এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ব্রুনাই দেশের গল্প

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ জুন ২০১৯ | ১৭৬১ বার পঠিত
  • আশেপাশের ভূতেরা – ব্রুনাই
    ----------------------------------

    ব্রুনাই-এর মত এত বেশী ভূতের আশে পাশে আমি অন্য কোন দেশে থাকি নি। দেশটা ছোট বা চারিদিকে ঘন বন ইত্যাদি আছে কিনা বলতে পারব না, তবে ব্রুনাই-য়ে ভূতের ঘনত্ব অন্যদেশের থেকে অনেক বেশী। নিমো গ্রাম ছাড়ার পর দীর্ঘদিন দেশের বা বিদেশের বড় বড় শহরে বাস করেছি, তেমন ভাবে ভূত নিয়ে ভাবিত হই নি।
    ব্রুনাই-য়ে এসে আবার অনেক দিন পরে ভূতেদের সাথে মেলামেশা শুরু করলাম। এদিকে ঠাকুমার শেখানো বাংলা ভূত তাড়ানো মন্ত্র সব ভুলে গেছি – সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা প্রথম প্রথম।

    তখন সবে ব্রুনাই গেছি এসেছি, আমাদের পার্মানেন্ট ঘর তখনো কোম্পানী দেয় নি, রয়েছি সেই টেম্পোরারী দেওয়া বাংলো গুলোতে। ওই জাগয়াটায় আটটা বাংলো ছিল এমন ব্যবহারের জন্য, মানে অন্যদেশ থেকে নতুন কেউ এলে তার স্থায়ী বাঙলো রেডী না হওয়া পর্যন্ত এখানে থাকতে হত। ফলে প্রতিবেশী বলে তেমন কেউ ছিল না, মাঝে মাঝেই পুরো খালি হয়ে যেত এলাকা। স্থায়ী বাঙলোয় ট্রান্সফার হয়ে যাবার আগে বেশ কিছু সপ্তাহ আমাদের ওই বিশাল ফাঁকা মাঠের মাঝে বিশাল বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। এমন অবস্থায় একদিন সী ভিউ হোটেলের তলায় যে রেষ্টুরান্ট ছিল (চারকোল নাম ছিল সেই রেষ্টুরান্টটার) সেখানে রাতের ডিনার করে ফিরছি। হোটেলটা সমুদ্রের পাশেই – আর সমুদ্রের সমান্তরালে চলে গেছে মূল রাস্তা। আমি খেয়ে দেয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছি – এমনিতে ব্রুনাইয়ের রাস্তায় ট্রাফিক কি জিনিস কেউ জানে না – সব সময়েই রাস্তা ফাঁকা, তায় আবার সেদিন রাত হয়ে গেছে। গাড়ি চালাতে চালাতে দেখি সামনে রাস্তের ফুটপাথ দিয়ে একটা ছোট ছেলে খুব জোরে ছুটছে – প্রথমে বেশী খেয়াল করলাম না। আর রাস্তার আলোয় খুব স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না পাশের ফুটপাথের। কেমন এক আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিছু ছেলেটা যতই আস্তে গাড়ি চালাই, তার সমান বেগে কি ভাবে দৌড়াচ্ছে বুঝতে পারলাম না। নিজের অজান্তেই গাড়ির অ্যাক্সিলেটারটায় পা দিলাম – ছেলেটা খানিক দৌড়েই আস্তে আস্তে অস্পষ্ট হতে শুরু করল । দিয়ে এক সময় মিলিয়ে গেল। পাশে বসা অমৃতার সাথে গল্প করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম বলে আর বেশী মাথা ঘামালাম না – নিজের দেখার ভুল বলে কাটিয়ে দিলাম।

    তার পরের সপ্তাহে আবার গেছি রাতের বেলা সী-ভিউ হোটেলের নিচে আরেকটা দোকান আছে কফি বিনস্ অ্যান্ড টি লিভস (সংক্ষেপে সি বি টি এল, যা হল গিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্টারবাকস) – এরা বেশ ভালো স্যান্ডুউইচ করে। খাবার কিনে ফিরছি গাড়ি চালিয়ে একাই সেদিন – আর একটু এগিয়ে এসেই সেই এক জায়গাতেই দেখি আবার ছেলেটা রাস্তার পাশে দৌড়াচ্ছে – আমি এবার ওকে খেয়াল করতে রাখলাম। খানিকটা প্যারাল্যাল দৌড়ে হঠ করে ছেলেটা রাস্তার মাঝে ঢুকে পড়ল – এতো কাছে ব্রেক মেরে অ্যাক্সিডেন্ট আটকাবার কোন সম্ভাবনাই নেই, তবুও আমি রিফ্লেক্সের জন্য গাড়ির ব্রেকে চাপ দিলাম – গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটার দিকে – আমি প্রায় চোখ বন্ধ করে দেব কি হঠ করে দেখলাম ছেলেটাকে ভেদ করে গাড়ি চলে গেল যেন। ছেলেটার দেহ মিহি হয়ে গাড়ি যাবার জায়গা করে দিল – ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকালাম রিয়ার ভিউ মিররে। কেউ নেই! ব্যাপারটা ব্যাখা করতে পারলাম না। পরের বার যখন বাঙালীদের গ্যাদারিং হল আমি অনেক ইতস্তত করে ঘুরিয়ে এই প্রসঙ্গটা তুললাম – সব শোনার আগেই দেবজিতদা বলল সেও একই জিনিস দেখেছে এবং অনুভব করেছে। যা বোঝা গেল ওই রাস্তার পাশেই একটা গরীব ঘরের ছেলে নাকি কবে খেলতে খেলতে রাস্তায় চলে এসে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায় – তারই আত্মা খেলে বেড়ায় রাতের বেলায় প্রায়শঃই। সী ভিউ হোটেল ছেড়ে একটু এগিয়ে রাস্তার বাঁ পাশেই প্রথমে কবরখানা এবং তার গায়েই চাইনীজ সিমেট্রি। এটাও জানা ছিল না – পরে রাতের দিকে গাড়ি চালিয়ে এদের পাশ দিয়ে আসার সময় না তাকাবার চেষ্টা করতাম প্রাণপণ।

    টেম্পোরারী বাংলো গুলো খুব বেশী ব্যবহার হত না বলে মাঝে মাঝেই মেনটেনেন্স নিয়ে সমস্যা হত এবং কোম্পানীর লোক ডাকতে হত ঠিক করে দেবার জন্য – এই এসি কাজ করছে না, গ্যাসের লাইনে হালকা প্রবলেম, লাইট জ্বলছে না ঠিক ঠাক – এই সব। একদিন এক ছেলে এসেছে আমার বাড়িতে এসি ঠিক করতে, আমি বললাম তাকে, “আচ্ছা এই যত মেনটেনেন্স প্রবলেম কি কেবল আমাকে দেওয়া বাড়িটাতেই? কই আমার পিছনের বাড়িটায় তো তোমাদের কাউকে যেতে দেখলাম না কোনদিন”? ছেলেটা বলল, স্যার ওই পিছনের বাড়িতে তো প্রায় এক বছর হল কেউ আসে নি! এবার আমার অবাক হবার পালা – আমাদের বাড়ির পিছনের বাগান আর পিছনের বাড়ির বাগান লাগোয়া। সেদিন ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কেচে বাইরে বাগানের তারে মেলতে গেছি, তখন তো ওদের বাড়ির বাগানে একটা মেয়েকে হেঁটে বেড়াতে দেখলাম – সাদা মতন রং, আমার সাথে খুব কম সময়ের জন্য চোখা চোখি হল, আমি হাই বললাম, সেও মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল! তাহলে সেটা কে!! আমার সন্দেহ বাড়তে থাকে। এ তাহলে কাদের দেখছি! চোখের অবস্থা আমার তো খুব একটা খারাপ নয়! উইকেট কিপিং করেছি প্রবল পরাক্রমে!

    কিছু দিন পরে আমরা নিজেদের স্থায়ী কাঠের বাঙলোয় স্থানান্তরিত হলাম। সেই বাড়িটা যা আগে অনেকবার লিখেছি একেবারে সমুদ্রে ধারে। আমি প্রায় রোজই অফিস থেকে ফিরে সমুদ্র সৈকত দিয়ে দৌড়াতাম – ব্রুনাই-য়ের সূর্যাস্ত অদ্ভূত – দৌড় শেষ হলে, সূর্যকে অস্তাচলে পাঠিয়েই ঘরে ফিরতাম। ছুটতে গিয়ে মাঝে মাঝে অন্যদের সাথে দেখা হয়ে যেত, কোন পরিবার জলে ঝঁপাই জুড়তে এসেছে, কেউ কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে – কেউ বা আমার মত কেবলই দৌড়াতে গ্যাছে সেখানে। প্রথম প্রথম আমি দেখতাম একটা বাচ্ছা ছেলে আর মেয়ে নিজেরা খেলছে, খুবই কম বয়েস, হয়ত ৬-৭ বছর করে হবে। আমার অবাক লাগত এই ভেবে যে এত ছোট ছেলে-মেয়ে একা একা এত জলের ধারে কি করছে। এদের বাবা মায়ের কি একদমই হুঁস নেই! তবে বিদেশে বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দুম করে কিছু জিজ্ঞেস করার নানা সমস্যা আছে, সেই সব ভেবে আর ওদের অ্যাপ্রোচ করি নি কোনদিন।

    ভাবলাম পরের দিনে গিয়ে পানাগা ক্লাব (আমরা যেখানে থাকতাম সেই এলাকাটার নাম ছিল পানাগা) ব্যাপারটা তুলব। তা ক্লাবে যাবার আগেই রবিবার ফুটবল খেলার শেষে ওমানি এক লোকের সাথে কথা প্রসঙ্গে ব্যাপারটা বললাম। আমার মুখে ঘটনা শুনে তার দেখলাম ম্লান হাসি, আমাকে জানতে চাইল, “বাচ্ছা দুটোর কি একজন নাইজেরিয়ান মেয়ে আর ছেলেটা ডাচ্‌”? আমি বললাম, “নাইজেরিয়ান বা ডাচ্‌ কিনা জানি না তো, তবে মেয়েটার গায়ের রঙ কালো সেটা মনে হয় ঠিক, কিন্তু তুমি জানলে কি করে”? সে যা বলল, তাতে আমার আবার চমক লাগলো – কয়েকমাস আগে নাকি এক নাইজেরিয়ান কাপল তাদের বাচ্চা মেয়ে নিয়ে ব্রুনাই-য় ট্রান্সফার হয়ে আসে। পানাগা ক্লাবের বীচ সেল্টার বলে যে জায়গাটা আছে তার পাশে বাচ্চাদের সমুদ্রের ধারে বালিতে খেলা খুবই জনপ্রিয়। তাই সেই বাচ্চা নাইজেরিয়ান মেয়েটি এবং ডাচ বাচ্ছা ছেলেটি খেলছিল এক বিশাল কাঠের গুঁড়ির আশে পাশে। এমন কাঠের গুঁড়ি আমরা সমুদ্রের জলে ভেসে আসতে দেখি নিয়মিত। এবার হয়েছে কি খেলতে খলতে, ওতো বড় গুঁড়ির সেন্টার অব গ্রাভিটি এদিক ওদিক হয়ে যায়। ফলে সেই গুঁড়ি উলটে যায় – দূর্ভাগ্যবশতঃ সেদিকে উল্টায় সেদিকেই খেলছিল ছেলেমেয়ে দুটি। তারা চাপা পরে মারা যায় হাসপাতালে নিয়ে যাবার কিছু ক্ষণের মধ্যেই। যারা সমুদ্রের ধারে দৌড়াতে যায়, তাদের অনেকেই নাকি দ্যাখে আজও – কিন্তু মজার কথা হল, তারাই দ্যাখে যাদের জানা ছিল না ঘটনাটা। জানার পরে তারা আর কোনদিন ওদের দ্যাখে নি। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল – তার পর ছুটতে গিয়ে আর কোনদিনই ওই বাচ্চা দুটিকে দেখি নি।

    মে মালয়েশিয়ার মেয়ে, পুরো না মে ওক লুই – কিন্তু ওকে আমরা মে বলেই ডাকতাম। মে-কে আমি সেই অনেক দিন ধরে চিনি, আমষ্টারডামের সময় থেকে। মে হল্যান্ডে পড়াশুনা করে সেখানকার ছেলেকেই বিয়ে করে এখন ডাচ সিটিজেন। ইন ফ্যাক্ট মে যখন প্রেগন্যান্সী লীভে গিয়েছিল, তখন আমিই ওর কাজটা ওর ইউনিটে গিয়ে করেছিলাম ছয় মাস – সেই জায়গাটা আমার হল্যান্ডের উত্তরে, আমষ্টারডামের থেকে ট্রেনে তিন ঘন্টার দূরত্ব। মে যখন আমার পরে ব্রুনাই-য়ে ট্রান্সফার নিয়ে এল তখন সোফিয়া অনেকটা বড় হয়ে গ্যাছে, প্রায় তিন বছরের মেয়ে, ফুটফুটে। আমাদের মত প্রথমে টেম্পোরারী বাড়িতে খুব কম সময় থেকে মে-রাও পেয়ে গেল তার নিজেদের বাড়ি। ওদের বাড়ি গুলো আবার পুরোটা কাঠের – আমাদের ক্যাম্পাসে তাদের বলা হত কানাডিয়ান স্টাইলের হাউস। কোন চাইনীজ উৎসবে মে ওর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতো। এর কিছু দিন পর মে বলল যে সে সোফিয়া-কে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছে। বাড়িতে কার সাথে যেন সোফিয়া কথা বলে – হয়ত সোফায় বসে আছে, কিন্তু সে পাশের কারো সাথে কথা বলে যায়, পাশের জায়গা আদপে ফাঁকা।! সোফিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলে যে বলে, কেন আমি তো আমার ফ্রেণ্ডের সাথে কথা বলি যে আমার পাশে বসে থাকে। তোমরা কি আমার ফ্রেন্ডকে দেখতে পাচ্ছ না যে জিজ্ঞেস করছ কার সাথে কথা বলছি? মে খুব টেনশনে পরে গেল – অনেক আলাপ আলোচনার পর ব্রুনাই-য়ের এর স্থানীয় লোকজন বলল যে ঐ বাড়িতে নাকি দোষ পেয়েছে। তাদের কথা মত বাড়িতে দোয়া পড়া হল বেশ সময় জুড়ে – স্থানীয় মৌলানা বা ওই স্থানীয় কেউ এসে বাড়িতে জমকালো করে মুসলিম মতে জীন তাড়াবার যে সব পদ্ধতি আছে সব পালন করল। মনে করা হল এর মাধ্যমেই ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি হবে। কিন্তু কিছু দিন ঠিক থাকার পর আবার যা কে তাই!

    এর পর মে ঠিক করল নিজের ধর্মমতে বা চাইনীজ বৌদ্ধিক নিয়মে কিছু ট্রাই করবে। মে কনসাল্ট করল ফ্রেড এর সাথে – ফ্রেড আমার টিমে কাজ করত, ব্রুনাই এর চাইনীজ বাসিন্দা, ওয়েল্ডিং এক্সপার্ট। ফ্রেড সব শুনে বলল যে এমন ব্যাপার সে আগেও শুনেছে এবং কি করলে আত্মা চলে যাবে তার কার্যকরণও নাকি তার জানা। কিন্তু ব্যাপার একটাই – সে ঘরে ঢুকে কার্যপদ্ধতি করার আগে আগের অন্য ধর্মমতে ধারণ বা পালন করা জিনিসগুলো হঠাতে হবে। তা না হলে নাকি ওর মন্ত্র কাজ করবে না। মে-এর তখন এমন অবস্থা যে তাতেই সায় দিল। ফ্রেড গিয়ে বাড়িতে কি সব করে এসে আমাকে পরের দিন জানালো যে মে এখন যে কানাডিয়ান হাউসে থাকে তার তো অনেক হিষ্ট্রী। বাড়ির নাম্বার জানা থাকলে সে আগেই বলতে পারত ঘটনা কি। ব্রুনাই এ বেশীর ভাগ বিদেশী বাড়িতে এক পাশে সুইমিং পুল বানাতো। আসলে ব্রুনাই-য়ে এ সূর্য তো পর্যাপ্ত – তাই সূর্য নিয়মিত না দেখতে পাবার দেশ থেকে এসে সুইমিং পুলের ধারে রোদ পোয়ানো খুব জনপ্রিয় ছিল। তাই সেই বাড়িটাতে অনেক দিন আগে এক ফ্যামিলির ছোট মেয়ে সুইমিং পুলে ডুবে মারা যায় – সেই থেকে তার আত্মা বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ফলে যারা খোঁজখবর নিয়ে বাড়ি পছন্দ করে তারা ওই বাড়িতে এড়িয়ে যায় – মে জানত না বলে সেই বাড়িটা নিয়েছিল। এবার কিন্তু ফ্রেড বাড়ি শুদ্ধিকরণ করার পরেও কিছু পরিবর্তন হল না – সোফিয়া তার পরেও নিজের মনে আশে পাশে থাকা বন্ধুর সাথে কথা বলতে থাকে। এক সময় মে মেনে নেয় ব্যাপারটা – কারণ তার সে দেশে থাকার সময় শেষ হয়ে আসছিল, তাই আবার বাড়ি পাল্টানোর কথা ভাবে নি। এর কিছুদিন পরে মে অন্য দেশে চলে যায়। আমাকে গত বছর মে জানিয়েছিল এখন আর সোফিয়া পাশে কাউকে দেখে না। অন্য দেশে যাবার পর কিছু দিন সোফিয়া জিজ্ঞেস করত যে তার ফ্রেন্ড আসছে না কেন!

    ব্রুনাই-য়ে এই ভাবেই চলছিল – আমরা প্রথমে গিয়ে যে বাড়িতে উঠি সেই ব্লকটায় কেবল বিবাহিত কাপলরা থাকত, সন্তান সহ কাপলরা অন্য সব ব্লকে। ফলে আমার আশে পাশের বেশীর ভাগ বাড়িই প্রায় ফাঁকা থাকত। এমন একটা সময় এল যে আমার চারিদিকের ছয়টা বাড়িতে কেউ নেই – আর ছয়টা বাড়ি মানে ঘর থেকে যত দূর দেখা যায় গাছের ফাঁক দিয়ে তার কোনটাতেই কেউ থাকত না। অমৃতা দেশে মাঝে মাঝে বেশী দিন থেকে যেত আমি ব্রুনাই চলে আসার পরও – তখন আমি একা থাকতাম ওই বাড়ি এবং ওতটা জায়গায় একা। তবে রাতের বেলা মাঝে মাঝে সাইকেল নিয়ে কোম্পানীর সিকিউরিটি গার্ডরা টহল দিয়ে বেড়াত। আমার একদম সামনের বাড়িটায় শেষ বাসিন্দা ছিল এক ফিলিপিন্সের লোক। তার সাথে এক সুন্দরী মহিলা থাকত – তবে সেটা তার গার্লফ্রেন্ড নাকি বউ সেটা জানতাম না। তবে ব্রুনাই-য়ে একসাথে থাকতে হলে বিবাহিত হবে এমন রুল ছিল – আমষ্টারডামের মত গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কেউ বিদেশ থেকে যেতে পারত না। ফলে অনুমান করে নিতে পারি যে সেই মেয়ে খাতায় কলমে বউ ছিল তার। সেই মেয়েটাও ফুলের বাগান ভালোবসত – বাড়ির বাগানের ধারে ধারে বেশ কয়েকটা করবী গাছ লাগিয়েছিল যেখান থেকে অমৃতা মাঝে মাঝে পুজোর ফুল তুলে আনত, কিছু বলত না সে বরং হাসত। কোন এক সময়ের পর সেই মেয়েটাকে আর দেখতে পেতাম না, আর কিছু দিনের পর সেই লোকটাকেও, দেশে ফিরে গেল সে। সেই থেকে বাড়িটা ফাঁকা।

    আমি তখন বাড়িতে একা - একদিন বিকেলে সমুদ্রের ধার দিয়ে ছুটে সূর্য প্রায় ডুবে গ্যাছে এমন অবস্থায় বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ঢোকার আগে কি মনে হল সেই পাশের বাড়ির বাগানের দিকে এগিয়ে গেলাম – বিকেলের প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া রোদ সাদা ফুলের গাছ গুলিতে লেগে বড় মনোরম দেখাচ্ছে। ভাবলাম গিয়ে দুটো সাদা ফুল তুলে নিয়ে আসি – আমি বাড়ির সেই ফাঁকা বাড়ির তলা দিয়ে হেঁটে তাদের পিছনের বাগানে যাচ্চি হঠাৎ কেমন যেন বাচ্ছার হাসি এবং ছুটে খেলে বেড়ানো শুনলাম মাথার উপরের কাঠের মেঝে থেকে। থমকে দাঁড়ালাম – ভুল শুনলাম নাকি? এদিকে বেলা শেষ হয়ে আসছে, আশে পাশের ল্যাম্পপোষ্টের আলো জ্বলে উঠছে নিজে থেকেই। না ভুল শুনছি না তো – কেমন যেন এক ঝুমঝুমির শব্দ, হালকা পায়ে কে যেন হাসতে হাসতে দৌড়াচ্ছে কাঠের মেঝেতে। আমার গায়ে কেন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল – একটু ভয় ভয় করছে। আশে পাশে দেখলাম কেউ নেই, কিন্তু নজর করে দেখলাম দূর থেকে সেই সিকিউরিটি গার্ডগুলো রাতের ডিউটি শুরু করছে – সাইকেল নিয়ে ঠহল দিতে তারা এদিকে আসছে। আমি সাহস পেয়ে সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। সাধারণত কেউ বাড়ি ছেড়ে দেবার পর, হাউসিং ডিপারমেন্ট বাড়িতে চাবি দিয়ে চলে যায়। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম মূল দরজার দিকে – ভিতরে শব্দটা আবছা হয়ে আসছে। ঘরের ভিতরে বাইরের থেকে বেশী অন্ধকার – আমি দরজার হাতলটায় চাপ দিলাম – আমি নিশ্চিত ছিলাম যে দরজা বন্ধ, কিন্তু আমাকে অবাক করে দরজা চাপ দিতেই খুলে গেল। বুকটা ধক করে উঠলে – ভিতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না। ভিতরে পা না দিয়ে, দরজার পাশের সুইচটা দিলাম হাত বাড়িয়ে। দপ করে আলো জ্বলে উঠল – আর দুর দার করে কেউ যেন ভিতরের ঘরে ঢুকে গেল। আমি প্রবল ভয় পেয়ে ছুটে নীচে চলে এলাম। এদিকে সাইকেল নিয়ে তখন দুজন সিকিউরিটি গার্ড বাড়ির সামনে চলে এসেছে – আমাকে ছুটে ওমন ভাবে দৌড়ে বেরোতে দেখে সাইকেল থামালো – আমি ব্যাপারটা খুলে বললাম, তারপর তিনজনে মিলে আবার সিঁড়ি ভেঙে ঘরে ঢুকলাম – গার্ডের হাতে বিশাল টর্চ, ঘরে যদিও আমি আলো জ্বালিয়ে ছিলাম ড্রয়িং রুমটায় – সেখানে কেউ নেই। আমরা ভিতরের বেডরুমে ঢুকলাম – সেই ঘরের ল্যাম্প কেটে গ্যাছে, সুইচ দিলেও আলো জ্বলল না। টর্চ জ্বেলে আমরা সারা বাড়ি খুঁজলাম, কাউকে পেলাম না। গার্ডগুলো বলল স্যার আপনি মনে হয় বেড়ালের শব্দ বা ছুটে যাওয়া দেখেছেন। আমি আর কি বলি!

    এর পর অনেক দিন কেটে গ্যাছে – আমি ঘটনা অমৃতাকে বলি নি, সে হয়ত তা হলে ফুল তুলতে যেতে ভয় পাবে। এর পর এক সময় আমরা একটা ফিলিপিনো কাজের মেয়ে নিয়োগ করি – তার সাথে আমি একদিন কথা বলতে বলতে জানালাম যে আমাদের সামনের বাড়িটায় একটা ফিলিপিনো ফ্যামিলি থাকত। সে বলল, স্যার জানি। আমি খুব একটা অবাক হলাম না, কারন হয়ত ওরা চার্চ যাবার সূত্রে চিনেছে। তার পর সে নিজে থেকেই বলল স্যার ওদের খুব ট্রাজেডি – মেয়েটি নাকি এক সময় প্রেগন্যান্ট হবার পর দেশের বাড়ি ম্যানিলা যায়। সেখানে নাকি কি কারণে পড়ে গিয়ে চোট পায়, ব্লীডিং শুরু হয় – প্রায় পাঁচ মাস মত প্রেগন্যান্সী তখন। ডাক্তারে বলে যে পড়ে যাবার ফলে ভিতরের বাচ্ছাটা মারা গ্যাছে এবং ইমিডিয়েট অ্যাবরশন করাতে হবে – মৃত বাচ্ছা বা ভ্রূণ বের করা হয়, মেয়ে ছিল। এর পর সেই মহিলা আর ব্রুনাই ফিরতে চায় নি, এতো বেশী আঘাত পেয়েছিল। আর তার পর লোকটিও ট্রান্সফার নিয়ে ব্রুনাই ছেড়ে দেয়! আমার কান শুনে যাচ্ছে সেই কাজের মেয়েটির কথা, কিন্তু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেই দিনের সন্ধ্যের ঘটনা – বাচ্ছার দৌড়বার শব্দ খিল খিল হাসির সাথে, ঝুমঝুমির শব্দ। আমি মুখে কিছু বলতে পারি না –

    -----------------------------------------------------------------------------------
    তেম্বুরং ন্যাশানাল পার্ক – ব্রুনাই
    -----------------------------------------------------------------------------------

    ব্রুনাই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট্ট দেশ, মাত্র তিন লক্ষ মানুষের বাস। এই দেশের সুলতান দীর্ঘদিন পৃথিবীর সবথেকে ধনী ব্যক্তি ছিলেন, বিল গেটস তাঁকে স্থানচ্যুত করার আগে। আমি বেশ কয়েক বছর বাস করেছি এখানে এবং সারা পৃথিবীর নানা দেশে ঘুরলেও এই ছোট্ট দেশটি মনের মধ্যে অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে। নানা ব্যক্তিগত কারণ ছাড়ার এই দেশ ভালো লাগার এক মূল কারণ হল তার অফরুন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যা মানুষ দ্বারা এখনো ধর্ষিত হয় নি। ইচ্ছে আছে ব্রুনাই নিয়ে একটু একটু করে কিছু লিখে রাখি, এবং সেই ভেবেই শুরু করা যাক তেম্বুরং ন্যাশানাল পার্ক দিয়ে।

    ব্রুনাই দেশটা চারটে জেলা নিয়ে সংগঠিত – মুয়ারা, বেলাইট, টুটং এবং তেম্বুরং। এর মধ্যে তেম্বুরং এর অবস্থান একটু অদ্ভুত – এই জেলার তিনদিকে এক অন্যদেশ মালয়েশিয়া এবং আর বাকি এক দিকে জল। ফলতঃ ব্রুনাইয়ের মূল ভূখণ্ডের সাথে এর জোগাযোগ একটু ঘুরপথে। তাই মালয়েশিয়ায় না ঢুকে ব্রুনাইয়ের মূল ভূখন্ড থেকে তেম্বুরং যাবার একমাত্র উপায় এই মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল কেবল জলপথ। বছর দুই আগে এক যোগাযোগ কারী সেতু চালু হয়েছে, এখন গাড়ি করেও তেম্বুরং এ যাওয়া যায়, অন্তত কিছুটা পর্যন্ত।

    তেম্বুরং জেলা হল প্রায় ৫৫০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে – এবং এর উত্তরের মাত্র খুব ক্ষুদ্র একটি অংশেই আমরা যেতে পারি, মানে যেখানে তেম্বুরং ন্যাশানাল পার্ক আছে। আর বাকি জায়গা জুড়ে প্রায় দূর্ভেদ্য জঙ্গল। একনায়ক তন্ত্রের অনেক সমস্যা আছে, কিন্তু কিছু ভালো গুণও বর্তমান, যার মধ্যে অন্যতম হল, গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে বেশী হ্যাজানো হয় না। এই যেমন, ১৯৯১ সাল নাগাদ ব্রুনাইয়ের সুলতান বলে দিলেন তেম্বুরং ন্যাশানাল পার্ক হিসাবে বিবেচিত হবে, সংরক্ষিত অরণ্য এবং গাছ ইত্যাদি কাটা একদম বন্ধ। ব্যাস সেই থেকেই তেম্বুরং সংরক্ষিত হয়ে গেল – ফালতু বিল পাস নেই, ডিবেট নেই, কাজ না থাকা বোদ্ধাদের টিভি-কাগজে এই নিয়ে আলোচনা বা মতামত বিতরণ নেই!

    আমরা যখন প্রথম তেম্বুরং যাই তখনো সেই ব্রীজটা চালু হয় নি – এমন ব্রীজের কাজও শুরু হয় নি। ফলতঃ গাড়ি, স্পীডবোট, জঙ্গলের জীপ, লঙবোট ইত্যাদি চাররকম যানবহন পরিচালিত হয়ে পৌঁছানো তেম্বুরং। প্রথমে আমাদের বাড়ি থেকে ব্রুনাইয়ের রাজধানী বান্দার-এ পোঁছানো, সেখান থেকে প্রায় এক ঘন্টার স্পীড বোটে করে গিয়ে বাঙ্গার টাউনে। এই টাউনের পাশে আছে মালয়েশিয়ার সারাওয়াক জেলার ভিতর দিয়ে ব্রুনাইয়ে প্রবেশ করা লিমবাং নদী। সেই বাঙ্গার থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এবার জঙ্গুলে জীপে করে যাত্রা শেষে বাতাং ডুরি বলে এক জায়গায় পৌঁছানো। এই বাতাং ডুরি থেকেই নেওয়া হল লঙবোট (লম্বা নৌকা) এবং শুরু হল যাত্রা তেম্বুরং নদী বরাবর।





    এই নৌকা গুলো চালানো একটু ট্রিকি ব্যাপার – কারণ জলের গভীরতা এখানে খুবই কম, পাথুরে নদী এবং পথ জানা থাকলে নৌকা আটকে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। এই বোট গুলো মূলত চালায় স্থানীয় বাসিন্দা ‘ইবান’ প্রজাতি। ইবানদের নিয়ে গল্প অন্য এক সময়। এই যাত্রা বড়ই সুখপ্রদ – প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে ৪৫ মিনিটের নৌকা যাত্রা শেষে পৌঁছানো ডাঙায় – এবং আর একটু হেঁটে তেম্বুরং ন্যাশানাল পার্কে পৌঁছে যাওয়া।

    সেই গভীর জঙ্গলের ভিতরে ব্রুনাই সরকারের এক রিসর্ট আছে, নামটাও খুব সুন্দর “উলু উলু রিসর্ট”। আমরা সেখানেই ছিলাম দুই দিন। বড় মধুর – কাঠের ঘর, ঘরের সামনেই বারান্দা – বসার জায়গা এবং কুল কুল শব্দে বয়ে যাওয়া তেম্বুরং নদী। মন ভালো করে দেয়। সেখানে পৌঁছে দুপুরের লাঞ্চ ইত্যাদি হল – লাঞ্চের পর এটা সেটা অ্যাক্টিভিটি, জঙ্গলে হাঁটা – শেষ বিকেলে গা হাত পা ধুয়ে সেই বিশুদ্ধ নদীর পাথরে বসে বসে বিকেলের আলো শেষ হয়ে আসা দেখা। সন্ধ্যেবেলা ব্যবস্থা ছিল বারবিকিউ – বিশাল কিছু জমকালো ব্যাপার নয়, সাধারণ কিন্তু স্বাদু খাবার।





    সন্ধ্যে শেষে রাত গভীর হলে আমাদের বলা হল রাতের জঙ্গল সাফারী করতে নিয়ে যাওয়া হবে। এবং রাতের বেলা নাকি নানা লুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী আমাদের ভাগ্য থাকলে দেখা যাবে। সেই মত প্রস্তুতি নেওয়া হল – আমি প্রথম থেকেই ঘরে বসে ভাঁট দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলাম – ওই রাতের বেলায় পায়ে গামবুট পড়ে, মাথায় হেডলাইট লাগানো ক্যাপ পড়ে আমার অ্যাডভেঞ্চারের কোনই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কি আর করা, সবার পাল্লায় পরে আমাকেও যেতে হল – আমাদের বলা হল শব্দ করা যাবে না একদম, আর যাবে না অকারণে আলো জ্বালানো। গাইড আমাদের কি করতে হবে বলে দেবে – আমরা শুধু তাকে ফলো করে যাব। আবার সেই রাতের বেলা লঙবোটে করে বেরোনো – শব্দ করা যাবে না, তাই ইঞ্জিন চালানো হল না জঙ্গলের কাছে গিয়ে – দাঁড় বেয়ে পীচ ডার্ক জঙ্গলে আমাদের নামানো হল। প্রায় সবারই প্রবল উৎসাহ কি জানি কি দেখব বলে – আমি কেবল সন্নিগ্ধ, কারণ ট্যুর গাইডদের আমার চিরকালই এক সন্দেহ জনক প্রজাতি মনে হয়। রাত জাগা অমৃতার কাছে স্বাভাবিক, কিন্তু আমার কাছে নয়। রাত বাড়লেই আমার ঘুম পেয়ে যায়, আর ঘুম পেয়ে গেলে আমাকে ডাইনোসরও সামনে এসে বিষ্মিত করতে পারবে না।!

    তো যাই হোক, জলের মধ্যে দিয়ে ছপ ছপ করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা গাইডের পিছু পিছু এগুচ্ছি। এক সময় গাইড বলল – সসসসসস, তোমাদের একটা বিশাল ইন্টারেষ্টিং জিনিস দেখাবো। এই বলে অনেক কসরত করে এক পাশে পড়ে থাকা গুঁড়ির তলায় আলো ফেলল, সবাই উত্তেজিত একটা সাপ দেখে। আমার টার্ন এলে আমি দেখলাম একটা জল-ঢোঁড়া সাপ বিরক্ত হয়ে এপাশ ওপাশ করছে। আমিও বিরক্ত হচ্ছি মনে মনে – জল ঢোঁড়া সবার দ্যাখা শেষ হলে আবার এগুনো, খানিকটা গিয়ে আবার সসসসসস – এবার দ্যাখানো হল একটা সোনা ব্যাঙ! বিরক্তিতে আমার সব কিছু চড় চড় করছে – বাকি পাবলিক বেশ এনজয় করছে। কিন্তু নিমোর ছেলেকে জল ঢোঁড়া এবং সোনা ব্যাঙ দেখিয়ে ইমপ্রেস করা একটু চাপের ব্যাপারই! আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি আর এগুচ্ছি না, আমার বিশাল ভয় করছে, কিছু একটা হয়ে যেতে পারে আমার হার্টে – আমাকে রিসর্টে ফেরত পাঠানো হোক। ফিরে এলাম –

    পরের দিন খুব ভোরে ওঠার প্ল্যান – রিসর্ট থেকে ক্যানপি ওয়াক করে হেঁটে সেই কিছু একটার চূড়ায় উঠে সূর্যদয় দেখতে হবে। এটাতে আমার খুব ইন্টারেষ্ট লাগলো – অমৃতার আবার ভোরে উঠতে চাপ। আমি ঠেলে ঠুলে তুলে নিয়ে গেলাম পরের দিন সকালে – মনে রাখার মতন অভিজ্ঞতা। সেই ক্যানোপি ওয়াক টাওয়ারটি জমি থেকে প্রায় ৫০ মিটার মতন উঁচুতে – অ্যালুমিনিয়ামের স্ট্রাকচার, তার দিয়ে গাছের সাথে বাঁধা। সেই টাওয়ারে উঠে রেন ফরেষ্টের গাছের মাথা ছাড়িয়ে সকালের প্রথম সূর্যের আলো দেখা। এটা না গেলে মিশ করতাম – রিসর্টে ফিরে ব্রেকফাষ্ট করে আবার জঙ্গলে যাওয়া – এবার এক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে। সেটাও খুব আনন্দে কাটল – সাথে হল জলকেলি। ভিজে টিজে ফিরে রিসর্টে লাঞ্চ করতে গিয়ে শুনলাম সেই ক্যানোপি ওয়াকের তার ছিঁড়ে স্ট্রাকচার এখন উপরে ঝুলছে একদিক থেকে! বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বুঝতে পারলাম।













    বিকেলের দিকে এবার ফেরার পালা – সেই একই পথে বিপরীত দিক থেকে ফিরে আসা। আমরা সবাই ক্লান্ত – মুখে এসে লাগছে খোলা নদীর হাওয়া – সমুদ্রের নোনতা স্বাদও কি মিশে আছে বাতাসে? আমার চোখের পাতাও কোন এক সময় জুড়ে এল –

    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
    এম্পায়ার হোটেল – ব্রুনাই
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    ব্রুনাই দেশটাকে প্রকৃতি ভালোবাসা উজার করে দিয়েছে – অরণ্য, সমুদ্র, সৈকত দিয়ে। প্রকৃতি ছাড়া এ দেশে বিশেষ কিছু দেখার নেই। তবে যা দেখার আছে তার মধ্যে অন্যতম হল ‘এম্পায়ার হোটেল’। শুধু হোটেল বললে অবশ্য তার শুদ্ধ মূল্যায়ন হয়ে উঠবে না। স্থাপনের পর থেকে এম্পায়ার হোটেল হয়ে উঠেছে ব্রুনাই-য়ের এক সিম্বল, সে দেশের আভিজাত্যের এবং সংস্কৃতির আইকন। আর শুধু তো হোটেল নয়, তার সাথে বিশাল গলফ কোর্স, সিনেমা হল, বোলিং এর জায়গা, বিশাল কনভোকেশন হল, এই সব মিলিয়ে হয়ে উঠেছে এম্পায়ার হোটেল অ্যান্ড কান্ট্রী ক্লাব।

    ব্রুনাই-য়ের প্রিন্স আর্চার নাকি এই হোটেল তৈরী করেছিলেন রাজ পরিবারের রিল্যাক্স করার, তাঁদের আত্মীয় এবং অতিথিদের থাকার জন্য এবং কালে কালে ২০০০ সাল নাগাদ এটা সাধারণ জনতার জন্য খুলে দেওয়া হয়। বেশ কিছু বিশ্ব বিখ্যাত ব্যক্তির পদার্পণ হয়েছে এই হোটেলে নানা সময়ে – মাইকেল জ্যাকসন ব্রুনাই-য়ে এলে এই হোটেলের ভিলা গুলোর একটাতেই ওঠেন। কিছু পাবলিক দাবী করে এই হোটেল নাকি ফাইভ স্টারের তকমা ছাড়িয়ে সেভেন স্টার এর পদমর্যাদা ভুক্ত হয়েছে!

    এম্পায়ার হোটেল এবং কান্ট্রি ক্লাব মিলিয়ে মোট জায়গা ১৪৫ একর (৪৩৫ বিঘা)! সেই হোটেলের রুম সংখ্যা প্রায় ৫২০ মতন। ডিলাক্স রুম, বিশাল বিশাল ভিলা ছাড়াও আছে ৬৬৫ বর্গ মিটার জুড়ে ‘এম্পায়ার সুইট’।, একদম পেন্ঠহাউসে – সেই সুইটে আছে প্রাইভেট সুইমিং পুল, সওনা এমন কি পুল রুমে মুভি প্রোজেক্টার পর্যন্ত আছে।

    ব্রুনাইয়ে বেশী কোন জায়গা ঘুরতে যাবার না থাকার জন্য, লোকজন প্রায়ই এই এম্পায়ার হোটেলে ছুটি কাটাতে আসত। বাড়ি থেকে একটু ড্রাইভ করে এসে উইক-এন্ড কাটানো বা এদের খুব ভালো রেষ্টুরান্টের একটাতে খেতে আসা অনেক ফ্যামিলির কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল। আর নিজের দেশ থেকে পরিবারের বা বন্ধুবান্ধব কেউ বেড়াতে গেলে তাদের সবাইকে এই এম্পায়ার হোটেল দেখাতে নিয়ে আসা বা থাকতে আসা একটা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল প্রায় সবার কাছেই।

    আমরা যখন প্রথম ব্রুনাই-য়ে যাই তখন এম্পায়ার ওদের হোটেলের মেম্বার হবার অফার ছিল। আমি প্রথম কয়েক বছর ছিলাম এম্পায়ার ক্লাবের মেম্বার, পরে কেন জানি না মেম্বার অফার ওরা বন্ধ করে দেয়। সেই মেম্বারশিপ ডিলে হোটেলে থাকা যেত, ব্রেকফাষ্ট, আরো এটা সেটা কি সব অফার – তবে যেটা মনে আছে তা হল, চেক আউটের দিন ওরা একটা বড়সড় কেক দিত। আমরা অনেকেই সেটা সাথে করে নিয়ে আসতাম, বেশী খেতে না পেরে বাড়ির কাজের লোককে অনেকটা দিয়ে দেওয়া। খুবই চমৎকার কেক বানাতো ওদের পেষ্ট্রী সেফটা।

    এই হোটেলের মার্বেলের কাজের ছড়া ছড়ি এবং মুগ্ধ হয়ে দেখার মত – সব মার্বেলই নাকি খোদ ইতালি থেকে আনা। হোটেলের ভিতর যেমন, বাইরেটাও তেমনি চমৎকার – একেবারে সমুদ্রের ধার থেকেই শুরু হয়েছে সুইমিং পুল এবং তার পাশেই হোটেলের বিখ্যাত রেষ্টুরান্ট। সেই রেষ্টুরান্টে বিশেষ বিশেষ দিনে ব্যুফের ব্যবস্থা থাকত, সি-ফুড স্পেশাল। অনেক দিন শুধু খেতে গেছি সেখানে। আর যখন হোটেলে থাকতে যেতাম তখন তো এক সন্ধ্যেবেলা এই রেষ্টুরান্টে খাওয়া মাষ্ট ছিল। এম্পায়ারে সাকুল্যে আট-টা রেষ্টুরান্ট ছিল। এদের ইতালিয়ান রেষ্টুরান্টও খুব ভালো ছিল, কিন্তু চাইনীজ ছিল তার থেকেও বেশী বিখ্যাত।

    আরো একটা খুব সুন্দর সময় কাটাবার যায়গা ছিল ‘লবি লাউঞ্জ’ – ব্রুনাই ড্রাই কান্ট্রি, তাই অনেকের এম্পায়ার হোটেলের মূল অসুবিধা ছিল এখানে মদের অনুপস্থিতি। ফলে লবি লাউঞ্জে বসে বিয়ার নয়, আপনাকে কফি, চা, লেমন টি বা আর যা কিছু নন-অ্যালকোহলিক ড্রিংক্সই খেতে হবে। এদের একটা খুব সুন্দর ট্রাডিশন ছিল, ব্রিটিশদের কাছ থেকে শেখা আর কি – এই লবি লাউঞ্জে বসে ‘হাই-টি’ খাওয়া। কফি-চা ইত্যাদির সাথে আপনাকে ওরা এনে দেবে স্পেশাল করে বানানো স্যান্ডউইচ, পেষ্ট্রী এবং নানাবিধ কেক। অনেকবার সেই লবিতে বসে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে কফি খেয়েছি।

    সুইমিং পুল তো বড়দের জন্য আছেই, পাশেই আছে ছোটদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী পুল। সমুদ্র সৈকতের বালিতে ফুটবল বা ভলিবল খেলার জায়গা, আছে টেনিস কোর্ট, স্কোয়াশ কোর্ট, ব্যাডমিন্টন – আর সেই বোলিং এবং বিশাল গলফ কোর্সের কথা তো আগেই বলেছি। চাইলে আপনি সাইকেল চেয়ে নিয়ে হোটেলের চারিদিকে চক্কর দিয়ে আসতে পারেন।

    আর ব্রুনাইয়ের মত জায়গাতেই সম্ভব যে এত বড় হোটেলের ভিতরে বাঙালী কুক খুঁজে বের করে ফেলা। আমাদের যে ব্যানার্জীদা পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি না খেতে পারার জন্য বেড়াতে যেতেই ইতস্তত করত কোথাও, সেই দাদা পর্যন্ত মাঝে মাঝে ঘুরতে আসত এম্পায়ার হোটেলে। শেষবার আমার জানামতে গিয়েছিল নিজের বিবাহ বার্ষীকি উদযাপন করতে। দাদার কাছে জলে ইত্যাদিতে নামা বা কিছু খেলা ধূলা করা অকল্পনীয় ব্যাপার – তাই দাদা গিয়ে গায়ে পাওডার লাগিয়ে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে হেঁটে হেঁটে সারা হোটেল ঘুরে বেড়াত। এবং খাবার আগে ফোন করে হোটেলের বাংলাদেশী কুকটাকে ডাল-ভাত বানাবার কথা বলে দিত। রুমে বসে বসে জানলা দিয়ে সাউথ চায়না সী দেখতে দেখতে ডাল-ভাত খাওয়ার আনন্দই আলাদা।

    আমার অনেক চেনা বাঙ্গালীর আবার হোটেলের ওই আটটা রেষ্টুরান্টের একটাও পছন্দ হত না – সেখানকার ইণ্ডিয়ান খাবার নাকি ভালো হয়! তাই প্রায় ৬ কিলোমিটার দূর থেকে অর্ডার দিত ‘বোম্বে প্যালেস’ বলে একটা রেষ্টুরান্টে – সেখান থেকে রুটি-ভাত-মাংস আসত এই সেভেন স্টার হোটেলের রুমে ডেলিভারী দিতে।

    এই হোটেলে অনেক সন্ধ্যা কাটিয়েছি আমি আর অমৃতা – মেহুলও গিয়েছিল একবার। একবার তো এই হোটেলের বলরুমে কি একটা পারফর্ম করেছিল অমৃতা, মনে হয় দিওয়ালী সেলিব্রেশন ইন্ডিয়ান কমিউনিটি থেকে। সূর্য যখন ডুবে আসত, তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যেতাম সমুদ্রের ভিতর দিকে – সেই ঝাউ বনের ভিতর দিয়ে এমন একটা জায়গাও বানিয়ে রেখেছিল এম্পায়ার হোটেল – সমুদ্রের ভিতরে বসে আমরা আলো জ্বলে উঠতে দেখেছি একে একে মৃদু ভাবে – আর পিছনে তখন সূর্য অন্ধকার ঘনিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে অমৃতার চুলগুলো আমায় ঝাপটা দিয়ে যায় –

    সঙ্গে ছবিগুলো নানা সময়ে এম্পায়ার হোটেলে থাকতে গিয়ে তোলা –




















    ----------------------------------------------------------------------------------------
    লাবি হোম স্টে – ব্রুনাই
    ----------------------------------------------------------------------------------------

    দক্ষিণ ভারতীয় বিশেষ করে তামিল হলে কল্যাণ-দাকে ব্রাহ্মণ বলে চালানো খুবই মুশকিল হয়ে যাবে। কারন আর বাকি পাঁচটা বাঙালী বামুনের মতই শৈবিক জিনিস পত্রে কল্যাণদার মোহ – যার মধ্যে মাংস এবং হুইস্কি প্রধান। আবার মাংসের মধ্যে যদি ছাগল, তদোপরি খাসির মাংস হয় তাহলে কল্যাণদা খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ত। দাদা একেবারে আমার দেশের লোক, বর্ধমানের কাছে কালনা গেট পেরোলেই কল্যাণ-দার এলাকা শুরু যাকে বলে। খাসির মাংস নিয়ে গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে কল্যাণদার গলা ধরে আসতে এবং চোখের কোন ছলছল করতে আমার নিজের সামনা সামনি দেখা। তবে আমাদের কাছে কল্যাণদা ছিল আদি অকৃত্রিম বাঙালী ব্রাহ্মণ – ব্রুনাইয়ে আমাদের সব পূজোই করত এবং সব পূজোর মন্ত্র ছিল ইউনিফর্ম এবং স্ট্যানার্ড।

    এবার ঘটনা হল, খাসির মাংস ব্রুনাই-য়ে পাওয়া যাবে কোথায়? আর খাসির মাংস চিনবেই বা কে? খাসির মাংস চিহ্নিত করে কিনে নিয়ে আসতে কলকাতার ছেলেদের পাঠানো আর দশটাকার লটারি কিনে এক কোটি টাকা জিতে কি করব সেই প্ল্যানিং করা একই সাকসেস প্রব্যাবেলিটির পর্যায় ভুক্ত। আমার নিজের খাসির মাংস নিয়ে বিশাল কিছু ফ্যানিনেশন ছিল না, ব্রুনাই সুপার মার্কেট থেকে কেনা অষ্ট্রেলিয়ান ল্যাম্বেই আমার দিব্য চলে যেত। তবে অমৃতা খাসির মাংস ভালোবাসত, সেই সূত্রেই ব্রুনাইয়ে কোথায় খাসির মাংস পাওয়া যায় তা নিয়ে মাথা ঘামানো আর কি। সেই খাসির মাংস কোথায় পাওয়া যাবে ব্রুনাই-য়ে, কবে, কোথায় এবং কিভাবে তার ডাটাবেস তৈরী করে আপডেটেড রাখার দায়ীত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল কল্যাণদা।

    তা এই ভাবেই কল্যাণদা একবার গোপন সূত্রে খবর আনলো যে লাবি বলে এক জায়গায় নাকি ছাগল চরে বেড়াতে দেখা গ্যাছে, কারা ফার্মিং করছে, এবং বললে ছাগল কেটে মাংস রেডি করে দেবে – এমন মাংস যাতে তখনো টাটকা রক্ত লেগে থাকবে। কিন্তু ছাগল কিনতে হবে গোটা – মানে পুরো ছাগলের মাংসটা নিলে তবেই তারা কেটে রেডি করে দেবে। মাংস যতই ভালো বাসুক কল্যাণ-দা একা একা ১২-১৪ কিলো মাংস রয়ে সয়ে খাওয়াটাও চাপের ছিল (ডীপ ফ্রীজে রেখেও) – ফলে এক হোয়াটস গ্রুপ সৃষ্টি হল যাতে কে কত মাংস নেবে তার বুকিং হত। কল্যাণ-দার পরেই সর্বোচ্চ বুকিং থাকত হাসান-এর। কেউ দুই, কেউ তিন এই ভাবেই মোটামুটি হয়ে যেত একটা খাসি উদ্ধার – আমার থাকত ওই কিলো দুই এর মধ্যে। শুভঙ্কর ব্রুনাই থেকে অন্য দেশে সিফট করে যাবার পর, বাঙালী খানেওয়ালা তেমন কেউ আর ছিল না।

    তবে মাংস প্রথম অর্ডার দেবার আগে কিন্তু কল্যাণদা সরোজমিনে তদন্ত করে এসেছিল লাবি গিয়ে যে মাল আদৌ খাসি কিনা। আর সেই দেখতে গিয়েই মনে হয় প্রথম সামনে আসে লাবি-হোম স্টে এর ব্যাপারটা। লাবি হল ব্রুনাইয়ের বেলাইত জেলার অন্তর্গত এক মুকিম – প্রায় ২৩০০ মত লোকের বাস সেখানে। জঙ্গল ছাড়া তেমন কিছুই নেই – ফলতঃ একেবারে মাটির কাছাকাছি লোকেরা ছাড়া সেখানে কেউ থাকত না তেমন। যারা থাকত তাদের মূল কাজ কর্ম ছিল চাষবাস এবং পশুপাখি পালন। এখান থেকেই আমরা দেশী মুরগি, হাঁসের ডিম, লেবু, পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদি সব পেতাম গ্রামীণ বাজারে। এখান থেকে চাষীরা বিক্রি করতে আসত বেলাইত হাটে শুক্রবার এবং শনিবার। সব তরতাজা মাল – আলাদা করে অরগ্যানিক নিয়ে ভাবতে হত না। সবই সেখানে প্রাকৃতিক। আমি এইখানে যা পুঁইশাক দেখেছি (এবং আরো নানাবিধ শাক) এবং যা খেতে ছিল, তেমন শাক এবং স্বাদ আমাদের দেশেও পাওয়া যায় না। কল্যাণদা এই মার্কেট থেকেই নিয়মিত ব্রাহ্মীশাক কিনে খেত। লাবি শুরু হত আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ৩০ মিনিট মত ড্রাইভ করে গেলে। তবে সেখান থেকে যত ভিতরে যাওয়া যায়, জঙ্গল তত ঘন হয়। খুবই সুন্দর জায়গা এবং সেই রাস্তায় গাড়ি চালাতেও দারুণ লাগত। আমরা এখানে মাঝে মাঝেই যেতাম – সেখানে এক ঝর্ণাও ছিল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে। তবে সেই নিয়ে গল্প পরের বার। এই বারের ফোকাস হোম-স্টে।

    তা যা বলছিলাম, সেই গভীর জঙ্গলেই ভিতরে এক ব্রুনাই-য়ের কর্ণেল বাড়ি বানিয়ে ছিল – বিশাল বাড়ি, মনে হয় খামার বাড়ি বা টাইম পাশের জন্যই বানানো। মাংস কিনতে গিয়ে কল্যাণদা খবর আনল এখন সেই বাড়িতে নাকি হোম-স্টে টাইপের করা যায়। দুই-দিন একরাত আউটিং-এর জন্য খুবই ভালো জায়গা – বাড়ি ভাড়া নামমাত্র। তবে বাইরে থেকে খাবার নিয়ে যাওয়া তেমন যায় না – সেখানে রান্নার ব্যবস্থা সব আছে। যারা কেয়ারটেকার তাদের ফ্যামিলি থাকে এবং তারাই এই খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা দেখাশোনা করে। মূল মালিকের এই বাড়ি ভাড়া দিয়ে পয়সা ইনকামের কোন ইচ্ছে নেই, খানি সেই কেয়ারটেকারদের খরপোষ উঠে গেলেই তারা খুশি। ঘুরে আসার পর যা বুঝেছিলাম, কেয়ারটেকার দ্বারা বাড়ির মালিকের পিছন মারা যাওয়া কেবল ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ নয়, ব্রুনাই-য়েও তা প্রবল ভাবে বর্তমান।

    গোটা বাড়িটা ভাড়া নিলে একটা সুবিধা ছিল, সবাই মিলে চেনাশুনার মধ্যে হইচই করা যাবে। চারটে পরিবার এঁটে যায় – সেবার গিয়েছিলাম আমরা, কল্যাণদা, সুব্রত এবং শীর্ষেন্দুদা – এই চার ফ্যামিলি। এর মধ্যে আবার শীর্ষেন্দু-দা অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য। দাদা আমাদের একেবারে নিরামিষ – পেঁয়াজ, রসুন পর্যন্ত খেত না। সকাল শুরু করত তামার এক ঘটিতে জল খেয়ে – দিন শেষ কি ভাবে করত মানে রাতে শুতে যাবার আগে ঠিক কি করত বলতে পারব না! শীর্ষেন্দুদার ডায়েটারি রিকোয়ারমেন্ট এতই স্ট্রীক্ট ছিল যে গোটা ব্রুনাই এর কেটারিং/রেষ্টুরান্ট তা কালে কালে জেনে গিয়েছিল। এবং তারা অস্যোসিয়েশন করে এক স্ট্যানার্ড মেনু বানিয়েছিল দাদার জন্য – আমাদের কেবল বললেই হত, পার্টিতে ব্যানার্জী-দা আছে, ব্যাস ঠিক খাবার চলে আসত। তবে লাবির ভিতরের জঙ্গলের গেষ্ট হাউসে সেই খবর পৌঁছায় নি। ফলে আমাদের এক্সর্টা এফর্ট দিতে হয়েছিল ব্যানার্জী-দা রান্নার জন্য।

    সেবারে ঠিক হল যে ছেলেরা রান্না করবে, আর মেয়ারা রিল্যাক্স করবে। ফলে আমি, সুব্রত আর কল্যাণদা করলাম রান্নার কাজ – শীর্ষেন্দু-দার রান্নার ব্যাপারে নলেজ ছিল এক্সামপ্লেরী – মানে দাদা আমাদের চা-কিভাবে করতে হয় সেটাও জানত না। ফলে চান টান করে পাওডার মেখে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী পরে ঘোরা ঘুরির মধ্যেই দাদার কার্যকলাপ সীমবদ্ধ ছিল। আমি করলাম খাসির মাংস রান্না, সুব্রত করল মুরগীর মাংস, কল্যাণদা করল ডাল। কল্যাণদা ডাল রান্না করতে গিয়ে এমন দিকে টার্ন নিল যে রূপা বৌদি এসে স্বামীর তথা বর্ধমানের মান রক্ষা করল। এর পর কল্যাণদার পোস্ত রান্না করার কথা ছিল, তবে ডালের গতি প্রকৃতি দেখে রূপা বৌদি আর স্বামীকে অ্যাডভেঞ্চারে সামিল হতে দিল না, বিশেষ করে যখন একগাদা ক্ষুধার্ত পাবলিক হাঁ করে বসে আছে। দুপুরের লাঞ্চ বেশ জমকালো হল।

    বিকেলের দিকে এদিক সেদিক ঘোরা ঘুরি – আশে পাশের ফার্মিং গুলো দেখা। চারিদিকে অপার শান্তি – তবে মশার খুব উপদ্রব, আর জঙ্গলে সন্ধ্যে নামে খুব তাড়াতাড়ি। এক সময় সূর্য ডুবে গেল – আমরা রাতে হালকা রান্না করলাম – খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হল বাঙালী ভাঁট। কর্নেল এর বাড়িটা এখন ভালো পপুলার হয়ে গ্যাছে, তাই বাড়ির সাইডে এক্সটেনশন হয়েছে – যেখানে অনেকে পার্টি দেয়। একটা স্টেজ সহ পার্টি হল আছে – সেই স্টেজে সঙ্গের বাচ্চারা গান বাজনা পরিবেশন করল। এমনকি মেহুল-ও হাতে মাইক নিয়ে ঘুরে ফিরে কি সব গান গাইল। বাড়ি ঘুরে বোঝা গেল কর্ণেল এর সাথে ব্রুনাইয়ের সুলতানের বেশ খাতির ছিল। তবে ব্রুনাই-য়ের তো আর কোন পাকিস্তান নেই, ফলে যুদ্ধু যুদ্ধু খেলার অবকাশ বা রাজনৈতিক তাগিদও নেই সুলতানের। ফলে কর্ণেলের যুদ্ধের ছবি বিশেষ কিছু দেখলাম না – তবে এদেশ ওদেশ থেকে পাওয়া শ্যুভেনিয়র দেখলাম বেশ কিছু। কেন পেয়েছিল কে জানে! নীচে লেখা ছিল ছবির – কিন্তু আর পড়ে দেখতে ইচ্ছে হয় নি সেই রাতের অন্ধকারে।

    রাত বাড়লে একটু মদ্য পানের প্রস্তাব উঠল – যদিও সেই গেষ্ট হাউসে মদ্যপানের সামনা সামনি অনুমতি নেই (ব্রুনাই ড্রাই কান্ট্রি), তবে অন্য ভাবে কি আর একটু খাওয়া যাবে না! সুব্রত বেশী কথার মানুষ না – আর হালকা না পান করলে সুব্রত গলা আবার ভালো খোলে না। মেয়েরা সব শুয়ে পড়লে আমি সুব্রত আর কল্যাণদা নীচের একটা কনফারেন্স রুম টাইপের আছে, সেখানে খানিক ভাঁট মেরে শুয়ে পড়লাম।

    পরের দিন সকালে খুব ভোরে উঠে আমি বাইরে দিয়ে হেঁটে এলাম – শীর্ষেন্দু-দা একমাত্র দেখলাম উঠেছে, তামার ঘটিতে জল খাচ্ছে। আর একটু বেলা হলে সবাই উঠে ব্রেকফাষ্ট করে একটু জঙ্গলের দিকে যাওয়া হল, হালকা টেকিং করতে – একটা ঝর্ণা, ছোট নদী মত আছে – তার পাশে কিছু হেঁটে, কিছু বসে টাইম পাশ হল। দুপুরের দিকে ফিরে চান-টান করে ডিমের ঝোল ভাত, হালকা রান্না, ওই দিক রান্না কেয়ারটেকার করেছিল – একটা শাক, আলুভাজাও মনে হয় দিয়েছিল।

    দুপুরের খাবার শেষে ব্যাগ ইত্যাদি গুছিয়ে একটু হালকা রেষ্ট নিয়ে ফেরার পালা – বিকেল হয়ে গিয়েছিল, আমাদের গাড়ি বনের ভিতর দিকে আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে চলেছে, গাছের ফাঁকে সূর্য ডুবে আসছে আস্তে আস্তে – মেহুল ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের সবুজ দেখছে – নিজের ঘর আর খানিক দূরেই –














    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৬ জুন ২০১৯ | ১৭৬১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকি | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০২:৪৫48848
  • আমি এটা শুরু করলাম - অমিতাভদাও আশা করি আবদান রাখবে :)
  • Ela | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৩:৪৮48849
  • ব্রুনাইতে কি শিশুদের ভূতের আধিক্য? ঘটনাগুলো পড়ে কেমন মনখারাপ হয়ে গেল।

    আমার মা, ৭৩ বছর বয়স, কোনও শিশুমৃত্যুর কথা শুনলে বা কাগজে পড়লে বলেন, আহা ভগবান তো বদলে আমাকে নিতে পারতেন। সঙ্গত কারণেই আমি তাতে নানা আপত্তি জানাই।

    আজ আপনার লেখা পড়ে আমারও সেই একই কথা মনে হল। বদলে আমি গেলে কি এমন খারাপ হত!
  • Amit | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৪:০৩48850
  • না হে সুকি। আমি ভগবানে একদম বিশ্বাস করিনা, কিন্তু ভুতে পুরো মাত্রায় করি। কখনো একা থাকলে আমি টিভি চালিয়ে, আলো জ্বালিয়ে ঘুমোই, ভাবি টিভি র আওয়াজ পেলে হয়তো ভুত বাবাজি বুঝবে না আমি একা আছি। তাই ব্রুনেই থাকতে বিশেষ আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়নি। ভাগ্যিস হয়নি, তোমার ওই সব দেখলে যে আমি ভিরমি খেতুম নিশ্চিত।

    বৌ অবশ্য বলে যে আমি এতটাই বদখত যে ভুতেও ছোঁয়না, সে অন্য গল্প।
  • dd | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৪:১১48851
  • ব্রুনেইতে অ্যাতো ভুত।

    আর সব ধর্ম সর্ব জাতি সমন্বয়। এ তো ভুতের UNO।
  • dc | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৫:৫৯48852
  • বাবারে ব্রুনেই তাহলে কখনো ঘুরতে যাবো না। অমিত এর সাথে আমার খুব মিল দেখছি, আমিও ভুতে পুরো মাত্রায় বিশ্বাস করি আর একা থাকতে হলে টিভি চালিয়ে দি। বা ঘুমনোর সময়ে হেডফোনে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি যাতে ভুতুড়ে কোন আওয়াজ কানে না ঢোকে।
  • সুকি | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৬:১৮48853
  • এলা,
    ব্রুনাই-য়ে শুধু শিশু ভূত এমন ব্যাপার নয়। কথিত আছে যে ব্রুনাইয়ের দুই প্রান্তের দুই শহরের মধ্যে সংযোগকারী যে হাইওয়ে আছে তার ধারে মাঝে মাঝে একজনকে লিফট চাইতে দেখা যায় গভীর রাতের দিকে। লিফট চায় ঠিক আছে - কিন্তু তার মুন্ডু দেখতে না পাবার জন্য পাবলিক একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে।

    অমিতাভদা,
    আমার প্রশ্নটা ঠিক ক্লীয়ার হয় নি - মানে ভূতের গল্প শুধু বলি নি, ব্রুনাই-য়ের অভিজ্ঞতার গল্পও তোমার কাছে হয়ত কিছু আছে, সেটা শেয়ার করার কথাই বলছিলাম।

    ডিডিদা,
    হ্যাঁ যা হয় আর কি - প্রচুর এক্সপ্যাট কাজ করে ব্রুনাইয়ে বলে নানা ভুত জড়ো হয়েছে।

    ডিসি,
    আপনার কানে হেডফোন লাগিয়ে শোবার ফান্ডাটা মনে ধরল - এটা এবার প্রযোগ করব।
  • Amit | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ০৬:১৯48854
  • তাহলেই দেখেন গ্রেট পিপল থিঙ্ক alike
  • Atoz | ***:*** | ১৬ জুন ২০১৯ ১০:৫৯48855
  • ও বাবা, ভূতে ভূতে ছয়লাপ। ডাইনে ভূত বাঁয়ে ভূত।
    ওই ফুলবাগানের বাড়ির ব্যাপারটায় আমি তো প্রথমে মনে করেছিলাম, মহিলাই ভূত। বর মানুষ বৌ ভূত, মিলেমিশে থাকে। আশেপাশের কাপল অনেকেই হয়তো এরকম। বৌ মানুষ বর ভূত অথবা উল্টোটা।
    মানুষে ভূতে দাম্পত্য কলহ হবারও চান্স নেই, কারণ মানুষে না হয় ঝগড়া করতে পারে, মারামারিও করতে পারে, কিন্তু ভূত কী করে ঝগড়া করবে বা মারামারি করবে?
  • সুকি | ***:*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০১:১৫48858
  • এই তো অমিতাভদা লিখছে - আমি তোমার সাথে একমত, পুরো বোর্ণিও টাই ভূতে ভর্তি :)

    বাই দি ওয়ে বিনটুলুতে কি LNG নাকি GTL এ কাজ করছিলে?
  • Amit | ***:*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০৬:৩৮48856
  • তবে একটা ছোট ঘটনা শোনো। ব্রুনেই ঠিক নয়, তবে বোর্নিও র মধ্যেই। বিন্টুলু বলে একটা ছোট শহরে ছিলুম তখন, বেশ বড়ো LNG প্লান্ট এক খানা তে প্রজেক্ট চলছিল। ব্রুনেই বর্ডার থেকে ২৫০ মাইল হবে। সেরকমই ঘন জঙ্গল, ওরকম ঘন জঙ্গল আর দেখলুম না কোথাও দুনিয়ায়, দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। অফিস টাও বেশ গাছ পালা ভর্তি, সাপ তো প্রায়ই বেরোয়। আমি বর্ষাকালে গাম বুট ছাড়া সাইট যেতাম না পারতপক্ষে। এমিনিতেও যেতাম না অবশ্য, আমি চিরকাল ই চূড়ান্ত অলস।

    সেখানে একা থাকতে হচ্ছিলো, কারণ স্কুল এর বড্ডো সমস্যা ছিল, সব মালয় মিডিয়াম। একটা শেল এর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ছিল , কিন্তু শালারা তখন ওখান থেকে পাততাড়ি গুটানোর প্ল্যান করছিলো, তাই স্কুল টা বন্ধ করার তালে ছিল। হারামজাদারা কিছুতেই আমাদের বাচ্চা দের ভর্তি নিলো না। হারামজাদা টা শেল কে নয় কিন্তু, ওই স্কুল এর অ্যাডমিন কে বললাম। :) :)

    তখন মেজর প্রজেক্ট চলছে খান কতক, ইচ্ছে না থাকলেও সন্ধ্যে বা রাত অব্দি কাজ করতে হচ্ছে, ফ্যামিলি ব্যাক টু ইন্ডিয়া, আমি বাড়ি ফিরেই বা কি করবো। সঙ্গে মালয়েশিয়ান বাচ্চা কেয়কটা ছেলে মেয়ে। বেশ হাসি খুশি, লোক গুলো কিন্তু ইন্ডিয়ার মতো অফিস সারাক্ষন টেনশন এ বসে থাকে না বা কাঠি দেয় না, সিম্পল লোকজন। তো বেটারা সন্ধে হলেই কেটে পড়ে, আমাকে বেশ কদিন রাত অব্দি থাকতে হয়েছে অফিস এ। প্রায় বা পুরো একাই।

    একটা চীনা ছেলে আমার ২-৩ তে টেবিল পরেই বসতো। কোনোদিন শালাকে দেখতাম না সন্ধের পর থাকতে, কোনো না কোনো নাইট ক্লাব এ গিয়ে মাল খেয়ে মারামারি করা ছিল তার প্রিয় পাস টাইম। ওটাকে ১-২ বার পুলিশ স্টেশন থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল আমাদের ম্যানেজার। সবার সামনে ওকে খিস্তি করেছে বহুবার, কিন্তু ভবি ভোলাবার নয়। অনেকটা মুজতবা আলী র সেই চাচা কাহিনীর অস্কার র মতো।

    আমি একদিন অফিস এ বসে আছি সন্ধের পরে, প্রায় একাই বলা যায়, এতো বড়ো অফিস এ অন্য দিকে কেও থাকলেও আওয়াজ পাওয়া যায়না। আর লোকগুলো বেশি হৈচৈ করে অফিস এ আড্ডাও দেয় না। মনে হলো সেই মালটা অফিস এ খুট খৎ করছে। আমি পাত্তা না দিয়ে কাজ করছি। একটু পরে বেরিয়ে গেছি। তো কদিন পর পর এ রকম হয়েছে, আমি একদিন লাঞ্চ এর সময় ওকে ধরেছি কি হে তোর কাজে খুব মন দেখছি আজকাল। আজকাল আর সন্ধে হলেই মারামারি করতে যাচ্ছিস না, সে দেখি আমার দিকে হা করে চেয়ে আছে। ওর পাশের বন্ধু টা বলে ও তো লাস্ট কদিন দুপুরেই কেটে পড়ছে এক নতুন গার্ল ফ্রেন্ড কে পটাতে। ম্যানেজার টা মাটির মানুষ ছিল মাইরি ( "মা মাটি মানুষ" না কিন্তু) , একটু কাতর সুরে কেও ছুটি চাইলে দিয়ে দিতো, নিজেও শুক্কুরবার হলেই কেট্যে পড়তো কুয়ালামপুরে। তো সে বাড়িতে কার অসুখ বলে লাস্ট এক সপ্তাহ কেটে পড়ছে আর তাকে নাকি শপিং মলে আইস ক্রিম খেতে দেখেছে অনেকে। তো বাচ্চা ছেলে প্রেম করবে না তো কি আমরা বুড়োরা করবো।

    তো সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবি নি আর, ভাবলাম অন্য কেও হয়তো ওর টেবিল এ কিছু খুঁজছিলো। কিন্তু সেই বেটা গিয়ে আরো কজনকে জিগিয়েছে, তারপর সবাই এসে আমাকে ধরেছে আমি কবে কবে শুনেছি এসব কান্ড। তারপর আলোচনা করে দেখে কেও তো ছিল না অফিস এ তখন, সবার দম বেরিয়ে গেছে। মাইরি বলছি আমি তখনও ভয় পাইনি, আসলে অত ভাবিও নি। ভেবেছি সিকিউরিটি বা অন্য কেও এসে হয়তো দেখছে কেও কোনো বাওয়াল করছে কি না, খালি অফিস এ একটু ইনটু মিন্টু কেস দু একটা হচ্ছিলো বটে এদিক সেদিক। ম্যানেজার টা একটু দুঃখ করে বলতো আমাকে মাঝে মাঝে আজকাল কার ছেলে মেয়ে গুলোর নৈতিক স্খলন নিয়ে।

    তার দুদিন পরে বিশাল হৈ চৈ। আমি তার আগের দিন জলদি বেরিয়ে গেছি আলো থাকতে থাকতে, একটা মেয়ে নাকি একা ছিল, সে নাকি সন্ধের পরে একটা সাদা মূর্তি কে ভেসে যেতে দেখেছে ওই অফিস এ, আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে, দেখেই চেঁচিয়ে অজ্ঞান। জানিনা হ্যালু ছিল নাকি গাজা ফাজা খেত একটু আধটু। তারপর সে নাকি জ্ঞান ফিরতে নিজেই কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে সিকিউরিটি কে ডেকে এনেছে, অনেকটা দূরে সেই অফিস। সিকিউরিটি এক্সেস কার্ড ডাটা কম্পু চেক করে দেখেছে ওই সময় মেয়েটা ছাড়া আর পুরো বিল্ডিং এ কেও নেই। জানিনা কেও শয়তানি করেছে কি না , কিন্তু এক্সেস কার্ড ছাড়া ঢোকাটা বেশ চাপের আর কি।

    তো সেদিন দিনের বেলা সবাই বেদম চেঁচামেচি জুড়ে দিলো অফিস এ, ওখানে লোকে মারাত্মক বিশ্বাস করে এসবে। লোকাল ওঝা ডেকে এনে বেশ কিছু শান্তি শস্ত্যন হলো, বেশ রেড ইন্ডিয়ান টাইপের পালক লাগানো টুপি পরে এসেছিলো ওঝা মশাই। গোটা অফিস এ গোল মরিচের গুঁড়ো ছড়ালো, তাতে নাকি ভুত পালাবে। ভুতের কথা জানি না, আমাদের বেশ হাঁচি হলো সেদিন।

    আর আমি, মাইরি বলছি তার আগে কোনোদিন ওসব নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবি নি, কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর কোনোদিন একা অফিস এ থাকি নি, কেও থাকে নি, সন্ধে হলেই সব হাওয়া। আর মোটামুটি তার পর থেকে আমার এমন ভয় লেগে গেলো যে, আমি একটা বেশ বড়ো বাড়ি নিয়ে থাকতাম একাই, সোজা সেসব ছেড়ে পেয়িং গেস্ট হয়ে ঢুকে গেলাম একটা মালয় ফ্যামিলি র সাথে, মোটা মুটি তিন মাস পরে প্রজেক্ট শেষ হলো আর আমি ও পত্রপাঠ হাওয়া, সোজা ব্রুনেই তে এসে ল্যান্ড করলাম।

    তাই বলছি বাওয়া, শুধু ব্রুনেই এক না, পুরো বোর্নিও আইল্যান্ড ই মনে হয় বেদম ভুতুড়ে জায়গা।
  • ন্যাড়া | ***:*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০৭:৪২48859
  • সুকি তো দেখি ধুঁয়াদার ছেলে। সকালে তাগড়াই আ্যলুমিনিয়াম স্ট্রাকচারে উঠল, বিকেলে সেটা হেলে ঝুলতে লাগল!
  • শঙ্খ | ***:*** | ১৭ জুন ২০১৯ ০৮:১৯48857
  • বাহ।
  • Amit | ***:*** | ১৭ জুন ২০১৯ ১০:৩০48860
  • সুকি, LNG তে ছিলুম, GTL টা ওটার একেবারে পাশেই। একটা তে সাইরেন বাজলে অন্যটাতে সোনা যেত।
  • সুকি | ***:*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০১:০৬48863
  • ন্যাড়াদা,
    ধাতুবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করেও অ্যালুমিনিয়ামের পতন প্রেডিক্ট করতে পারি নি, এই দুঃখ আর রাখব কোথায়।
  • - | ***:*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৪:২১48861
  • সোনা যেত? সাইরেন বাজিয়ে?
  • Amit | ***:*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৪:৫২48862
  • ওহ, ওটা "শোনা যেত" হবে।

    :) :)
  • aranya | ***:*** | ১৮ জুন ২০১৯ ০৫:৩২48864
  • ইয়ে, সুকি, ভৌতিক ঘটনা সমূহ কি সত্যিই তোমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা?
  • সুকি | ***:*** | ০৪ জুলাই ২০১৯ ০৩:৪৬48865
  • আরেকটা পর্ব যোগ করলাম।

    অরণ্যদা,
    আপনার প্রশ্নটা মিস করে গিয়েছিলাম। উত্তর তেমন কিছু নেই যদিও, মানে ভূতে বিশ্বাস না করলে, ভূতের দেখা মেলা চাপের :)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন