ছবি: রমিত
"সময়ের অভিশাপ বয়ে চলেছি আমরা।যতটুকু যুক্তি ও বিজ্ঞানের পদ্ধতি শিখলাম সেটা যতক্ষণ জাগতিক লাভের পালে হাওয়া দিতে ব্যবহার করছি, ততক্ষণ সব ঠিক। কিন্তু তার বাইরে যে অনন্ত অজানা সমুদ্র - যার পরিধি ছুঁয়ে যায় মহাকাশের অগণ্য তারকা, প্রাণের অতুল বিস্ময়, বিমূর্ত চিহ্নের মূক অর্থময়তা, আর এসবের ওপারে সেই অবিনশ্বর, নামহীন অস্তিত্বের নিশানা যা জেগে থাকে স্বপ্নের দিগন্তে - সেখানে যুক্তি ও পরীক্ষার দাঁড় বেয়ে ভেলা ভাসানোর আমার ইচ্ছা হতাশার নামান্তর বই কিছু নয়। "
Treatise on Algebra তে খৈয়াম প্রথম তৃতীয় ঘাতের সমীকরণের সাধারণ সমাধান দেখান। বইটি সম্পূর্ণই লেখা সমরখন্দ শহরে। সে সময়ে সেলজুক সুলতান আল্প আর্সলান মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেলজুক দের তুলনায় পুরোনো তুর্কিদের মনে হচ্ছে শান্তির দূত। সমরখন্দ তখনও সেলজুক অধীনে আসেনি। তবে চারিদিকে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
এর মধ্যে চারিদিকে রটনা আল্প নাকি সেই অবাক সেলজুক যে কিনা নারীলাজুক। যদিও নটা বৌ। তারা হারেমে হাসাহাসি করে। অনেক মেয়ে আছে যারা এমনিই হারেমে হারেমে ঘোরে। যদি কিছু নেকনজরে পড়া যায়। এইভাবে এই গল্প হারেমে হারেমে ভেসে বেড়ায়। সেখান থেকে জানতে পেরেছে জাহান।
ওই দেখোনা জাহান আর ওমর এক অন্যকে কেমন বাহুবন্ধনে বেঁধে মধুবাক্যে কলকল করে হাসছে। ওরা বুঝিবা সুলতানকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। নয়তোবা খলিফার বাগদান নিয়ে কোনও চটুল রসিকতা। জাহান বলছে। ওমর শুনছে। তৃতীয় ঘাতের সমস্যায় কিছু দিয়ে কিছু কেড়ে নিতে হয়। ঠিক যতটুকু ঠিক ততটুকু। যেকোনো উপাদানে হবে না। প্রেমেও তাই।
অথবা, আমরা ভুল। এও হতে পারে যে ওরা এটা ভেবে আলোড়িত যে এই রোজা শেষের আধ ভেজা রাতে আর কেউ বুঝি এত সুখী নয়। "অনেক নগর ঘুরলাম", সুরাপাত্র ডান থেকে বাম হাতে নিয়ে বলে ওমর। "কত নারী - কেউ অর্থের জন্য, কেউ খ্যাতির জন্য, কেউ প্রথার জন্য, কেউবা অসুখের জন্য - সুখ দিলো। কিন্তু সুখের জন্য সুখ ত শুধু সমরখন্দ আমায় দিলো। একবার, নিশাপুরে -"
এবার জাহানের শোনার পালা। তার অধরে ঝুলছে হাসি, দুচোখের কাজলে হাসির ঝিলিক। গালের তিল কাঁপছে থরথরিয়ে। মনে হয় গল্প শেষ হলেই সে খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে। অথবা অশ্রুস্নাত হবে এই রাত। কী হবে সে কে বলতে পারে। মনে পড়ে যায় প্রথম সেই আকুলতামসী রাত। ঘরের দীপ নির্বাপিত। এক অজানা রমণীর উষ্ণতা ছুঁয়ে যায় ওমরের ইন্দ্রিয়।
- "তুমি চোখ সরিয়ে নিলে, তাই নিজেই চলে এলাম"
- "এখনো কি পর্দা তোমার মুখে?"
- "এই রাত ছাড়া আর পর্দা কোথায় এই রাতে?"
একবার সুরায় ঠোঁট ভিজিয়ে আবার শুরু করে ওমর। "- একবার নিশাপুরে। এরকমই এক রমজানের রাত। হাওয়ায় খবর এলো তুঘ্চাই এর সৈন্যরা নগরের ঘরে ঘরে ঢুকে ছেলেদের হত্যা করবে, পর্দা ভেঙে পর্দানসীন দের ইজ্জত নেবে। মর্দরা সেই রাতেই সেঁধিয়ে গেল প্রাচীন শহরের সুপ্ত অন্তঃপুরে। পড়ে রইলো হারেমবাসিনীরা বিজয়ীর শাণিত অস্ত্রের অপেক্ষায়। পরের প্রহরে জানা গেলো তুঘ্রীল তার ভাইকে বুঝিয়েছে রমজানের সময় এমন করা সঠিক নয়। রমজান শেষ হলে সে যা খুশি করতে পারে। এইভাবে শুরু হলো ত্রাসের রমজান।
এ কেমন রোজা যার শেষ জুড়ে আছে ধর্ষণ ও মৃত্যু? রোজা ভঙ্গের রাতে ত মানুষ যা প্রার্থনা করে তাই পায়। কিন্তু এক শহর নারী যদি প্রার্থনা করে যে রোজা ভঙ্গই না হয়, তবে? কোরআনে এর হদিশ নেই, হাদীসেও না। রশিদুনরাও এমন সংশয়ের কোনো নিদান দিয়ে যাননি। এর থেকে কি মুক্তি নেই?"
জাহানের চোখ জলে ভেসে যায়। বহুদূরে দিগন্তের কাছে যে নীল সমুদ্র দেখা যায় তার মধ্যে এক একাকী বাতিস্তম্ভের মাথায় ঘুরপাক খায় শঙ্খচিলের ঝাঁক। রাতের দীপিকা সে এক অচেনা জাহান। দিনের আলোয় প্রিয়তমের হাত ধরবার অধিকার তার নেই। নগরকন্যা সে; দূর দ্বীপ সে শুধু দেখতে পায় ওমরের চোখে। কোথায় আলেক্সান্ড্রিয়া, কতদূরে বাগদাদ, রাম, কালের কোন অতলে বলখ - ওমর গল্প বলে আর জাহান শোনে। মিথ্যা কৌতুকের প্রতিশ্রুতি ঝুলিয়ে রাখে চোখেমুখে।
মনে মনে সে চলে যায় তুগরীলের নিশাপুরে। খুলে দিতে চায় দরজা। বলতে চায় আমি তো হারেমবাসিনী নই। আমি তো কবি। ওমরের মত নই , তবু। আমার ইজ্জত আমি না দিলে কেউ নিতে পারবে না। চেষ্টা করলেও না। রমজানের সময় না, পরেও না। তার চেয়ে হে বুভুক্ষু সৈনিক বল তোমার দেশের কথা। কতদূর থেকে এলে। কতদিন দেখোনি মা কে, বোন কে। তোমার বাদামি ঘোড়ার শপথ তোমায় কবিতা শোনাবো আমি। যে কবিতা শুনে ধর্মরক্ষক সুলতান নাসের খান - অমন দুর্ধর্ষ খান - ভোর রাজসভায় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন।
"কী আশ্চর্য মায়ার শহর আমার নিশাপুর। কী আশ্চর্য মায়া আছে প্রার্থনায় যে নিষ্ঠুরহৃদয় সেল্জুক যোদ্ধার মন বদলে যায়। বড় ভাই তুগরীল নিজের ছুরিকা নিজের বুকে স্থাপন করতে চায় বিজিত নগরকে রক্ষা করতে। ছোটভাই এসে বুকে টেনে নেয়। ভালবাসার স্রোতে ধুয়ে মুছে যায় ত্রাসের রমজান। কী আশ্চর্য মায়া এই ভালবাসায়।"
"কী আশ্চর্য মায়া এই সাহসে"
"কী ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে তোমার জ্যোৎস্নাসিক্ত গাল"
"এবার বুঝি ভোর হয়ে এল"
"বুঝি এবার ভোর হয়ে এল"
সত্যি পুবদিক রাঙ্গা হয়ে এসেছে। ফিকে আলোয় দেখতে পাচ্ছি আবু তাহের হন্তদন্ত হয়ে আসছে ওমরের বাড়ির পথেই। কোনো এক ঘোর বিপদের ইঙ্গিত তার চোখেমুখে। তাহেরের মনে আছে সে একবার ওমরকে বলেছিল, "তোমায় একদিস্তা সাদা কাগজ দিয়ে ভাবলাম তুমি অঙ্ক কষে ভরিয়ে দেবে। তা না তুমি পদ্য লিখে শেষ করলে?" "কারণ আমি লোভী, আমি অমরত্ব চাই " উত্তরে নির্বিকার ওমর - "আমার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পরের প্রজন্মের বিজ্ঞানী এসে ভ্রান্ত প্রমাণ করবে, করবেই। কিন্তু আমার রুবাইয়াত কেউ মুছে ফেলতে পারবে না"। রুবাইয়াত ও তার স্রষ্টাকে বাঁচাতেই হবে এই প্রতিজ্ঞা করে আরও দ্রুত পথ চলতে থাকে তাহের।
আমরা পথের ধারে সরে আসি বরং। দেখো আরও দূরে লাল দিগন্ত আরও লাল করে কাদের অশ্বক্ষুরধুলি আকাশ ফেলছে ছেয়ে। ভালো করে দ্যাখো এ সেই আল্প আর্সলান - রামবিজয়ী আর্সলান যার নটা বউ - তার বাহিনী আসছে সমরখন্দ এর উপকন্ঠে। কাজী তাহেরের পরামর্শে চিরকালের মতো সমরখন্দ ছেড়ে যেতে হবে যে এবার ওমরকে। তাকে লিখতে হবে তৃতীয় ঘাতের সমীকরণের ইতিবৃত্ত। রুবাইয়াতের পাতা উঠবে ভরে।
পিছনে থেকে যাবে রাত আলো করা জাহান। পর্দা খুলতে গিয়ে যে রাত্রিকে খুলে ফেলেছিল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।