধরে আমি আর্ট মিউজিয়ামের দিকে এগোই। এই এলাকাতেই এ শহরের প্রতিষ্ঠাতা দন পেদ্রো দে মেন্দোসার মূর্তিটি রয়েছে। তার তলায় যা লেখা তার অনুবাদ হয় 'বুয়েনোস আইরেস ইজ ইওর ইমমরট্যালিটি।'

    ভাইরাল হওয়া প্যারডি ভিডিওর কিশোরীদের খুব সম্ভবত মূল গানটির রিফ্রেনের প্রয়োজন তাই কখনই হবে নাঃ

    আমার যত্নে গড়া ভালবাসা দে ফিরায়া দে।

    অন্তিম পর্ব
    বুয়েনোস আইরেসের বৃত্তান্ত আসলে শেষ হয়ে গেছে। গত এক মাস ধরে বেশিরভাগদিন রুটিন ছিল সকালে উরিবুরু এলাকায় উনিভারসিদাদ দে বুয়েনোস আইরেসের একটা ইন্সটিটিউটে বসে কাজ, আর দুপুর থেকে রাত ন্যাশনাল ফিল্ম স্কুলের লাইব্রেরিতে। উইকএন্ডে আর্ট মিউজিয়ামগুলোয় ঘুরে ঘুরে ক্যাটালগ তল্লাশি, ফিল্মমেকার বা প্রোগ্রামারদের সঙ্গে সারমিয়েন্তো কি পালেরমোর কাফেতে দেখা করা। অনেকরাত কেটেছে ফিল্ম স্কুল থেকে ফেরার পথে গোটা রাস্তা মেট্রো না ধরে হেঁটে ঘুরে কোররিয়েন্তেসের অসাধারণ বই আর ডিভিডির দোকানে দোকানে, থিয়েটারের ধারের রাস্তায় (থিয়েটারে যাওয়া হয় নি, এই দুঃখ থেকেই গেল), পথ ভুল করে অনেক অনেক দূর রাস্তায় রাস্তায় এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে ভাঙা স্প্যানিশে রাস্তার খোঁজ চেয়ে। মেট্রো স্টেশনে রাস্তার মিউজিশিয়ানদের রেকর্ড করে। ট্রেনে তাঙ্গো পারফর্মরতদের অন্য সবার সঙ্গে হাততালি দিয়ে। কাফে তরতোনিতে চেলিস্ট বন্ধুর নেমন্তন্ন পেয়ে তাঙ্গো দেখে আর তার পাশে রাস্তার সেইসব বাড়ি আর বারে, যেখানে বোর্খেস (গ আর খ এর মাঝামাঝি উচ্চারণ বাংলায় লেখা সম্ভব নয়) 'এল আলেফ' লিখে এক বান্ধবীকে পাণ্ডুলিপিটি দিয়ে আসেন। আর কাফেতে বসলেই বস্তা ভরে গেছে অদরকারি সস্তার পেনে, টিস্যু পেপারে, যেহেতু দুই ডিগ্রি শীতে সাত-আট বছরের সদ্য ফেরি করতে শেখা মুখেরা পিঠের ব্যাগ থেকে আপনার টেবিলে সেইসব রেখে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে, আপনি পেসো বের করলে নেবে, নইলে আবার জিনিস নিয়ে চলে যাবে। শুধু একবার একজন ফিসফিস করে বলে ফেলেছিল, ত্রেইন্তা সেনিওর, ত্রেইন্তা...

    সান ইসিদ্রোয় ওকাম্পোর বাড়িতে গেলে দেখবেন সেখানে প্রশস্ত বারান্দায় বার আর ভেতরের ঘরে রেস্তোরাঁ, পর্যটকদের জটলায় ট্যুরিস্ট গাইড আর বইয়ের দোকানে 'সুর' পত্রিকার পাশেই আর্জেন্টিনা ভ্রমণের চটকদার বই। গোটা এক মাসে একমাত্র মন্দ অভিজ্ঞতা।

    বুয়েনোস আইরেসে আর্ট মিউজিয়াম অনেকগুলি, তার মধ্যে ২-১টায় যাওয়াই হল না। এদেশে থাকার মেয়াদ ছিল প্রায় এক মাস, ভিসা পেয়েছিলাম চল্লিশ দিনের (অতীতে একবার জার্মান দূতাবাস আমাকে সাতদিন ইউরোপে থাকার জন্য ঠিক সাতদিনের ভিসাই দিয়ে ধন্য করেছিলেন)। ভাবছি ভাগ্যিস এখানে মাস তিনেক থাকতে আসিনি। কোনভাবেই আর দেশে ফেরা যেত না। বছরখানেকের জন্য এসে আর ফিরতে পারেনি এমন উদাহরণ বিরল নয়।

    এখানে পরিস্থিতি ক্রমেই সংকটজনক হচ্ছে, আগামী কয়েকমাসে, আইএমএফের বেলআউট নেবার পরে, আরই খারাপ হবে। নতুন মিলেনিয়ামে যে বিপজ্জনক সংকট তৈরি হয়েছিল সেদিকে ফিরে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে কারুর কারুর।

    কাল রাতে এ যাত্রায় শেষবারের মতো বসে বসে ফিল্ম স্কুলের লাইব্রেরিতে ছবি কপি করছিলাম। ৮ টায় বন্ধ হয়, কিন্তু তার মধ্যে শেষ হবার সম্ভাবনাই নেই। কর্মীরা সদলবলে আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন তোমার জন্য রাত ১০ টা পর্যন্ত আমরা বসে থাকব। আমি একা, আমার জন্য একজন থাকলেনও সোয়া ৯টা পর্যন্ত। মনে পড়ল পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভে আমাকে এক কর্মী একদা বলেছিলেন, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, সন্ধেবেলা, যে ছবিটা দেখছেন তার শেষ রীলটা পরের সপ্তাহে এসে দেখবেন।

    এরপরে কাফেতে কাফেতে ঘুরে আপনি আবার বিদায় নেবেন সবার কাছে। সবাই আপনাকে লাতিন আমেরিকায় সময় নিয়ে আসতে বলবে পরের দফায়। সোলানাসের 'এল বিয়াখে'র নায়কের মতো তিয়েররা দেল ফুয়েগো থেকে মেহিকো পর্যন্ত অনন্ত সময়। শুধু লীলা মজুমদারের গল্পের ট্রেনের চাকাই কি বলতে পারে, "আবার আসিস, আমোদ হবে?"

    উৎসবের পার্টি, অসুস্থতার ব্যসন, সিকি দুর্ভিক্ষ আর মিনি রাষ্ট্রবিপ্লব (ফুল আজকাল আর হয় কই?), কনগ্রেসোর সামনের রাজদ্বার এবং এই আর একটা আইএমএফ বেলআউটের সময়কে যদি শ্মশান বলি তবে আবদুর রহমানের মতোই বুয়েনোস আইরেস ও চাণক্যের সব কটা পরীক্ষায় পাশ করে গেল।

    রাতের ফ্লাইটে ওঠার এখনো অনেকটা দেরি। তারপর দিন দেড়েকের অতীব কষ্টকর জার্নি থাকে। তবে উঠে পড়লেই নিশ্চিন্ত। তার আগে পর্যন্ত আমি উদ্বেগে থাকি। উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি। আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৮ জুলাই ২০১৮ | ১৫১০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • T | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০২:৩৭64980
  • দুর্দান্ত।
  • | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৩:৪০64981
  • একদম অজানা দেশ, কি ভাল যে লাগল।
  • দ্রি | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৪:০২64982
  • টাইম এবং স্পেস দুটোই খুব জ্যান্তভাবে ধরা পড়েছে।

    অজানা দেশ তো বটেই। এই সময়টাও খুব সুন্দর ফুটেছে। ভেনেজুয়েলান ইমিগ্র্যান্ট, আইএমেফের লোন ... কাগজে যখন পড়ি মনে হয় দূরের ছবি। এই লেখায় সেটা অনেক ক্লোজাপে চলে এল।
  • কল্লোল | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৪:৫২64983
  • ভীষন ভালো লাগছে। লেখাটায় বুয়েনোস আইরেসের গন্ধ-স্পর্শ আছে। শহরটার সাথে আত্মীয়তা গড়ে দিলেন মশয়।
    আরও আরও লিখুন পরিচয়।
  • বিপ্লব রহমান | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৪:৫৬64984
  • আহা কি মায়া! কি মায়া! ছবির দেশ, কবিতার দেশ!

    খানিকটা হিউমার ও উইট থাকলে অনায়াসে একে আলী সাহেবের লেখা বলে চালানো যেতো। ব্রাভো
  • lcm | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ০৫:১২64985
  • খাসা, তাজা, মুচমুচে লেখা
  • b | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ১০:১৮64978
  • খুব ভালো। এক অজানা অদেখা দেশ, ছবির মত ফুটে উঠলো।
  • h | ***:*** | ২৮ জুলাই ২০১৮ ১০:৩৬64979
  • ফ্যানটাস্টিক।
  • I | ***:*** | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০১:১৪64990
  • দুর্দান্ত।
  • সিকি | ***:*** | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৭:০৫64986
  • পরিচয়, কটা ছবি দেবে না?
  • Tim | ***:*** | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৭:৫৬64987
  • ভারি চমৎকার লেখা। মেক্সিকোবাসের জোড়াতালি দেওয়া স্প্যানিশ বলার দিনগুলো মনে পড়ে গেল।
  • পরিচয় | ***:*** | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৮:৫৯64988
  • ছবি দেব, তবে ফেসবুকে। গুরুতে মনে হয় দেওয়া যায় না।
  • b | ***:*** | ২৯ জুলাই ২০১৮ ০৯:৩৭64989
  • ছবি দেবেন না। লেখাটার ছবিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন