এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বাপের কান্ধে থুইলাম মাথা ভাস্যা দিলাম নাও

    পারমিতা দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১০ মার্চ ২০১৯ | ৪২৩৮ বার পঠিত
  • তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ১
    -------------------------------
    আস্তে আস্তে যেন একটা সময় আমার চোখের সামনে একটু একটু করে অবয়ব নিচ্ছে। একটা আনকোরা ক্যানভাসে একটু করে ছবির ফুটে ওঠা দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। যে সময়কে প্রশ্ন করা যায়, যে সময়কে খুব সহজে ছোঁয়া যায়। তাতকুরা আসলে আমার হাই মাইওপিয়া অতিক্রম করে ছুঁতে পারা সেই সময়।

    আস্তে আস্তে যেন একটা গোটা গ্রামের ঘুম ভাঙছে আমার চোখের সামনে। সকালবেলা আড়মোড়া ভেঙে যে গতিবেগে বাইরবাড়ির থেকে জন বেরিয়ে চাষের খেতের দিকে গেল, আমি তার পাশাপাশি ঠিক সেই গতিবেগে হাঁটছি। পিছিয়ে পড়ছি না, সেও আমাকে ফেলে দুড়দাড় করে কাজের নেশায় ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে না। তাতকুরা আসলে সেই আমার অনেক কষ্টে এগিয়ে পিছিয়ে অবশেষে সমান্তরালে হাঁটতে পারা ক্যালিব্রেটেড গতি।

    আস্তে আস্তে জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় যেন অশীতিপর মৃত প্রপিতামহের দল, তাঁদের পূর্ণ যৌবন ও দোর্দন্ডপ্রতাপ নিয়ে বেঁচে উঠছেন তিনশো বছরের বটের নীচে বাঁধানো বেদীর সমবেত সিদ্ধান্তগ্রহণে, পুকুরপাড়ের কর্মব্যস্ততায়, অন্দরমহলের সংক্ষিপ্ত অথচ প্রভাবশালী উপস্থিতিতে। তাতকুরা আসলে বাৎসরিক ফুলমালাতর্পণ থেকে মুক্তি পাওয়া আমার সেই গমগমে পূর্বপুরুষদের নিজের শক্তিশালী ভূমিকায় ফেরা।

    আস্তে আস্তে আমার বিক্রি হয়ে যাওয়া মাধ্যমিকের ইতিহাসবই থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি সহস্রপদী অক্ষর এসে আমার গায়ে, মাথায় বসছে, কানের কাছে গুনগুনিয়ে চলেছে তো চলেইছে । তাড়ালেও যাবে না, এই উপলব্ধির পর যাদের সঙ্গ পেতে আমি যে শুধু অভ্যস্ত হয়েই যাচ্ছি তাই নয়, তারা চেনামুখ নিয়ে এসে আমার কাছে আদর, মনোযোগ এমনকি বিজয়া-নববর্ষের পোস্টকার্ড পর্যন্ত দাবী করছে। তাতকুরা আমার সেই চেনা ইতিহাসবই-এর জ্যান্ত অক্ষরদের ভালোবেসে উঠতে পারা ।

    আস্তে আস্তে এক পিতা অবশেষে জীবন সায়াহ্নে এসে সাদা চাদরের রোগশয্যায় তার সমস্ত রঙ উপুড় করে দিয়ে প্রাণপণে ছবি এঁকে চলেছে। জীবন যত অকরুণ হচ্ছে, সেই ছবিতে রঙের পোঁচ ততই ঝলমলে হয়ে উঠছে, খাড়া-বড়ি-থোড় থেকে বেরিয়ে আসছে অলীক সত্যের রূপকথা। সেই রূপকথার আয়ু কত কেউ জানে না, সেই রঙীন ছবির সামনে কেউ এক মুহূর্ত থমকাবে কিনা জানা নেই, সেই ব্যক্তিগতয় কেউ কোনদিন একবিন্দু নৈর্বক্তিকতা খুঁজে পাবে কিনা সে প্রশ্নও একসময় অবান্তর । শুধু থাকে পিতরৌ, তার আঁকার কলমখানার হাতবদলের অপেক্ষায়। তাতকুরা আমার কাছে এক পিতার উনিশ বছরের কিশোর মুখখানা।



    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ২
    -------------------------------

    দীঘির ধারে আকাশে দুই তালগাছ পরপর
    ওই কি তোমার বাড়ি বাবা, ওই আমাদের ঘর?
    গ্রামের লোকে নিশেন কি দেয় দূরের অতিথ এলে
    তাল-বরাবর ওই বাড়ি যাও, ডালভাতমাছ মেলে।
    দাদীর কবর ওইখানে নেই , নেই ডালিমের তল
    চারুলতা ঠাকমা কি নেয় ওই পুকুরের জল?
    চারটি ছোট শিশু রেখে তারার দেশে গেল
    সত্যজিতের ছবি কি তাই মায়ের নামই পেল?



    কলার ভেলায় জীবন হাসে, পদ্মা-পাড়ি-চর
    একবৃন্তের কুসুম কাজিন, দুই দেশেতে ঘর
    কানু-মনু দাদু তাদের, চোখের দেখার পার
    প্রশান্ত আর আরব সাগর মধ্যিখানে যার ।
    ভানুদাদুর বয়স বাড়া কবেই থেমে গেছে
    ভিটে-আঁকড়া হার মানলো একাত্তরের কাছে ।



    দুটি পায়ে হাঁটা রাস্তার সংযোগে একশো প্লাস বয়সী বেলগাছ।
    ছোট্ট ছোট্ট মিষ্টি বেল নাকি।
    ওদিকে আছে একসারি সুপারি গাছ, জুম করলে দেখতে পাবে।
    এদিকে কলা ঝাড়, বীচিকলা, মিষ্টি বলে মিষ্টি। বীজগুলি ছাড়িয়ে চালের গুঁড়া দিয়ে
    ভালো করে মাখো।
    একটা কলাপাতা পেতে লেয়ারে পাতো মিশ্রণ। উপরে আরেকটা কলাপাতা দাও, চাটুতে সেঁকা হলেই কলাপিঠে রেডি।
    আজ রোববার, সুপারি পাড়ার দিন। তরতর করে গাছে উঠ। সঙ্গী কিশোর
    পাশের গাছটি ঝাঁকালে লম্বা পাতা এগিয়ে আসে। পাতা ধরে টপকে পাশের গাছে এসে পড়। গাছ থেকে গাছ টপকে সুপারি পাড়ার কাজ সারা ।
    বেয়াল্লিশের কথা, ২০১৬-র ছবি।
    গাছেরা মরে নাই, স্মৃতিরা অনুরূপ।



    একাল-সেকাল দুই জমানার দুই বধূ হার্দিক
    খুড়শাশুড়ী ভারত থেকে। নদিন রবেন ঠিক।
    এলো সুপারি পাড়ার ধূম
    ওলো আয় ছুটে কুমকুম -
    দুইজনাতে ঝুড়ি ভরে জমাই লিমেরিক



    মেঘ গুঞ্জার দুই দাদাভাই ভিনদেশেতে থাকে
    প্রমিত-প্রসিত - অরা দুজন পৃথক ভাষায় ডাকে।
    এর সুয্যি, ওর চন্দা, ওর দিন এর রাতে,
    দুইটা লাফায় খড়ের গাদায়, দুইটা বিছানাতে!




    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৩
    ---------------------------------
    - আমার চিঠিপত্র লেখার অভ্যাস বরাবরই কম। তোর মা কি এরজন্য কম ঝামেলা করেছে?
    - মাকে চিঠি? কেন? সারাজীবন তো একই ছাদের নীচে “মুখ থাকতে কলম কেন” টাইপস দেখে এলাম দুজনকে।
    - আরে একাত্তরে গারো পাহাড়ে যেতে হল না আমাকে, তখন একগাদা অ্যাড্রেসলেখা পোস্টকার্ড সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিল, সে আর ব্যবহার করা হয়ে ওঠে নি।
    - পোস্টকার্ড? এ হে হে হে - খাম, নিদেনপক্ষে নীল ইনল্যান্ড -
    - (কান খাড়া করে শোনা চরিত্রর মঞ্চপ্রবেশ) তুমি সেবার যা চিন্তায় ফেলেছিলে, ওই গন্ডগোলের মধ্যে কোন খবর না দিয়ে - সারা নৈহাটী তোলপাড়। আর বোলো না। কান্ডজ্ঞানহীন।
    - সবাইকে উত্তরবঙ্গ, বর্ধমান এইসব জায়গায় আত্মীয়স্বজনের কাছে ড্রপ করতে করতে এলাম যে -
    - এতদিন নিপাত্তা, কে খোঁজ এনে দেবে? রটে গেল, মাস্টারমশাই-এর জামাই মেঘালয়ের রিফিউজি ক্যাম্প থেকে আত্মীয়দের আনতে গিয়ে নিখোঁজ। নিশ্চয়ই ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেছে।
    - একাত্তরে রিফিউজি ক্যাম্পে কেন গেলে বাবা? ঠাকুরদা সহ তো তোমরা পার্টিশানের সময়েই চলে এলে।
    - হোলো কি, বাংলাদেশে বড়কাকু তো তখন পার্টির সক্রিয় কর্মী। ভীষণ ব্যস্ত সে সময়ে। কখনও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিচ্ছেন গোপনে, কখনও চিরকুটের অনুমতিসাপেক্ষে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ট্রেনিং ক্যাম্পে ভারতে। রাজাকারদের চক্ষুশূল। কিন্তু গ্রামের ভিতর দিনের বেলা তাদের কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। হিন্দু-মুসলমানে আমাদের গ্রামে ছিল প্রচন্ড সম্প্রীতি। কতবার মুসলমানরা আমাদের হেল্প করেছে ইয়ত্তা নেই। কিন্তু বড়কাকু পার্টির কাজে বাইরে বাইরে। রক্ষা করে কে? ঠিক হল, বাড়ির মেয়েরা, রণুর মামাতো বোনেরা, ভানুর পরিবার ছুট ছুট বাচ্চাদের নিয়ে চলে আসবে। পরিস্থিতি বদলালে ফিরত যাবে। সোজা বর্ডার দিয়ে আসার উপায় ছিল না, তাই মেঘালয় ঘুরে আসা। রিফিউজি ক্যাম্প থেকে ওদের আনতেই আমি গিয়েছিলাম।
    সেখানে তখন যুদ্ধপরিস্থিতি। পাশেই মিলিটারি ট্রেনিং ক্যাম্প। লিখে দিতে হল, ওরা অবস্থা ঠান্ডা হলেই ফিরত যাবে। এই অবস্থায় পোস্টকার্ড পোস্ট করার কথা খেয়ালই ছিল না।
    - তখনও (ভানু) কাকু আসতে চায় নি এদেশে?
    - না, ওরই তো সবাইকে নিয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু পারল না তো শেষ পর্যন্ত। ওর স্ত্রী হাসি শোক করার সময়টুকু পর্যন্ত পায় নি।

    (বাবার নৈর্ব্যক্তিক বলে যাওয়া। আমি কান পেতে রই।)



    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৪
    --------------------------------

    ফলপাকুড় কিচ্ছাকথা ।। ওগো ও সুজন
    চম্পাবতী কইন্যা করে বাসনা পোষণ
    অরুণ দাসের পুঁথি করহ শ্রবণ ।

    **** **** **** **** ****

    "আজ বাসুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো কয়েক মিনিটের জন্য। বাসু আমার ভাইপো, বাংলাদেশে থাকে ও নেত্রকোনায় অধ্যাপনা করে । ময়মনসিংহের তাতকুরা গ্রামে আমাদের বাড়ির নানারকম ফল গাছের কথা উঠলো । টেলিফোন রেখে বাংলাদেশে ছোটবেলার ফলগাছের সম্বন্ধে নানা কথা মনে পড়ে গেলো।

    আমাদের বাড়িতে অনেক রকমের ফলের গাছ ছিল। কলা, আম, কাঁঠাল, নারকেল, জাম, আমলকি, কামরাঙ্গা, জলপাই, ভুবি, করমচা, তেঁতুল দুরকম - একটা আঠালো, খুব টক, আরেকটা একটু মিষ্টি মিশ্রিত টক। শেষটাকে আমরা ডাকতাম আমলি বলে। আর প্রথমটা তেঁতুল। দুটো তাল গাছ ছিল। একটায় তাল হতো না। পুরুষ গাছ। অন্যটাতে ফল হতো প্রচুর আর ভীষণ মিষ্টি। আমরা ওই তালের রসওলা আঁটি চুষে চুষে খেতাম। তার চেয়েও বড় কথা ওই ফলওলা গাছটা ছিল আমাদের বাড়ির একটা ল্যান্ডমার্ক। সোনাকাকুর (আমার ছোট কাকা) কাছে শুনেছি গ্রামে রাত্রিবাসের আশ্রয়প্রার্থী কেউ এলে তাকে ওই তালগাছটা দেখিয়ে বলা হতো, ওই বাড়িতে যাও, থাকার জায়গা পাবে। বাসুর মুখে শুনলাম প্রায় দুশো বছরের পুরোনো এই প্রাচীন গাছটির গোড়ার মাটি আলগা হয়ে গিয়ে গাছটি পড়ে যায়। গাছটা ছিল বাড়ির একটা পুকুরের এক কিনারায়।

    কুলগাছ ছিল তিন রকমের। একটা কাশীর কুল, বেশ লম্বাটে মিষ্টি ফল হতো । একটা ছিল কাঁচের মার্বেলের মাপে আর টক । আরেকটায় খুব ছোট কুল হতো - আগেরটার বিচির সাইজের কিন্তু মিষ্টত্ব তারই বেশি। রান্নাঘরের উপর ঝুঁকে ছিল গাছটা। রান্নাঘরের চালে উঠে এই গাছের কুল পাড়া আমাদের কাছে বেশ একটা আমোদের খেলা ছিল। কুল শুকিয়ে তৈরী হতো কুলের আচার।

    ছিল গোটা বারো খেজুর গাছ। পুকুরপাড়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সারি দিয়ে লাগানো হয়েছিল এই গাছ গুলি। বয়স কত কে জানে ! দশ বারো হাত লম্বা। কতগুলি পুরুষ ও কতগুলি মেয়েগাছ। কিন্তু এই গাছগুলিতে ফল হতো আঁটিসর্বস্ব। আমরা খেতাম বটে কিন্তু শাঁস প্রায় নেইই - আঁটিই সার। তবে একটা অন্য অপূর্ব স্বাদের জিনিস হতো ওই ফল থেকে - সুগন্ধি ও সুস্বাদু খেজুরের গুড়। পৌষপার্বণের সময় পায়েস ও পিঠাতে এই গুড় ব্যবহার করা হতো।

    কয়েকটা বিশেষ গাছের কথা বলা যাক। বাড়ি থেকে বেরিয়েই ধানক্ষেতের ধারে ছিল একটা আমগাছ। বড় বড় আম হতো - প্রায় ফজলি আমের সাইজ কিন্তু ভীষণ টক। এই গাছের আম দিয়ে আমের টক, আম-ঝোল আর আমপোড়া সরবত হতো । একবার একটা পাকা আম আমি আর সমবয়সী টুনিকাকা লুকিয়ে রাখলাম আমাদের ফল লুকিয়ে রাখার জায়গায়। বেশ কয়েকদিন পর যখন আমটার কথা মনে পড়লো, তখন নামিয়ে দেখলাম খোসার এক তৃতীয়াংশ কালো হয়ে গেছে। অন্য জায়গাগুলোও বেশ কালচে। সহজেই খোসাটা উঠে গেলো । এক কামড় দিতেই চমকে গেলাম। কোথায় সেই টক আম, এ তো দারুণ মিষ্টি ! বুঝলাম এই গাছের আম মজে গেলে খাওয়ার উপযুক্ত হয়। তবে সেবছর আমি আর টুনিকাকু ছাড়া বাড়ির কেউই আর এই তথ্যটি জানলো না।

    বাড়ির দক্ষিণ দিক বাদ দিয়ে অন্য তিন দিকের সীমানা বরাবর একটু উঁচু কাঠা দশেক জমি ছিল। তাতে অনেক রকম গাছ ছিল। একটা আমলকি গাছ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পুজোর পর পরেই এই গাছের সব পাতা ঝরে যেত আর ওই পাতাহীন গাছে ঝুলতো কাঁচা, পাকা, আধপাকা অসংখ্য আমলকি - সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আরেকটা কাঁঠাল গাছের কথাও বলতে হয়। গাছের নাম "বৈশাখী", কারণ বৈশাখের প্রথম সপ্তাহেই ওই গাছে পাকা কাঁঠাল পাওয়া যেত। এই গাছটাকে ঘিরে ছিল কয়েকটা আম গাছ। বলে রাখি, আমাদের বাড়িতে কোন নামী আমগাছ ছিল না - সব দেশি আম। খুব পোকা হতো আর মাত্র দুটো গাছে মিষ্টি আম হতো। বাড়ির কাছেই শ্বশান আর তার ধারের আমগাছের সব ফল টক। আমরা গাছে উঠে ঝিনুক নিয়ে আমের খোসা চেঁছে ফেলে নুন দিয়ে খেতাম। একবার সোনাকাকু আমাদের আম অভিযানে সঙ্গী হয়ে আবিষ্কার করলেন একটা আমগাছ বোধয় ল্যাংড়া আমের। কয়েকটা ডাঁসা আম পাড়া হলো। বাড়িতে এনে কয়েকদিন রেখে বুঝা গেলো ওটা সত্যি ল্যাংড়া আমের গাছ। সব থেকে মজার ব্যাপার হলো, বাকি সব আমগাছে পোকা লাগলেও এই গাছটায় কখনো লাগতো না।

    জাম পাড়ার কথা বলি। সাধারণত: আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হলে পরে জাম পাকতো। একবার জাম পাকতে শুরু করলে দিন পনেরো কুড়ির মধ্যে সব জাম পেকে যেত। কাজেই জাম অনেক দিন ধরে রয়েসয়ে খাওয়া যেত না। বার দুই তিন জাম পেড়ে নিলেই সব শেষ। ওই জাম পাড়া ছিল একটা উৎসবের মতো ব্যাপার। মাছ ধরার বিরাট জাল বের করে রাখা হতো । আট দশ জন মিলে একসঙ্গে যাওয়া হতো জাম পাড়তে। ছ সাত জন ওই বিশাল জাল মেলে ধরতো আর দু তিন জন গাছে উঠে ডাল ধরে বেশ করে ঝাঁকুনি দিতো । এই ঝাঁকুনিতে কিন্তু আধপাকা বা কাঁচা জাম পড়বে না, শুধু পাকা জামই পড়বে নিচে মেলে রাখা জালে। মাটিতে পড়লে তো জাম থেঁতলে যাবে, তাই ওই জালের ব্যবস্থা। তারপর ঝুড়ি ভরে ওই জাম বাড়িতে এনে জলে ধুয়ে বাটিতে নিয়ে একটু নুন আর সর্ষের তেল দিয়ে ঝাঁকিয়ে নেওয়া । জামগুলি ফেটে যেত - ওই জরানো আম খাওয়ার মজাই আলাদা।

    আরো দুটো ফলের কথা না বললে এই গল্প সম্পূর্ণ হবে না। একটা ছিল বেতফল। তিনচারটে গোলমরিচ একসঙ্গে করলে যত বড় আকার হয় ফল তত বড়। বেতফলের মধ্যে বেতের বোনা পাটির প্যাটার্নের মতো প্যাটার্ন হতো। থোকায় থোকায়। পাতাগুলো ছিল কাঁটায় ভর্তি। তবু ওই ফলের থকা কষ্ট করে খেয়ে কেটে এনে পড়ার ঘরে ঝুলিয়ে রাখতাম। এই বেতবন ছিল প্রতিবেশী অমলেশদের । বৌদির সাহায্যে এই থোকা কেটে আনতাম। আরেকটা পাড়াতুতো ফল ছিল ডেউয়া। ভীষণ টক আর বেশি খেলেই কোষ্ঠকাঠিন্য। ফলের "কিচ্ছা" এখানেই শেষ। "


    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৫
    -------------------------------

    চারুলতার কথা (১৯১৩? - ১৯৪১)

    আমার ঠাকুমা চারুলতা। বাবাসহ ছোট ছোট চারটি সন্তানকে রেখে খুব অল্পবয়সে মারা যান। প্রতিবাদী, হয়তো একটু রাগীই কিন্তু বহু দশক আগে সঠিক জায়গায় তাঁর প্রতিবাদের ধরণটি উল্লেখযোগ্য। শিক্ষণীয়ও বটে।

    বাবা(অরুণ কান্তি দাস )-র কলমেই শোনা যাক।

    ***************

    " মা সম্বন্ধে আমার বিশেষ কিছু মনে নেই। আমার মা আমার সাত বছর বয়সে এবং তাঁর খুব অল্প বয়সে(তিরিশের নিচে) মারা যান। আমার মায়ের বিয়ের সময়ে তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি (মানে আমার দাদামশাই এবং দিদি, অর্থাৎ ঠাকুরদা ও ঠাকুমা) কেউই জীবিত ছিলেন না। বিয়ের পরেই বাড়ির বড় বৌ হিসেবে সংসারের সব দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। সেটা এতটাই যে মায়ের সাথে আমাদের, তাঁর সন্তানদের (তিন ভাই ও এক বোন) খুব একটা ঘনিষ্ঠতা হবার সুযোগ হয় নি। তাসত্ত্বেও আমাদের প্রতি তাঁর নজর ছিল প্রখর। একটি উঠান ঘিরে আমাদের বাড়িতে ছিল দুটি পরিবার। একটা আমাদের, আরেকটা বাবার এক কাকার। যদিও ওই লাইনটি ঠাকুরদার আমলে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো, তবুও দুটি পরিবারের মধ্যে তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওই জ্ঞাতি দাদামশাই-এর ছিল সাত কন্যা ও এক পুত্র। সাত কন্যার মধ্যে শেষের দুজন আমার সমবয়সী। বয়স্থা পিসিমাদের মধ্যে তিনজন তখনও অবিবাহিতা। তাছাড়া আমার জন্মের পরের বছরই বড়কাকুর বিয়ে হয়। খুড়ীমা ও পিসিরা মিলে আমাদের যত্নআত্তি করার লোকের অভাব হয় নি। আমার মনে আছে সন্ধেবেলা যখন সবার ঘরে শোবার জন্য বিছানা পাতা হতো, তখন আমি ঘুরে ঘুরে দেখতাম কার বিছানা সবচেয়ে পরিষ্কার এবং সেখানেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বেশিরভাগ দিনই আমি শুয়ে পড়তাম রাঙা পিসিমার (দাদামশাই-এর বিধবা কন্যা) কাছে। তারপর ঘুমন্ত অবস্থায় চালান হয়ে যেতাম মায়ের বারোয়ারি বিছানায়।

    মা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিলেন। ফর্সা রং, পানপাতা ডৌলের মুখের গড়ন এবং কোমর ছড়ানো লম্বা চুল। লম্বা বেশি ছিলেন না। খুবই কর্মঠ ছিলেন, যেমন সেকালের মেয়েদের রেওয়াজ ছিল। আমাদের লেখাপড়ার দিকে মার খুব নজর ছিল। একদিন আমি খুব জেদ করেছিলাম স্কুলের যাবো না বলে। আর মার এক কথা, স্কুলে যেতেই হবে। আস্তে আস্তে মা খুব রেগে উঠলেন। বাঙাল মেয়ে তো, রাগ ও জেদ একটু বেশিই ছিল। রান্না করতে করতে উঠে এসেছিলেন, হাতে ছিল রান্নার হাতা। সেটাই ছুঁড়ে মারলেন আমার দিকে। এসে লাগলো ডান পায়ে, হাঁটুর নিচে। জায়গাটা কেটে গেলো বেশ গভীর ভাবেই। বড় খুড়ীমা এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। একটা ঔষধ লাগিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে বেশ করে বেঁধে দিলেন। ইস্কুলে আর যেতে হলো না। পায়ের ওই কাটা দাগ আজও (চুরাশি বছর বয়স পর্যন্ত) রয়েছে; মৃত্যু পর্যন্তই মায়ের স্মরণ চিহ্ন থাকবে।
    মার লেখাপড়া বেশি ছিল না। বোধ হয় কিছুদিন প্রাথমিক ইস্কুলে পড়েছিলেন। ছিল খুব প্রতিবাদী স্বভাব। একটা উদাহরণ দিই।

    বাবার ছিল সন্ধ্যায় বৈঠকখানায় (আমরা বলতাম “বাইরবাড়ি”) পাশা খেলার নেশা। সেই খেলা ভাঙতে অনেক রাত হয়ে যেত। মা বহুদিন এ নিয়ে বাবাকে অনুযোগ করেছেন কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। তারপর এক অভিনব উপায়ে প্রতিবাদ করলেন। বাঁশের ফালি থেকে পাশা তৈরী করে তাতে কালি দিয়ে ফোঁটা দিলেন। যখন রাতে বাবার আসার সময় হয়ে এলো, তখন আমাকে নিয়ে বারান্দার মাটিতে আঁকা পাশার ছক বানিয়ে আমার সঙ্গে পাশা খেলতে বসলেন। বাবা যে পথে আসবেন ঠিক তার পাশেই। বাবাকে আসতে দেখেও উঠলেন না। বাবা ঘরের মধ্য থেকে মাকে ডেকে খাবার দিতে বললেন। মা উত্তর দিলেন, এই দানটা শেষ করে একটু পরে যাচ্ছেন। বাবা ব্যাপারটা বুঝে চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষন পরে মা উঠলেন। বাবাকে খেতে দেওয়া, আমাকে বিছানায় শোয়ানো এবং অন্যান্য সাংসারিক কাজ করলেন। তবে এরপর থেকে বাবা পাশার আড্ডায় আর বেশি রাত করতেন না।

    মা নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অল্পবয়সে চলে না গেলে আমাদের জীবন কিভাবে গড়ে উঠতো কে জানে! "


    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৬
    --------------------------------

    কৃষিবিজ্ঞান ছিল বাবার পেশা আর সবুজের অভিযান বাবার নেশা।

    শোনেন, অরুণ কান্তি দাসের কলমে তাতকুরায় তাঁর বাপ পিতেমোর ভিটার ফুলবাগানের স্মৃতিচারণ। আর সেই সঙ্গে রইল সত্তর বছর আগের স্মৃতি হাতড়ে তাঁর হাতে আঁকা একটি ম্যাপ | সময় - চল্লিশের দশকের কাছাকাছি । কইবেন কেমন লাগল।

    **************

    "আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই হিন্দুপাড়ার মূল রাস্তা পুব-পশ্চিমে বিস্তৃত । আমাদের বাড়ির সামনে এসে রাস্তাটি সামান্য বাঁদিকে ঘুরে পশ্চিমদিকে ভূইঁয়া জ্যাঠামশাই-এর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছে। আর ওই রাস্তার শাখা সোজা আমাদের বাড়িতে এসে ঢুকেছে।
    ওই তেমাথায় ছিল একটা বেল গাছ। খুব মিষ্টি ফল। একটু ছোট সাইজের। ওই বেল গাছ পেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই রাস্তার দুপাশে দুটি কামিনী ফুলের গাছ। বর্ষায় সাদা ফুলে ভরে যেত গাছদুটি আর তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো সারা বাড়ি জুড়ে। কামিনী ফুলের গাছ ছাড়িয়ে ২০-২৫ হাত সোজা গেলেই ভূইঁয়া জ্যাঠামশাই ও ঠাকুর জ্যাঠার(কবিরাজ ছিলেন) দোকান। তার বাঁদিকে, মানে দক্ষিণে আমাদের ফুলের বাগান। কামিনী ফুল গাছের লাগোয়া বাগানের উত্তর সীমানার অর্ধাংশে (মানে যেটুকু রাস্তা সেটুকু প্রায় ১০-১২ হাত ) পূর্ব-পশ্চিমে সার দিয়ে ছিল গন্ধরাজ ফুলের একটা সারি। গ্রীষ্মের শেষ থেকে বর্ষার শেষ পর্যন্ত এই সুগন্ধি ফুল ফুটতো, আমাদের খুব প্রিয় ফুল ছিল। ছবির বাগানটা ছিল ১৫-১৬ হাত চওড়া ও ২০-২৫ হাত লম্বা। বেলগাছের সোজা দক্ষিণে সোজা দক্ষিণে ছিল একটা বিশাল কদম ফুলের গাছ।

    বাগানের পুব ও দক্ষিণ সীমানা বরাবর ছিল মেন্দি বা মেহেন্দির সারি - ওটা বেড়ার কাজ করতো। বড় কাঁচি দিয়ে ছেঁটে দিলে একটা দেওয়ালের মতো দেখাতো। মেন্দির ফুল ফুটতো বর্ষায়। বেগুনি রঙের ফুল - থোকায় থোকায় হতো। যেন সবুজ দেওয়াল জুড়ে বেগুনিরঙের ছোপ। তারপর ফুল ঝরে গিয়ে সবুজরঙের গোলমরিচের আয়তনের ছোট ছোট ফলের থোকা হতো। তারপর এগুলো আয়তনে আরও বড় হলে পেকে দিয়ে রং বদলে হতো লালচে কমলা। ওই রঙিন থোকা বেশ কিছুদিন থাকতো, তারপর মরে যেত।
    ততদিনে শীত এসে গেছে। গন্ধরাজ ফুলগাছের গোড়া নিষ্পত্র, উপরের দিকে পাতা। ফুল উপরের দিকেই। গন্ধরাজের সারি শেষ হতে না হতেই একটা শেফালী ফুলের গাছ। প্রচুর ফুল হতো ওই গাছে। দুর্গাপুজোর পর থেকে ওই গাছে ফুল ফোটা শুরু হতো আর ফুটতো সারা শীত জুড়ে। সকালবেলা শেফালী ফুল ঘাসের উপর পরে থাকতো আর আমরা সেগুলো কুড়িয়ে নিতাম। ফুলের বোঁটা থেঁতো করে রস বার করে বাড়ির ছোট ছোট মেয়েরা তাদের পুতুলের পোশাক রাঙাতো।

    বাগানের ঠিক মাঝখানে ছিল বেশ ঝোপওয়ালা একটা গোলাপ গাছ। গোলাপি রঙের এই গোলাপও ছিল সুগন্ধি। শীতে প্রচুর ফুল হতো এই গোলাপ গাছে। ফুল তোলা আমাদের বারণ ছিল ।গোলাপ ছাড়াও ছিল হলদে রঙের একটা ঘন্টাকৃতি ফুল। আমরা ঘন্টা ফুলই বলতাম। পরে হর্টিকালচারের বইতে এর একটা অন্য বাংলা নাম পেয়েছিলাম - এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। এই ফুলেও গন্ধ ছিল । কবিরাজ জ্যাঠা মশাইদের শালগ্রামঠাকুরের পুজোয় এগুলো খুব ব্যবহার করা হতো। একটা জবাফুলের গাছ ছিল ঠাকুর জ্যাঠামশাইদের ঠাকুরঘরের ঠিক পিছনে । এই জাতের জবা এখন আর দেখতে পাই না। ফুলের পাপড়ি পাঁচিটি সরুমতন এবং ওই পাপড়ির ধারগুলি চিরুনির মতো খাঁজকাটা। হালকা লাল রঙের ফুল। পৌষ আর মাঘ বাদ দিয়ে সারা বছরই ফুটতো এই ফুল।

    এ ছাড়া ফুটতো সুগন্ধি বেলফুল। আমরা বলতাম বেলী। মালা গেঁথে মেয়েরা পরত।
    ফুলবাগানে যে ফাঁকা অংশটা পড়ে থাকতো, সেখানে শীতকালে গাঁদা ফুল লাগানো হতো। আর গাঁদা শেষ হয়ে গেলে গ্রীষ্মের নানা মরশুমী ফুল। সবই দেশী ফুল। বিদেশী ফুলের গাছ আমাদের বাগানে ছিল না, গৌরীপুর রাজবাড়িতেও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

    দেশ ছাড়ার সময়ে বাগানের আর যত্ন নেওয়া হতো না। গোলাপ গাছটা মরে গিয়েছিলো। অন্য গাছগুলোও পরিচর্যার অভাবে অগোছালো হয়ে পড়েছিল। "



    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৬
    ---------------------------------

    গোলাভরা ধান নাকি। বিলে জাল পাতা।
    পাঠশাল বাড়িময় গোটা রূপকথা ।।

    - এই দ্যাখ্। তাতকুরার প্রাইমারি স্কুল, আমি পড়েছি এখানে। আমার বয়সের সমান প্রায়। ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমাদের গ্রামের শিক্ষার উদ্যোগ নিয়ে দুটো যাকে বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানাই শোন্।
    (১) তাতকুরায় মেয়েদের স্কুল শুরু হয় ছেলেদের স্কুলেরও আগে।
    (২) আমাদের স্কুল, এই যে ছবি দেখছিস “তাতকুরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়” - এখানে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও পড়তে যেত।

    - বাব্বা, হেবি মডার্ন ছিলে দেখছি। চল্লিশের দশকের গ্রামদেশে রীতিমত কো-এড স্কুল!




    কিছুদিন আগে ছবিটা দেখলাম। কলকাতা থেকে নিয়মিত তাতকুরা-তীর্থযাত্রী আমার কাকা, আমরা ডাকি চিনিকাকু বলে । ফেসবুকে ছবিটা আপলোড করেছিলেন। বললেন : "একসাথেই বড় হয়েছি। আমার বয়সী প্রায় । গুরুচরণ- অন্নদাচরণ -অরুণ কান্তি তিন প্রজন্ম ; সমসাময়িক আর তিন প্রজন্ম সিতু -তুতা- টুরি ৷ সম্পর্ক ছোট জোতদার ও আশ্রিত ভাগচাষীর ৷ তিন পুরুষের পারিবারিক সম্পর্ক ৷ আনুমানিক ১২৯০ সন থেকে ৷ সরকারি মতে প্রজা ৷ টুরি আমার চিরসখা, অনুজ ও আত্মীয় ৷ দুজনেরই কামনা ছিল আর একবার যেন দেখা হয় ! এই ইচ্ছা অপূর্ণ থাকেনি - ২০১৬ সালে অবশেষে দেখা হল ৷ একাত্তরের দুর্যোগে মোক্ষদাচরণের প্রধান সহায় ছিল সৈয়দ (টুরি বা ট্যুইরা ) ৷ ওদের ঋণশোধ কবে শেষ; ওদের কাছে দাস(পূর্বে সরকার) বাড়ির ঋণ অপরিশোধ্য।"

    তাতকুরার সৈয়দ আলী। আমার কাকা কলকাতা, লন্ডন, প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপনা, রাজনীতি-সমাজচেতনা-বয়সকালে-অ্যাকটিভিজম।

    তবু মনে হয়, দুইজনে মিলে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। আমি ছবিটি ডাউনলোড করে আইফোন ফোটো এডিটারে কনট্রাস্ট বাড়িয়ে দিই। সৈয়দ আলীকে অনেক রঙীন দেখায়।



    তাতকুরা, ময়মনসিংহ - ৭
    ———————————
    আমার পিতামহ অন্নদাচরণ(১৯০৫-১৯৯২)-এর মুখ্য ভালোবাসা ছিল ছাপার অক্ষর। চোখে ভাসে বিভিন্ন অবস্থানে কাগজ, বই এমনকি ঠোঙা পড়ুয়া দাদুর ছবি। ডাক্তার হলে কি হবে, ডাক্তারীতে তাঁর মোটেই মন ছিল না। বাবা(অরুণকান্তি দাস)-এর লেখায় ভেসে উঠলো দাদুর পশ্চিমী ধাঁচের পেরেন্টিং ও রিওয়ার্ড সিস্টেমে নিজের দুই ছেলেকে কিছু “লাইফ স্কিল” শেখাবার গল্প।

    **************************

    “সবজিবাগান ও ইংলিশ প্যান্ট"

    গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শুরুর কথা। আমার বাবা ছিলেন অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। ডিপ্লোমাধারী - এল,এম,এফ। এ ডিপ্লোমা এখন আর চালু নেই। কিন্তু ডাক্তারিতে বাবার খুব একটা মন ছিল না। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন না। বেলা একটায় তাঁর ডাক্তারি কর্মকান্ড শেষ হয়ে যেত একটি সরকারী ডাক্তারখানায়। শুধু আউটডোরের ব্যবস্থা সেখানে। তবে ঐ সময়ে গ্রামাঞ্চলে রোগ বলতে ছিল ম্যালেরিয়া, পেটের অসুখ, কৃমির উপদ্রব, চর্মরোগ ইত্যাদি।

    বাবার আসল আকর্ষণ ছিল কৃষিবিদ্যায়। বইপত্রও কিনেছিলেন। বাবার আকর্ষণকে প্যাশন না বলে অবসেশানও বলা যায়। আমাদের ঐ অঞ্চলে তখন(১৯৪০-এর দশক) ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, পালং, মটরশুঁটি, টমেটো - এসব বিদেশী সব্জি। এসবের চল বাবাই সর্বপ্রথম ঐ এলাকায় চালু করেন। পরীক্ষামূলকভাবে নয়, রীতিমত ব্যবসার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। বাজারে আমাদের বাড়ির সব্জী বিক্রয়ও হতো। আমার বড়কাকা মোক্ষদাচরণের সুপারভিশানে কামলারা সবজি বাজারে নিয়ে বিক্রয় করতো। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সরকার থেকে “গ্রো মোর ফুড” বলে একটা বিশেষ প্রোগ্রাম চালু ছিল। সেই উপলক্ষ্যে ময়মনসিংহ শহরে একটি কৃষি প্রদর্শনী করা হয়েছিল। বাবা ঐ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে পুরস্কার পেলেন নানা ধরনের কৃষি যন্ত্র।তারমধ্যে লোহার লাঙল, জলসেচের ঝাঁঝরি ইত্যাদির কথা মনে আছে।

    নিজের ছেলেদের মধ্যে কৃষি সম্বন্ধে আগ্রহ তৈরীর উদ্দেশ্যে বড় দুই ছেলেকে (আমি ও ভানু, যথাক্রমে ১০ ও ৮ বছরের) সব্জীক্ষেত করার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। অবশ্য জমি তৈরী করা, মাটি কুপিয়ে মাটিতে সার মিশানো এসব পরিশ্রমসাধ্য কাজ করতো কামলারা। আমাদের কাজ ছিল চারা লাগানো, আগাছা পরিষ্কার, ঝাঁঝরিতে করে জল দেওয়া - এইসব হালকা পরিশ্রমের কাজ। আসলে ঐ ছোট্ট ক্ষেতের মালিকানা আমাদের দিয়ে গাছের প্রতি মমত্ববোধ জাগানো। যে ছোট ছোট দুটি প্লট আমাদের দু ভাইকে দেওয়া হয়েছিল, যতদূর মনে পড়ে, তাতে লাগানো হয়েছিল, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো আর বেড়ার গায়ে মটরশুঁটির লতা। আমি আন ভানু দু ভাইই খুব উৎসাহের সাথে এগুলির যত্ন নিতাম।

    আমাদের ছোট্ট প্লটদুটি ছিল বাড়ির পাশে, কুয়োর কাছে, একদম লাগোয়া। পাড়ার কয়েকটি বাড়ি থেকে এই কুয়ো থেকে খাবার জল নেওয়া হত। ঐসব বাড়ির মহিলারা যখন আসতেন তাঁরা আমাদের দুই তিন বালতি করে জল দিতেন। তাতেই মিটে যেত আমাদের ক্ষেতের জলসেচের কাজ। বিকালে জল দেওয়ার আগে সমস্ত আগাছা পরিষ্কার করে নিতাম। দিন দশপনেরো বাদে বাদে গোবর সারের সাথে বিদেশী নুন সার(পরে কৃষিবিদ হবার সুবাদে জেনেছি ওটা আসলে ছিল অ্্যামোনিয়াম সালফেট) ভাল করে মিশিয়ে সেই মিশ্রণ গাছের গেড়ার মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে দেওয়া হত। মিশ্রণ তৈরী করতো কামলারা আর গাছের গোড়ার মাটির সঙ্গে মেশানোর কাজটা করতাম আমরা দু ভাই। যথাসময়ে মটরশুঁটি আর টমেটো গাছে ফুল এল। আমাদের আনন্দ আর দেখে কে! নিয়মিত (একটু বেশীই নিয়মিত) সারজল আর অন্যান্য পরিচর্যা পেয়ে আমাদের ক্ষেতের কপি বাবার করা কপির চেয়ে বেশী নধর হয়ে উঠলো। বাড়ির রান্নার কাজেই যদিও এগুলাকে লাগানো হল, বাজারদর অনুযায়ী এগুলোর দাম অবশ্য বাবার কাছে জমা থাকল।

    সবজীবাগান তো হল। ইংলিশ প্যান্ট কি আর সবজীবাগানের সাথে তার যোগটাই বা কেথায়? ঐ আমলে আমরা যে প্যান্ট পড়তাম তা ছিল একটু মোটা কাপড়ে তৈরী ডোরি বা ফিতে দেওয়া আন্ডারওয়্যারের মত। তবে তা নিয়ে আমাদের কোন অসন্তোষ বা অভিযোগ ছিল না। সম্ভবত: এই সময়েই কলকাতায় জাপানি বোমা পড়ে ও আমাদের এলাকার জমিদারেরা সাময়িকভাবে কলকাতাবাস তুলে দিয়ে ভদ্রাসনে ফেরেন। তাদের বাড়ির দু-একজন ছেলে আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ওরা হাল আমলের বোতাম দেওয়া প্যান্টুলুন কাটের হাফপ্যান্ট পরতো। ঐ কাটের প্যান্ট আমাদের কাছে পরিচিত ছিল ইংলিশ প্যান্ট বলে। আমাদের ঐ কাটের প্যান্ট পরার খুবই ইচ্ছে ছিল কিন্তু বাড়ির অভিভাবকদের কাছে গিয়ে ইংলিশ প্যান্ট চাইবার সাহস কারো ছিল না।

    এখন ঐ কপি-টপির দাম বাবদ যে টাকা বাবার কাছে জমা ছিল, বাবা জানতে চাইলেন, তা দিয়ে আমরা কি করতে চাই? আমরা ইংলিশ প্যান্টের আবেদন করেই ফেললাম। তাতে জানা গেল যে আমাদের উপার্জনের টাকায় অমন প্যান্ট সম্ভব নয়। তাতে আমরা “যা হয় করে দেওয়া হোক” বলে চলে গেলাম। কদিন পর বাবা আমাদের নিয়ে গৌরীপুর গেলেন। দর্জির দোকানে আমাদের প্যান্টের মাপ দিইয়ে ঐ প্যান্ট অর্ডার করালেন। তারও দিন দশ বারো পর সাদা “ড্রিল” কাপড়ের তৈরী প্যান্ট নিয়ে এসে দু ভাই-এর হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমরা দুভাই সেই প্যান্ট পরে রীতিমাফিক সামনে থাকা গুরুজনদের প্রণাম করেই বাইরে ছুট - বন্ধুদের “ইংলিশ প্যান্ট” দেখাতে হবে তো! ওদের কারোরই তো এ জিনিস নেই !!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১০ মার্চ ২০১৯ | ৪২৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • de | ***:*** | ২০ মার্চ ২০১৯ ০৫:২৭49765
  • এই পর্ব খুবই সুন্দর -

    তাতকুরার লেখার পরে মাসীমার, মানে তোমার মায়ের ছেলেবেলার গপ্পোও শুনতে চাই -
  • rabaahuta | ***:*** | ২০ মার্চ ২০১৯ ০৬:৫৯49766
  • আমার বাবার কাছেও ডুরিওলা প্যান্ট থেকে বোতামওলা প্যান্টের রোমাঞ্চকর উত্তরণের গল্প শুনতাম!

    খুব ভালো লাগছে। গত উৎসব সংখ্যায় এই স্মৃতির অংশবিশেষ বেরিয়েছিল, তখন থেকেই মনে হচ্ছিল আরো কিছু যদি শোনা যেত।
    অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্যে।

    ~~~
    (ময়মনসিংগীদের স্মৃতিচারণের কী আলাদা রকম ঐতিহ্য আছে? সদ্যই লীলা মজুমদারের উপেন্দ্রকিশোর পড়ছিলাম, সিজনস অব বিট্রেয়াল পড়ছিলাম, অচিন্ত্যদার লেখা মনে পড়লো, আমার দাদুদের কাছে শুনতাম - ওঁদের প্রচুর স্মৃতিরক্ষামূলক শতাব্দীপ্রাচীন লিখিত দলিলও আছে, সুযোগ পেলে কখনো ছবি তুলে নিয়ে আসবো।)
  • | ***:*** | ২০ মার্চ ২০১৯ ০৭:০৮49767
  • অন্নদাচরণ কারকুনের একটা ছাপা স্মৃতিকথা ছিল দাদুর কাছে। দাদু বারবার পড়ত ওটা। আমি তখন এই ১০-১১। অক্ষরের সর্বগ্রাসী খিদেয় ওটাও পড়েছিলাম, কিন্তু ভাষাটা এমন সাংঘাতিক শুদ্ধ তৎসম বাংলা ছিল যে ঐ বয়সে একেবারেইউ ভাল লাগে নি। মনেও নেই। এখন মনে হয় কারো কাছে যদি পেতাম একবার বইটা। স্বাধীনতারও আগে ছাপা বই।

    পামিতে, এই উল্টেপাল্টে দেওয়া ফর্ম্যাটটা খুব ভাল লাগছে গো।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন