এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটি স্পোর্টস ট্যুর এবং অন্যান্য গল্প

    Parichay Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ১৬৩৬ বার পঠিত
  • প্রস্তাবনাঃ যাদবপুর ইউনিভার্সিটির একটি দল কোন এক টুর্নামেন্টে খেলতে বেনারস গিয়েছিল, বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে ক্রমাগত এক অচেনা পরিবেশে নজরদারি এবং আক্রমণের শিকার হয় তারা, যাদবপুরে দেশবিরোধী কাজকর্মের অভিযোগ তুলে তাদের চিহ্নিত করা হয়। নিজেদের ওপরে শারীরিক আক্রমণের ভয়ে তারা ইউনিভার্সিটির জার্সি পরে খেলতেও পারেনি। প্রথম খেলায় হেরে তারা কলকাতায় ফিরে আসে পরের ট্রেনে।

    একটি ছবির গল্পঃ দক্ষিণ ভারতের সিনেমা সম্পর্কে দীর্ঘদিনের অ্যাকাডেমিক উৎসাহ-পোষণকারী আমি মহেশ বাবু-ভূমিকা চাওলা অভিনীত একটি তেলুগু ছবি বেশ পছন্দ করি, ছবির নাম ‘ওক্কাডু’ (২০০৩)। এর একটি তামিল রিমেক আছে, ‘গিল্লি’ (২০০৪)। আরও নানা ভাষায় এর রিমেক আছে, বাংলাতেও, কিন্তু সেটা নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। তেলুগু ছবিটিতে অজয় (মহেশ বাবু) এক তরুণ কবাডি খেলুড়ে, হায়দরাবাদের পুরনো শহরে চারমিনারের কাছেই তার বাস। সে দলবল নিয়ে খেলতে যায় রায়লসীমা অঞ্চলে, কারনুল শহরে। রায়লসীমা ফ্যাকশনিস্ট আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভায়োলেন্সের জন্য বিখ্যাত (তামিল ছবিতে রায়লসীমার জায়গা নেয় তামিল সাউথ, মাদুরাই অঞ্চল, এ নিয়ে তামিল সিনেমা স্কলার রাজন কৃষ্ণনের লেখা আছে)। ছবির কারনুলে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছে ওবুল রেড্ডি (প্রকাশ রাজ) নামক এক ফ্যাকশনিস্ট গোষ্ঠীপতি, স্বপ্নার (ভূমিকা) বলপূর্বক পাণিগ্রহণে সে উৎসাহী। এরপরে যা হবার তাই হয়। দৈবপ্রেরিত মহেশ বাবু উদ্ধার করে স্বপ্নাকে, রায়লসীমার রুক্ষ মাটি পেরিয়ে তারা পালায় হায়দরাবাদ, পেছনে পড়ে থাকে কবাডি টুর্নামেন্ট। স্বপ্নাকে প্রথমে নিজের বাড়িতে আর পরে চারমিনারে লুকিয়ে রাখে অজয়, যে চারমিনার ওল্ড সিটির ইসলামিক আর্কিটেকচারের আইকন বিশেষ। ছবি যেভাবে শেষ হতে পারত সেভাবেই শেষ হয়, অজয় আর ওবুল রেড্ডির সম্মুখ সমরে, কবাডি ময়দানেই। আর শেষে চারমিনারকে সাক্ষী রেখে অজয় স্বপ্নার ক্লাইম্যাকটিক এমব্রেসে।

    তেলুগু সিনেমার যশস্বী গবেষক এস ভি শ্রীনিবাস এই ছবিটি বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন সিঙ্গাপুরের একটি জার্নালে, নাম ‘কার্ডবোর্ড মনুমেন্টসঃ সিটি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাণ্ড ‘নেশন’ ইন কনটেম্পোরারি তেলুগু সিনেমা’। তখনো অন্ধ্রপ্রদেশ ভাঙেনি, কিন্তু তেলুগু নেশনের ভাঙন স্পষ্ট হচ্ছে। নেশনের মধ্যের ‘অপর’ অঞ্চলগুলি যা চিরকাল সিনেমায় ‘অপর’ হয়েই থেকেছে, তেলেঙ্গানা এবং তার মধ্যমণি মুসলিমপ্রধান হায়দরাবাদের ওল্ড সিটি আর ফ্যাকশনিস্ট সন্ত্রাস-জর্জর রায়লসীমা, তাদের বিচ্ছেদের সুর ধরা পড়ছে। এই ছবি-শরীরে কিভাবে নেশনের অপরদের কনফ্লিক্ট রিজলভড হয়ে যায় বা যায় না, সেটিকেই শ্রীনিবাস পড়তে চান। হায়দরাবাদের এক পিঠে মাল্টিন্যাশনাল ক্যাপিটালের জোয়ার, আর এক পিঠে চাঁদের আলো পড়ে না, সেই ওল্ড সিটি চন্দ্রবাবু নাইডুর ডেভেলপমেন্টের অন্য দিকে দাঁড়িয়ে থাকে। আর এক পিঠ ‘সামন্ততান্ত্রিক’ রায়লসীমা, যে দাঁড়িয়ে থাকে মডার্নিটির চৌকাঠের বাইরে। এই ছবিতে সাময়িকভাবে হায়দরাবাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যায় যখন ওল্ড সিটি হয়ে যায় ফ্যান্টাসি স্পেস, চারমিনারের রেপ্লিকা তৈরি করা হয় স্টুডিওতেই, রানঅ্যাওয়ে কাপলের প্রেমে ওল্ড সিটি তার চিরস্থায়ী ছাপ মাখিয়ে দেয়। বিশেষ করে চারমিনারের দৃশ্যগুলিতে, অথবা রায়লসীমা-সন্ত্রাসী আর পুলিশের যৌথ আক্রমণে দিশাহারা অজয় আর স্বপ্না যখন রাস্তা জুড়ে মক্কা মসজিদগামী নামাজ আদায় উৎসাহীদের ভিড়ের সুযোগে পালাতে থাকে শহর ছেড়ে। রিজিয়ন যাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না তেমন এক রিজিয়নলেস অন্ধ্র প্রদেশের ইম্যাজিনারি জাস্টিফিকেশন দেয় ‘ওক্কাডু’।

    পরিশিষ্টঃ ২০০৩ এর ‘ওক্কাডু’। ২০০৪ এর বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় ডেভেলপমেন্টের পোস্টার বয় চন্দ্রবাবু নাইডুকে ধরাশায়ী করে মুখ্যমন্ত্রী হন এক রক্তপিপাসু ফ্যাকশনিস্ট নেতা, ওয়াই এস রাজাশেখর রেড্ডি (ওয়াই এস আরের ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে জানতে ইকনমিক অ্যাণ্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে প্রকাশিত কে বালাগোপালের ‘অন্ধ্র প্রদেশঃ বিয়ণ্ড মিডিয়া ইমেজেস’ লেখাটি দেখা যেতে পারে)। ফ্যাকশনিজম তার দাবী আদায় করে নেয় তেলুগু ন্যাশনালিজমের কাছ থেকে। রায়লসীমার সামন্তরাজ হায়দরাবাদের সাইবার শহরে হানা দেয়।

    যাদবপুরের খেলার দলের যেমন হয়েছে এমন হয়েই থাকে। এমন সময়ে ফিরে আসে সবাই নিজের শহরে। মডার্নিটির কাছে, যেখানে এক অন্য নেশন দাবী জানাতে পারে না। অন্তত এখনো পারছে না। সবাই ভাল করে ঘুমোতে চায়, ঘুমলেই যেন সব ঠিক হয়ে যাবে। তফাত এই, এখানে কোন ছবির গল্প নেই। এই ছবি অন্ধ্রের ধুলো ওড়া পথের কোন মুভি থিয়েটারে রিলিজ করবে না। আমার কাছে কেবল একটি পছন্দের ফিল্ম আখ্যানের একটা নতুন এন্ট্রি পয়েন্ট হয়েই থাকবে। এমন কত কত নতুন ছবিশরীরে প্রবেশের পথ খুঁজে পাই আমরা। যে ছবির ফ্যান্টাসি স্পেসে, ইম্যাজিনারি সিটিতে মহেশ বাবু ভূমিকার হাত ধরে চড়া রোদে হায়দরাবাদের অলিতে গলিতে দৌড়ে বেড়ান। এবং কবাডি টুর্নামেন্টের মাঠ নেশন হয়ে যায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ | ১৬৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন