এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  গপ্পো

  • সাবু ও শনিপোকা ৫ - বিসর্জন 

    swagatam sen লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২৩৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • | | | |
    সমগ্র রাত্রির অন্ধকার ভাঁজ ভাঁজ করে জেগে ওঠে স্তরে স্তরে। যেন একটার পর একটা পরদা সরে সরে যায় সাবুর চোখের সামনে থেকে। প্রথম স্তরে থইথই করছে ঘুম কালোদিঘির জলের মতো টলটলে। সেখান থেকে ক্রমাগত আলেয়ার মতো দপ করে উঠে আসে খিদে। দীঘির ধার জুড়ে আছে খেপাবুড়ির বাগান। সাবু পুরোটা অন্ধকারে ঠাহর করতে পারে না শুধু নাকে আসে ভেজা ঘাসের গন্ধ আর মনে হয় ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবে উল্টোদিকের একটা দোতলা বাড়ির বারান্দায় কার একটা হাসিমুখ।

    মুখটা খুব চেনা চেনা ঠেকে। তারপর হঠাৎই মনে পড়ে সামনের রাস্তার ইয়া বড় পোস্টারে হ্যাটপরা হিরোইন এরকমই চেপেচুপে হাসে। হিরোইন ততক্ষণে মাটিতে নেমে এসে সাবুর মাথায় হাত দিয়ে দেখছে। তার পাশেই তখন ছিল মা দুর্গা পুরনো পাড়ার গেলবারের প্রতিমার মত। অঞ্জলি দেবার সময় খুঁটিয়ে দেখেছিল সাবু। মায়ের চোখ নত। দশ হাত নিয়ে সাবুদের ঘরে দাঁড়াতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। ত্রিশূলটা বারবার আটকে যাচ্ছে বেড়ায়।

    তার পিছনে ঝুমুর একটা পদ্মফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে, ঠিক লক্ষ্মী ঠাকুরের মত লাগছে, একচিলতে আলো কোত্থেকে পড়েছে মুখে।

    সবার পিছনে সেই দাড়িওয়ালা। তার চোখ লাল আর অনবরত ঘুরছে। একটা ডিগবাজি খেয়ে সে সাবুর বিছানার কাছে চলে আসে।

    ‘কিরে হতভাগা, সেই আমাকেই টেনে আনালি? অত করে বললাম যে আজরাতে খালধারে আসতে?’

    ‘তুমি-কি-সদানন্দ?’ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে সাবু।

    ‘আমিই সদানন্দ, আমিই নিরানন্দ। ওসব জেনে তোর কি? তোকে মা বেছেছে উড়ানের জন্য। এইবার ওঠ!’

     ‘আমি যে উড়তে চাই না!’ সাবুর গলা ধরে আসে। ঘুমন্ত মায়ের মুখের দিকে তাকায়। কি নিশ্চিন্ত লাগছে ওর মাকে। কোত্থেকে রাতফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। হিরোইন আর দুর্গা কখন ভ্যানিশ করে গেছে।

    সদানন্দের মনে দয়া হয়। পাশে ঘন হয়ে বসে। ‘উড়বি না কিরে? এ সুযোগ কেউ ছাড়ে পাগল? আমাকেই দ্যাখ গাছের মগডালে উঠে চামুণ্ডা মন্ত্র পড়লাম আর যত পুলিশের বেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল।’ সাবুর বুকে হাত রাখে সদানন্দ।

    সাবু কপালে হাত বুলিয়ে ঘাম মোছার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গরম, সেও কি পুড়ছে?

    পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মা ভাসানে যাচ্ছে। পাড়ার কাকিমারা মুখ রাঙ্গা করে চলছে পিছে পিছে। কেতো আর সুবোধ ভাসানের নাচ নাচছে ঘুরে ঘুরে। বাবাকে দেখতে পাচ্ছে সাবু একটা আখওয়ালাকে দিয়ে আখ কাটাচ্ছে। আর কত বেলুন। লাল-নীল-কমলা হরেক রকম আকাশে উড়ছে। উড়তে উড়তে ওরা বহুদূর চলে গেল। সাবুও উড়ছে তাদের পিছনে। নিচ থেকে সদানন্দ তাল ঠুকে বলছে ‘তবে? উড়বি না কিরে? জয় মা!’

    দেখতে দেখতে সাবু পার হয়ে যায় বঙ্গলক্ষ্মীর বাজার। ব্যাগ হাতে কাকুরা সন্ধের বাজারে মাছ বাছতে বাছতে অবাক হয়ে উপরে তাকিয়ে দেখে। মৃত মাছেরাও অপলক চোখে দেখেছিল সাবুর উড়ান। মিষ্টির দোকানে বিজয়ার লাইন। তার মধ্যেও গুটিকতক মাছি কাজ ফেলে সাবুর চারপাশে ঘুরে মেপে নিয়ে গেল। বাজার পেরিয়ে বিজন সান্যালের তিনতলা বাড়ি। গেলবার সরস্বতী পুজো করবে বলে হীরু আর সাবু এসেছিল চাঁদা চাইতে। মোটা বই ছুঁড়ে তাড়িয়ে দেন। আজ ব্যালকনিতে বসে গেলাসে কি খাচ্ছে মোটা বউএর সাথে। হাঁ করে দুজনে তাকিয়ে থাকে সাবুর দিকে। হঠাত সাবুর খুব ইচ্ছে করে ফ্যাচফ্যাচ করে হাসতে।

    উড়তে উড়তে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে সাবু। সদানন্দকেও দেখা যাচ্ছে না। শুধু গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে - ‘এবার মারণমন্ত্র দে সাবু’

    সাবুর হালকা করে মাথা ঘোরাচ্ছে। কোনটা সোজা, কোনটা উলটো গুলিয়ে যাচ্ছে।

    ‘সব বেটাকে ভস্ম করে দে।’

    হেমন্তের হিম জমছে সাবুর পায়ে, মাথায় বুকে। আঃ কি আরাম। এই ত শুধু মন্ত্রটা পড়লেই খেল খতম। কিন্তু কে যেন সাবুর মাথায় একটা অন্যসুর ভোরে দিয়েছে, কিছুতেই বিচ্ছিরি সুরটা মাথা থেকে বেরুচ্ছে না। একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকের মত। সেই শনিপোকাটাকে এবার দেখতে পায় সাবু। গঙ্গার দিক থেকে উঠে এসেছে কিন্তু আকারে বিশাল বড়। বুঝতে পারে সাবু এ ওরই কাণ্ড।

    সাবু নীচে দেখতে পায় কোটি কোটি চোখ। সব ওর দিকে তাকিয়ে। কেউ কোলাকুলি ভুলে, কেউ প্রতিবাদ করতে গিয়ে, অনেক বাচ্চা মারামারি থামিয়ে। বোকা চোখ, হিংস্র চোখ, সরল চোখ, কুটিল চোখ, আড়চোখ, খরচোখ, চশমা আঁটা, লজ্জানত, বিস্ফারিত, উদার চোখ, বইপড়া আর ছানিপড়া চোখ; ধুলোমাখা চোখ; লোভী চোখ; অন্ধ চোখ। সাবুর কিছুতেই মনে পড়েনা মারণমন্ত্র। আর মাথার ভিতর বিচ্ছিরি সুরটা বেজেই চলেছে।

    অনেক নীচে দেখতে পায় মায়ের প্রতিমা ঘুরছে গঙ্গার ঘাটে। সাবু মায়ের মুখটা একবার দেখতে চায়। প্রতিমা ঘুরছে। সাবু মায়ের পাটা জড়িয়ে ধরতে চায়। সাবু কে কে নিচ থেকে টানছে। সদানন্দের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে সাবু। প্রতিমা ঝপাং করে জলে পড়ে আর তার জল ছলকে আসে সাবুর মুখে।

    সাবু চোখ মেলে দেখে মা একবাটি জল নিয়ে দাঁড়িয়ে। সাবুকে মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সাবু পোকাটাকে খোঁজে কিন্তু দেখতে পায়না। কিন্তু আওয়াজটা আরও স্পষ্ট শুনতে পায়।

    ভোর হয়ে গেছে। এবার শব্দটা বুঝতে পারে সাবু। পাখির কিচিরমিচির ও কাকেদের কা-কা ছাপিয়ে চোপড়ার গলির ওপার থেকে শোনা যায় কে যেন টেপে চালিয়েছে অকাল আগমনী - 

    অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম আদিত্যায়ৈরুতবিশ্বদেবৈঃ। 
    অহং মিত্রাবরুণোভা বিভরম্যহম ইন্দ্রাগ্নী অহমশ্মিনোভা।
     
    (শেষ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | |
  • ধারাবাহিক | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:448:c400:9fe0:2107:955d:4c73:***:*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:৪৪511867
  • দারুণ!!
  • | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৫০511869
  • অপূর্ব 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন