৪ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪ সাল। দ্য স্টেটসম্যান এবং ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া-র পাতায় প্রকাশিত হল চাঞ্চল্যকর ‘EMPRESS vs. TROYLUCKO RAUR’ মামলার সর্বশেষ রায়। রাজকুমারী নামে এক বারাঙ্গনাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির আদেশ হল অপরাধী ত্রৈলোক্য রাঁড়-এর।
এই রায়ের কিছুদিন আগের ঘটনা। বড়বাজারের এক বিখ্যাত গয়নার দোকান থেকে উধাও দশ হাজার টাকা মূল্যের জহরত। কোনও এক রানির পছন্দ করা জহরতগুলি ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’-র শর্তানুযায়ী দোকানের যে কর্মী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, নিখোঁজ তিনিও। তদন্তে নামলেন দারোগা প্রিয়নাথ। খুন এবং চুরির দায়ে ধরা পড়ল দুই অপরাধী। আশ্চর্যের কথা হল তাদের মধ্যে একজন মহিলা। পেশায় সে বারবণিতা, নাম ত্রৈলোক্যতারিণী। সেদিন অবশ্য প্রমাণাভাবে রেহাই পেয়ে গিয়েছিল ত্রৈলোক্য। কিন্তু শেষরক্ষা হল না।
উপরের দুটি ঘটনারই অনুপুঙ্খ বিবরণ আমজনতা জেনেছিল ভারপ্রাপ্ত ডিটেকটিভ পুলিশ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়-এর বিবরণে। তাঁর ‘দারোগার দপ্তর’-এর তিনটি সংখ্যা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল ত্রৈলোক্যের অপরাধের কাহিনি। উনিশ শতকের স্বল্প বিনোদনের যুগে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গরম খবর কেমন হুলুস্থুল ফেলেছিল সাধারণ মানুষের মধ্যে, তার প্রমাণ ‘দারোগার দপ্তর’-এর মোট কিস্তির সংখ্যা। একুশ বছরে ২১৭টি!
এ জাতীয় পুলিশি কেস ফাইলেই বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের গোড়াপত্তন। এইসব লেখায় অপরাধের সঙ্গে মেয়েদের পাকাপোক্ত যোগাযোগের হদিশ মেলে বটে, কিন্তু, পুলিশ দারোগার বাস্তব তদন্তকাহিনিতে মেয়েদের মূল চরিত্রে অর্থাৎ গোয়েন্দা হিসেবে ঠাঁই পাওয়া স্বভাবতই সম্ভব ছিল না। পরবর্তীতেও গোয়েন্দাকেন্দ্রিক সিরিজ সাহিত্য এবং রহস্যরোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রকাশিত গোয়েন্দা গল্পগুলিতে সেই পরম্পরা অক্ষুণ্ণ থেকেছে। মেয়েরা যে ‘অবলা’ এ কথা সর্ববাদিসম্মত সত্য, সুতরাং বটতলা জাতীয় বাজারচলতি বইয়ে একা হাতে দুশমনকে শায়েস্তা করা বলশালী ডিটেকটিভের চরিত্রে তাদের কেউ নির্বাচন করেনি কখনোই। আবার বুদ্ধিনির্ভর হুনুর চরিত্রগুলিও বরাবরই বরাদ্দ থেকেছে পুরুষের জন্যই। যদিও সাম্প্রতিক কালে মিতিনমাসি-দময়ন্তীদের নিয়ে সিনেমা-ওয়েবসিরিজের বাড়বাড়ন্তের যুগে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস করা মুশকিল, কোনও মহিলা যে গোয়েন্দা হতে পারেন এই ধারণা মেনে নিতেই নারাজ ছিল সেকাল। কিন্তু সাহিত্যের বাইরে বাস্তবের দিকে দৃষ্টি ফেরালেও দেখা যায়, প্রথম মহিলা পেশাদার গোয়েন্দা কেট ওয়ার্ন-কে চাকরি দিতে নিতান্তই অনিচ্ছা ছিল ডিটেকটিভ এজেন্সি পিংকারটনের। কারণ আর কিছুই নয়, মেয়েরা এই পেশার পক্ষে অনুপযুক্ত, কোনও যুক্তি ছাড়াই এমন এক ধারণা বদ্ধমূল হয়ে বসে ছিল তৎকালীন সমাজে। মেয়ে মাত্রেই অনিবার্যভাবে বুদ্ধিহীন, এমন হাজারও ঠাট্টা-তামাশা সেই মিথের পরম্পরা বয়ে নিয়ে চলেছে এখনও। আর সেই কারণেই, গোয়েন্দাসাহিত্যের মতো সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধিনির্ভর একটি সংরূপের নায়ক হয়ে ওঠা মেয়েদের পক্ষে খুব একটা সহজ ছিল না। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় কাটিয়ে ফেলার পরেও গোয়েন্দাকাহিনি মেয়েদের জন্য খলনায়িকার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভূমিকা বরাদ্দ করে উঠতে পারেনি।
কিন্তু বাজার যে বিষম বস্তু। বিশ শতকের মাঝামাঝি স্ত্রীশিক্ষা আন্দোলন যখন তার গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছে, তখন প্রশ্ন উঠছিল, আধুনিক শিক্ষিতা মেয়েদের পছন্দসই বইয়ের জোগান কোথায়? এমন চরিত্রও তো অপ্রতুল, যার মধ্যে নিজেদের খুঁজে নিতে পারে তারা। সুতরাং এ পর্যন্ত যে গোয়েন্দার ভূমিকা ছিল পুরুষের একচেটিয়া অধিকারে, এমনকি মেয়েদের কলমেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি, এবার সেই চাকাটা ঘুরল। আনুমানিক ১৯৪৪ সালে দেব সাহিত্য কুটীরের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজে ‘গুপ্তঘাতক' নামে একটি উপন্যাস লিখলেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। যেখানে রহস্যভেদ করে একটি মেয়ে, কৃষ্ণা। ‘প্রহেলিকা’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দুটি সিরিজে মোট চারটি উপন্যাস লেখার পর কৃষ্ণা চরিত্রের জনপ্রিয়তা গড়ে তুলল একখানা সম্পূর্ণ ‘কৃষ্ণা’ সিরিজ। মোট এগারোটি কাহিনিতে রহস্য উদ্ঘাটনে হাত পাকিয়ে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের প্রথম মেয়ে গোয়েন্দার তকমা পেয়ে গেল কৃষ্ণা। পুরুষের মতো বাহুবল নয়, ‘আকস্মিক বিপদে পড়ে শুধু উপস্থিত বুদ্ধির জোরে কেমন করে উদ্ধার পেতে পারেন’ মেয়েরা, তারই হদিশ দেবে এ বই- ১৯৫২ সালে কৃষ্ণা সিরিজ প্রবর্তনের এই বিজ্ঞাপনটিই এযাবৎ প্রচলিত মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার মিথকে নাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। আসলে বুদ্ধি আর মেধার জগতে মেয়েরা অনধিকারী, সমাজনির্ধারিত এই ধারণার বাইরে গিয়েই কৃষ্ণা চৌধুরীকে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন প্রভাবতী দেবী। জানা যায়, প্রথাগত পড়াশোনা করে বিএ ডিগ্রি অর্জনের বাইরেও একাধিক বিষয়ে ব্যুৎপত্তি রয়েছে কৃষ্ণার। “কৃষ্ণা মাতৃভাষা ছাড়া আরও পাঁচ-সাতটি ভাষা শিখিয়াছে। …পিতা তাহাকে অশ্বারোহণে পারদর্শী করিয়াছে, মোটর সে নিজেই চালায়, পিতার সহিত বর্মার জঙ্গলে সে বহু শিকার করিয়াছে। উপযুক্ত ব্যায়ামের ফলে তাহার দেহ সুগঠিত, শক্তিশালিনী; দেহে যেমন তার অটুট শক্তি, অন্তরে তার তেমনই অকুতো সাহস।” কৃষ্ণার জনপ্রিয়তার দরুন মেয়ে গোয়েন্দা অগ্নিশিখা রায়কে কেন্দ্র করে আরও একটি পৃথক সিরিজ ‘কুমারিকা’-র প্রবর্তন করেছিল দেব সাহিত্য কুটীর। এরও লেখিকা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন যখন ভারতের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে, সবাই প্রাণভয়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে চাইছে, সেই সময় বইয়ে পড়া যুদ্ধের স্বরূপ নিজের চোখে দেখতে চেয়ে শিখা পাড়ি দেয় চট্টগ্রামে। স্পষ্টতই, সুপারহিরোদের সঙ্গে নিজের যে মানসিক প্রতিস্থাপন সম্ভব ছিল না, কৃষ্ণা বা শিখার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হল নতুন প্রজন্মের বাঙালি মেয়েদের কাছে।
গোড়ায় যে প্রসঙ্গ উঠেছিল, মেয়েদের নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কিত সেই পিতৃতান্ত্রিক মিথটির কথা আবার মনে করে নেওয়া যাক। এই মিথের বশেই বহুদিন বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দার দেখা মেলেনি, এবং পরবর্তী কালে মেয়ে গোয়েন্দাদের লড়াইয়ের একটা দিক ছিল মেয়েদের বৌদ্ধিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা। কৃষ্ণা-শিখারা সে কাজ করেছে, তবে তাদের গোয়েন্দাগিরির ধরনটাই ছিল অ্যাডভেঞ্চার-কেন্দ্রিক এবং চেজিং-নির্ভর। কিন্তু প্রাথমিক পর্বের এই অ্যাডভেঞ্চার প্রীতি কাটিয়ে উঠে কয়েক দশক পরে বৌদ্ধিক পরিচয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই নিজের পথ বদল করে নিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দানীরা। এই যেমন, ১৯৬০ সালে দেব সাহিত্য কুটীর থেকে প্রকাশিত বার্ষিকী ‘অপরূপা’-তে দেখা মিলেছিল এমন এক মহিলার, যিনি কাঁথা সেলাই করে আর রাজ্যের খবর শুনে জীবন কাটিয়ে ফেলার পরও ঘরে বসেই ছাড়িয়ে ফেলতে পারেন অতীতের হত্যারহস্যের জট। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের লেখা এই ‘বিন্দিপিসির গোয়েন্দাগিরি’-র প্রায় সমকালেই ঘরে বসে মেয়েদের গোয়েন্দাগিরির আরেকখানা উদাহরণ পাওয়া গিয়েছিল। গোটা তিনেক গল্পে প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত হাজির করেছিলেন সদুঠাকুমা ওরফে সৌদামিনী দেবীকে। ‘ঠাকুমার গোয়েন্দাগিরি’ গল্পে সদ্যবিধবা সেই ঠাকুমা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিবলে ধরে ফেলেছিলেন ঠাকুরদার খুনিকে। অবশ্য বলে রাখা ভালো, ‘বিন্দিপিসির গোয়েন্দাগিরি’ ছিল তার ত্রিশ বছর আগে ‘দ্য স্টোরিটেলার’ পত্রিকায় বেরোনো আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য রেজারেকশন অফ এমি ডুরান্ট’ গল্পের অনুকৃতি। সদুঠাকুমার মধ্যেও মিস মার্পলের ছায়া পড়েছিল ভালোরকম। এই প্রবণতাটির জন্যই হয়তো, পরবর্তী কালে মেয়েদের মগজাস্ত্রের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি আশাপূর্ণা দেবী দিব্যি একহাত নিয়েছেন গোয়েন্দাকাহিনিতে পুরুষ গোয়েন্দা ও পুরুষ-লেখকদের একাধিপত্যের অভ্যাসকে। ১৪০৪ সালের শারদীয়া শুকতারায় প্রকাশিত তাঁর ‘মেয়ে গোয়েন্দার বাহাদুরি’ গল্পে সাধারণ গৃহপরিচারিকা কাজল বাড়িতে বসেই সমাধান করে ফেলেছে পাশের বাড়িতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডের। আর মেয়েদের ঘরোয়া গোয়েন্দাগিরির অভ্যাসটিকেই সাহিত্যরসে জারিয়ে তুলে লেখিকা মুচকি হেসে কটাক্ষ করে গিয়েছেন আগাথা ক্রিস্টিকে নকল করা গোয়েন্দা গল্পলিখিয়েদের।
তবে বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দানীর উৎসে পাশ্চাত্যের ঋণ থাকলেও এ কথা মানতেই হবে, পিতৃতান্ত্রিক অপরাধ-সাহিত্যপরিসরে গোয়েন্দা হিসেবে নারীদের উঠে আসা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। আর এই উত্থান যে ধূমকেতুর মতো সহসা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়ার মতো নয়, সে কথাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার পরবর্তী দুই দশকেই। তাই কৃষ্ণা-শিখার মতো অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাতোয়ারা সম্পন্ন তরুণী কিংবা বিন্দিপিসি-সদুঠাকুমার মতো ঘরোয়া বয়স্কা মহিলা নন, ক্রমশ এই দুনিয়ায় আসর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন সেই মেয়েরা, যাঁরা পেশাগতভাবেই গোয়েন্দাগিরি বা অন্য কোনও বৃত্তিকে অবলম্বন করেছেন। অজিতকৃষ্ণ বসুর ডিটেকটিভ নন্দিনী সোম সায়েন্স কলেজ থেকে এক্সপেরিমেন্টাল সাইকোলজির স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানাধিকারিণী। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ফেরত নন্দিনী মগজাস্ত্র প্রয়োগে পাল্লা দিতে পারে তাবড় পুরুষ গোয়েন্দার সঙ্গে। আবার মানসী দাশগুপ্তের কলমে হাজির হয়েছিল গোয়েন্দানী শমিতা চৌধুরী, যে পেশায় সাংবাদিক। সাংবাদিকের কাজ যেমন সত্য খবরের অনুসন্ধান, সেই সত্যান্বেষণের নেশাটি সে বয়ে এনেছিল নিজের ব্যক্তিক জীবনেও। এই পথেই সাতের দশকে মাসিক রোমাঞ্চ পত্রিকার পাতায় দেখা দিল আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ দময়ন্তী দত্তগুপ্ত। মনোজ সেনের সৃষ্ট এই গোয়েন্দানী বিবাহিতা, ইতিহাসের অধ্যাপিকা। ইতিহাস যেমন নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে অতীতকে পুনর্গঠন করে, তেমনই কোনও অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণ করে তার উৎসে পৌঁছোতে চায় দময়ন্তী। অপরাধীকে তাড়া করায় তার আগ্রহ নেই, রহস্য সন্ধানটুকুই তার লক্ষ্য। কৃষ্ণা বা শিখা যে সাধারণ বাঙালি মেয়ের থেকে আলাদা, তাদের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম থেকেই পাঠককে বারবার এ সম্বন্ধে অবহিত করে তোলা হয়েছিল। কিন্তু নিপাট সাধারণ দাম্পত্য-সংসার-ভালোবাসার ঘরোয়া গেরস্থালি থেকে যে ঝলসে উঠতে পারে বুদ্ধির দীপ্তি, আর তা অবশেষে পৌঁছে যেতে পারে নিখুঁত গোয়েন্দাগিরির পারঙ্গমতায়, বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে দময়ন্তী-ই তার প্রথম উদাহরণ।
মেয়ে গোয়েন্দাদের বুদ্ধিনির্ভর রহস্যভেদের এই যাত্রায় একজনের কথা না বললেই নয়। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের এযাবৎ প্রবাহিত ধারায় তার জুড়ি মেলে না। মেয়ে গোয়েন্দারা অভিযানে নামলেও তাদের শরীরী শুদ্ধতা রক্ষার যে অলিখিত দায় ছিল, আটের দশকে সেই ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ জানাল অদ্রীশ বর্ধনের গোয়েন্দানী নারায়ণী। ‘কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক’-দের জন্য যে গোয়েন্দাকাহিনি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন অদ্রীশ, সেখানে তাঁর রহস্যভেদী চরিত্রদের চলার পথে কোনোরকম ছুঁতমার্গের বেড়া তুলে দিতে চাননি তিনি। মেয়েদের বুদ্ধিহীনতার পাশাপাশি মুষ্টিমেয় সংখ্যক মেয়ে গোয়েন্দার অ-শরীরী অস্তিত্বের যে পরম্পরা বাংলা সাহিত্য বয়ে নিয়ে চলেছিল এর আগে পর্যন্ত, শরীর-মনের যুগলবন্দিতে সৃজিত নারায়ণী নিঃসন্দেহে সেই পরম্পরার প্রতি এক সপাট প্রত্যাখ্যান। সম্প্রতি সেই ইশারাই খানিক ফিরে এসেছে অধীশা সরকারের গোয়েন্দানী বিদ্যুৎলতা বটব্যালের আদলেও।
শরীরী স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার না হলেও, সমাজের ছকভাঙা ‘পুরুষালি’ পেশা গ্রহণের জন্য ব্রহ্মচর্য পালনের যে আর প্রয়োজন নেই, সে কথা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল শমিতার হাত ধরেই। দময়ন্তীর রহস্যভেদের ফাঁকেফোকরে ঝিলিক দিয়ে গিয়েছে সমরেশ-দময়ন্তীর সোহাগি দাম্পত্য। পরবর্তীতে পেশাদার গোয়েন্দা প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি ওরফে মিতিনের সত্যানুসন্ধানের গল্প বুনতে বুনতে সুচিত্রা ভট্টাচার্যও ছুঁয়ে গিয়েছেন মিতিন-পার্থর নিরালা লগ্নতার ছবি। সত্যি বলতে, মেয়ে গোয়েন্দাদের বুদ্ধির দীপ্তি যতই থাকুক, গোয়েন্দাগিরিকে বেছে নিয়ে ‘নারীধর্ম গৃহধর্ম’ পালন না করার দরুন কৃষ্ণা বা শিখাকে কম নিন্দা শুনতে হয়নি। সেই প্রেক্ষিতে চমকে দেওয়ার মতো ব্যতিক্রম দময়ন্তী-মিতিনরা। সহধর্মীর ভূমিকা পালন করেই তাদের গোয়েন্দাগিরিতে যোগ্য সংগত চালিয়ে গিয়েছে তাদের সঙ্গী প্রভঞ্জন, সমরেশ কিংবা পার্থ। নয়ের দশকের মাঝামাঝি গোয়েন্দানী গার্গীর একরকম সহযোগী হিসেবে সায়নকে উপস্থিত করেছেন তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। অঙ্কের মেধাবী ছাত্রী গার্গী প্রথমে থাকত দাদা-বউদির পরিবারে, পরে ‘ঈর্ষার সবুজ চোখ’ উপন্যাসে ভগ্নীপতি সায়ন চৌধুরীকে বধূহত্যার অভিযোগ থেকে মুক্ত করে সে এবং ঘটনাচক্রে বিবাহ করে তাকে। সাম্প্রতিক কালে দেবারতি মুখোপাধ্যায় লিখেছেন মেয়ে গোয়েন্দা রুদ্রাণীর রহস্য সমাধানের কাহিনি, তার সহকারী এবং জীবনসঙ্গী প্রিয়ম। অর্থাৎ, পুরুষশাসিত কাজের জগতে নারীর এককভাবে নিজেকে প্রমাণ করা, নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ বলে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার যে প্রয়াস বাঙালি গোয়েন্দানীদের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে দেখা গিয়েছিল, কয়েক দশক যেতে না যেতেই তার মোড় ঘুরে গিয়েছে বললে ভুল হয় না। দময়ন্তী থেকে প্রজ্ঞাপারমিতা কিংবা গার্গী, সকলেই নারী-পুরুষের সহযোগিতার একরকম পাঠ দিয়ে গিয়েছে বারবার। আর সেইসঙ্গেই পুরুষ গোয়েন্দাদের একলা থাকার অভ্যাস ভেঙে গিয়ে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে নির্মিত হয়েছে যৌথ যাপনের অভিনব বয়ান।
বেঁধে বেঁধে থাকার সহমর্মিতা অবশ্য গোয়েন্দানীদের যাত্রাপথে মিশে যাচ্ছিল গোড়া থেকেই। ছয়ের দশকে চার কিশোরী গোয়েন্দাকে নিয়ে নলিনী দাশ যে গোয়েন্দা গণ্ডালু সিরিজ শুরু করেন, তার মূল ইউএসপি হয়ে উঠেছিল চারটি মেয়ের বন্ধুত্বের জোর। সাম্প্রতিক কালে পারমিতা ঘোষ মজুমদারের গোয়েন্দা চরিত্র ইকনমিক্সের ছাত্রী ও প্রাক্তন সাংবাদিক রঞ্জাবতী মজুমদার অবিবাহিত, কিন্তু বন্ধু ও সহকারী লাজবন্তীর পরিবারকেই সে আপন করে নিয়েছে। সুতরাং সামাজিক সম্পর্কের বাঁধন থাক বা না থাক, মেয়ে গোয়েন্দাদের এই পরম্পরায় বুদ্ধির পাশাপাশি রয়েই যাচ্ছে নারীসুলভ মানবিকতার স্পর্শ, বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সহমর্মিতার বোধ। সে কারণেই কৃষ্ণা বলে— ‘মেয়েদের বিপদে মেয়েরা না দেখলে কে দেখবে বলো?’ তেমনই ‘প্রেম’ গল্পে যে পদ্মিনী খুন হয়ে যাওয়ার পর তকমা পেয়েছিল নিম্ফোম্যানিয়াক ব্যাভিচারিণীর, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তার মনোবিশ্লেষণই হয়ে ওঠে দময়ন্তীর রহস্যভেদের চাবিকাঠি।
আরও এক পদ্মিনীর কথা বলা যাক এই প্রসঙ্গে। তিনি অবশ্য ভিক্টিম নন, অপরাধী। প্রথম খুন, পুরোনো দিনের এক অভিনেত্রী। দ্বিতীয় খুন, এক হেয়ারড্রেসার। তৃতীয় খুন, থুড়ি, খুনের চেষ্টা এক সাংবাদিককে। এককালে রুপোলি পর্দা কাঁপানো মহানায়িকার এহেন মতিভ্রম কেন হঠাৎ? এখানেও আলোর দিশা দেখাল মনের অন্ধকারই। দময়ন্তীর মতো ঘরে বসেই রহস্যের জট ছাড়ালেন যিনি, তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন বহুদিন আগে। রেঁধে বেড়ে, পোষা বেড়াল আর টেলিভিশন নিয়েই দিন কাটত তাঁর। কিন্তু মাথা খাটিয়ে আস্ত একটা রহস্যের গোড়ার কথা যে তিনি বুঝে ফেলতে পারেন, পড়ে-পাওয়া-চোদ্দো-আনা সুযোগটা না এলে তিনি তা জানতেন কেমন করে! ‘শুভ মহরৎ’ সিনেমার রাঙাপিসিমার মতো অনেক মেয়েরই যে এমন ঘরোয়া গোয়েন্দাগিরির অভ্যাস, পুরোনো সাহিত্যে তার ইঙ্গিত ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। সে নল-দময়ন্তীর কাহিনিতে দময়ন্তীর নলকে চিনে নেওয়াই হোক, কিংবা বিপ্রদাস পিপলাই-এর মনসামঙ্গলে শিবকে সন্দেহ করে চণ্ডীর মনসাকে খুঁজে বের করা। কিন্তু মেয়েরা বুদ্ধিহীন, এই প্রচলিত মিথের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যের প্রাথমিক প্লটনির্মাণ। বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে গোয়েন্দানীর আবির্ভাব একদিকে সেই পুরোনো অবজ্ঞার সপাট জবাব। আরেকদিকে সৃষ্টিশীল পুরুষের একলা থাকার উন্নাসিক মুদ্রাদোষ পুরুষ গোয়েন্দাদের যে নিঃসঙ্গ জগতে ঠাঁই দিয়েছিল, তার বিপরীতে পরিবার-পেশা-প্যাশনকে একসঙ্গে সামলে ভালোবাসা ঘেরা এক পৃথিবী গড়ে দিয়েছেন ‘মাল্টিটাস্কার’ মেয়ে গোয়েন্দারা। সেও বড়ো কম কথা নয়!