এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • আমেরিকার নির্বাচন এবং বিভাজন 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১৩৪ বার পঠিত
  • আমেরিকা নির্বাচনে একটা জিনিস সবাই জানে, কিন্তু কক্ষনো গভীরে ঢোকেনা, সেটা হল গ্রাম-শহরের বিভাজন। বস্তুত ভারতের থেকে বিভাজনটা অনেক বেশি। যদি কাউন্টি ধরে লাল আর নীল ম্যাপ দেখেন তো পিলে চমকে যাবে। প্রায় পুরোটাই লাল, অর্থাৎ রিপাবলিকান। খুচরো-খুচরো কিছু জায়গায় নীলের ছিটে । অঙ্কের হিসেবে মোটামুটি ২৫০০ রিপাবলিকানদের দখলে। আর ডেমোক্রাটরা তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ২০%। তাহলে নির্বাচনে কমবেশি ৫০-৫০ হয় কীকরে? কারণ, রিপাবলিকানরা যে কাউন্টিগুলো পায়, তার প্রায় সবটাই গ্রামে এবং কিছুটা শহরতলীতে। সেখানে লোক কম। আর বড় শহরে থাকে একটা বিপুল জনসংখ্যা। সেটা ডেমোক্রাটদের ঘাঁটি। 

    এই দুই এলাকার বিভাজনটা কিন্তু বিপুল। এবার বড় শহরে, এক্সিট পোল অনুযায়ী ডেমোক্রাটরা জিতেছেন মোটামুটি ৬০-৪০ ব্যবধানে। আর গ্রামে ঠিক উল্টো। ট্রাম্প জিতেছেন মোটামুটি ৬৫-৩৫ ব্যবধানে। বিশ্বের আর কোথাও এত প্রকট ব্যবধান দেখা যায় কিনা সন্দেহ। শহরতলীতে একটু মিশ্র। ট্রাম্পই একটু এগিয়ে (৫১-৪৭)।  এই বিভাজনটা তিরিশ বছর আগেও এত প্রকট ছিলনা। ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, এবং গত তিনটে নির্বাচনে একদম লাইন কেটে দেখিয়ে দেওয়া যায়।  

    কথা হল, এর থেকে কী বোঝা যায়? শহরে এবং শহরের সমৃদ্ধ শহরতলীতে থাকে দুই ধরণের লোক। এক, একদম গরীবস্য গরীব। এবং তার একটা বিরাট অংশ কালো। দুই, সমৃদ্ধ 'আধুনিক' 'শিক্ষিত' লোকজন, হোয়াইট কলার যাঁদের বলে।  সার্ভিস সেক্টরের বিরাট অগ্রগতি হয়েছে গত আড়াই দশকে।  দশ বছর আগের একটা ডেটা থেকে দেখা যায়, শহরের ৬০%ই কাজ করতেন সার্ভিস সেক্টরে (২০১৪ সালে) এর মধ্যে এসেছে নানা হাইটেক কাজ। ফিনান্স, রিয়েল এস্টেট, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইটি এবং আইটি নির্ভর কাজ পুরোটাই শহরে।সংখ্যাটা ১০ বছরে বেড়েছে নিঃসন্দেহে। এই বিপরীতমুখী দুই মেরুর বাসিন্দারা একযোগে মূলত ডেমোক্রাটদের বিরাট ভোটব্যাঙ্ক। আরেক ধরণের শহরতলী আছে, যেখানে সংগঠিত বা অসংগঠিত শ্রমিকরা থাকেন, এঁরা ব্লু কলার কাজ করেন, কিন্তু অতটা গরীব নন। এই অংশটা নিয়ে জোর টক্কর। এই মুহূর্তে যা মনে হচ্ছে, ট্রাম্প এই অংশটার বড় সমর্থন পাচ্ছেন। এটার স্বপক্ষে এখনও তথ্য নেই, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই এসে যাওয়া উচিত। 

    উল্টোদিকে গ্রামের চরিত্রটা আলাদা। সেখানে সার্ভিস সেক্টর ৪০%। কিন্তু হাইটেক খুবই কম। এছাড়া বাকিটা ভর্তি মধ্যবিত্ত বা গরীব (অল্প কিছু বড়লোক), ব্যবসায়ী, সরকারি চাকুরে, উৎপাদন বা নির্মাণ শ্রমিক, চাষী, এইসব। মূলত সাদা এলাকা। এই বিস্তীর্ণ গ্রাম আমেরিকা ট্রাম্প তথা রিপাবলিকানদের ভোটার। 

    এই বিভাজনটা খুব কৌতুহলোদ্দীপক। লক্ষ্য করে দেখবেন, ডেমোক্রাটদের ট্রাম্পবিরোধী প্রচার মূলত আজকের আইডেন্টিটি পলিটিক্স নির্ভর (অর্থনীতি নিয়ে নানা কথা বলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু অর্থনীতি বা স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে ভেঙে পড়ার মুখে, সেটা একদমই স্বীকার করেননা)। তাঁদের ফোকাসে সবসময়ই থাকে ট্রাম্প জাতিবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী ইত্যাদি। বড় সার্ভিস সেক্টর কোম্পানিগুলোও এই আইডেন্টিটি পলিটিক্সের খুব বড় সমর্থক। কৌশলটা মহিলাদের মধ্যে সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। হিলারি মহিলাদের ১৩% ভোট বেশি পেয়েছিলেন, বাইডেন ১৫%। কিন্তু কমলার ক্ষেত্রে সেটা নেমে এসেছে ৮% এ।  কিন্তু শহরের সমৃদ্ধ এলাকার পুরুষ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই কাজ করেছে বলে আন্দাজ করা যায় (যদিও এখনও আলাদা কোনো তথ্য পাইনি) কালোদের ক্ষেত্রে কাজ করেছে, হিস্পানিকদের ক্ষেত্রেও, তার তথ্য আছে। ক্রমশ কমছে, তাহলেও শহুরে কালো ভোটব্যাংক, ডেমোক্রাটদের ক্ষেত্রে এখনও অব্যাহত।

    উল্টোদিকে ট্রাম্পের মূল ফোকাস প্রথম থেকেই ভেঙে পড়া অর্থনীতি, মূল্যবৃদ্ধি। অন্য দেশ থেকে লোক এসে কাজ খেয়ে নিচ্ছে, বিদেশে  যুদ্ধ করে বাজে খরচা হচ্ছে, সবই ওই একই প্যাকেজের অংশ। এটা গ্রাম এবং একটু পিছিয়ে পড়া শহরতলীতে খুব ভালো কাজ করেছে। যাঁরা মনে করছেন, অর্থনীতি দারুণ চলছে, তাঁরা অবশ্যই  এই বাজারে সমৃদ্ধ লোক, তাঁদের মোটামুটি ৯০% কমলাকে ভোট দিয়েছেন। দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক সেটা মনে করছেন না, তাঁদের বড় অংশটাই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। সেই জন্যই ট্রাম্প গ্রামে ভোট বিপুলভাবে বাড়িয়েছেন, এমনকি শহরতলীতেও খানিকটা। এমনকি, মহিলা, কালো, হিস্পানিক, সর্বত্রই থাবা মেরেছেন। 

    মোদ্দা কথা হল, এই ভোটটা পুরোটাই শ্রেণীভিত্তিক হয়েছে। শহুরে আইডেন্টিটি পলিটিক্স সম্পূর্ণ ডাহা ফেল করেছে। শ্রেণীভিত্তির নাড়ি  ট্রাম্পের মতো লোক ধরতে পেরেছেন, আর শিক্ষিত ও বুদ্ধিমানরা পারেননি, এ দুঃখের হলেও, অপ্রত্যাশিত কিছু না। সারা পৃথিবীতেই মেধাবীদের এরকম দুর্দিন, নইলে অবস্থা এদিকে গড়াতনা। বার্নি স্যান্ডার্স বলেছেন, (হুবহু নয়), যে, শ্রমজীবী মানুষকে ডেমোক্রাটরা ভুলে গেছে, আশ্চর্যের কিছু নেই, শ্রমজীবীরাও ডেমোক্রাটদের ভুলে যাবে। খুব খাঁটি কথা। কিন্তু উনি সেনেটে লড়তে পারছেন, আর এই লড়াইটা কেন লড়ছেন না, তার ব্যাখ্যা দেননি। 

    এই কেবল এবং কেবলমাত্র আইডেন্টিটি-পলিটিক্স, এটা গত কুড়ি বছরের একটা নতুন ঘটনা। বড় পুঁজির একটা অংশ এটাকে এনডোর্স করে, সন্দেহ হয়, অ্যাজেন্ডাটা মূলত তাদেরই, ডেমোক্রাটিক পার্টি শুধু আজ্ঞাবহ মাত্র। পুরোনো পুঁজিপতিরা উল্টো ঘরানায়, তারা সোজাসাপ্টা শোষণে বিশ্বাস করে। সেটায় অনেকে রেগে গিয়েছিলেন। পুঁজি এবং এনডোর্সমেন্টের ভাগাভাগি করে দেখানোই যায় জিনিসটা। ১০০% মিলবে না, কিন্তু বেশিটাই মিলবে। কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই, কারণ, বিভাজনটা ভোটারা জলবৎ তরলং করে দিয়েছেন। 

    সূত্রঃ 
    এক্সিট পোলঃ https://www.cnn.com/election/2024/exit-polls/national-results/general/president/
    বিভিন্ন বছরের তুলনাঃ https://www.cnn.com/interactive/2024/politics/2020-2016-exit-polls-2024-dg/
    ২০১৪ সালের তথ্যঃ https://www.ers.usda.gov/data-products/chart-gallery/gallery/chart-detail/?chartId=78844
    ২০২৪ এর একটা তথ্যও আছে, কিন্তু লেখায় ব্যবহার করা হয়নি, আবার অন্য সূত্র খুঁজে অঙ্ক করতে হবে বলেঃ https://www.bls.gov/emp/tables/employment-by-major-industry-sector.htm
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১১৩৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Debasis Bhattacharya | ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:৫০539250
  • গুরু, 
     
    পেপারটি ইন্টারেস্টিং। হদিশ দেবার জন্য ধন্যবাদ! 
     
    আচ্ছা, আরেকটা কথা বলি। 'ALTER' ভাল চ্যানেল, কিন্তু ওটা হরর শর্ট মুভি-র, সাই ফাই নয়। ভাল সাই ফাই শর্ট দেখতে হলে 'DUST' দেখুন। 
  • Guru | 103.25.***.*** | ০৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:৫৯539270
  • @দেবাশীষ বাবু , অনেক ধন্যবাদ |
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন