এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • অসিধারী ও বেনামী বন্দুকবাজ

    সৈয়দ আযান আহমেদ
    আলোচনা | সিনেমা | ১২ আগস্ট ২০২৩ | ৮০৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)

  • বেতের মত ধারালো ছিপছিপে চেহারা। চোখ বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ। টাটকা রোদের মত গায়ের রঙ। নাকটা ছুরির ফলার মত নেমে এসেছে। একপলক তাকালেই তাঁর ব্যক্তিত্বে এক বেপরোয়া ঔদ্ধত্যের আঁচ মেলে। কাঁধে ফেলে রাখা তেলচিটে ময়লা ধরা পনচো, ঠোঁটে আধখাওয়া জ্বলন্ত সিগার আর কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল। কাঠখোট্টা দৃষ্টিতে কখনো বিরক্তি-অসন্তোষ কখনো আবার নিরাবেগ উন্নাসিকতার দুরন্ত মেলবন্ধন।

    রহস্যময় চরিত্রটার কোন নাম নেই। তবুও দর্শক তাকে চেনে ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম-এ। সে হিরো নয়, অ্যান্টিহিরো। দূরে, অনেকটা দূরে ধূলি ধূসরিত প্রাঙ্গণে সে আচমকাই জেগে ওঠে কালভৈরবের মত।

    ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’ খুব দৃঢ় এবং স্বাধীনচেতা মানুষ । দুঁদে ধুরন্ধর। বন্দুক চালনায় ক্ষিপ্র এবং সুদক্ষ। তবে স্বভাবে খানিক বেপরোয়া ও আখরবাজ। কম কথার এই অনালাপী নিভৃতচারী হল এক নির্লজ্জ সুযোগসন্ধানী। যে গাছের খায় আবার তক্কে তক্কে থাকে তলারও কুড়োবে বলে।

    সিনেমার ইতিহাসে ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’ হল সবচেয়ে আইকনিক চরিত্র। সে এক আমেরিকান কাউবয় বাউন্টি-হান্টার। যাদের মূলত উপস্থিতি ছিল আমেরিকান গৃহযুদ্ধের কিছু আগে-পরে ফ্রন্টিয়ার অঞ্চল বা ওয়াইল্ড ওয়েস্টে । মূলত তৎকালীন সময়ে যা ছিল নেটিভ আমেরিকানদের কিছু নিজস্ব এলাকা। আর নয় তো কিছু অরাজক অঞ্চল যা আবার দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবক্ষেত্র। সরকার মাথার চড়া দাম ধার্য করে রেখেছেন। সেই দুষ্কৃতীদের শায়েস্তা করে সরকারের দপ্তরে জীবিত বা মৃত জমা করেই পেট চলত বাউন্টি হান্টারদের ।

    সার্জিও লিওনের পরিচালনায় ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় “A Fistful Of Dollars”। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক ছিল হলিউডে ওয়েস্টার্ন ছবির স্বর্ণযুগ। আমেরিকান কাউবয়দের একচেটিয়া রাজত্ব চলছে তখন। যদিও এসব ছবিতে কাউবয়রা ছিল গতে বাঁধা। এরা ছিলেন ন্যায়বাগীশ এবং সচ্চরিত্র । এদের উপর সচরাচর একটা ইতিবাচক গ্ল্যামারাইজড আলোর ঝলকানি থাকত। পোশাক পরিচ্ছদের দিক থেকেও তারা ছিলেন ধোপদুরস্ত । ছিমছাম পরিপাটি সেই চরিত্ররা যেন সদ্য ক্ষৌরকর্ম করে উপস্থিত হতেন স্ক্রিনে । চলচ্চিত্রে আমেরিকান কাউবয়দের মাথায় থাকত ঝকঝকে সাদা টুপি , গায়ে উজ্জ্বল রঙের পোশাক, আর হাতে ঝাঁ-চকচকে বন্দুক। তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে রয়ে যেত নায়কসুলভ ছাপ। আত্মবিসর্জন দিয়ে দশের জন্য উথলে উঠত তাদের দরদ। নেহাত ভুলেমুলে বেচাল করলেও তাদের সব বেআইনি কাজ কারবারের পিছনেই খুঁজে পাওয়া যেত গোঁজামিল ন্যায়সঙ্গতা।

    লিওনে চরিত্রটা লিখতে গিয়ে সবার প্রথম এইসব গতানুগতিকতাকে সমূলে উপড়ে ফেললেন। এমনই এক নতুন স্বাদের চরিত্র তিনি প্রস্তুত করতে চাইলেন যে হবে বাস্তবসম্মত, এবং সামগ্রিক ভাবে সততার আলোয় আঁকা, অর্থাৎ চরিত্রটাকে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য। এতদিন কাউবয় চরিত্ররা ছিল একঘেয়ে স্থবির নিষ্প্রভ। ওয়েস্টার্ন নায়কদের সেই আর্কিটাইপটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলেন লিওনে। দেখা গেল সেই নামহীন জনৈক, ওয়েস্টার্ন হিরোদের নীতিবিরুদ্ধ কাজ - নেটিভ আমেরিকানদেরও গুলি করতে পেছপা হয় না। এমনকি তার রাস্তায় যেই এসে দাঁড়াক নির্দ্বিধায় তাঁর লাশ ফেলে দেয়। ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম এভাবেই হয়ে উঠল একেবারে স্বাতন্ত্র্যসূচক এবং সেই একঘেয়ে কাউবয়দের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। সে নোংরা, কৃপণ, একলষেঁড়ে, অনুদার, স্বার্থপর, ত্রুটিপূর্ণ। পারিপাট্য এবং নৈতিকতার বালাই নেই তাঁর স্বভাবে। লিওনের গল্পের ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’ হল কম কথার মানুষ – স্বল্পভাষী। লিওনে বিশ্বাস করতেন চলচ্চিত্রে সংলাপ শুধুমাত্র দৃশ্যকে ওজনদার বানাতেই ব্যবহার করা উচিৎ। কারণ চলচ্চিত্রে ন্যারেশনের মূল ভূমিকা পালন করে চলমান ছবি। তার ধারণা ছিল এই বাগবিমুখতাই চরিত্রটাকে করে তুলবে ছায়াময়। করলও তাই।

    লিওনে ভেবেছিলেন এমন একটা চরিত্র যার সম্বন্ধে দর্শক জানবে না সে কে, কোথা থেকে তার আগমন, আর কোথায়-ই বা তার গন্তব্য। যদিও তার চেহারা এবং পোশাক পরিচ্ছদে একাধিক সংস্কৃতির ছাপ, তবুও তার সম্বন্ধে আমরা যেন রয়ে যায় অন্ধকারেই। আমরা শুধু এটুকু জানব যে, তাঁর একমাত্র প্রেরণা হল অর্থ। আর যে কোনও পরিস্থিতিতেই বন্দুকের ঘোড়া টানতে সে দ্বিধাহীন, অবিচল। তবে তার অতীত, তার নামের মতই গূঢ় রহস্যে পরিবৃত। আমরা জানব না সে ভালোর পূজারী, নাকি মন্দের উপাসক। দর্শকরা এই ধাঁধার টুকরোগুলো জুড়তে বসবেন, ডুবসাঁতার দিয়ে চালাবেন নিজস্ব অনুসন্ধান। আর তাতেই চরিত্রটা হয়ে উঠবে আরও ডাইনামিক। সবাই প্রথম নাম শুনবে নতুন এক জঁরার – স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্ন। যদিও এই লজঝড়ে জঁরাটির অস্তিত্ব আগেই ছিল, তবে তার আসল জন্মদাতা কাম প্রতিপালক হলেন সার্জিও লিওনে। আর তাতেই মূর্ত হবে সিনেমার ইতিহাসে একটি আইকনিক চরিত্র : দ্যা ম্যান উইথ নো নেম।

    ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেমে’র মাথায় উঠল ছেঁড়াফাটা বাদামি টুপি, গায়ে কোঁচকানো কাপড়চোপড়, হাতে রইল পুরনো ০.৪৫ রিভলভার। এমনই এক চরিত্র যে নিজের আর্থিক মুনাফা ছাড়া অন্য কোন বিষয়েই আগ্রহ দেখায় না বিশেষ।

    এবং যার নৈতিকতা পেন্ডুলামের মত সতত দোদুল্যমান। তাকে একবার মনে হয় ন্যায়পরায়ণ, আবার পরমুহূর্তেই মনে হয় দুর্নীতিগ্রস্ত। ছবির সর্বত্র ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’কে ভাল এবং খারাপের মধ্যে যে কোন একটা দিককে বেছে নিতে হয়। দর্শক হিসেবে আমরাও ধন্দে থাকি, কোনও এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কী হবে তার প্রতিক্রিয়া? দর্শকের পক্ষে গল্পের ভবিষ্যদ্বাণী খাড়া করাটাই অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর এটাই হল ছবিতে তৈরি হওয়া বেশ কিছু শক্তিশালী মুহূর্তের জ্বালানী। এই নামহীন মানুষটি আগ বাড়িয়ে অন্যদের রক্ষা-টক্ষা করে না, অন্যায়-টন্যায় সংঘটিত হচ্ছে দেখলেও থাকে নিরুত্তাপ উদাসীন, এবং ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উপকার করে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সে নিশ্চিত হচ্ছেন এই উপকারের বিনিময়ে সেও উপকৃত হবে।

    লিওনে চরিত্রটাকে আসলে এমনভাবেই এঁকেছেন যাতে তাকে ভালো খারাপের চিরাচরিত সংজ্ঞাতে না ফেলা যায়। নীতি শব্দটাই যেন তার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অপ্রাসঙ্গিক। ‘দ্য ম্যান উইথ নো নেম’আমেরিকান সংস্কৃতির সেরা ফিকশনাল চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা, যা চলচ্চিত্রের মূল ধারায় অ্যান্টিহিরোদের আসার পথটাকেই সুগম এবং সুপ্রশস্ত করেছিল।
    আগেই বলেছি গল্প, উপন্যাস বা চলচ্চিত্রে অ্যান্টিহিরো এমনই এক মানুষ যার চরিত্রে হাজারো ত্রুটিবিচ্যুতি। একাধিক ফাঁক। কখনও বা অভাব জরুরী সাহস এবং চারিত্রিক দৃঢ়তারও। নিখুঁত বা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার দিকে তার কিছুমাত্র ঝোঁক নেই । সচ্চরিত্র সজ্জন হয়ে উঠতেও সে চায় না বিশেষ। নীতি-নৈতিকতার ধার ধারে না , আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না। নিত্য অনুশীলন চালায় না মূল্যবোধের। সে হাঁটাচলা করে গল্পের 'নায়ক' এর প্রচলিত নীতির পরিসীমার অনেকটা বাইরে দিয়ে। অথচ হীন বা নীচ বলেও দাগিয়ে দেওয়া যায় না তাকে। কারণ তার চরিত্রের কিছু খাঁটি দিক রয়েছে। আর সেই দিকগুলোতে সে যেন নিষ্কপট, অতুলনীয়, নজিরবিহীন। জীবনের নানা সময়ে সে রেখে যায় ব্যতিক্রমী উৎকর্ষের নজির, যা কখনো-সখনো ছাড়িয়ে যায় তথাকথিত নায়কের মহত্ত্বকেও। তখন তাকে মনে হয় অদ্বিতীয় কোন ছদ্মবেশী অবতার বুঝি। তাই স্বভাবে হাজারো খামতি থাকা সত্ত্বেও দর্শক অ্যান্টিহিরো বা প্রতি-নায়কের প্রতি আকৃষ্ট, মোহগ্রস্ত। আসলে তলিয়ে ভাবলে আমরাও তো দোষমুক্ত নই, তাই দোষে গুনে ভরা অ্যান্টিহিরো হয়ে ওঠে যেন আমদেরই অনেক কাছের, খুব আপন মানুষ আর ঠিক ততোধিক বিশ্বাসযোগ্য। একটু ভীতু, কিছুটা ছিদ্রান্বেষী, সামান্য অনৈতিকও ।

    প্রাচ্য হোক কি পাশ্চাত্য, সাহিত্য কি সিনেমায়, সর্বত্রই অ্যান্টিহিরোদের অবাধ যাতায়াত । ষাটের দশকে এই একটা দিকে অন্তত প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য হাত ধরাধরি করে এমন কিছু তৈরি করে যা সময় এবং সংস্কৃতিকেও অতিক্রম করে যায়। 1961 সালে মুক্তি পেল কুরোসাওয়ার Yojimbo এবং 1965 তে সার্জিও লিওনের A Fistful Of Dollars । দুটো ছবিতেই এমন এক অ্যান্টিহিরোর গল্প শুনি যে লড়াইরত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীর মধ্যে ধুঁকতে থাকা একটা জনপদকে রক্ষা করতে আসরে নামে এবং তা করতে গিয়ে নৈতিকভাবে ধূসর অনেক কাজই তাকে করতে হয়। দুই গল্পের এত মিলজুল কোন কাকতালীয় বিষয় নয় , বরং A Fistful Of Dollars কে বলা যায় Yojimbo-র অননুমোদিত রিমেক ।
    পরিচালক হিসেবে আকিরা কুরোসাওয়া বৈচিত্র্যময়তার সমস্ত দিককে ছুঁয়ে গেলেও মূলত চানবারা ঘরানার সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। চানবারা গোত্রের ছবিতে মূলত সামুরাইদের জীবন portray করা হয়, আর তাই এ জাতীয় ছবির একটা জরুরী উপাদান হয় তরোয়ালের লড়াই। Yojimbo তে আমরা দেখি এক রনিনকে। সামন্ততান্ত্রিক জাপানে, রনিন এমন এক জাতের সামুরাই যাদের কোন মনিব থাকত না। এবং নিজের পরিবার ও বংশের সাথেও সমস্ত সম্পর্কও চুকিয়ে আসত তারা। সেরকমই এক ভবঘুরে রনিনের গল্প Yojimbo। সময়টা হল টোকুগাওয়া শোগুনে যুগের সমাপ্তি। অর্থাৎ সামুরাইরা প্রায় অবলুপ্তির পথে।

    গল্পের রনিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছয় এক নামহীন জনপদে। সেখানকার আইন-কানুন নিজেদেরই হাতে তুলে নিয়েছে শহরেরই দুই যুযুধান গোষ্ঠী । স্থানীয় জুয়ার ব্যবসায় পুরোমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ হাতে পাওয়ার লক্ষ্যে লড়ছে দুই পক্ষ। আর তাতে মরছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। আমাদের প্রতিনায়ক সেই মৃত্যুমিছিল চাক্ষুষ করে প্রথমটায় তেমন একটা বিব্রত না হলেও, পরের দিকে তার দোদুল্যমান নৈতিকতা একটু আঁকুপাঁকু করে ওঠে বটে । শেষমেশ অবিশ্যি সেই দাঙ্গাবিধ্বস্ত অরাজকতায় দুর্বৃত্তদের সাফা করার কাজে হাত দেবে সে। এবং সবটাই করবে কূট এবং ধূর্ত পদ্ধতি অবলম্বনে। প্রয়োজনে হয়ে উঠবে কিছুটা অনৈতিকও । গল্পে কুরোসাওয়ার প্রতিনায়ক অজ্ঞাতকুলশীল। যদিও ঐ গ্রামে সে নিজের পরিচয় দেয় সানজুরো নামে। যেহেতু চরিত্রটার কোন ব্যক্তিগত জীবন বা ইতিহাস বাতলানোর দিকে পরিচালকের আগ্রহ ছিল না বলেই হয়তো বা সানজুরো হয়ে উঠেছিল এতটা গতিশীল, এতখানি বেজোড়, আর একেবারে স্বতন্ত্র। চরিত্রটা আলোছায়াময় বলেই দর্শককে সম্মোহন করার ক্ষমতা ছিল পেল্লায়।

    কুরোসাওয়া যেমন সার্জিও লিওনের উপর আপাদমস্তক প্রভাব ফেলেছেন, তেমনই কুরোসাওয়াও একেবারে প্রভাব মুক্ত নন। তার ছবির সাথে নাড়ির যোগ রয়েছে আমেরিকান ছবির জগতে আরেকটি ধারার – ওয়েস্টার্ন। এর কারণ সম্ভবত জন ফোর্ডের ছবির প্রতি কুরোসাওয়ার প্রবল আগ্রহ ও একনিষ্ঠ ভালোবাসা। “Yojimbo”-তে আমরা আসলে একধরণের আমেরিকান ফ্রন্টিয়ার বা wild west এর প্রাচ্য প্রতিবিম্বকে দেখতে পাই। যে অরাজকতার রাজ্যে সব ধরণের অনাচার এবং নৈরাজ্য আস্ফালনকে সমূলে উচ্ছেদ করতে এসেছে।

    যদিও ইয়োজিম্বোর নান্দনিকতা এবং তার বর্ণনামূলক উপাদান কিছুটা হলেও ওয়েস্টার্ন ছবি থেকে প্রভাবিত , তবুও তার প্রধান চরিত্রের অবস্থান পশ্চিমা দুনিয়ার ওয়েস্টার্ন জঁরার গতানুগতিক নায়কদের থেকে অনেকটাই আলাদা। ইয়োজিম্বো এবং আগের দশকের ওয়েস্টার্ন ছবিতে আমরা যে নায়কদের দেখতে পাই তাদের নৈতিকতার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। Yojimbo তার প্রতিনায়ককে ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার একঘেয়ে সহজ সংজ্ঞা থেকে সটান বের করে আনে। যে নায়ক নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে অবাধে মিথ্যা বলতে বা মুহুর্মুহু বিশ্বাসঘাতকতা করতেও পেছপা হয় না। ভাল এবং খারাপের বাইনারি সংজ্ঞা থেকে নায়ককে মুক্তি দেয় Yojimbo। আর তাতেই পাশ্চাত্যের ছবির জগতের একটি বিশেষ জঁরা পুনঃউদ্ভাবনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।

    যদিও স্প্যাগেটি ওয়েস্টার্নের অস্তিত্ব ইতালিতে পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই, তবে সার্জিও লিওনই প্রথম পরিচালক যিনি এই সাবজঁরায় বক্স-অফিসে আন্তর্জাতিক সাফল্য এনে দিলেন। A Fistful Of Dollars চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় কার্যতই একটা বিস্ফোরণ ঘটাল। চরিত্রদের হাত, পা, মুখ এবং চেহারার দীর্ঘ ক্লোজ-আপ শট নিয়ে লিওনে নতুন এক টেকনিকের জন্ম দিলেন। দৃশ্যের মধ্যে অসহ্য নীরবতা এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের দৈনিক কর্কশ শব্দ দিয়ে সেই নীরবতাকেই ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়ে এক আশ্চর্য শিল্প রচনা করলেন তিনি। লিওনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রায় শ-খানেক চলচ্চিত্রের নির্মাণ ঘটল একাদিক্রমে। প্রতিটা ছবিরই ভিত্তি ছিল নায়কের আলোছায়াময় নৈতিক অবস্থান এবং হিংস্রতাকে শৈল্পিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা , যার পুরো নির্যাসটাই Yojimbo থেকে ছেঁকে তোলা। লিওনের ছবিতে রনিনের মতই এক ভবঘুরে কাউবয়কে দেখি আমরা। ঘুরতে ঘুরতে সে একদিন আস্তানা গাড়ল মেক্সিকো বর্ডারের এক বেনামী শহরে। যে শহরকে শাসন করছে নিজেদের মধ্যে নিত্য সংঘাতে জড়িয়ে থাকা দুই যুযুধান গোষ্ঠী। মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করা ক্লিন্ট ইস্টউড সেই দুই পক্ষকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবেন। এবং তাদের শুধু নিকেশই করবেন না, সেসব সম্পাদন করার আগে দুই পক্ষের কাছ থেকেই যারপরনাই ফায়দা লুটবেন।
    The man with no name ছবিতে স্বল্পভাষী - প্রায় নির্বাক , সানজুরোর মত অতটা বাক্যবাগীশ নয় । সচরাচর আবেগ অনুভূতি প্রকাশ করে না । সানজুরোর মত তার কোন ম্যানারিসম নেই। The man with no name উদ্ধত শালগাছের মত কেবল দাঁড়িয়ে থাকে, ধারালো দৃষ্টিতে চতুর্দিক খুঁটিয়ে দেখে, তারপর প্রয়োজনমত আলোর বেগে ঘোড়া টেনে দেয়। তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের পিছনে উদ্দেশ্য একটাই – টাকা । আর ঠিক এখানেই গতানুগতিক ওয়েস্টার্ন ফিল্মের মহৎ হিরোদের চেয়ে সে একেবারে আলাদা হয়ে ওঠে। আদর্শ চরিত্রের নির্ভুল নিখাদ অবস্থানের অনেকটা দূর দিয়ে যে হেঁটে যায়। নিজস্ব স্বার্থ বই কোন মহৎ উদ্দেশ্যও তাকে অনুপ্রাণিত করে না । পূণ্যের লোভ দেখিয়ে যাকে বাধ্য করা যায় না সততার দিকে ঝুঁকতে । A Fistful of Dollars এর চূড়ান্ত সাফল্যের পর পরাক্রমশালী বন্দুকবাজই হয়ে উঠল ওয়েস্টার্ন ছবির ধরতাই। আমরা দেখলাম এক জাতের ভিলেনকে যাদের কাছে হিংস্রতাই হল একমাত্র বিনোদন, আর দেখলাম এক জাতের মার খাওয়া রক্তাক্ত অ্যান্টিহিরোদের যারা শেষমুহুর্তে পাশার দান উল্টে দিতে পারে। এবং অতি অবশ্যই যুদ্ধ জয়ের শেষেও যাদের নৈতিকতা নিয়ে কাটাছেঁড়া চালানো যায়।

    Yojimbo-র শেষ দৃশ্যে শত্রুপক্ষের দলপতিকে আমরা একটা পিস্তল বের করতে দেখি। এই দৃশ্যের পিছনে সামুরাই এবং তলোয়ার যুদ্ধের অবলুপ্তির দ্যোতনা লুকিয়ে থাকে। কুরোসাওয়া দেখিয়েছেন সামান্য একটা অস্ত্র সম্মুখ সমরের সংজ্ঞাটাকেই কেমন বদলে দিতে পারে রাতারাতি।। অন্যায় ভাবে এক পক্ষকে দিতে পারে অন্যায্য সুবিধা । কুরোসাওয়া এই পিস্তলের মাধ্যমে জাপানের উপর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাব নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। দেখিয়েছেন বৃহত্তর বিশ্ব কীভাবে বদলে দিচ্ছে জাপানি সভ্যতাকে। Yojimbo-র বয়স-জীর্ণ জাপানি গল্পের মধ্যেই কুরোসাওয়া সংযোজন করেছেন ওয়েস্টার্ন প্রভাবিত পাশ্চাত্য উপাদান। তবে গল্পের সেই প্রভাবকে তিনি ব্যবহার করেছেন পরিবর্তনের বিশ্বব্যাপী জোয়ারের বিরুদ্ধেই। এই দুই কালজয়ী সৃষ্টির পরেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছে অজস্র ছায়াছবি যারা প্রমাণ করেছে শক্তিশালী শিল্প এবং নিরবধি থিমের উভয়ই সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে। শুধু তাই নয়, এক স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই ছায়াছবির আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতির অনন্য ধারণাকেই।




    ছবিঃ কচাস
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ আগস্ট ২০২৩ | ৮০৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন