গোদার প্রশ্ন তুলেছিলেন চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ বা সমালোচনার জন্য প্রবন্ধ না লিখে আরেকটা চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন করা হবে না। গোদারের সিনেমার মতই তাঁর এই ভাবনাটি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক, যদিও এই ধরণের কোন সফল প্রচেষ্টা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শুভদীপ অবশ্য সেই পথে হাটেননি, তার লেখা একাধিক চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্কলন হল “সাদা পর্দার আলো” বইটি। সিনেমা শিল্পমাধ্যমের ব্যাপারে অনভিজ্ঞ লোকজন প্রায়শই কোন বিশেষ সিনেমা সম্পর্কে প্রশ্ন করে থাকেন যে সেটি আর্ট ফিল্ম না কমার্শিয়াল ফিল্ম। এই প্রশ্ন কবিতা, সাহিত্য এমনকি নাটকের ক্ষেত্রেও কিন্তু করা হয়না। সফল কবিতা বা ব্যর্থ কবিতা বলতে আমরা বুঝি কবিতাটি শৈল্পিকভাবে সফল না ব্যর্থ। সিনেমার ক্ষেত্রেও কিন্তু একই বিশ্লেষণ প্রযোজ্য। শুভদীপের প্রবন্ধগুলি কিন্তু সেইসব চলচ্চিত্রকারদের নিয়ে যাদের কাজ শৈল্পিক ভাবে নিপুণ। শুভদীপের প্রবন্ধে যেমন আছেন গোদার, বার্গম্যান, আন্তনিওনি, হিচকক, চ্যাপলিন তেমনই আছেন কিয়ারোস্তামি, ওজু, আমাদের সত্যজিৎ, মৃণাল এবং বর্তমান সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার নুরি বিলজ সিলান।
যে কোন সফল প্রাবন্ধিকের লেখনীর একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। শুভদীপের লেখনীর দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। দ্বিতীয়টির কথায় আমরা একটু পরে আসছি। শুভদীপ কোন প্রবন্ধের শুরুতেই সাধারণত মূল বিষয়ে সরাসরি প্রবেশ করেন না। এখানে মূল বিষয় বলতে বলা হয়েছে চলচ্চিত্র বা চলচ্চিত্রকার সম্পর্কিত আলোচনা। লেখকের একাধিক প্রবন্ধই শুরু হয় কোন উদাহরণ/ উপমা বা কোন সংজ্ঞার ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ দিয়ে। যেহেতু প্রবন্ধগুলি সময়কাল অনুযায়ী সাজানো (বইয়ের সর্বপ্রথম প্রবন্ধ তার সাম্প্রতিকতম লেখা), তাই বোঝা যায় সময়ের সাথে লেখক এই স্টাইলটি রপ্ত করেছেন। প্রথম প্রবন্ধে (উত্তরঔপনিবেশিকতার বয়ান – রেনোয়া ও মালের চলচ্চিত্র) তিনি উপনিবেশ, উত্তর ঔপনিবেশিক দুনিয়া, ওরিয়েন্টালিজম নিয়ে বিষদে আলোচনার পর ছবির বিষয়ে আসেন। আরো উদাহরণ হিসেবে কিয়ারোস্তামি ও সিলানের উপর প্রবন্ধগুলির কথা বলা যেতে পারে। বিস্তারিত লিখলাম না কারণ আগ্রহী পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন। আসলে লেখক পাঠকদের প্রথমে একটা প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসতে চান এবং তারপর সেখান থেকে তিনি তার ডালপালা ছড়ান, লেখার বিস্তার ঘটান। পাঠকের সঙ্গে এমন সংযোগের প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।
বইয়ের প্রথম তিনটি (উত্তর-ঔপনিবেশিকতার বয়ান ও মৃণাল সেনের উপর দুটি প্রবন্ধ) প্রবন্ধ পড়লে পাঠকের মনে হতে পারে লেখকের রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখার উপর ঝোঁক বেশি। পুরো বইটি পড়লে সে ভুলটা পাঠকের কেটে যাবে। তার বেশিরভাগ প্রবন্ধগুলিই আদতে বিশুদ্ধ চলচ্চিত্র সংক্রান্ত। এখানে তার লেখনীর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি লক্ষণীয়। বিষয়ের সাথে তার লেখার ধরণ বা ম্যুড পালটাতে থাকে। “চলচ্চিত্রে আধুনিকতা- আন্তর নব্য বাস্তববাদী আন্তনিওনি ও ব্লো-আপ” প্রবন্ধে লেখক ব্লো-আপ ছবিটিকে কেন্দ্র করে আন্তনিওনির নব্যবাস্তববাদী চিন্তার পরিসর এই ঘরানার অনান্য পরিচালকদের থেকে কিভাবে ভিন্ন সে বিষয়ে এবং বস্তুবিপ্লবের জমানায় বস্তুর সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং বস্তু কর্তৃক মানবমন নিয়ন্ত্রিত হবার বিষয়ে দীর্ঘ ও গূঢ় আলোচনা করেছেন। চলচ্চিত্রকে কেন্দ্রস্থলে রেখে দর্শন ও মনস্তত্ত্ব নিয়ে একটি অসাধারণ আলোচনা এই লেখাটি। আমার মতে এটিই এই বইয়ের অন্যতম সেরা লেখা। শুধু তাই নয়, লেখাটি পড়লে মনে হয় এই ধরণের জটিল আলোচনার লেখনী যেন এমনই হওয়া উচিত। অন্যদিকে আমরা যখন “সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র – পরশুরাম, তুলসী ও সত্যজিৎ” প্রবন্ধটি কিংবা “আলফ্রেড হিচককের ছবি, অপরাধের অন্তরাল” পড়ি, তখন মনে হয় পরশ পাথরের ম্যাজিক রিয়ালিটির সাথে বা হিচককের “অপরাধের অন্তরালের” সাথে এই লেখাগুলির ম্যুডও যেন বদলেছে। বিষয়ের সাথে লেখনীর বদল ঘটানো খুব সহজ কাজ নয়, শুভদীপ কিন্তু এই কাজটি সফল ভাবে করেছেন।
বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধ নিয়েই অনেক কথা বলা যায়, তবে বিশেষ করে উল্লেখ করব গোদারের উপর প্রবন্ধটি (গোদারের চলচ্চিত্র – নবতর চিত্রভাষার প্রস্তাবনা)। অনেক সিরিয়াস সিনেমাপ্রেমীর কাছেই গোদার মানেই দুর্বোধ্যতা, তাঁর সিনেমা অনেকেই ডিকোড করতে অক্ষম। এই লেখাটি গোদারকে বোঝার জন্য একটা ভালো স্টার্টিং পয়েন্ট। লেখাটি পড়লে গোদারের ছবি বোঝার ক্ষেত্রে দর্শক একটা আন্দাজ তৈরি করতে পারবেন, গোদার চর্চা কোথা থেকে শুরু করতে হবে সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা হবে। অবশ্য লেখাটি আরেকটু দীর্ঘ হলে ভালো হত। মৃণাল সেনের উপর দুটি প্রবন্ধ মোটামুটি একই ধরণের। দুটিকে মিলিয়ে একটি প্রবন্ধ হলে ভালো হত।
পরিশেষে একটি ডিসক্লেমার দিয়ে এই লেখা শেষ করছি। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে যেখানে মানুষ ৩০০ শব্দের বেশি পড়তে চায় না, সেখানে শুভদীপের লেখাগুলি পাঠকের সিরিয়াসনেস ও মনঃসংযোগের দাবি রাখে। এই বইটি শুধুমাত্র সিরিয়াস পাঠকদের জন্যই। বইটির পাঠ চলচ্চিত্র অনুরাগীদের সিনেমার টেকনিক্যাল দিকের থেকেও মাধ্যমটির শিল্পকলার রস আস্বাদন করতে সক্ষম করবে। একজন শিল্পীর উপর নানা দিক থেকে আলো ফেলে কিভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করা যায় তার অনন্য নিদর্শন এই বইয়ের বিবিধ প্রবন্ধগুলিতে লেখক রেখেছেন। চলচ্চিত্র নিয়ে এমন বিবিধ প্রবন্ধের বই ইদানীং কালে খুব কমই লেখা হয়েছে। গুরুচণ্ডা৯কে এমন একটা বইয়ের পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাই।