এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • ২১শে জুলাই 

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ২১ জুলাই ২০২৫ | ৫১৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সমস্ত ইতিহাসের মধ্যে এই একুশে জুলাইয়ের ইতিহাসটাই একদম স্মৃতি থেকে বলতে পারি। তখন ৯৩ সাল।  এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়ে গেছে, দাঙ্গা-টাঙ্গাও, হয়েছে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোথায় বিজেপি? লোকে বলত, ওসব তো গোবলয়ের অসভ্য কাণ্ডকারখানা, এখানে শুধু সিপিএম-কংগ্রেস। সিপিএম তখনও ৭২-৭৭ এর কংগ্রেসি গুণ্ডামি আর ১১০০ কর্মী খুন হবার কথা নিয়ে ব্যস্ত। এখন যেমন ৩৪ বছর, তখন ছিল ৭২-৭৭। আর কংগ্রেস ভাবত, এত খুন-জখম-ধর্ষণ-টর্ষনের পরেও, এই সিপিএম ব্যাটারা জেতে কীকরে। গনিখান সোজাসাপ্টা লোক ছিলেন। ভোট-টোটের চক্করে না গিয়ে স্টেনগান হাতে নিয়ে সিপিএমকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলেছিলেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের ধারণা ছিল লোকে ভোট দিতে পারলেই তিনি জিতবেন। ওইজন্যই ৯৩ সালে বাধ্যতামূলক ভোটার কার্ডের দাবীতে মিছিল ডেকেছিলেন ২১ জুলাই। 

    তখন মমতা মিটিং ডাকলেই গুছিয়ে ভিড় হত। তার একটা কারণ হল, তিনি ক বছর আগে হাজরা মোড়ে সিপিএমের হাতে মার খেয়ে মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ছিলেন। অতএব তিনি লড়াকু আর সিপিএম বিরোধী। বাকি সব কংগ্রেসি নেতাদের, দলের কর্মীরাই বলত তরমুজ। ফলে সেই মিটিংএও প্রচুর লোক হল। দিদির ভাইরাও সেই সময় ছিল খুব জঙ্গী। ঘটনাস্থলে ছিলামনা বলে গ্যারান্টি দিতে পারবনা, তবে শুনেছি, তারা পুলিশ কর্ডন ভাঙার প্রচুর চেষ্টা করে। ইট-পাটকেলও ছোঁড়ে। পুলিশরা আহত হয়। এবং  পুলিশ সেসময় ছিল আরও জঙ্গী। তারা দুচাট্টে ইট খেলেই, প্রথমে একটু কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে, সোজা দড়াদ্দম গুলিতে চলে যেত। সেবারও যায়, এবং খান তেরো-চোদ্দো লোককে মেরে ফেলে।

    পরের বছর থেকেই শুরু হয় ২১ জুলাই শহীদ দিবস পালন। এর আগে শহীদের ব্যাপারটা একচেটিয়া ছিল সিপিএমের। ৭২ থেকে ৭৭, একটা-দুটো না, ১১০০ শহীদ। তখন দেয়ালে ইন্দিরা গান্ধির বড় বড় নখ আঁকা হত, আর সেই নখ থেকে রক্ত ঝরত। পাল্টা কোনো শহীদ ছিলনা। ২১ জুলাই কংগ্রেসকে কিছু শহীদ দেয়। তরমুজ কংগ্রেস নেতারাই হইহই করে পালন করতে শুরু করেন। 

    এইভাবে কয়েক বছর চলে। তারপরই নাটকীয় পটপরিবর্তন। ১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করে ফেলে কংগ্রেসকে দক্ষিণবঙ্গে প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত করেন। বিজেপির সঙ্গে জোট বাঁধেন। বিজেপির সভাপতি তপন শিকদার, সবাইকে আশ্চর্য করে দমদম থেকে জিতেও যান লোকসভায়। সেই জয় নিয়ে লোকে বহুদিন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করত। কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টরা বলত, এতে সুভাষ চক্রবর্তীর হাত আছে। সুভাষবাবু কখনও আমাকে কোনো গোপন মিটিং এ না ডাকায় সত্যাসত্য বলতে পারবনা। 

    কে জানে কেন, সেই বছর থেকেই ২১ জুলাই তৃণমূলের শহীদ দিবসে পরিণত হয়। কংগ্রেস আর ওই বস্তু কখনও পালন করেনি। ভাগাভাগি হলে সব শহীদই নির্ঘাত তৃণমূলে চলে যেতেন, এটা হয়তো তাঁরা জানতেন। কী আত্মবিশ্বাস, ভাবা যায়না। ওদিকে সেই সময়ই চলতে থাকে সিপিএমের সোনার সময়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৭। ৯৬ সালে জ্যোতিবাবুকে সারা ভারতের সব দল মিলে ঝোলাঝুলি করতে থাকে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য, কিন্তু সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটি দুবার মিটিং করে বলে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী  হওয়াটা একদমই ভালো ব্যাপার না।  ২০০৪ এ বামপন্থীরা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসন পায় লোকসভায়। ২০০৬ সালে বুদ্ধবাবু পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সিপিএম নেতা হিসেবে আনন্দবাজারের খেতাব ( ব্র‌্যান্ড বুদ্ধ) পান। উল্টোদিকে মমতা সেবার লোকসভায় নিজে ছাড়া আর কাউকে জেতাতে পারেননি। বিজেপির সঙ্গেও ঝগড়া করে ছেড়ে চলে এসেছেন কদিন বাদে। তখন ২১ জুলাই হত খুবই টিমটিম করে। কীভাবে হত, কে জানে, ঠিক মনেও নেই। 

    ২০০৭ সাল থেকে মমতার কপাল ফেরে। বুদ্ধবাবু ঠিক করেন  পশ্চিমবঙ্গকে সিঙ্গাপুর বানিয়ে দেবেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন শুরু হয়। পুলিশ আবার গুলি করে ১৪ জনকে মারে নন্দীগ্রামে। ২০১১ সালে মমতা ক্ষমতায় আসেন। ২১ এ জুলাইয়ের  সময় যিনি পুলিশ কর্তা ছিলেন, তিনিও সোজা চলে আসেন তৃণমূলে। মমতা জ্যোতিবাবুকে গিয়ে প্রণামও করে আসেন। কোনটা সৌজন্য, কোনটা কী, জানিনা, কিন্তু ২১শে জুলাইও আকার-প্রকারে বাড়তে থাকে। কংগ্রেস সেই সময় মমতার সঙ্গে জোট করেছিল। কিন্তু ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চে কেউ থাকতেন শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা। হয়তো থাকতেন, কিন্তু শহীদ দিবসটা তৃণমূলেরই ছিল। 
    কংগ্রেস শহীদ দিবসের সর্বসত্ত্ব ত্যাগ করে সিপিএমের সঙ্গে জোট করে ২০১৬ সালে । অধীররঞ্জন খালি 'সিপিএমের শহীদ আমাদের শহীদ' বলতে বাকি রেখেছিলেন। সিপিএমও পাল্টা হিসেবে নিজেদের ১১০০ শহীদকে ছেড়ে দেয়। শহীদে শহীদে কাটাকুটি হয়ে যায়। সিপিএমের ব্রিগেডে অধীর, নৌশাদ, এদেরকে দেখা যেতে শুরু করে। বাংলাদেশে যেমন জেনজি ইতিহাস শুরু হচ্ছে ২০২৪ থেকে, বাম-কংগ্রেস জোটও অতীত রিসেট করে ইতিহাস শুরু করে ২০১৬ থেকে। 

    এই সময় ক্রমশ ২১ জুলাইয়ের আকার বাড়তে থাকে, আর ডিম্ভাত জোক শুরু হয়। সিপিএম আমলেও মাছভাত (মার্ক্সবাদ) জোক ছিল, কিন্তু খুবই সামান্য। ২০১৯ থেকে সিপিএমে শূন্য যুগ শুরু হয়, আর ২১শে জুলাই এলেই এই ডিম্ভাত জোক, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।  এইটাই মোটামুটি চলছে বছর পাঁচ ধরে। 

    তার মানে অবশ্য এই নয়, যে, ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে গেছে। প্রতিবারই নানা চমক থাকে। এবারের চমক এই, যে, মোটামুটি এত বছর ধরে চলার পর ২০২৫ সালে অবশেষে কলকাতা হাইকোর্ট বুঝতে পেরেছে, যে, ২১ শে জুলাই সমাবেশ করলে যানজট হয়। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিন ধরেই এই গোপন ব্যাপারটা জানতাম। বললে বিশ্বাস করবেন না, এসপ্ল্যানেডের সব বড় মিটিংয়েই হয়, এটাও আমি জানি। 

    যাহোক, তাতেও দুগ্গা দুগ্গা করে ২১শে জুলাই হচ্ছে। আদালত পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে উদ্যোক্তারা যেন এই মিটিং অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাবার কথা বিবেচনা করেন। সে, ইচ্ছে হলে নিয়ে যান, কিন্তু বন্ধ যেন না করেন। সিপিএমের ব্রিগেড আর তৃণমূলের ২১শে জুলাই বাংলার ঐতিহ্য। গানের জগতে যেমন ডোভার লেন। এর কোনো একটায় ডাক না পেলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মান থাকেনা। কেউ দুটোতেই ডাক পেলে আমরা সেটাকে গ্র‌্যান্ড স্লাম বলতে পারি। নৌশাদ আর কং সভাপতি কি কেরিয়ার স্লাম পাবেন? দিলীপ ঘোষ কি হঠাৎ মঞ্চে উপস্থিত হবেন? এইসব চমক দেখার জন্যই  বছর বছর ধরে এই মিটিংগুলো হয়ে চলা দরকার। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২১ জুলাই ২০২৫ | ৫১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sambuddha Bisi | ২১ জুলাই ২০২৫ ১৩:৫৪732591
  • টাইমলাইন কে জিপ করে ফেলায় যে জাদুবাস্তবতা জন্মায়, এটা আগেও দেখেছি। বন্দরের সান্ধ্যভাষাতেও।
     
    আলঝেইমার সুলভ বিস্মৃতির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা  একটা জাতির কিছু ইতিউতি মানুষ চিরকুটে কিসব লিখে রাখে, নইলে যদি ভুলে যায়? সে গল্প কি আর্কেদিও না আর্কেদিও বুয়েন্দিয়ার? অরেলিয়ানো না অরেলিয়ানো হোসের? এত বছর বাদে সে আর মনে পড়ে না।
  • কৌতূহলী | 103.249.***.*** | ২১ জুলাই ২০২৫ ১৫:৪৪732593
  • সিপিএমের ব্রিগেড ,তিনুদের ২১ জুলাই আর ভাজপার ৩০ টা চেয়ার আর দশটা লোক নিয়ে বিরাট বিরাট জনসভা , সবই বাংলার ঐতিহ্য
  • দীপ | 2402:3a80:198f:30a9:878:5634:1232:***:*** | ২৩ জুলাই ২০২৫ ০০:৪৮732615
  • এই লেখাটাও থাকুক। 
    সবার দৃষ্টিভঙ্গি থাকাই ভালো।
    ----------------------------------------------
     
    এক প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের জবানিতে ২১শে জুলাই।

    ২১ এ জুলাই সম্বন্ধে কোন পোষ্ট করবো না বলে ঠিক করেছিলাম | কিন্তু বন্ধুদের অনুরোধে লিখতে হলো |

    ২১ জুলাইএর মূল ঘটনাতে যাবার আগে দুটি নির্বাচনের ফলাফলের কথা উল্লেখ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি | ১৯৯১ সালে লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ফলাফল ছিল সিপিআইএম ২৭ টি , আরএসপি ৪ টি , সিপিআই ৩ টি , ফরোয়ার্ড ব্লক ৩ টি এবং কংগ্রেস ৫টি আসন পেয়েছিল | একই সাথে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার ফলাফল ছিল নিম্নরূপ সিপিআইএম ১৮২ , ফরোয়ার্ড ব্লক ২৯ , আরএসপি ১৮ , সিপিআই ৬ , পিএসপি ৪ , মার্কসবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক ২ এবং জাতীয় কংগ্রেস ৪৩ টি আসন | ওই দুটি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে ওই সময়কালে সারা রাজ্যে সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট খুবই শক্তিশালী ছিল এবং সেই তুলনায় রাজ্যসরকার বিরোধী জাতীয় কংগ্রেস ছিল খুবই দূর্বল | মমতা ব্যানার্জী ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের যুবসংগঠন যুবকংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী এবং কেন্দ্রের নরসীমা রাও মন্ত্রীসভার  যুবকল্যান ও ক্রীড়া দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী | প্রথম থেকেই মমতা ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী নেত্রী  | তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল যে করে হোক বামফ্রন্টের পতন ঘটিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া | ১৯৯২ সালের অক্টোবর মাসে ব্রিগেড গ্রাউন্ডে তিনি যুবকংগ্রেসের এক সমাবেশে বামফ্রন্টের বিদায়ঘন্টা বাজিয়ে ঘোষনা করেন যে আগামী নির্বাচনেই বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার পতন হবে  | এর পরই তার মনে উদয় হয় যে , সিপিআইএমের জয়লাভের পিছনে রয়েছে ব্যাপক রিগিং | তাই তিনি দাবি জানাতে থাকেন যে পশ্চিমবঙ্গে সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা চলবে না | কিন্তু সচিত্র পরিচয়পত্র দেবার দায়িত্ব তো কেন্দ্রের নির্বাচন কমিশনের , এর সাথে রাজ্যকে যুক্ত করার কোন অর্থই হয় না | কিন্তু মমতা ব্যানার্জী আবার কবে যুক্তিতর্কের ধার ধারলেন | তাই তিনি সচিত্র পরিচয় পত্রের দাবিতে ১৯৯৩ সালের ২১ এ জুলাই যুবকংগ্রেসের ব্যানারে রায়টার্স বিল্ডিং অভিযানের ডাক দিলেন | এই হচ্ছে ২১ এ জুলাই ঘটনার পটভূমিকা | মমতার ঐ কর্মসূচির সাথে কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্বের যেমন সোমেন মিত্র বরকৎ গনিখান চৌধুরী সুব্রত মুখার্জী অজিত পাঁজা প্রদীপ ভট্টাচার্য দের কোন যোগাযোগ ছিল না , বরং তারা অনেকেই ঐ অযৌক্তিক আন্দোলনের বিরোধি ছিলেন | ঐ সময় মমতা ব্যানার্জীর সাথে হাতে গোনা কয়েকজন নেতা নেত্রী ছিল , তারা হলো মদন মিত্র পঙ্কজ ব্যানার্জী সৌগত রায় সোনালি গুহ এবং আরো কয়েকজন | ২০ জুলাই মমতার বাড়িতে এক গোপন সভাতে ঠিক হয় যে সোনালি গুহ এবং শ্যামলী ভদ্র নামে দুইজন যুব তৃণমূল কর্মী বোরখা পরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর রাইটার্সে যাবার রাস্তায় অপেক্ষা করবে | মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় আসা মাত্র তারা দুইজন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়বে | পুলিস তাদের সরিয়ে দিতে গেলে তারা রাস্তায় শুয়ে পড়ে চিৎকার করতে শুরু করবে | ইতিমধ্যে সারা কলকাতায় বিশেষ করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায়  প্রচার করা হবে যে পুলিস দুইজন সংখ্যালঘু মহিলাকে প্রচন্ড মারধোর করেছে | এই সুযোগে বিভিন্ন এলাকায় গোলমাল বাঁধানো হবে | সোনালি এবং শ্যামলী সুযোগ মতো ঘটনাস্হল থেকে সরে পড়বে | সবই ঠিক ছিল , কিন্তু শ্যামলীর বোরখার আড়াল থেকে তার হাতের শাঁখা ও পলা একজন পুলিস অফিসারের চোখে পড়ে যাওয়াতে তাদের দুইজনকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় | ফলে মমতা ব্যানার্জীর গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে পারে নি | 
    ২১ এ জুলাই মমতার ডাকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েক হাজার যুব কংগ্রেস সমর্থক কলকাতায় এসে হাজির হয় | ব্রেবোন রোড , বিবি গাঙ্গুলী স্ট্রীট , মিশন রোড ও মেয়ো রোড থেকে বেলা ১১ টার দিকে মিছিল শুরু হয় | প্রথম গোলমাল শুরু হয় টি বোর্ড অফিসের সামনে | পুলিসের ব্যারিকেড ভেঙে বিশৃঙ্খল জনতা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিস টিয়ারগ্যাস ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে | কিন্তু জনতা পুলিসের দিকে যথেচ্ছ ইট পাথর ছুঁড়তে শুরু করে | সব থেকে বড় ঘটনা ঘটে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে কিছুটা দূরে | উচ্ছৃঙ্খল যুবকংগ্রেস কর্মীরা পুলিস বেষ্টনি ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিসের উচ্চপদস্হ অফিসাররা যুবকংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন | কিন্তু উসকানি মূলক বক্তৃতা দিয়ে জনতাকে খেপিয়ে মমতা ব্যানার্জী সহ অন্য সবাই ঘটনাস্হল থেকে সরে পড়েছিল | উন্মত্ত জনতা তখন পাগলের মতো ছুটছে রাইটার্স ভবন লক্ষ্য করে | তারা রাস্তার দুইধারের দোকানপাটে ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে | পুলিস প্রথমে লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটিয়ে পরিস্হিতি আয়ত্ব আনার চেষ্টা করে | কিন্তু এই সময় পুলিসকে লক্ষ্য করে বোম নিক্ষেপ করা হয় এবং পাইপগান থেকে গুলি চালানো হয় | অনেক পুলিস অফিসার ও ফোর্স গুরুতরো ভাবে আহত হয় | ওই আহত পুলিস কর্মচারীদের মধ্যে অধিকাংসই আহত হয়েছিলেন পাইপগান থেকে ছোঁড়া গুলিতে ও বোমের স্প্রিন্টারে | ঐ আহত পুলিস কর্মচারীদের মধ্যে আমি যে তিনটি নাম সংগ্রহ করতে পেরেছি তারা হলো কলকাতা গোয়েন্দা পুলিসের এসআই একে গাঙ্গুলীর মাথা ফেটে যায় এবং হাতে কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয় , পাইপ গানের গুলির আঘাতে আহত হন তালতলা থানার সার্জেন্ট ডি কে ঘোষাল , এসআই কালাচাঁদ সমাদ্দার আহত হন বোমার স্প্রিন্টারে | কোনভাবেই উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে কন্ট্রোল করতে না পেরে পুলিস গুলি চালালে ১৩ জন মারা যায় | ঐ মৃত ১৩ জনের মধ্যে একজনের শরীরে কোন গুলির চিহ্ন ছিল না | ঐ ব্যক্তির পিএম রিপোর্টে বলা হয়েছিল , কজ্ অফ ডেথ সিরোসিস্ অফ লিভার অর্থাৎ মৃত্যূর কারণ অত্যধিক মদ্যপান | আগামীকাল কিন্তু ঐ ব্যক্তিকেও শহীদ হিসাবে সন্মান জানানো হবে | ঐ সময় রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মনীষ গুপ্ত | ১৯৯৩ সালের ৩ রা আগষ্ট তিনি কলকাতা হাইকোর্টে একটি হলফনামা জমা দিয়ে বলেন , ওই দিন অর্থাৎ ২১ এ জুলাই ১৯৯৩ যুবকংগ্রেসের ডাকা জমায়েতে বহু সশস্ত্র দুস্কৃতকারী মদ্যপ অবস্হায় জড়ো হয়েছিল | তাদের অনেকের কাছেই বোম ও পাইপগান ছিল | ঐ দুস্কৃতকারীরা তিনটি গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় , পুলিসের জিপ উলটিয়ে দেওয়া হয়, ৩৫ টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয় , রাস্তার পাশের ৩০০ টির মতন দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় এবং ২১৫ জনের মতো পুলিস কর্মচারী আহত হয়েছিল | মোট ৩৪১ রাউন্ড টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটানো হয়েছিল | কোনভাবেই জনতাকে কন্ট্রোল করতে না পেরে পুলিস গুলি চালালে ১৩ জন ব্যক্তির মৃত্যু হয় |

    এইবার দেখা যাক ২১ জুলাই সম্বন্ধে তৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে কী লেখা হয়েছিল 
    ২৪ জুলাই ১৯৯৩ দি হিন্দু পত্রিকাতে লেখা হয়েছিল , গন্ডগোল তৈরিতে সদা ব্যাগ্র সমাজবিরোধী শক্তি ও গুন্ডারা অবাধ বিচরনের দিন পেয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর কংগ্রেস নেতৃত্ত্বের কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না | মহাকরণ ছাড়াও বিক্ষোভকারীরা কলকাতা পুরসভা দপ্তরে হামলা চালায় | তাদের তান্ডবের হাত থেকে কোন হাসপাতালের জরুরী বিভাগ রক্ষা পায় নি | বিবেকবর্জিত ব্যক্তিদের ছড়ানো হিংসা মোকাবিলা করতে গেলে সরকারের কাছে খুব বেশি বিকল্প খোলা থাকে না |

    দি স্টেটসম্যান ২৩ জুলাই লিখেছিল , যদি দলের মধ্যে নিজেকে জাহির করা নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর কোন সমস্যা থেকে থাকে , নির্দোষ নাগরিকদের উপর তার দায় তিনি চাপিয়ে দিতে পারেন না | কংগ্রেস আই দলের যুবশাখার  অপরিনত নেতৃত্বের দ্বারা সংগঠিত পূর্বপরিকল্পিত হিংস্রতা এবং রাজ্য কংগ্রেসের সম্পূর্ণ অসহায়তার জন্যেই ঐ ঘটনা ঘটেছে | 

    আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ এ জুলাই লিখেছিল , দেশের বড় বড় সমস্যাগুলো তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়াইয়া গিয়াছে | বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তাহার সাড়া মেলে নাই | নিন্দনীয় জবরদস্তি মহাকরণ দখলের উদ্যোগ |

    দি টাইমস অফ ইন্ডিয়া ২৩ জুলাই লিখলো , নৈরাজ্যই পুলিসকে ব্যবস্হা নিতে বাধ্য করে | দোকানপাট লুট , বেসরকারি যানবাহন পুড়ানো , কর্তব্যরত পুলিস কর্মচারীদের আক্রমন করা .....একজন নেত্রীর অহংবোধ তৃপ্তি ছাড়া গোটা বিক্ষোভটির অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না |
    ২৪ এ জুলাই বর্তমান পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয় | তাতে লেখা হয়েছিল যে কংগ্রেস নেতা গনিখান চৌধুরী মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সাথে দেখা করে তাঁকে বলেন যে , তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও বলেছেন যে , তিনি মমতা ব্যানার্জীর ঐ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ সমর্থন করেন না |

    ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী মুখ্যমন্ত্রী হবার পর প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন উক্ত ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের জন্যে | মমতা ব্যানার্জীর সাক্ষ্যগ্রহন না করেই সুশান্ত চ্যাটার্জী তার রিপোর্ট জমা দিলেও আজ পর্যন্ত তা বিধানসভায় পেশ করা হয় নি , আর হবে বলেও মনে হয় না | কারণ মমতা ব্যানার্জী ভেবেছিল যে কমিশনের রিপোর্টে এমন কিছু থাকবে যাতে তার পক্ষে সিপিআইএম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব হয় | কিন্তু কমিশনের রিপোর্টে এমন কিছু না থাকাতে তার আশা পূর্ণ হয় নি |

    একটা ছোট্ট খবর দিয়ে লেখাটা শেষ করবো , তা হলো ২০০১ সাল থেকে তৃণমূলের এই বাৎসরিক মহোৎসবের বেশির ভাগ টাকা দেন ব্যবসায়ী সঞ্জীব গোয়েঙ্কা | অবশ্য একটা শর্ত আছে তা হলো তৃণমূল কংগ্রেস কোনদিন সিইএসসির কোন কাজের বিরোধিতা করবে না |

    কালিদাস ঘোষ
    জলপাইগুড়ী
    ২০.০৭.২০২৫
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন